মাত্র ২৬ বছর বয়সেই ক্রিকেট বলের আঘাতে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছিলেন ফিলিপ হিউজ। পুরো বিশ্ব হতবুদ্ধি হয়ে গিয়েছিলো এই ঘটনায়। তবে শুধু ফিলিপ হিউজই নন, অকালে মৃত্যুবরণ করেছেন অনেক ক্রিকেটাররাই। আজ আমরা শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করবো এমনই কয়েকজন ক্রিকেটারকে, যারা সুবাস ছড়ানোর আগেই মৃত্যুর করাল গ্রাসে পরাজিত হয়েছেন জীবনযুদ্ধে।
মানজারুল ইসলাম রানা (বাংলাদেশ)
মাত্র ২২ বছর বয়সেই বাংলাদেশের এই প্রতিভাবান স্পিনার ঢলে পড়েন মৃত্যুমুখে। লেফট-আর্ম অর্থোডক্স বোলার হিসেবে বেশ নাম কুড়িয়েছিলেন ততদিনে। বাংলাদেশের লাল-সবুজ জার্সি গায়ে খেলে ফেলেছিলেন ২৫টি একদিনের আন্তর্জাতিক ম্যাচ এবং ৬টি টেস্ট ম্যাচ।
কিন্তু সড়ক দুর্ঘটনায় অকাল মৃত্যু হানা দেয় রানার অদৃষ্টে। রানা’র মোটরসাইকেল এবং একটি মাইক্রোবাসের মুখোমুখি সংঘর্ষে তৎক্ষনাৎই মারা যান তিনি। রানা’র মৃত্যুতে শোকের ছায়া নেমে আসে পুরো ক্রিকেটঅঙ্গনে।
বেন হলিওক (ইংল্যান্ড)
ক্রিকেটার হিসেবে বড় ভাইয়ের মতো এত বিখ্যাত না হলেও ইংল্যান্ডের জার্সি পড়ার সৌভাগ্য হয়েছিলো বেন হলিওকের। তবে সেই সুদিন কয়েক বছরের মধ্যেই পরিণত হয় আক্ষেপ ও বিষাদে। মেলবোর্নে জন্ম নেওয়া এই ক্রিকেটার ২০০২ সালে পার্থে একটি গাড়ি দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান। মৃত্যুকালে হলিওকের বয়স ছিলো মাত্র ২৪ বছর।
বেন হলিওক ইংল্যান্ডের জার্সি গায়ে চাপিয়ে খেলেছেন ২টি টেস্ট এবং ২০টি একদিনের আন্তর্জাতিক ম্যাচ। উল্লেখ্য, বেন হলিওকের বড় ভাই অ্যাডাম হলিওক একসময় ইংল্যান্ডের ওডিআই ফরম্যাটের অধিনায়ক ছিলেন।
কলিন স্মিথ (ওয়েস্ট ইন্ডিজ)
ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলের এই বিখ্যাত অলরাউন্ডারও প্রাণ হারান একটি গাড়ি দুর্ঘটনায়। মাত্র ২৬ বছর বয়সেই ক্রিকেটকে অনেক কিছু দেওয়ার আগেই ১৯৫৯ সালে পরপারে পাড়ি জমান কলিন স্মিথ। তবে কলিন স্মিথ গাড়ি দুর্ঘটনায় মারা গেলেও প্রাণে বেঁচে যান আরেক কিংবদন্তী অলরাউন্ডার স্যার গ্যারি সোবার্স।
একটি চ্যারিটি ম্যাচ খেলতে তৎকালীন ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলের তিন সদস্য কলিন স্মিথ, গ্যারি সোবার্স এবং টম ডিউডনি একসাথে লন্ডনযাত্রা শুরু করেন। লন্ডনেরই রাস্তায় একটি ট্রাকের সাথে সংঘর্ষে কোমায় চলে যান কলিন স্মিথ। পরবর্তীতে কোমা থেকেই মৃত্যুবরণ করেন তিনি।
হানসি ক্রনিয়ে (দক্ষিন আফ্রিকা)
নায়ক থেকে দ্রুত ভিলেনে পরিণত হওয়া হানসি ক্রনিয়েও খুব অল্প বয়সেই দুনিয়া থেকে বিদায় নেন। যদিও ততদিনে সব ধরণের ক্রিকেট থেকে বহিষ্কৃত ছিলেন তিনি।
একসময় দক্ষিণ আফ্রিকাকে নেতৃত্ব দেওয়া ক্রনিয়ে ২০০০ সালে স্পট ফিক্সিং কেলেঙ্কারির জন্য ক্রিকেট থেকে আজীবনের জন্য নিষিদ্ধ হন। এর ঠিক দুই বছর পর একটি প্লেন ক্র্যাশে পৃথিবী থেকে চিরবিদায় নেন এই ক্রিকেটার। ২০০২ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার জর্জ এয়ারপোর্টের নিকটবর্তী পাহাড় ওটেনিকুয়া’র সাথে ধাক্কা খেয়ে উড়োজাহাজটি ভূপাতিত হয়। আর দুর্ভাগ্যজনকভাবে যাত্রী হিসেবে সেই উড়োজাহাজেই সওয়ার হয়েছিলেন হানসি ক্রনিয়ে। প্লেন ক্রাশের সাথে অনেক যাত্রীর সাথে শেষ পরিণতি বরণ করেন ক্রনিয়ে।
রুনাকো মর্টন (ওয়েস্ট ইন্ডিজ)
ওয়েস্ট ইন্ডিজের সাবেক এই ব্যাটসম্যান একটি ট্র্যাজিক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান। ত্রিনিদাদের হয়ে একটি ম্যাচ খেলে বাড়ি ফেরার পথে নিজেই অ্যাক্সিডেন্ট করে বসেন এই ব্যাটসম্যান।
২০১২ সালে একটি ঘরোয়া ম্যাচ খেলে বাড়ি ফেরার পথে একটি পোলের সাথে ধাক্কা খায় মর্টনের গাড়ি। আর সেই দুর্ঘটনায় সাথে সাথেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন এই ব্যাটসম্যান। মৃত্যুকালে মর্টনের বয়স ছিল মাত্র ৩৩ বছর।
লরি উইলিয়ামস (ওয়েস্ট ইন্ডিজ)
একজন প্রতিভাবান অলরাউন্ডার হিসেবে বেশ নাম কুড়িয়েছিলেন লরি উইলিয়ামস। দেরিতে আন্তর্জাতিক অভিষেক হলেও নিজেকে মেলে ধরতে সময় নেননি একটুও। কিন্তু জীবনই বা সেই সময়টুকু আর দিলো কোথায়! মাত্র ৩৩ বছর বয়সে জীবনের কাছে হার মেনে পরপারে পাড়ি জমান এই ক্রিকেটার।
লরি উইলিয়ামসও আকস্মিক গাড়ি দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান। ২০০১ সালে জ্যামাইকার কিংস্টনে বাসের সাথে গাড়ির মুখোমুখি সংঘর্ষে এই পরিণতি ঘটে উইলিয়ামসের কপালে। ১৯৯৬ সালে অভিষেক হওয়া লরি মৃত্যুর আগ পর্যন্ত খেলেছেন ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলের হয়ে। ছোট্ট ক্যারিয়ারে ওয়েস্ট ইন্ডিজের হয়ে তিনি খেলেছেন ১৫টি একদিনের আন্তর্জাতিক ম্যাচ।
রমন লাম্বা (ভারত)
বিখ্যাত এই ভারতীয় খেলোয়াড় প্রাণ হারান বাংলাদেশের মাটিতেই। ১৯৯৮ সালে বাংলাদেশের ঘরোয়া লিগের আবাহনী ও মোহামেডানের মধ্যকার একটি ম্যাচ খেলতে ঢাকায় পা দেন রমন লাম্বা। সেই ম্যাচ খেলার সময় মোহামেডানের ব্যাটসম্যান মেহরাব হোসেনের একটি শট উড়ে এসে লাগে ফিল্ডিংরত রমন লাম্বার মাথায়। সেই আঘাত নিয়েই মাঠ ছাড়েন তিনি। তবে এরপর আর কখনোই মাঠে ফিরে আসেননি এই ভারতীয় ক্রিকেটার। তিনদিন হাসপাতালে লড়াই করে অবশেষে হার মানেন তিনি, চলে যান না ফেরার দেশে। মৃত্যুকালে রমন লাম্বার বয়স ছিল ৩৮ বছর।
টম মেনার্ড (ইংল্যান্ড)
ইংল্যান্ডের জাতীয় দলে কখনো খেলতে না পারলেও কাউন্টির দল সারে’র হয়ে দুর্দান্ত পারফর্ম করছিলেন টম মেনার্ড। হয়তো কিছুদিনের মধ্যেই তার জন্য খুলে যেত জাতীয় দলের দরজা। কিন্তু সেই সুযোগ আর পেলেন কই! মাত্র ২৩ বছর বয়সেই ওপারে পাড়ি জমালেন এই প্রতিভাবান ব্যাটসম্যান।
২০১২ সালের জুনের ১৮ তারিখ লন্ডনের একটি আন্ডারগ্রাউন্ড ট্রেনের সাথে ধাক্কা খেয়ে মৃত্যুবরণ করেন এই ক্রিকেটার। তবে পরবর্তীতে জানা যায়, অতিরিক্ত অ্যালকোহল নেওয়ার ফলশ্রুতিতে অনেকটা মাতাল অবস্থায়ই ট্রেনের সাথে সংঘর্ষ হয় টম মেনার্ডের। আর এই দুর্ঘটনায় তাৎক্ষণিকভাবেই প্রাণ হারান টম।
ফিলিপ হিউজ (অস্ট্রেলিয়া)
৬৩ নট আউট।
ক্রিকেট মাঠে অপরাজিত থাকলেও অদৃষ্টের নির্মম পরিহাস্যে জীবনযুদ্ধে পরাজিত হতে হয়েছিলো তাকে। সিডনি ক্রিকেট মাঠে শেফিল্ড শিল্ডের একটি ম্যাচে বাউন্সারের আঘাতে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন হিউজ। পরবর্তীতে দুইদিন হাসপাতালে থেকে লড়াই করে প্রাণ হারান এই প্রতিভাবান ব্যাটসম্যান।
মাত্র ২৫ বছর বয়সেই অস্ট্রেলিয়া মূল দলে জায়গা পাকাপোক্ত করে ফেলেছিলেন, অভিষেকের পরই চিনিয়েছিলেন নিজের জাতটা। ২৬তম জন্মদিনের কিছুদিন আগে শন অ্যাবটের আকস্মিক এক বাউন্সারে আহত হওয়ার পর মৃত্যুবরণ করা হিউজ অস্ট্রেলিয়ার হয়ে খেলেছেন ২৬টি টেস্ট ম্যাচ এবং ২৫টি একদিনের আন্তর্জাতিক ম্যাচ। ফিলিপ হিউজের আকস্মিক মৃত্যুতে ক্রিকেটঅঙ্গনে নেমে আসে গভীর শোকের ছায়া। হিউজের মৃত্যুর পরই হেলমেটের পেছনে বাড়তি সেফটিকেজ ব্যবহারের জন্য কড়াকড়ি আরোপ করে আইসিসি।
ম্যালকম মার্শাল (ওয়েস্ট ইন্ডিজ)
সর্বকালের অন্যতম সেরা পেসার হিসেবে খ্যাত ম্যালকম মার্শালও মারা যান অতি অল্প বয়সেই। যদিও ততদিনে খেলা থেকে অবসর নিয়েছিলেন তিনি, তবে নিজের অভিজ্ঞতা ও জ্ঞান ছড়িয়ে দেওয়ার আগেই পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করেন মার্শাল।
মাত্র ৪১ বছর বয়সে কোলন ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে পরপারে পাড়ি জমান তিনি। কোলন ক্যান্সার মার্শালের শারীরিক অবস্থাকে শোচনীয় করে তোলে। সেই সময় এই পেসারের ওজন ছিল মাত্র ২৫ কেজি। এই ক্যান্সারের সাথে কয়েক মাস লড়াই করে ৪১ বছর বয়সে সবাইকে ছেড়ে চলে যান মার্শাল। তবে ক্রিকেটে মার্শালের অবদান ভোলার নয়। ওয়েস্ট ইন্ডিজের হয়ে ৮১ টেস্ট খেলে ৩৭৬টি উইকেট সংগ্রহ করেছিলেন এই পেস কিংবদন্তি।