বরুশিয়া ডর্টমুন্ড সর্বশেষ জার্মান বুন্দেসলিগা শিরোপা জিতেছিল ১১/১২ মৌসুমে। এরপর বুন্দেসলিগার সিংহাসনে সেই যে চেপে বসল বায়ার্ন মিউনিখ, আর ওঠার নাম নেই। একচ্ছত্র আধিপত্য তাদের, বরুশিয়া ডর্টমুন্ড ছাড়া লিগে তাদের সমকক্ষ কোনো দল নেই। যেখানে বরুশিয়া ডর্টমুন্ড তাদের হারাতে পারছে না, আর কে পারবে! পেপ গার্দিওলা, ইয়াপ হেইঙ্কেসের স্বর্ণালি সময়ে তারা ট্রফি তো ঘরে তুলেছেই, এমনকি কার্লো আনচেলত্তির আমলে ‘নড়বড়ে বায়ার্ন’ও ট্রফির সিংহাসন হারায়নি। এমনকি নতুন কোচ নিকো কোভাচও তার প্রথম মৌসুমে বুন্দেসলিগা জেতার সৌভাগ্য অর্জন করেছেন।
কিন্তু প্রবল ক্ষমতাবান শাসকও তার সিংহাসন হারায়, ক্ষমতাচ্যুত হয়। গার্দিওলা ও হেইঙ্কেসের কোচিং আমলে ও রোবেন-রিবেরি জুটির অবসরের পর বায়ার্নও খেই হারাতে শুরু করেছে। সাথে আছে লেভানডস্কি, মুলার ও নয়্যারের বয়স-সমস্যা ও মধ্যমাঠের দুর্বলতা। তাদের আক্রমণের দুই উইংয়ের অবস্থাও যাচ্ছেতাই। এসব সমস্যার বিরূপ প্রভাব দেখা গিয়েছিল গত মৌসুমেই। এবার প্রাক-মৌসুম ও ডর্টমুন্ডের সাথে জার্মান সুপার কাপের ফাইনাল ম্যাচে নিকো কোভাচের দলে সবকিছু থেকেও যেন নেই।
রোবেন-রিবেরি জুটি হারিয়ে বায়ার্ন যখন নতুনভাবে তাদের দল সাজিয়ে নেবার চেষ্টা করছে, তখনই পুনঃজাগরণ হয়েছে বরুশিয়া ডর্টমুন্ডের। তবে তারা যে লড়াইয়ের মাঠে ফিরে আসছে, তার আভাস গত মৌসুমেই দিয়ে রেখেছিল তারা। শুধু লুইসিয়ান ফাভরের দল শেষের দিকে গিয়ে সবকিছু গোলমেলে পাকিয়ে ফেলে বলে শিরোপাহীন থাকতে হয়েছে। কিন্তু গত মৌসুমের পারফরম্যান্স, ফাভরের ফুটবল দর্শন এবং এই মৌসুমে দারুণ কিছু খেলোয়াড় কেনায় বরুশিয়া ডর্টমুন্ডে হয়ে উঠছে বায়ার্ন মিউনিখের যোগ্য প্রতিপক্ষ। হয়তো তাদের রাজ্যে হানা দিয়ে শিরোপা কেড়ে সিগন্যাল ইদুনা পার্কে আনতেও পারে তারা।
একটু বায়ার্ন প্রসঙ্গে আসা যাক। তারা যে হাত গুটিয়ে বসে আছে, তা নয়। রক্ষণ মজবুত করতে রিলিজ ক্লজ পরিশোধ করে নিয়ে আসা হয়েছে লুকাস হার্নান্দেজকে। বিশ্বকাপের ফরাসি তারকা বেনজামিন পাভার্ডও এসেছেন মিউনিখে। স্ট্রাইকার পজিশনে লেভানডস্কির বিকল্প ‘তরুণ তুর্কি’ জান-ফিতে আর্প। কিন্তু দুর্দান্ত সেই রোবেন-রিবেরি জুটি হারিয়ে বায়ার্ন তাদের আক্রমণের গতি হারিয়ে ফেলেছে। উইংয়ে কিংসলে কোমান প্রচণ্ড ইনজুরিপ্রবণ। একমাত্র ভরসা সার্জি ন্যাব্রি। এ সমস্যার সমাধান করতে লেরয় সানে ও উসমান ডেমবেলের দিকে হাত বাড়িয়েছিল তারা, কিন্তু কাজের কাজ হয়নি। অথচ বিপরীতে স্বল্পমূল্যে নির্ভরযোগ্য খেলোয়াড় ঠিকই বেছে নিতে পেরেছে বরুশিয়া ডর্টমুন্ড।
এ মৌসুমে ডর্টমুন্ড ছেড়েছে মাত্র দু’জন খেলোয়াড়, ক্রিশ্চিয়ান পুলিসিচ ও আবদু দিয়ালো। তাদের বিক্রি করে অর্থও মন্দ পায়নি ডর্টমুন্ড বোর্ড। যদিও সে অর্থকে সঠিকভাবেই ব্যবহার করেছে তারা। যদি রক্ষণের কথা বলা হয়, ডর্টমুন্ড প্রথমে কিনেছে আর্জেন্টিনার প্রতিভাবান তরুণ ডিফেন্ডার লিওনার্দো বালেদ্রিকে। তবে তাকে নিয়ে এ মৌসুমে মাতামাতি কম। ডর্টমুন্ড তাকে কিনেছে ভবিষ্যতের কথা মাথায় রেখে। কিন্তু বর্তমানের কথা ভেবে তারা বায়ার্ন থেকে ফিরিয়ে এনেছে ম্যাট হামেলসকে। আবদু দিয়ালো চলে যাবার পরে ডর্টমুন্ডে কাগজে-কলমে সেন্টারব্যাক ডিফেন্ডার ছিলেন তোপরাক ও আকিনজি। হামেলসকেও বায়ার্ন বিদায় করে দিয়েছে বয়সের কারণে। যেহেতু এবার তোপরাক ওয়েডার ব্রেমেনের হয়ে ধারে খেলবেন, তাই ম্যাট হামেলসকে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েই ডর্টমুন্ডের একাদশে ফিরতে হবে।
ডর্টমুন্ডের রাইটব্যাক ও লেফটব্যাক নিয়ে দীর্ঘদিন সমস্যা ছিল। দীর্ঘদিনের কান্ডারি লুকাস পিচেক ও মার্সেল স্মেলজারের বয়স হয়ে গেছে, আগের সেই গতিও নেই। সুতরাং তাদের নিয়মিত ব্যবহার করা বোকামি হবে। এখানে ডর্টমুন্ড নিয়ে এসেছে গত মৌসুমের বুন্দেসলিগার সেরা একজনকে। তিনি হলেন লেফটব্যাকে খেলা নিকো শ্যুল্জ। আর রিয়াল মাদ্রিদ থেকে লোনে আসা আশরাফ হাকিমিকে ঠিকই গড়ে তুলেছে তারা। মধ্যমমানের, কিন্তু প্রতিভা থাকা একজন খেলোয়াড় ডর্টমুন্ডের সংস্পর্শে এসে ধীরে ধীরে নির্ভরযোগ্য একজন খেলোয়াড় হয়ে উঠছেন।
মাঝমাঠের সেন্ট্রাল-ডিফেন্সিভ মিডফিল্ড পজিশনে গত মৌসুমে নিয়মিত খেলেছেন অ্যালেক্স উইটসেল। উইটসেলের মতো আরেকজন খেলোয়াড় থাকলেও মিডে দু’জনকে একসাথে ব্যবহার করা যায়নি। তাই ইউলিয়ান ভাইগেল অধিকাংশ সময়ে খেলতেন সেন্টারব্যাক হিসেবে। কিন্তু ভাইগেল আসলে সেন্টারব্যাক পজিশনের একটু উপরে খেলতে বেশি পছন্দ করেন। তাই ম্যাট হামেলসের থাকার জন্য হয়ত ফাভরে এই দুইজনকে একসাথে মাঝমাঠে ব্যবহার করতে পারবেন।
ডর্টমুন্ড কোচ যদি খুব বেশি চিন্তাভাবনা না করেন, তবে সেক্ষেত্রে উইটসেল ও ভাইগেলের একদম উপরে সেন্টাল-অ্যাটাকিং মিডফিল্ডার পজিশনে থাকতে পারেন নতুন সাইনিং ইউলিয়ান ব্র্যান্ড্ট। যদিও বেয়ার লেভারকুসেনে তিনজন ডিফেন্ডারকে রেখে চারজন দিয়ে বানানো মিডফিল্ডে খেলে এসেছেন তিনি। তবে সবকিছু ছাপিয়ে তিনি একজন আর্দশ প্লে-মেকার, যিনি গোল করতেও পারেন, গোল করাতেও পারেন। তাই ফাভরে যদি তার স্বভাবমতো চারজনকে কেন্দ্র করে মধ্যমাঠ সাজান, সেখানেও প্লে-মেকার ভুমিকায় থাকবেন ব্র্যান্ড্ট।
বরুশিয়া ডর্টমুন্ডের আক্রমণত্রয়ী সবথেকে চমকপ্রদ। লেফট-উইংয়ে বর্তমান জার্মানির অন্যতম সেরা খেলোয়াড় মার্কো রঈস, রাইট-উইংয়ে গত মৌসুমের আবিষ্কার জর্দান স্যাঞ্চো, এবং একমাত্র স্ট্রাইকার পজিশনে থাকা পাকো আলকাসের, যিনি বার্সেলোনায় ভুলে যাওয়ার মত মৌসুম পার করে ঠিকই ডর্টমুন্ডে এসে নিজেকে খুঁজে পেয়েছেন।
ডর্টমুন্ডের একাদশ কেমন হবে, বলা মুশকিল। কারণ, বর্তমানে দলটি দারুণ ভারসাম্যপূর্ণ। প্রত্যেক পজিশনে একের অধিক খেলোয়াড় আছে। প্রত্যেক খেলোয়াড়ের বিকল্প মজুত আছে, যা দিয়ে বিভিন্নভাবে স্কোয়াড সাজানো যায়। তাদের কোচ লুইসিয়ান ফাভরে হয়তো ঠিক এমনই ভাবছেন, যদিও তিনি ৪-২-৩-১ ফর্মেশনে দলকে খেলাতে পছন্দ করেন। তিনি যদি এবার ঠিক এই ফর্মেশনও ব্যবহার করেন, তাহলেও ডর্টমুন্ড পুরো বুন্দেসলিগা ছাপিয়ে ইউরোপে ত্রাস ছড়ানোর মতো দল হয়ে যায়।
কেন এমন বলছি? বর্তমান এই দলে যেমন প্রতিভাবান খেলোয়াড় আছে, তেমনই আছে ‘অলরাউন্ডার’ ধাঁচের খেলোয়াড়। উদাহরণস্বরূপ, ইউলিয়ান ব্র্যান্ড্ট; তিনি প্লে-মেকারের ভূমিকায় খেলতে পারেন, আবারও দুই উইংয়ে খেলতেও স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। মারিও গোৎজে, যিনি একসময় অ্যাটাকিং মিডফিল্ডার, তো অন্য সময় স্ট্রাইকার। জার্মান তরুণ মারিওস উলফ আদতে উইঙ্গার হলেও রাইটব্যাকেও তিনি খেলতে পারেন। অথবা মাহমুদ দাঊদ, মাঝমাঠের যেকোন পজিশনে তিনি স্বাচ্ছন্দ্যে খেলতে পারেন। এমন একটি দলের ‘সেরা’ হয়ে উঠতে সঠিক পরিচর্যার দরকার। ইয়ুর্গেন ক্লপ বা টমাস টুখেল বিদায়ের পর অনেকদিন ডর্টমুন্ড এমন একজন কোচের দেখা পায়নি। কিন্তু লুইসিয়ান ফাভরে এসে সেই আশার বাণী শোনাচ্ছেন। গত মৌসুমে দারুণভাবে শুরু করেও ব্যাটে-বলে হয়নি বেশ কিছু কারণে। সেই চিহ্নিত সমস্যার সমাধান ডর্টমুন্ড বোর্ড করে দিয়েছে। শুধু ফারভে এখন তার ফুটবল কৌশল খাটাবেন।
গত মৌসুমে দারুণ শুরুর পরও ডর্টমুন্ড বায়ার্নের সাথে শিরোপা লড়াইয়ে পিছিয়ে গিয়েছিল একমাত্র ইনজুরি আর ফর্মের কারণে। ডর্টমুন্ডে একাদশে অধিকাংশ খেলোয়াড় ইনজুরিপ্রবণ। তাদের সেরা খেলোয়াড় ইনজুরিতে মাঠের বাইরে থাকেন অধিকাংশ সময়ে। যদিও রঈস গত মৌসুমে অপেক্ষাকৃত কম ইনজুরিতে ভুগেছেন। ডর্টমুন্ড ড্র করেছে গোল করতে না পেরে, কারণ দলের স্ট্রাইকার ইনজুরিতে। মাঝমাঠের ইউলিয়ান ভাইগেল বা মারিও গোৎজে থেকে রক্ষণের ম্যানুয়েল আকিনজিও বাদ যাননি। দলের প্রথম পছন্দের গোলরক্ষকও রোমান বুর্কি খেলা থেকে দূরে আছেন বেশ কিছুদিন থেকেই।
এমনকি ডর্টমুন্ড এ মৌসুমে যাদের দলে ভিড়িয়েছে, তারাও বেশ ইনজুরিপ্রবণ। ইউলিয়ান ব্র্যান্ড্ট ও থ্রগান হ্যাজার্ডের সুপার কাপে অভিষেক হয়নি এই ইনজুরির কারণেই। তাই ইনজুরি যদি মৌসুমের গুরুত্বপূর্ণ সময়ে এভাবে হানা দেয়, তাহলে এই স্কোয়াড নিয়েও বিপাকে পড়তে পারে ডর্টমুন্ড।
সুক্ষ্ম সমস্যার আরেকটি হলো, গোলরক্ষক। তাদের প্রথম পছন্দের গোলরক্ষক রোমান বুর্কি দীর্ঘদিন মাঠের বাইরে। এই অবস্থায় মূল গোলরক্ষকের স্থান নিয়েছেন দলের দ্বিতীয় পছন্দের গোলরক্ষক মারউইন হিটজ। তবে হিটজ বা বুর্কি কেউই তেমন ভরসাযোগ্য খেলোয়াড় নন। কয়েক ম্যাচ টানা ভালো খেললেই এদের প্রতি সেভাবে আসলে আস্থা রাখা যায় না। এদের ব্যাপারটা আসলে লিভারপুলের প্রাক্তন গোলরক্ষক লরিস কারিউসের মতো, সারা বছর আস্থা রেখে সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ এক ম্যাচে ডুবিয়ে দেবার প্রবণতা বেশি। তাই বুন্দেসলিগা থেকে ইউরোপের মঞ্চে খেলার জন্য ডর্টমুন্ডের ভরসাযোগ্য একজন তারকা গোলরক্ষক প্রয়োজন ছিল। যদিও ডর্টমুন্ডের নতুন গোলরক্ষক কেনার কোনো আগ্রহ নেই। সম্ভবত কোচও আস্থা রাখতে চাচ্ছেন বুর্কি ও হিটজদের উপর। তাই গোলরক্ষক-সমস্যা এ মৌসুমে আর সমাধান হবার সুযোগ নেই।
প্রাক-মৌসুম ম্যাচে প্রতিটা ম্যাচই ভালো খেলেছে তারা। বায়ার্ন মিউনিখকে হারিয়ে মার্কো রঈস অধিনায়ক হয়ে জিতেছেন ডর্টমুন্ডের প্রথম শিরোপা। নতুন মৌসুম তারা শুরু করবে এ মাসের ১৭ তারিখে এসসি পাডারবর্নের বিপক্ষে ম্যাচ দিয়ে, শুভ সূচনার দিকেই চোখ থাকবে তাদের। কারণ এবার পাড়ি দিতে হবে অনেক রাস্তা, যেতে হবে বহুদূর।