পৃথিবীতে খেলার সাথে মিশে রয়েছে আবেগ। আর খেলাটি যখন ফুটবল, আবেগের মাত্রাটিও তখন পৌঁছে যায় তার সর্বোচ্চ চূড়ায়। আর ফুটবল বিশ্বকাপ হলে তো কথাই নেই, দেশ-জাতি-বর্ণ নির্বিশেষে শত কোটি চোখ তাকিয়ে থাকে একটি বলের দিকে।
ফুটবল খেলার স্মৃতি রোমন্থন করতে গেলে দেখা যাবে, বেশিরভাগ ফুটবলপ্রেমী শৈশবে বা কৈশোরে সাদাকালো রঙের ফুটবল দিয়ে খেলেছে। সাদা আর কালো রঙের পঞ্চভুজ ও ষড়ভুজে মোড়া একটা ফুটবল; আশি-নব্বই দশকের এমন কোনো মানুষ নেই, যে এই বল দিয়ে ফুটবল খেলেনি বা দেখেনি। এমনকি বর্তমান সময়ে নতুন ডিজাইনের বলের আবর্তন হবার পরেও সেই ক্লাসিক ফুটবল এখনো দেখেত পাওয়া যায়। কিন্তু সেই সময়কালের ফুটবল এমন সাদাকালো রূপ কেন নিয়েছিল এমনটা কি কেউ কখনো ভেবে দেখেছে?
এর পেছনে যে কারণ এবং ইতিহাস রয়েছে, তা অনেকেরই অজানা। সেই ইতিহাস এবং সংযোজিত আধুনিক প্রযুক্তিকে (এনএফসি) সাথে নিয়ে, এবারের রাশিয়া ২০১৮ ফিফা বিশ্বকাপে হাজির হয়েছে টেলস্টার-১৮ বলটি।
টেলস্টারের ইতিহাস
বিশ্বখ্যাত স্পোর্টস এপারেল, অ্যাডিডাসের তৈরি টেলস্টার-১৮ বলটি, ১৯৭০ সালে মেক্সিকোতে অনুষ্ঠিত ফিফা বিশ্বকাপে অ্যাডিডাসের তৈরি সর্বপ্রথম বল টেলস্টার-১ এর আধুনিক সংস্করণ। অতীতের স্মৃতি বিজড়িত এই আইকনিক বলটির নামের পেছনে রয়েছে আরো বড় একটি ইতিহাস। ৫০ বছর আগে পৃথিবীর যোগাযোগ ব্যবস্থা এবং টেলিভশন প্রযুক্তিতে আমূল পরিবর্তন আনা প্রথম মহাকাশ টিভি স্যাটেলাইটের (সফল) সাথে সম্পর্কিত সেই ইতিহাস।
১৯৭০ এর ফিফা বিশ্বকাপের অফিসিয়াল ফুটবল ডিজাইন করার দায়িত্ব পায় জার্মান স্পোর্টস অ্যাপারেল কোম্পানি অ্যাডিডাস। লক্ষ্য একটাই- সাদাকালো টেলিভিশনে ফুটবল খেলা দেখার সময়, মনোক্রম টিভি স্ক্রিনে ক্ষুদ্র বলটি যেন সহজেই দৃষ্টিগোচর হয়। সেই বছরই প্রথম টেলিভিশনে ফিফা বিশ্বকাপ সারা বিশ্বে সরাসরি সম্প্রচারের ঘোষণা দেয়া হয়। ফলে এই টুর্নামেন্ট আয়োজকদের মধ্যে উচ্ছ্বাসের কোনো কমতি ছিল না। তাই আয়োজকদের মধ্যে তখনকার সময়ে প্রচলিত বাদামী রঙের বলটিকে আরো উন্নত করার চিন্তাও ছিল। কারণ সাদাকালো টেলিভিশনে বাদামী রঙের বলটি তেমন ভালভাবে দেখা যেত না, তাই দর্শকদের মধ্যে খেলা দেখাকে আরো জনপ্রিয় এবং সহজ করার লক্ষ্যে তৈরি করা হয়েছিল প্রথম টেলস্টার বল।
অ্যাডিডাস মূল টেলস্টার বলের ডিজাইন করার পর তা রাতারাতি সকলের কাছে অধিক গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছিল এবং জনপ্রিয়তার দিক থেকে পূর্বের সকল বলকে অতিক্রম করেছিল। এমনকি বর্তমান সময়ে যদি কাউকে একটি ফুটবল বলের বর্ণনা দিতে বলা হয়ে থাকে, তাহলে নিশ্চিতভাবে তার মনে সবার প্রথমে সাদা কালো সেই ক্লাসিক বলের চিত্রই ভেসে উঠবে। হয়ত সে জানেও না যে, তার দৃশ্যপটে যে বলটির ছবি ভেসে উঠেছে, সেটিই মূল টেলস্টার। ফুটবল ঐতিহ্যকে নতুন রূপ দান করার লক্ষ্যে তৎকালীন সময়ে অ্যাডিডাস সাদা ষড়ভুজ এবং কালো পঞ্চভুজের সমন্বয়ে ৩২টি প্যানেল বিশিষ্ট টেল্টার বলটি প্রবর্তন করে। বলের সাদাকালো কন্ট্রাস্টের কারণে, মৃদু এবং উজ্জ্বল আলো উভয় ক্ষেত্রেই তা ক্যামেরা এবং দর্শকের চোখে সহজে দৃষ্টিগোচর হয়ে থাকে। অর্থাৎ বল তৈরির পরিকল্পনায় যে চ্যালেঞ্জ ছিল, অ্যাডিডাস তা ভালভাবেই মোকাবেলা করেছিল ।
কিন্তু মনে প্রশ্ন জাগতেই পারে, বলের নামটা কেন টেলস্টার হল? এই প্রশ্নের উত্তর পেতে হলে আমাদেরকে ইতিহাসের পাতায় আরো একটু পেছনের দিকে বিচরণ করতে হবে। ১৯৬২ সালের ১০ জুলাই, আমেরিকান ব্রডকাস্ট কোম্পানি এটিএন্ডটি, বেল ল্যাবস, নাসা, ব্রিটিশ জেনারেল পোষ্ট অফিস এবং ফ্রেঞ্চ ন্যাশনাল পোস্টের সাথে সম্মিলিতভাবে পৃথিবীর কক্ষপথে একটি ছোট টেলিভিশন স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ করেছিল। এই স্যাটেলাইটের নাম ছিল টেলস্টার। গোলাকৃতির স্যাটেলাইটটির ব্যাস ছিল তিন ফুট এবং এর বাইরের পৃষ্ঠ ছিল সাদাকালো প্যানেলে আবৃত। ঠিক যেন ফুটবলের মতো। টেলস্টার নামক এই স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণের পর পৃথিবীর একপ্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে টেলিফোন কল, ফ্যাক্স ম্যাসেজ এমনকি টেলিভিশন সিগন্যাল পর্যন্ত পাঠাতে সক্ষম হয়েছিল, যা এর আগে মানুষের কাছে ছিল কল্পনাতীত। টেলিভিশন স্যাটেলাইট হিসেবে সিগন্যাল পাঠানোর পর থেকে মানুষের কাছে পৃথিবী আরো ছোট হয়ে উঠলো। তখন থেকে এক দেশের টিভি অনুষ্ঠান অন্য দেশ থেকে দেখা সম্ভব হয়ে উঠেছিল।
টেলস্টার স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণের পরদিন থেকেই এটি প্রথম ট্রান্স-অ্যাটলান্টিক সিগনাল পাঠাতে শুরু করলেও এর আসল মর্ম অনুধাবন করতে আরো তেরো দিন সময় লেগেছিল। ১৯৬২ সালের ২৩ জুলাই আমেরিকান ব্রডাকাস্ট কিংবদন্তী, ওয়াল্টার ক্রনকাইটকে ইউরোপের মানুষজন তাদের ড্র্যইং রুম বা বেডরুমে বসে, টিভিতে দেখতে পায়। হয়ত একেক জায়গায় একেক রকমের সম্প্রচার দেখা গিয়েছিল, কিন্তু ২০ মিনিটের এই টেলিভিশন সম্প্রচার, টেলিকমিউনিকেশনের প্রথম মাইল ফলক হিসেবে ইতিহাসের পাতায় লেখা থাকবে।
মূলত ঐতিহাসিক সেই টেলিভিশন স্যাটেলাইটের সাদাকালো গড়ন এবং টেলিভিশনে খেলা সম্প্রচারের তাৎপর্যকে মাথায় রেখেই ১৯৭০ সালের বিশ্বকাপে অ্যাডিডাস তৈরি করেছিল প্রথম টেলস্টার বলটি। এই ২০১৮ রাশিয়া বিশ্বকাপের টেলস্টার-১৮ বলটি সেই প্রথম টেলস্টার বলেরই অনুকরণে তৈরি এবং ফুটবল ঐতিহ্যের সাক্ষী হিসেবে তৈরি করা হয়েছে।
টেলস্টার মেচতা
গ্রুপপর্বে ব্যবহৃত সাদাকালো টেলস্টার ১৮ বলটি, নকআউট পর্ব থেকে কিছুটা রূপ বদলেছে। অরিজিনাল টেলস্টার-১৮’র কালো বা ধূসর অংশটুকুর বদলে সেখানে লাল রঙের প্যানেল ব্যবহার করা হয়েছে এবং নাম দেয়া হয়েছে টেলস্টার মেচতা। এই লাল-সাদা টেলস্টার মেচতা বলটি নামকরণের পেছনেও দুটি কারণ লুকিয়ে আছে। প্রথমত, রাশিয়ান ভাষায় মেচতা শব্দের অর্থ স্বপ্ন বা স্বপ্নিল Mechta; Russian: Мечта, : Dream)। এর নামকরণ করা হয়েছে সোভিয়েত রাশিয়া কর্তৃক প্রেরিত মহাকাশযান মেচতা’র (লুনা-১) এর নামানুসারে। এটি ছিল মানুষসৃষ্ট প্রথম মহাকাশযান যা মুক্তিবেগ অতিক্রম করে পৃথিবীর অভিকর্ষ বলয়ের বাইরে যেতে সক্ষম হয়েছিল। দ্বিতীয়ত, বিশ্বকাপের নকআউট পর্বের টানটান উত্তেজনা এবং উৎসাহকে প্রতীকী রূপে এই লাল-সাদা টেলস্টার মেচতা বলের মাধ্যমে প্রকাশ করা।
অসন্তুষ্টি এবং বিতর্ক
২০১৭ সালের নভেম্বরে টেলস্টার-১৮ বলটি প্রথম অবমুক্ত করা হয়। এর পরই এই বল নিয়ে শুরু হয় বিতর্ক। মূলত তিনজন বিশ্ববিখ্যাত গোলকিপার টের স্টেগান, পেপে রাইনা এবং ডেভিড ডি গিয়া এই বলের সমালোচনা করেন।
স্পেন এবং জার্মানির মধ্যকার একটি প্রীতি ম্যাচে টেলস্টার-১৮ বলটি প্রথম ব্যবহার করা হয়েছিল। এবং খেলাটি ১-১ গোলে ড্র হয়েছিল। খেলা শেষে জার্মান গোল্কিপার টের স্টেগান টেলস্টার-১৮ নিয়ে তার হতাশার কথা জানান। তিনি বলেন, বলটিকে আরো উন্নত করার অবকাশ এখনো রয়ে গেছে। বলটি বাতাসে বেশি দিক পরিবর্তন করে এবং বলটি হাত দিয়ে ধরতে একটু বেগ পেতে হয়। কিন্তু করার কিছুই নেই, আমাদেরকে আরো পরিশ্রম করে এই বলটির সাথেই মানিয়ে নিতে হবে। স্পেনের গোলরক্ষক পেপে রাইনা তো বলটিকেই পরিবর্তন করার পরামর্শ দিয়েছিলেন। স্পেনের আরেক গোলরক্ষক ডি গিয়া বলেছিলেন, “বলটির মধ্যে একটি অদ্ভুত ব্যাপার রয়েছে। বাতাসে এর গতিপথ সহজে অনুমান করা যায় না। এই বলটিকে আরো বেশি ভারসাম্যপূর্ণ করার জন্য এর উন্নতির প্রয়োজন আছে”।
অন্যদিকে ফিফার বরাত দিয়ে লিওনেল মেসি বলটি নিয়ে বেশ ভাল মন্তব্যই করেছেন। ফিফার অফিসিয়াল ওয়েবসাইটে জানানো হয়, বিশ্বসেরা আর্জেন্টাইন ফুটবলার লিওনেল মেসি বলেছেন, “বিশ্বকাপ শুরু আগে বলটি নিয়ে খেলার সুযোগ পেয়ে ভালই হয়েছে। বলটির গতি এবং ভারসাম্য সম্পর্কে ভালই ধারণা পেয়েছি। তিনি আরো বলেন, “বলটির রঙ থেকে শুরু করে ডিজাইন সবকিছুই আমার বেশ ভাল লেগেছে”।
বিতর্কের মুখে টেলস্টার-১৮ এর ল্যাবরেটরি
প্রীতি ম্যাচগুলোতে ব্যবহারের পর টেলস্টার-১৮ নিয়ে খেলোয়াড়দের মধ্যে যে বিতর্ক এবং গোলরক্ষকদের অসন্তুষ্টি দেখা গিয়েছিল, তার জের ধরে বলটিকে সুইস ফেডারেল ল্যাবরেটরি অফ ম্যাটেরিয়াল সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলোজি- এম্পাতে পাঠানো হয়। ফিফার সূত্রমতে, এম্পা ২২ বছর ধরে ধারাবাহিকভাবে ফিফার জন্য বল পরীক্ষণের কাজটি করে আসছে। তারা বলটি পরীক্ষণের জন্য বেশ ন্যায়পরায়ণ এবং বল পরীক্ষণের পর তার ছাড়পত্র দেয়ার বেলায় বেশ কঠোর পদ্ধতি অবলম্বন করে থাকে।
এই পদ্ধতিতে বল পরীক্ষণ করলে প্রতিটি বল ছাড়পত্র পায় না। আর কেবল যে বলের ওজন এবং পরিধি এবং মাপ নির্ণয় করেই ছাড়পত্র দেয়া হয় তেমনটিও নয়। উপরন্তু, একটি পানির ট্যাংকে বলকে ২৫০ বারের মতো নিষ্পিষ্ট করে এর পানি শোষণ ক্ষমতা পরীক্ষা করা হয়। এই পরীক্ষণের পর বলটি খুবই নগণ্য পরিমাণ পানি শোষণ করে এবং এর ভেতরের বায়ুর তেমন কোনো তারতম্য হয় না। এমনকি এরপর বলটিকে ২ মিটার উঁচু থেকে ছেড়ে দিলেও মাটিতে আঘাত করে পুনরায় প্রায় সমান উচ্চতায় লাফিয়ে উঠতে পারে। আকারের দিক থেকে বলটি নিখুঁত কি না তা প্রমাণ করার জন্য বলটিকে ল্যাবরেটরিতে কমপক্ষে ৪০০০ পয়েন্টে মেপে দেখা হয়। রাস্তার পাশে একটি দেয়ালে বলটিকে ঘণ্টায় ৫০ কিলোমিটার বেগে ২,০০০ বার নিক্ষেপ করার পরেও বলটির আকারের কোনো পরিবর্তন হয় না।
তবে এম্পার বায়োমেট্রিক মেমব্রেন অ্যান্ড টেক্সটাইলের মার্টিন ক্যামেনজিন্ড মনে করিয়ে দেন, “পরীক্ষার জন্য নিয়ে আসা সব বল তো আর ছাড়পত্র পায় না। কোনো কোনো প্রস্তুতকারক কোম্পানির বল ছাড়পত্র পেতে ব্যর্থ হয়েই থাকে।” তবে বাতাসে বলটির গতিবিধি নিয়ে গোলরক্ষকদের মধ্যে যে সংশয় দেখা গিয়েছিল, তার সত্যতা কিছুটা হলেও তিনি আঁচ করতে পেরেছিলেন। তবে তার ভাষ্যমতে, পদার্থবিদ্যার পাশাপাশি বলটির মধ্যে আলোকবিদ্যাও প্রভাব রয়েছে। টেলস্টার ১৮ বলটি ক্লাসিক টেলস্টারের আদলে তৈরি করা হলেও এটিতে ঐতিহ্যবাহী সেই পঞ্চভুজ ও ষড়ভুজের প্যানেল ব্যবহার করা হয়নি, বরং অপ্রতিসমভাবে অসমাঙ্গ প্রিন্টের ব্যবহার করা হয়েছে। তিনি বলেন, “বলটি অধিক মাত্রায় ভাসমান এবং দিক পরিবর্তনশীল কি না তা পরীক্ষণের জন্য কিছু নির্দিষ্ট শর্তসাপেক্ষে একটি কম্পিউটারাইজড পায়ের মাধ্যমে বলটিকে কিক করে দেখেছি। কিন্তু বলটির গতিবিধি সম্পর্কে তেমন কোনো বিরুপ আচরণ খুঁজে পাইনি”।
তবে স্পেনের গোলরক্ষক পেপে রাইনা ঠিকই বলেছিলেন, “নতুন এই টেলস্টার- ১৮ বলটি স্ট্রাইকারদের জন্য আশীর্বাদ হয়ে আসছে। এই বিশ্বকাপে অন্যান্য বিশ্বকাপের চাইতে অনেক বেশি গোল হবে।”
ফিচার ছবি: soccer.com