বিশ্বের সবচেয়ে আলোচিত ও সমালোচিত কোচ হোসে মরিনহো।
পোর্তোর হয়ে চ্যাম্পিয়নস লিগ জিতে সারা বিশ্বের নজর কেড়েছিলেন। এরপর যেখানেই গেছেন, সাফল্য আর বিতর্ক তার সঙ্গী ছিলো। চেলসিতে অবিশ্বাস্য সাফল্য পেয়েছেন। কিন্তু একটা চ্যাম্পিয়নস লিগ জিততে পারেননি। আবার ইন্টার মিলানে গিয়ে ভিন্ন আরেকটা ক্লাবের হয়ে চ্যাম্পিয়নস লিগ জিতেছেন। রিয়াল মাদ্রিদে এসে বার্সেলোনার সাথে দ্বন্দ্বটা উষ্কে দিয়ে এক মহাচরিত্র হয়ে উঠেছিলেন।
নানা জায়গা ঘুরে এখন আবার ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগে আছেন কয়েক বছর ধরে। চেলসিতে দ্বিতীয় পর্ব শেষ করে এখন তিনি ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডে অ্যালেক্স ফার্গুসনের রেখে যাওয়া চেয়ারে বসছেন। সেখানে অবশ্য এখনও বড় কোনো সাফল্য ধরা দেয়নি মরিনহোর হাতে।
জীবনে পেয়েছেন অনেক স্বীকৃতি, অনেক বড় বড় অর্জন আছে তার। পর্তুগালের শতক-সেরা কোচের স্বীকৃতি পেয়েছেন। আবার উয়েফার সেরা ১০ কোচের একজন হিসেবে মনোনীত হয়েছিলেন। এই মরিনহোই সবচেয়ে বেশি অর্থ ব্যয়ের রেকর্ড গড়েছিলেন ইউরোপীয় ফুটবলে।
এখন তার মাথার ওপর প্রবল চাপ- ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডকে শিরোপা জেতাতে হবে এবং চ্যাম্পিয়নস লিগে সাফল্য পেতে হবে। এরকম একটা অবস্থায় তৃতীয় মৌসুম শুরু করেছেন মরিনহো।
এই অবস্থায় মরিনহোর সামনে অনেক প্রশ্ন।
দলবদলের বাজারে আসলে তিনি কী চেয়েছিলেন? পল পগবাকে নিয়ে যেসব গুঞ্জন শোনা যাচ্ছে, সেগুলো কি আসলেই সত্যি? এই মৌসুমে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের ভাগ্যে কী ঘটতে যাচ্ছে? সবচেয়ে অগ্নিগর্ভ প্রশ্ন হলো- ম্যানচেস্টার সিটির প্রামাণ্যচিত্র নিয়ে কী ভাবছেন?
আর এসব প্রশ্নের জবাব দিয়েছেন মরিনহো স্কাই স্পোর্টসকে দেওয়া এক সাক্ষাতকারে।
আপনি জয় দিয়ে মৌসুম শুরু করলেন। ম্যাচের পর ‘টিম স্পিরিট’ নিয়ে কথা বলেছেন। আপনি কেন এত সন্তুষ্ট ছিলেন?
আমরা যা আশা করতে পারতাম, তার চেয়ে ভালো খেলেছি। মাত্র তিনদিনের ট্রেনিংয়ের পর সেদিন আমাদের খেলোয়াড়রা মাঠে নেমেছিলো। তারা কেউ কেউ বড় ইনজুরি থেকে ফিরেছিলো। দল একটা কঠিন প্রাক মৌসুম পার করে এসেছিলো। এরপর ম্যাচের আগে আমরা সবাই একত্রিত হওয়ার জন্য মাত্র তিনদিন সময় পেয়েছি। আমাদেরকে ওই সময়ের মধ্যে প্রস্তুত হতে হয়েছে। কিছু খেলোয়াড় দলের জন্য অস্বাভাবিক চেষ্টা করেছে সেদিন। অবশ্যই এটা ভালো ফলাফল। আর পারফরম্যান্সেও আমি অনেক ইতিবাচক লক্ষণ দেখেছি।
আপনি দলবদলের সময় ‘অতিরিক্ত মানুষ’ খোজ করছিলেন। সেটা না পাওয়াতেও কি কাজটা কঠিন হয়েছে?
আমরা একটা অতিরিক্ত খেলোয়াড় নিয়ে কথা বলছিলাম। এর মানে এই নয় যে, আমরা অতিরিক্ত পাঁচ-ছয় জন খেলোয়াড় চেয়েছি এবং তারা আসেনি। একটা খেলোয়াড়ই চাচ্ছিলাম। কিন্তু দলবদলের বাজার যখন বন্ধ হয়ে গেলো, আমি সাথে সাথে বলেছি, আমি এ নিয়ে আর কথা বলবো না। সেই সাথে আমরা কী করেছি এবং কী করতে পারতাম, এ নিয়েও আর কথা বলবো না। এখন ব্যাপার হচ্ছে, আমাদের কী আছে এবং আমরা কী করেছি এবং আমরা আমাদের সামর্থে যা সম্ভব হয়, দলের উন্নতির জন্য সেটা করেছি কি না।
পল পগবাকে নিয়ে প্রশ্ন করতে হবে। সে কি বিশ্বকাপে তার ফর্মটা ক্লাবে নিয়ে আসতে পারবে কি না। অবশ্যই প্রথম ম্যাচে সে ফর্মটা নিয়ে এসেছে বলেই মনে হচ্ছিলো…
অসাধারণ পারফরম্যান্স, অসাধারণ দলীয় পারফরম্যান্স। যে বিষয়টা অবশ্যই আমাকে বেশি সন্তুষ্ট করেছে, তা হলো এই দলীয় পারফরম্যান্স। সেই সাথে কারো বিশেষ চেষ্টা। কারণ, এই তিনদিনের অনুশীলনের পর যে কারো এটা বলা খুব সহজ ছিলো যে, “আমি পারছি না, আমি ক্লান্ত।” কিন্তু তারা এটা বলেনি। তারা বরং বলেছে, “আমি আছি।”
পল পগবা ও আপনার সম্পর্ক নিয়ে এই সপ্তাহে অনেক ধরনের গুঞ্জন ও অনুমান হয়েছে। আপনি সেই প্রসঙ্গে আমাদের কী বলতে পারেন?
আমি এখন যতটা খুশি আছি, তা কখনোই ছিলাম না। আমার কাজ হলো খেলোয়াড়দের পারফরম্যান্স বের করে আনা, তারা যেন দলের হয়ে খেলে, এটা নিশ্চিত করা। খেলোয়াড়রা যেন সমর্থকদের জন্য খেলে, এটা নিশ্চিত করা। পল সেটাই করেছে লিস্টারের বিপক্ষে। আমি এর চেয়ে খুশি হতে পারতাম না। আমাকে বলতেই হবে যে, এটা খুবই মিথ্যা যে, আমাদের মধ্যে এই সপ্তাহে কোনো রকম ঝামেলা হয়েছে; আমি আমার হয়েও বলছি না, ওর হয়েও বলছি না।
এসব গুঞ্জন শুনে কি আপনি হেসে উড়িয়ে দেন?
আমি এসব হেসে উড়িয়ে দেই না। কারণ, এগুলো তো ভালো কথা নয়। লোকে যখন এসব বিশ্বাস করে তখন একটা খেলোয়াড়ের ভাবমূর্তি নষ্ট নয়। সে একজন ভদ্র ছেলে, শিক্ষিত ছেলে, সে কখনো অনুশীলন মাঠে বা অন্য কোথাও কারো সাথে সমস্যা তৈরি করে না। এসব আলোচনা লোকে বিশ্বাস করলে ওর ভাবমূর্তিতে আসলেই প্রভাব পড়বে। এসব আলোচনা লোকে বিশ্বাস করলে আমার ভাবমূর্তিতেও প্রভাব পড়বে। মানুষ ভাববে আমার কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই এবং আমার খেলোয়াড়দের সাথে ভালো সম্পর্ক নেই। এটা ক্লাবের ভাবমূর্তিতে প্রভাব ফেলে। কারণ, আমি ও পল ক্লাবেরই অংশ।
আপনি এই মৌসুমে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের কাছ থেকে কী আশা করেন?
গত মৌসুমে আমরা নিজেদের কঠিন একটা পরিস্থিতিতে ঠেলে দিয়েছিলাম। সেখান থেকে অবশ্যই আমাদের ভালো করতে হবে। আমরা একমাত্র প্রথমই হতে পারলে গতবারের চেয়ে ভালো করা যাবে। আমি যখন লোকেদের লেখা পড়ি বা লোকেদের কথা শুনি, কখনো কখনো মনে হয়, আমরা বুঝি ষষ্ঠ বা সপ্তম হয়েছিলাম গত বছর এবং সবাই আমাদের চেয়ে ভালো করেছিলো। আমরা তো দ্বিতীয় হয়েছিলাম।
এবার কি প্রথম হতে পারবেন?
আমরা অবশ্যই সেটা চেষ্টা করবো। কিন্তু আমাদের সামনে কঠিন কাজ। কারণ, গত বছরটা আমাদের জন্য খুব কঠিন ছিলো। এই মৌসুমে যারা সেরা চারে থাকবে, তাদের সবার জন্য আরও কঠিন হবে।
লিভারপুল যে বিস্ময়কর বিনিয়োগ করেছে, তারা অবশ্যই শিরোপা জিততে চাইবে। আমি আসলে বিনিয়োগ বলতে বোঝাতে চাইছি… অবিশ্বাস্য বিনিয়োগ। চেলসির অসাধারণ একটা স্কোয়াড আছে। ম্যানচেস্টার সিটিরও দারুন স্কোয়াড আছে। টটেনহাম তার খেলোয়াড়দের ধরে রেখেই একটা বিরাট বিনিয়োগ করেছে; এটাই আপনি সবচেয়ে ভালো বিনিয়োগ করতে পারেন। তারা হয়তো ২০০ মিলিয়ন পাউন্ড ব্যয় করতে পারতো। কিন্তু হ্যারি কেইন বা ক্রিস্টিয়ান এরিকসেনকে হারিয়ে ফেললে সেটা অনেক ক্ষতি হতো। ফলে নিজেদের সব সেরা খেলোয়াড় ধরে রাখাটাই অনেক বড় বিনিয়োগ। আর্সেনালও এবার খুব ভালো করবে। যদিও তারা প্রথম ম্যাচে হেরে গেছে। কিন্তু সব মিলিয়ে আমার মনে হচ্ছে, এই মৌসুমটা খুব কঠিন একটা মৌসুম হতে যাচ্ছে।
ম্যানচেস্টার সিটির প্রামাণ্যচিত্র নিয়ে অনেক কথা ও প্রচারণা হচ্ছে চারদিকে। এ নিয়ে আপনার চিন্তাটা কী?
আপনি অন্য সবাইকে শ্রদ্ধা দেখিয়েও ভালো একটা চলচ্চিত্র বানাতে পারেন। আপনার অসাধারণ একটা চলচ্চিত্র বানাতে বাকিদের প্রতি অশ্রদ্ধা দেখানো জরুরি না। আপনি ধনী ক্লাব হতে পারেন, সেরা সেরা খেলোয়াড় কিনতে পারেন। কিন্তু মান কখনো কিনতে পারবেন না। তারা এটাই পরিষ্কার করে দেখিয়েছে। আর এটাই হওয়ার ছিলো।