বর্তমান ফুটবল বিশ্বের প্লেয়ারদের মধ্যে আপনাকে যদি টপ ৫ সেন্ট্রাল অ্যাটাকিং মিডফিল্ডারের নাম খুঁজতে বলা হয়, তাদের মধ্যে আপনি অবশ্যই মেসুত ওজিলের নামটা পাবেন। বর্তমানে আর্সেনালে খেলা এই জার্মান ২০১৩ সালে আর্সেনালের ইতিহাসের রেকর্ড ট্রান্সফার ফি’তে আসেন রিয়াল মাদ্রিদ থেকে। এসেই দারুণভাবে মানিয়ে নেন আর্সেন ওয়েঙ্গারের সিস্টেমে। আর্সেন ওয়েঙ্গারের ফরমেশন ছিল ৪-২-৩-১, সেখানে একজন ‘নাম্বার টেন’ রোলের প্লেয়ারের গুরুত্ব ছিল যথেষ্ট। আর ওজিলের মতো দুর্দান্ত ভিশন আর পাসিংয়ের খেলোয়াড় ছিলেন এই দলের জন্য আশীর্বাদ।
ওই সময়ে তাও কেন আর্সেনাল সফল হয়নি? কারণ, ওজিলের সামনে খেলতেন ওয়ালকট-জিরুর মতো অধারাবাহিক ফিনিশাররা। তবে এদের নিয়েও ২০১৫-১৬ সিজনে লিগ প্রায় জিতেই নিয়েছিল, স্রেফ কিছুটা এদিক-ওদিক হলেই হয়তো আবার আর্সেনালের ঘরে উঠতে পারত শিরোপা।
২০১৭ সালে এফএ কাপ জয়ের পরে আর্সেন নিজের চুক্তি বৃদ্ধি করেন আর্সেনালের সাথে, সাথে মেসুত ওজিল পান প্রতি সপ্তাহে ৩,৫০,০০০ পাউন্ডের বিশাল বেতনের চুক্তি। কিন্তু এরপর আর্সেন ওয়েঙ্গার টিকতে পারেন মাত্র এক বছর। এরপর তার স্থলাভিষিক্ত হন উনাই এমেরি, এক বছর পরই ছাঁটাই হন তিনি। এরপর মাত্র চার ম্যাচের জন্য ফ্রেডি ল্যাংবার্গ হয়ে এরপর আসেন আর্তেতা। এত ট্যালেন্টেড প্লেয়ার হয়েও আর্তেতার একাদশে জায়গা করতে পারছেন না মেসুত ওজিল।
প্যান্ডেমিকের ব্রেকের পরে আর্সেনাল টিমে আর দেখা যায়নি মেসুত ওজিলকে। ফিটনেসের সমস্যাসহ নানা অজুহাত থাকলেও কোনোভাবেই তাকে সাবস্টিটিউট লিস্টেও রাখা সম্ভব হয়নি। আর্তেতার প্ল্যানে কি তাহলে মেসুত ওজিলের কোনো জায়গা নেই? দলের সবচেয়ে বেশি বেতন পাওয়া প্লেয়ার কেন বসে বসে বেতন নিচ্ছেন?
উত্তরের জন্য ফিরে যেতে হবে প্যান্ডেমিকের আগের সিচুয়েশনে। ডিসেম্বরে আর্তেতা আসার পর আর্সেনাল শিফট হয় ৪-২-৩-১ ফর্মেশনে। উনাই এমেরি এই ফর্মেশন ইউজ করলে রাখতেন না ওজিলকে। ওয়ার্করেট বেশি বলে ওই পজিশনে নামতেন ইয়োবি, নাহলে র্যামসি। পরবর্তীতে ৫-২-১-২ ফর্মেশনে শিফট করে ওজিলকে খেলানো হতো। আর্তেতা এসে আবার ওজিলকে জায়গা দেন নাম্বার টেন রোলে।
কিন্তু গত মৌসুমের শুরু থেকেই আর্সেনালের ডিফেন্সে ছিল বড়সড় ঝামেলা। না মুস্তাফি, না লুইজ, কেউই ঠিক এরর-ফ্রি কোনো ম্যাচই যেন বের করতে পারছিলেন না। কোনো না কোনো ভুলে বারবার গোল খাচ্ছিল আর্সেনাল। আর সেপ্টেম্বরের গ্রানিত সাকার অনুপস্থিতিতে বেশিরভাগ সময় তোরেইরা আর গেন্দৌজি দিয়ে চালানো হয় মিডফিল্ড। এই দুইজন আর সাথে থাকা সেবায়োসের কেউই ফিজিক্যালি তেমন স্ট্রং নন প্রিমিয়ার লিগের তুলনায়, যার ফলে বারবার এইখান দিয়ে বল চলে যাচ্ছিল ডিফেন্সে। এরপর সাকা ব্যাক করলেও সমস্যা থেকেই যায়।
এমেরিকে বরখাস্ত করে ফ্রেডি ল্যাংবার্গকে আনলেও তার ট্যাকটিক্স কোনো কাজেই লাগেনি, উল্টো তা ব্যাকফায়ার করে। তাই আর্তেতা ছাড়া আর কোনো অপশনই ছিল না।
আর্তেতা আসার পর দল শিফট হয় ৪-২-৩-১ ফরমেশনে। মুস্তাফি-লুইজ-সাকাদের খেলারও কিছু উন্নতিও হয়। ইনজুরিজনিত কিছু সমস্যার জন্য দলে শুধু কিছু চেঞ্জ আনা দরকার হতো।
কিন্তু ডিফেন্স সমস্যার কোনো সমাধান এলো না। মোটামুটি মাঝমাঠ থেকেই আক্রমণ নিয়ে এসে গোল দিয়ে দিতো বিপক্ষ দল। সাকা যতটা ডিএম রোলে সার্ভিস দেন, তার চাইতে তিনি অনেক বেশি কার্যকর হোল্ডিং মিডফিল্ডার রোলে। ‘প্লেয়িং ফ্রম দ্য ব্যাক’ সিস্টেমে নিচে ডিফেন্স থেকে বল নিয়ে উপরে সাপ্লাই দিতে তার লং বল অনেক কার্যকর, যেটা আমরা সুইজারল্যান্ড ন্যাশনাল টিমে দেখতে পাই। কিন্তু ডিফেন্স থেকে বল নিয়ে সামনে আগানোর সময় এরপর ঘুরে উপরে বল সাপ্লাইয়ের যে সময়টুকু, এখানে তাকে কভার দেওয়ার জন্য একটা ভাল ডিএম দরকার ছিল। দুর্ভাগ্যজনকভাবে তোরেইরা, গেন্দৌজি বা সেবায়োস – কেউই সেভাবে সমর্থন দিতে পারেননি। আর লোনে আসা সেবায়োস নাম্বার ৮ রোলের মিডফিল্ডার, যিনি ‘বক্স-টু-বক্স’ রোলে ভাল খেলেন। ডিফেন্সিভ রোলে সার্ভিস দিতে পারা মিডফিল্ডারের অভাবে তাই ডিফেন্সিভ এররও দেখা যায় বেশি।
কিন্তু… এইখানে ওজিলের দোষ কী?
মোটামুটি প্রতিটা দলের প্রায় সব প্লেয়ারই কাউন্টার অ্যাটাক খেলে ফল-ব্যাক করে, ডিফেন্সিভ সাপোর্ট দিতে নিচে নেমে যায়। কিন্তু ওজিলের প্লেয়িং স্টাইলে এইটা দেখা যায় না। তিনি দলের পাসিং হাব, তার গিফটেড ভিশন ভিড়ের মাঝেও ফাঁকা প্লেয়ার খুঁজে নেয়। কিন্তু ডিফেন্সে যাবেন না তিনি। আর ফিটনেসটাও এখন যেন ঠিক তেমন নেই। স্ট্রেন্থ-স্পিড অনেক কম অন্যদের তুলনায়, ফলে ফিজিক্যাল ব্যাটল জেতার পসিবিলিটিও কম। ওয়েস্টহ্যামের সাথে ওজিলের সর্বশেষ ম্যাচটার কথাই ধরুন। সেখানে ৮৮% পাসিং ছিল, অ্যাসিস্ট ছিল, চান্স ক্রিয়েশন ছিল; কিন্তু ডিফেন্সিভ ওয়ার্ক ছিল পুরোপুরি শূন্য। তাতেই অনুসিদ্ধান্ত চলে আসে, ওজিল খেললে কী হয়? আর্সেনালের ভঙ্গুর ডিফেন্স কোনো ব্যাকআপ পায় না।
তাহলে কথা উঠতেই পারে, আর্সেন ওয়েঙ্গারের সময়ে এমন হয়নি কেন? আর্সেন ওয়েঙ্গারের সময়ে কসিয়ালনি, মার্টেসাকার, মুস্তাফি, কোক্যেলান, র্যামসির মতো খেলোয়াড় ছিলেন, যাদের ডিফেন্সিভ ওয়ার্ক ছিল দারুণ। আর আর্সেনালের প্রচুর অ্যাটাক তৈরি হওয়ায় ছোট দলগুলো নিজেরা অ্যাটাকে চাপ বাড়াতে পারতো না।
আর্সেন চলে যাওয়ার পর এই অ্যাটাক কম হওয়ারও সমস্যা তৈরি হয়, যার ফলশ্রুতিতে অবামেয়াং-লাকাজেটের মতো ফরোয়ার্ড বাদে আর কোনো জায়গা থেকে গোল আসে না। আর মার্টেসাকার-কসিয়ালনি ডুয়োর স্ট্যাট দেখলেই বুঝতে পারবেন, এই দুইজন একসাথে থাকলে খুব কম গোলই খেতো আর্সেনাল।
আর্সেনালের পোস্ট-কোভিড সিচুয়েশন ছিল আরো খারাপ। প্রথম ম্যাচেই সিটির সাথে ০-৩ ব্যবধানে হার। শুরুতেই পাবলো মারির ইনজুরি, এরপর বদলি নামা লুইজের রেড কার্ড। এর পরের ম্যাচে আবার ব্রাইটনের সাথে ১-২ ব্যবধানের পরাজয়, এবার ইনজুরিতে পড়েন বার্নড লেনো। আর মাউপের সাথে মারামারির জেরে আর্তেতা দল থেকে বের করে দেন গেন্দৌজিকে।
আর্সেনালের চেঞ্জটা আসে এরপরই। মার্টিনেজকে পোস্টে রেখে এবার আর্তেতা দল সাজান ৩-৪-৩ ফর্মেশনে। উনাইয়ের মতো ৫-২-১-২ না করার প্রধান কারণ ছিল, আর্তেতার মিডের চাইতে উইংয়ে বেটার ডিফেন্সিভ ওয়ার্করেটের প্লেয়ার ছিল। বুকায়ো সাকা তখন দারুণ ফর্মে, কাউন্টার অ্যাটাকের জন্য পেপে-অবামেয়াং, আর এদের সাপোর্টে পিওর নাম্বার নাইন থেকে ফলস নাইনে চলে আসেন লাকাজেট।
এই ফরমেশনে শিফট করার পর দেখা গেল, সাকা বল ক্যারি করার সময় লুইজের সাপোর্ট পাচ্ছেন, লুইজ কোনো ভুল করলে দুই পাশের বাকি দুই সেন্টারব্যাকের সাপোর্ট পাচ্ছেন। আবার কাজ কমে যাওয়ায় লুইজ-মুস্তাফির এররও কমেছিল। এইজন্য অবশ্য ধন্যবাদ পান কিরেন টিয়ার্নি; অ্যাটাক আর ডিফেন্স দুই জায়গাতেই দারুণ সার্ভিস দিয়েছেন লেফট উইংব্যাক আর লেফট সেন্টারব্যাক রোলে। এখানে আবার ঝামেলা, টিয়ার্নি ছিলেন ওভারল্যাপিং সিবি। তাই তিনি উপরে উঠলে তার জায়গায় সাপোর্ট দিতে লেফটে থাকা নাইলসকে নিচে নামতে হতো। ফলে এই দলে কোনো নাম্বার টেনের জায়গা হতো না।
আর্তেতা তার ডিফেন্স ঠিক রাখতে দলকে ৩-৪-৩ ফরমেশনই বেছে নেন। তবে কিছু ম্যাচে এই ফরমেশনের জন্য কৈফিয়তও দিতে হয় তাকে। অ্যাস্টন ভিলার সাথে ৩-৪-৩ ফরমেশনে খেলান কোনো জেনুইন উইঙ্গার কিংবা প্লেমেকার ছাড়াই। ওই ম্যাচে ১-০ ব্যবধানে হারে আর্সেনাল। এই ম্যাচে ৪-২-৩-১ শিফট হয়ে ওজিলকে জায়গা দেওয়ার দরকার ছিল। কিন্তু বাকি যে বিগ ম্যাচ ছিল, ওইখানে এমন কমপ্যাক্ট ডিফেন্স নিয়ে খেলতে চাইলে ওজিলকে বাইরেই রাখা লাগবে। এইরকম কম্প্যাক্ট না খেললে হয়তো ম্যানসিটি বা লিভারপুলের সাথে জয়টা আসতো না।
আর ওজিল নিজেও সামান্য মানসিকভাবে বিপর্যস্ত ছিলেন ২০১৮ সাল থেকে। বিশ্বকাপ থেকে জার্মানির প্রথম রাউন্ডেই বিদায়। এরপর বলির পাঁঠা হলেন তিনি৷ তুর্কি প্রেসিডেন্টের সাথে মেলামেশা নিয়ে জার্মানি থেকে অনেকভাবেই অপদস্ত করা হয়। এরপর উইঘুরদের অধিকার নিয়ে সরব হলে সমর্থন পাননি ক্লাব থেকে। আর গত মৌসুমে সতীর্থ কোলাসিন্যাচের সাথে তাদের স্ত্রীদের নিয়ে শিকার হন ছিনতাইকারীদের আক্রমণের৷ কোলাসিন্যাচের সাহসিকতায় রক্ষা পেলেও তাদের কারোর পরিবার আর লন্ডনে থাকতে রাজি হয়নি।
আর্সেনাল আর ওজিলের এই সমস্যার কোনো সমাধান আছে কি?
আর্তেতার পার্মানেন্টলি ৩-৪-৩ ফরমেশনে থাকাটা সম্ভব নয় টপ ফোরে আসতে চাইলে। এইভাবে কাউন্টার অ্যাটাকের আশায় বসে থাকতে হয়, আর আর্সেনালের মিডফিল্ড থেকেও কোনো বল সাপ্লাই হয় না।
সমাধান হতে পারতো দুটো। এক, ষণ্ডা গোছের কোনো ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার আনা, যাকে পার করে বল নিয়ে যাওয়া হবে দুরূহ। তাতে ওজিলকে আবার নাম্বার ১০ রোলে এনে ৪-২-৩-১ ফরমেশনে শিফট করা যাবে। দুই, ওজিলকেই বাদ দিয়ে নতুন নাম্বার টেন আনা, যে কি না ডিফেন্সিভ সাপোর্টও দিতে সক্ষম।
আর্সেনাল বেছে নিয়েছে প্রথম সমাধানটাই। দলে এই মৌসুমে এসেছেন থমাস পার্টে, এসেই নিজের জাত চেনাতে শুরু করেছেন। তবে ওজিলের ভাগ্যের শিঁকে ছেঁড়েনি, গত মার্চের পর আর জার্সিটা গায়ে তোলার সুযোগ হয়নি। সম্প্রতি প্রিমিয়ার লিগ আর ইউরোপা লিগের স্কোয়াড থেকেও বাদ পড়েছেন। তবু ধৈর্য্য রেখেছেন ওজিল, বার্তা দিয়েছেন,
“I can promise you that this hard decision won’t change anything in my mindset – I will continue to train as best as I can and wherever possible use my voice against inhumanity and for justice.”
আমরাও অপেক্ষায় থাকবো তার প্রত্যাবর্তনের। আবার ফিরবেন ওজিল, আবার আক্রমণের পর আক্রমণে তটস্থ করে তুলবেন প্রতিপক্ষের রক্ষণভাগ, অনন্য সব জাদুতে মন্ত্রমুগ্ধ করবেন আবারও, এই প্রত্যাশাই রইলো।