১.
গ্রেট ইনিংস কাকে বলে? এই সংজ্ঞাটি একেকজনের চোখে একেক রকম। কারো চোখে সেঞ্চুরি করাটা গ্রেট ইনিংস, আবার কারো চোখে প্রয়োজনের সময় ৪০ রানের ইনিংসও গ্রেট।
‘বড় উপলক্ষ, প্রতিপক্ষ বড় দল, উইকেট হারিয়ে দল খাদের কিনারে, জেতার সম্ভাবনা খুবই কম’- এমন অবস্থা থেকে কেউ যদি মোটামুটি একাই দলকে রক্ষা করেন, তাহলে ৪০ রানের ইনিংসও গ্রেটের মর্যাদা পাবে। বলাই বাহুল্য, এমন ইনিংস এক জীবনে খুব বেশি খেলা সম্ভব নয়। খুব ভালো ব্যাটসম্যান হলে হয়তো হাতে গোনা ৫/৬টি। তার চেয়ে বড় কথা, এই ধরনের ইনিংস কেউ একই টুর্নামেন্টে একবারের বেশি খেলতে পারবেন না, এটাই স্বাভাবিক।
কিন্তু কোনো খেলোয়াড় যদি এক টুর্নামেন্টেই এরকম একাধিক ইনিংস খেলেন, তাহলে ইতিহাসে তাকে একটু আলাদা জায়গা দিতেই হয়। আর সেই টুর্নামেন্টটা যদি বিশ্বকাপের মতো বড় হয়, তাহলে তো কোনো কথাই নেই।
এমনই পারফর্মেন্স করে ক্রিকেটপ্রেমীদের চোখে অমর হয়ে আছেন ল্যান্স ক্লুজনার। বিশ্বকাপের মতো টুর্নামেন্টে ১৪০.৫০ গড়ে আর ১২২ স্ট্রাইক রেটে তিনি রান করেছেন ২৮১। বোলিংয়ে ২০.৫৮ গড়ে নিয়েছেন ১৭ উইকেট। টুর্নামেন্টে পেয়েছেন ম্যান অব দ্য সিরিজের পুরস্কার। কিন্তু পরিসংখ্যানের সাধ্য কী সব কিছু বোঝানোর। যদিও ‘ব্যাটিংয়ে ৪১.১০ গড় আর ৮৯.৯১ স্ট্রাইক রেটে ৩,৫৭৬ রান এবং বোলিংয়ে ১৭১ ম্যাচে ১৯২ উইকেট’ পরিসংখ্যান বিবেচনাতেও একজন অলরাউন্ডারের জন্য যথেষ্ট ভালো পারফর্মেন্স।
ওয়ানডেতে একই ম্যাচে বোলিং এবং ব্যাটিং ওপেন করেছেন এমন গুটিকয়েক ক্রিকেটারের মাঝে ক্লুজনার একজন। দলের প্রয়োজনে ১ থেকে ১০ নম্বর পজিশন পর্যন্ত ব্যাট করেছেন। ওয়ানডের সেরা অলরাউন্ডারের খুব সংক্ষিপ্ত তালিকাতেও তার নাম আসবে।
অথচ জাতীয় দলে তিনি সুযোগ পেয়েছিলেন বোলার হিসেবে। ১৯৯৬/৯৭ সালের কলকাতা টেস্টের শুরুটা তার জন্য সুখকর হয়নি। এক পর্যায়ে মোহাম্মদ আজহার উদ্দিন তার ১ ওভারেই ৫টি চার মারেন। শেষ পর্যন্ত সেই ইনিংসে কোনো উইকেট পাননি ক্লুজনার। পরের ইনিংসে অবশ্য দুঃখটা ভুলে যান তিনি, ৮টি উইকেট তুলে নেন মাত্র ৬১ রানের বিনিময়ে। অভিষেকেই ১ ইনিংসে ৮টির বেশি উইকেট এখন পর্যন্ত কেউ নিতে পারেননি।
পরবর্তীতে টেস্টে ১৭৪ রানের ইনিংসও আছে তার ক্যারিয়ারে, টেস্ট সেঞ্চুরি আছে ৪টি। কিন্তু ক্লুজনার স্মরণীয় হয়ে থাকবেন বিশ্বকাপের জন্যই। কী করেছিলেন ক্লুজনার সেই বিশ্বকাপে? একটু ঘুরে আসা যাক সেসময়ে।
২.
সময়টা ১৯৯৯ সাল, ইংল্যান্ডের মাঠে বিশ্বকাপ অনুষ্ঠিত হচ্ছে। দক্ষিণ আফ্রিকা টপ ফেভারিট হিসেবে টুর্নামেন্ট শুরু করেছে। টুর্নামেন্টের বাকি দুই ফেভারিট ছিল পাকিস্তান আর অস্ট্রেলিয়া। গ্রুপের প্রথম ম্যাচে ভারতের বিরুদ্ধে ম্যাচটা সহজেই জিতে নেয় দক্ষিণ আফ্রিকা। কিন্তু এর মাঝেও ক্লুজনার তার ফর্মের একটা ঝলক দেখান। ৪ বলের ইনিংসে পরপর ৩টি চার মেরে ম্যাচ শেষ করে ফিরেন।
গ্রুপের পরবর্তী ম্যাচ ছিল শ্রীলঙ্কার সাথে। সেই ম্যাচে মুরালির ঘূর্ণিতে ১২২ রানে ৮ উইকেট হারিয়ে পথ হারিয়ে ফেলে আফ্রিকা। সেখান থেকে ক্লুজনার দলকে ম্যাচে ফেরান ৪৫ বলে ৫২ রানের ইনিংস খেলে। শেষ ব্যাটসম্যান ডোনাল্ডকে নিয়ে ৩৩ রানের একটি জুটি করেন, যার মাঝে ডোনাল্ডের অবদান ছিল মাত্র ৩ রান। লো স্কোরিং ম্যাচে বোলিংয়ে ৩ উইকেট নিয়ে আফ্রিকাকে জিতিয়ে ম্যান অব দ্য ম্যাচ হন ক্লুজনার।
পরের ম্যাচেও একই দৃশ্য। ইংল্যান্ডের সাথে ১৪৮ রানেই ৭ উইকেট হারিয়ে ২০০ রানের কমে অল আউট হওয়ার শঙ্কা দেখা দেয়। কিন্তু ৪০ বলে অপরাজিত ৪৮ রান করে পথ হারানো দক্ষিণ আফ্রিকাকে আবার পথ দেখান ক্লুজনার। দল পায় ২২৫ রানের মাঝারি একটি পুঁজি। পরে বোলিংয়ে ১ উইকেট নিয়ে ম্যান অব দ্য ম্যাচ হন ক্লুজনার।
কেনিয়ার সাথে পরের ম্যাচেও ম্যান অব দ্য ম্যাচ তিনি। এবার অবশ্য ব্যাটিং করতে হয়নি, বল হাতেই তুলে নেন ৫ উইকেট। জিম্বাবুয়ের সাথে পরের ম্যাচে বোলিংয়ে পান ১ উইকেট। ব্যাটিংয়ে ক্লুজনার ৫২ রান করে অপরাজিত থাকলেও দক্ষিণ আফ্রিকা ম্যাচ হারে।
তবে প্রথমবার দক্ষিণ আফ্রিকা সেই বিশ্বকাপের অন্যতম টপ ফেভারিট পাকিস্তানের মুখোমুখি হয় সুপার সিক্স পর্বে। সেই ম্যাচে ২২০ রান তাড়া করতে গিয়ে ৫৮ রানেই ৫ উইকেট হারিয়ে ফেলে দক্ষিণ আফ্রিকা। সেই বিশ্বকাপে পাকিস্তানের বোলিং লাইন আপ ছিল দুর্দান্ত, দুইশ’রও বেশি রান করে তারা হারবে, এটা ভাবাই যেত না। ওয়াসিম, সাকলাইন, শোয়েব এর সাথে আজহার মাহমুদ আর আবদুর রাজ্জাক। কিন্তু অমন বোলিংকেও ছিন্ন-ভিন্ন করে ম্যাচ বের করে নেন সেই একজন, ল্যান্স ক্লুজনার। ৪১ বলে ৪৬ রান করে অপরাজিত থাকার পথে ওয়াসিম আর শোয়েবকে দুটি বিশাল ছয় মারেন তিনি। সাথে বোলিংয়ে ১টি উইকেট পাওয়ায় ম্যান অব দ্য ম্যাচ আবারও ক্লুজনার।
পরের ম্যাচ ছিল নিউজিল্যান্ডের সাথে, সেটাতে দক্ষিণ আফ্রিকা সেভাবে বিপদে পড়েনি। অস্ট্রেলিয়ার সাথে সুপার সিক্সের ম্যাচেও ক্লুজনার ২১ বলে ৩৬ রান করেন। কিন্তু সেই ম্যাচে পরাজয়ের মুখ দেখতে হয় দক্ষিণ আফ্রিকার।
তবে মূল ম্যাচটা হয় অস্ট্রেলিয়ার সাথে সেমিফাইনালে। মাত্র ২১৪ রানের টার্গেটে নেমে ৬১ রানেই ৪ উইকেট হারিয়ে বিপদে পড়ে যায় দক্ষিণ আফ্রিকা। ক্লুজনার যখন মাঠে নামেন, তখন ১৭৫ রানে ৬ উইকেট নেই। সবচেয়ে বড় কথা, শেন ওয়ার্ন তখন তার জীবনের অন্যতম সেরা ফর্মে বোলিং করছেন। উইকেট নেই, আস্কিং রান রেট বাড়ছে- এমন অবস্থায় তাকে ছেড়ে চলে গেলেন পোলক, তখন রান ১৮৩। এরপর মার্ক বাউচার যখন আউট হলেন, তখন ক্লুজনার বুঝে গেলেন, যা করার তাকে একাই করতে হবে। ৪৯তম ওভারের ৪র্থ বলে ম্যাকগ্রাকে উড়িয়ে মারলেন। ক্যাচ হয়ে যেত, কিন্তু টানটান মুহূর্তের স্নায়ুচাপে পড়ে পল রেইফেল মিস করে সেটিকে ছয় বানিয়ে দিলেন। গোটা ম্যাচের অনেক চড়াই-উৎড়াইয়ের পরে শেষ ওভারে দরকার হয় ৯ রান, হাতে তখন উইকেট ১ টি।
স্ট্রাইকে ক্লুজনার থাকায় সেই পরিস্থিতি সামলানোর সম্ভাবনা তখনও বেশ ভালোভাবেই ছিল। ফ্লেমিংয়ের প্রথম বলেই একটা চার মারলেন তিনি, আর দরকার ৫ বলে ৫। দ্বিতীয় বলে আরেকটা চার মারলেন। মাঠে থাকা সব অস্ট্রেলিয়ানরা মুখে হাত দিয়ে নিশ্চুপ। আর মাত্র একটি রান, তাহলেই বিশ্বকাপ ফাইনালে দক্ষিণ আফ্রিকা। কিন্তু অবিশ্বাস্যভাবে ডোনাল্ড নিজের ভুলে রান আউট হয়ে গেলেন। ক্লুজনার ১৬ বলে ৩১ রানে অপরাজিত থাকার পরেও ম্যাচ টাই হলো। টুর্নামেন্টের বাইলজ অনুযায়ী, আগের মুখোমুখি লড়াইয়ে অস্ট্রেলিয়া জয়ী থাকার কারণে টাই হওয়ার পরেও দক্ষিণ আফ্রিকা বাদ পড়ে যায়। কিন্তু ট্রাজিক হিরো হিসেবে সমগ্র বিশ্ববাসীর হৃদয় জয় করে নেন ক্লুজনার।
ম্যাচের হাইলাইটস
৩.
ব্যাটসম্যান হিসেবে ক্লুজনার সবসময়ই বিধংসী ছিলেন। ক্যারিয়ারের প্রথম ওয়ানডেতে শুন্য রান করে আউট হলেও ৩য় ম্যাচেই শক্তিশালী অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে অপরাজিত ৮৮ রানের একটি ইনিংস খেলেন। তবে সবাই প্রথম ক্লুজনারের জাত চেনে ১৯৯৭ সালে পাকিস্তানে অনুষ্ঠিত চার জাতির একটা টুর্নামেন্টে। এই টুর্নামেন্টের বাকি তিনটি দল ছিল পাকিস্তান, ওয়েস্ট ইন্ডিজ আর শ্রীলঙ্কা। সেই টুর্নামেন্টে ফাইনাল ম্যাচে সেই সময়ের সর্বজয়ী শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে তিন নম্বরে নেমে ৯৯ রানের ইনিংস খেলেন ক্লুজনার।
আধুনিক টি-টুয়েন্টি যুগে তিনি একজন অসাধারণ কার্যকরী খেলোয়াড় হতেন, সেটি না বললেও চলে। তার ঘরোয়া টি-টুয়েন্টি ক্যারিয়ার সেই সাক্ষ্যই দেয়। ২০০০ সালে উইজডেনের নির্বাচিত বছরের সেরা ৫ ক্রিকেটারের একজন হন এই অলরাউন্ডার।
ইনজুরির জন্য ক্যারিয়ারের শেষভাগটা মনের মতো হয়নি। ২০০৪ সালে শেষ আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেললেও ঘরোয়া ক্রিকেটে খেলে গিয়েছেন ২০১০ সাল পর্যন্ত। তবে বিশ্বকাপ ক্রিকেট যতদিন থাকবে, ক্লুজনারের কীর্তির কথা মানুষ সবসময়ই স্মরণ করবেন।