ছোটবেলা থেকেই সমস্যাটা ছিল তার। হঠাৎ হঠাৎ বুকটা কে যেন চেপে ধরতো, জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিলেও বুকে বাতাস পেতেন না; একটু ব্যথা টের পেতেন। সমস্যাটা কাউকে কখনো বুঝতে দেননি। মজায়, হাসিতে উড়িয়ে দিয়েছেন সবকিছু। ব্যাটিং করতে গিয়ে এমন হলে একটু বসে পড়ে পানি খেয়ে আবার শুরু করতেন। কাউকে টের পেতে দিতেন না।
সেবার অস্ট্রেলিয়া সফরে আর পারলেন না। ব্যথা বেড়ে গেল, নিঃশ্বাস নিতেই পারছিলেন না। ভর্তি হলেন হাসপাতালে। ডাক্তাররা জানালেন, হার্টের ভাল্বে সমস্যা; অস্ত্রোপচার করাতে হবে। জীবনে কখনো ঘুমের ওষুধও খাননি; অপারেশন তো দূরের কথা। ভয়ে মরে যাওয়ার উপক্রম হলো। তারপরও অপারেশন হলো। জ্ঞান ফিরল। একা একা শুয়ে আছেন পোস্ট অপারেটিভ টেবিলে। আত্মীয়-স্বজন বন্ধু-বান্ধব কেউ নেই পাশে। ভীষণ একা মনে হচ্ছিল নিজেকে। তারপরও পৃথিবীতে ফিরতে পেরে দারুণ খুশি। মনে মনে বললেন, “শুরু হলো আমার বোনাস জীবন। বাকি এই জীবনে আর কখনো আফসোস করব না। বাকি জীবনটা হবে আমার শুধু উপভোগের। আনন্দ দেবো আর আনন্দ নেবো।”
হ্যাঁ, বিশ্বজুড়ে আনন্দ বিলিয়ে বেড়ানো এক ‘দানব’ হয়ে উঠেছেন তিনি। তিনি আর কেউ নন; তিনি ক্রিস্টোফার হেনরি গেইল, ওরফে ক্রিস গেইল!
গেইলকে নতুন করে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার প্রয়োজন নেই। তিনি নিজে বলেন- কিং গেইল, ইউনিভার্স বস, বেস্ট অব বেস্টস। লোকে বলে, অতিমানব কিংবা এক ব্যাটিং দানব। সারা পৃথিবী তাকে চেনে একটার পর একটা রেকর্ড নিজের করে নেওয়ার জন্য। সারা দুনিয়া তাকে চেনে ছক্কার পর ছক্কা মেরে দুনিয়াকে আমোদিত করার জন্য। কিন্তু গেইল তার আত্মজীবনীতে বলেছেন,
“আমি রীতিবহির্ভূত। আমি এক অদ্ভুতুড়ে। কী ভাবছেন, আপনারা আমাকে চেনেন? আপনারা আমাকে জানেন না। আমাকে পড়তে পারেন, অধ্যয়ন করতে পারেন। আচ্ছা, অধ্যয়নের চেষ্টাও কি হয়নি? ভাবতে পারেন, ক্রিস গেইলকে তো চিনি- ওয়ার্ল্ড বস, দ্য সিক্স মেশিন, বোলারদের যম, রেকর্ড বইয়ে ঝড়, পার্টির রাজা। কিন্তু এসবই ভুল। আমি আসলে জটিল। আমাকে যতটুকু দেখছেন, তার চেয়ে বেশি দেখছেন না। নামটা হয়তো চোখের সামনে, কিন্তু সত্যিকারের ‘আমি’ লুকিয়ে অনেক দূরে। এখন প্রাণ-প্রাচুর্যে ভরপুর, তখন হয়তো চুপচাপ। আমি আত্মবিশ্বাসী, আমি লাজুক। একটা ভাঁড়, পর্যবেক্ষক। আমাকে চেনা যাবে না।”
আমরা তাহলে চেনার চেষ্টা বাদ দিয়ে একটু জানার চেষ্টা করি। জ্যামাইকার কিংসটনে এক নিম্নবিত্ত পরিবারে অনেকগুলো সন্তানের পর একটি সাধারণ লিকলিকে ছেলে হয়ে জন্ম হয়েছিল গেইলের। সংসারের অবস্থা ছিল যাচ্ছেতাই। মায়ের আগের এক বিয়ে; সেই ঘরের ছেলে-মেয়ে ছিল, নিজেরা অনেকগুলো ভাইবোন ছিলেন। সবমিলিয়ে একটা হৈচৈ পরিবেশ। এতগুলো সন্তানের মুখে রোজ খাবার তুলে দেওয়াটা সহজ কাজ ছিল না। তার বাবা খাবারটা দিতে পারতেন; তবে সেটা নামেমাত্র খাবার ছিল। সারাটা সপ্তাহ গেইলরা চেয়ে থাকতেন ছুটির দিনে একটু ভালোমন্দ খাওয়ার জন্য।
ভালোমন্দ খাবারের চেয়ে পিটুনিই বেশি খেতেন। পেটাতেন মা। গেইল খুব সুবোধ বালক ছিলেন না, এটা যে কেউ অনুমান করতে পারেন। স্কুল ফাঁকি দেওয়া, মাঠে মাঠে ঘুরে বেড়ানো, খাবার জন্য জেদ করা; এসব কারণে অহরহ মার খেতেন। পায়ের জুতো থেকে শুরু করে ঝাড়ু; সবকিছু দিয়ে পেটানো হতো। এভাবেই জীবনটা হয়তো কেটে যেত। হয়তো জ্যামাইকার রাস্তায় আরেকটা ভবঘুরে, নেশাগ্রস্ত যুবক হিসেবে বড় হয়ে উঠতেন। কিন্তু ছেলেটার জীবন বদলে দিলো লুকাস ক্রিকেট ক্লাব। গেইল বলেছেন, “লুকাস না থাকলে আমি আজ কোথায় থাকতাম জানি না; হয়তো রাস্তায়। লুকাস ক্রিকেট ক্লাবের পরিচর্যাই আমাকে গেইল করে তুলেছে।”
লুকাসের তত্ত্ববধানে খেলতে খেলতে জ্যামাইকার নির্বাচকদের নজরে পড়ে গেলেন। সাথে ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান ক্রিকেট বোর্ডই জেনে ফেললো জ্যামাইকা থেকে আরো একটা বিধ্বংসী ব্যাটসম্যান বেরিয়ে আসছে। তাকে নিয়ে নেওয়া হলো অনূর্ধ্ব-১৯ জাতীয় দলে। সেখানে খুব সময় কাটানোর আগেই জ্যামাইকার হয়ে প্রথম শ্রেণির অভিষেক হয়ে গেল। কয়েক মাসের মধ্যে ওয়ানডে অভিষেক এবং আর মাস ছয়েকের মধ্যে টেস্ট অভিষেক হয়ে গেল।
অভিষেকেই গেইল বুঝিয়ে দিলেন, ভবিষ্যত কী তার। না, ব্যাট হাতে ওয়ানডেতে যাচ্ছেতাই শুরু করেছিলেন। প্রথম ফিফটি পেতে ৯ ম্যাচ খেলতে হয়েছিল। এর মধ্যে ৬ বার এক অংকের ঘরে থাকতেই আউট হয়েছিলেন। টেস্টেও প্রথম ফিফটি পেলেন ৬ ইনিংস পর। প্রথম সফরেই দলের সিনিয়রদের সাথে বাজে ব্যবহার করলেন। রীতিমতো বেয়াদবি করে আলোচনায় তখন গেইল। তাকে হয়তো বাদই দিয়ে দেওয়া হতো। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই ব্যাট হাতে প্রতিপক্ষ বোলারদের সাথে এমনভাবে পেটানো শুরু করলেন, তাকে বাদ দেওয়ার কথা ভাবাও কঠিন হয়ে গেল।
চোখ-হাতের সমন্বয়ে বিশ্বের সেরা আক্রমণাত্মক ব্যাটসম্যানদের একজন হয়ে উঠলেন তিনি। টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট দুনিয়ায় আসার আগেই হয়ে উঠলেন মারমুখী ক্রিকেটের এক প্রতিশব্দ। প্রথম টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপেই সেঞ্চুরি করে বুঝিয়ে দিলেন, এই ফরম্যাট দিয়েই দুনিয়া শাসন করতে যাচ্ছেন তিনি।
বিশ্বে যখন ফ্রাঞ্চাইজি ক্রিকেট লিগ এলো, সবচেয়ে বেশি খুশি হওয়া মানুষটা ছিলেন নিশ্চয়ই গেইল। ততদিনে বোর্ডের সাথে ঝামেলা চরমে উঠেছে। প্রায়শই জাতীয় দলে খেলেন না। এই সুযোগে হয়ে উঠলেন টি-টোয়েন্টির অবিসংবাদিত সম্রাট। সবধরনের টি-টোয়েন্টি মিলিয়ে সবচেয়ে বেশি রান, সবচেয়ে বেশি সেঞ্চুরি, সবচেয়ে বেশি ছক্কা; একের পর এক রেকর্ড পকেটে পুরতে থাকলেন। আইপিএলে ১৭৫ রানের ইনিংস খেলে সর্বোচ্চ রানটাও নিজের করে নিলেন।
ক্রিস গেইল হয়ে উঠলেন বল পেটানোয় উস্তাদ। টেকনিক্যালি এই বৈশিষ্ট্য খুব একটা ভালো নয়। কিন্তু গেইল ব্যাট হাতে উইকেটে গেলে টেকনিক নিজেই পালানোর পথ খুঁজে পায় না। ওয়ানডে ক্রিকেটও কম পেলো না তার কাছ থেকে। দুনিয়ার প্রথম ব্যাটসম্যান হিসেবে বিশ্বকাপে ডাবল সেঞ্চুরি করলেন গত বিশ্বকাপেই। শুধু ওয়ানডে আর টি-টোয়েন্টির কথা বলায় গেইলের একটা দিক বাকিই থেকে গেলো। ক্রিস গেইল যে টেস্ট ক্রিকেটেও দুই দুইটি ট্রিপল সেঞ্চুরি করেছেন, সে কথা উল্লেখ না করলেই নয়।
বয়স বাড়ছে। বয়সটা বাড়ুক, কিন্তু গেইল বুড়ো হচ্ছেন না। এই তো এবার বিপিএলে এসেও রংপুরকে চ্যাম্পিয়ন করার পথে করলেন দুটো সেঞ্চুরি। তারপরও আইপিএল দলের মালিকরা ভুল বুঝেছিল। ভেবেছিল, গেইল বুঝি ফুরিয়ে গেছেন। তাই প্রথম দু’দিন ধরে অবিক্রিত থেকে গেলেন গেইল। শেষ মুহূর্তে কিংস ইলেভেন পাঞ্জাব কিনে নিলো তাকে। প্রথম দুই ম্যাচ মাঠের বাইরেও বসে থাকলেন। আর মাঠে নেমে প্রথম তিন ম্যাচে দুই ফিফটি আর এক সেঞ্চুরি।
এবার নিশ্চয়ই গেইলের দামটা বোঝা যাবে। গেইল হেসে বলেন,
“পরিসংখ্যান তো মিথ্যে বলে না। বিশ্বের সবচেয়ে বেশি ছক্কা আমার; তাতেও যদি ব্র্যান্ড গেইলে সিল মারা না হয়, কীসে হবে, কে জানে! আমার রেকর্ড আমার হয়ে কথা বলে। যদিও আমি আইপিএলের নিলামে একেবারে শেষ সময়ে বিক্রি হয়েছি, কিন্তু আমি এ নিয়ে চিন্তিত ছিলাম না। যদি এটা না-ও হতো, আমার জীবন থাকতো। আমার এই ক্রিকেটের বাইরে, আইপিএলের বাইরেও জীবন আছে। একটা পর্যায়ে তো আমাকে এসব আইপিএল এবং সবধরনের ক্রিকেট ছেড়েই দিতে হবে। ফলে আমি কখনোই এসব নিয়ে এত বেশি আচ্ছন্ন থাকি না।”
এই হলেন ক্রিস গেইল; দ্য সিক্স মেশিন। কিংবা একজন অতিমানব।
ফিচার ইমেজ- AFP