“পৃথিবীর পুরনো পথের রেখা হয়ে যায় ক্ষয়,
প্রেম ধীরে মুছে যায়, নক্ষত্রেরও একদিন মরে যেতে হয়…।”
জীবনানন্দ দাশ বলেছিলেন তার ‘দুজন’ কবিতায়। প্রকৃতির এই অমোঘ নিয়মের বাইরে কেউই নেই। সেই নিয়ম মেনেই শেষ ইউরো খেলতে নামবেন ইউরোপ-মাতানো অনেক তারকারা। পরবর্তী ইউরোতে যাদের ফেলে যাওয়া শূন্যতায় অনুভব করতে পারেন সমর্থকেরা, তাদের নিয়েই আজকের আয়োজন।
ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো
বয়স তার কাছে নেহায়েতই একটি সংখ্যা। কিন্তু তারপরও সবকিছুর সমাপ্তি আছে। এই ফেব্রুয়ারিতে ৩৬ বছরে পা দেওয়া রোনালদোর শেষ ইউরোই বলা চলে। তবে ফার্নান্দো সান্তোস তা মানতে নারাজ। সংবাদ সম্মেলনে রোনালদোকে নিয়ে তাই বলেছিলেন,
“আশা করি, সে আরো একটি ইউরো খেলবে।”
দলের সেরা খেলোয়াড়টিকে কে না চাইবে বেশিদিন ধরে রাখার জন্য! তবে বাস্তবতার খাতিরে চিন্তা করলে তা নেহায়েত অসম্ভব মনে না হলেও সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ। সে সম্ভাবনাও যতটুকু আছে, নামটা ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো বলেই।
১০৩ গোল নিয়ে ইউরোতে যাচ্ছেন রোনালদো। আলী দাইয়িকে পেছনে ফেলে ১ নম্বরে ওঠার লক্ষ্য নিয়েই আসবেন রোনালদো। কে না চাইবেন এই বিশ্বরেকর্ডটিকে একান্তই নিজের করে নেওয়ার জন্য এত বড় মঞ্চ?
পর্তুগালের জার্সি গায়ে সবচেয়ে বেশি ম্যাচ খেলা অভিজ্ঞ রোনালদোর সামনে অবশ্য হাতছানি দিচ্ছে আরো দুইটি রেকর্ড। এই ইউরোতে একটি ম্যাচ খেললেই পেছনে ফেলবেন টমাস রসিকির খেলা চার ইউরো টুর্নামেন্টকে, আর ১ গোল করলেই প্লাতিনিকে ছাড়িয়ে হবেন ইউরোর সর্বোচ্চ গোলদাতা। পাশাপাশি টানা পাঁচ ইউরোতে গোল করার একক কৃতিত্বও যাবে রোনালদোর ঝুলিতে। বিশাল কোনো অঘটন না ঘটলে রোনালদো যে সেটা ঢের পারবেন, একবাক্যে তার প্রতিদ্বন্দ্বীরাও স্বীকার করে নেবে।
ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়ন পর্তুগালের গত ফাইনালে ম্যাচটা শেষ করতে পারেননি রোনালদো, ইনজুরির কারণে মাঠ ছেড়ে উঠে যেতে হয়েছিল আগেভাগেই। শেষবারের মতো ইউরো মাতানোর আগে রোনালদো চাইবেন আবারও শিরোপা উল্লাসে মেতে উঠতে, এবার নিশ্চয়ই শেষ করতে চাইবেন মাঠ থেকেই!
সার্জিও বুসকেটস
“বুসকেটসকে আপনি খেলার সময় মাঠে দেখবেন না। কিন্তু যে ম্যাচটি সে খেলেনি, আপনি সেই ম্যাচেই বুঝতে পারবেন, বুসকেটস আজ নেই।”
দেল বস্ক বলেছিলেন বুসকেটস সম্পর্কে। ‘ফর্ম ইজ টেম্পোরারি বাট ক্লাস ইজ পার্মানেন্ট’ – কথাটা এই বছর বুসকেটসের সাথে দারুণ মানায়। টালমাটাল বার্সায় গত মৌসুমে গড়পড়তা খেলা বুস্কেটস এই মৌসুমে ফিরেছেন দুর্দান্ত প্রতাপে। তাই বুসকেটসকে দলে রাখতে দ্বিতীয়বার ভাবতে হয়নি এনরিকেকে। এমনকি সার্জিও রামোসের অবর্তমানে স্পেনের অধিনায়কের দায়িত্বও বুসকেটসের হাতে।
সামনের মাসে ৩৩ বছরে পা দিবেন বুসকেটস। তাই শুধু শেষ ইউরোই নয়, হয়তো স্পেনের জার্সি গায়েই শেষবারের মতো বুসকেটসকে দেখা যাবে ইউরোতে। ২০১২ ইউরো জয় করা বুসকেটস চাইবেন নিজের ট্রফি কেসে আরেকটি ইউরো মেডেল যোগ করতে। সেক্ষেত্রে তাকেই হয়ে উঠতে হবে মাঝমাঠের প্রাণ।
ম্যানুয়েল নয়্যার
তর্কসাপেক্ষে আধুনিক ফুটবলের সেরা গোলকিপারদের একজন এবং সর্বকালের অন্যতম সেরা সুইপার কিপার। ক্যারিয়ারে সম্ভাব্য সব কিছুই জিতেছেন। শুধু এক ইউরোর পালকটাই নেই মুকুটে। গত মার্চে ৩৫ বছরে পা দিলেন এই জার্মান ওয়াল, সামনের ইউরো আসতে আসতে ৩৮। সম্ভবত ইউরো শেষেই জাতীয় দলের হয়ে গ্লাভসজোড়া খুলে রাখবেন। তাই শেষবারের মতো আরাধ্য ইউরো জিততে মরিয়া নয়্যার। আর অধিনায়কের বাহুবন্ধনীও তারই হাতে।
জার্মানির হয়ে ইতোমধ্যেই খেলে ফেলেছেন ৯৮ ম্যাচ। এই ইউরোতেই ১৩তম জার্মান হিসেবে নাম লেখাতে যাচ্ছেন ১০০ ম্যাচ খেলা ক্লাবে। তবে তার আগেই নয়্যারের সামনে অগ্নিপরীক্ষা। ফ্রান্স ও পর্তুগালের সাথে একই গ্রুপে পড়া নয়্যারের অতিমানবীয় দেয়াল হওয়ার অপেক্ষাতেই জার্মান সমর্থকেরা। তবে নিজের শেষ ইউরোতে সব উজাড় করে দিলে নয়্যারের পক্ষে সেই দেয়াল হয়ে দাঁড়ানো সত্যিকার অর্থেই ডালভাত ব্যাপার, যা তিনি আগে প্রমাণ করেছেন বারবারই।
জর্জিও কিয়েল্লিনি
২০০৬ বিশ্বকাপ জয় দেখেছিলেন সাইডবেঞ্চে বসে। ২১ বছরের সেই তরুন কিয়েল্লিনি এখন ইতালির বিখ্যাত রক্ষনভাগের রথী-মহারথীদের একজন। মরিনহো তো একবার বলেই ফেলেছিলেন যে কিয়েল্লিনির উচিৎ হার্ভার্ডে যেয়ে রক্ষণ সামলানোর সহজপাঠ দেওয়া।
২০০৮ ইউরো থেকে খেলে আসছেন। দলের সবচেয়ে সিনিয়র ও অভিজ্ঞতাসম্পন্ন কিয়েল্লিনির হাতেই এইবার অধিনায়কের আর্মব্যান্ড। ইতালির হয়ে খেলেছেন ১০৮টি ম্যাচ, ইতালির হয়ে সবচেয়ে বেশি ম্যাচ খেলার তালিকায় সেটি ৭ নাম্বারে। ৩৬ বছরে পা দেওয়া কিয়েল্লিনির এটিই শেষ টুর্নামেন্ট। শেষবারের মতো ডিফেন্ডিং মাস্টারক্লাস দেখাতেও মরিয়া তিনি।
ম্যানুয়েল নয়্যারের মতো বিশ্বকাপ ছুঁয়ে দেখা হলেও ইউরোটা এখনও পরম আরাধ্যই রয়ে গেছে কিয়েল্লিনির কাছে। সবচেয়ে কাছাকাছি গিয়েছিলেন ২০১২ ইউরোতে, সেবার ফাইনালে স্পেনের কাছে হারতে হয়েছিলো তাদের। কয়েক বছর আগেও টালমাটাল ইতালির হারানো গৌরবময় সময় পুনরোদ্ধার করার গুরুদায়িত্ব এবার কিয়েল্লিনির হাতেই। ইতালির সাম্প্রতিক ফর্ম কিয়েল্লিনিকে আশা দেখাতেই পারে। বিদায়ের আগে একবার ইউরো জয়… এটাই তো প্রত্যাশা তার কাছে!
গ্যারেথ বেল
ফুটবলে নাকি তার মনোযোগের বড়ই অভাব, তার চেয়ে আগ্রহের জায়গাটা গলফের দিকেই। তবে ক্লাব পেরিয়ে জাতীয় দল আসলেই পাল্টে যাওয়া বেল। ওয়েলসের হয়ে নিজেকে উজাড় করে খেলে থাকেন। মনোযোগ থাকুক বা না থাকুক, গ্যারেথ বেলের প্রতিভা নিয়ে সংশয় ছিল না কোনোকালেই।
ওয়েলসের ইউরোপে সমীহ জাগানো শুরু করা বেলের হাত ধরেই। ওয়েলসের হয়ে সর্বোচ্চ গোলের মালিকও তিনি। সামনের মাসেই ৩২ বছরে পা দেওয়া বেলের জন্য এটিই শেষ ইউরো। গুঞ্জন রয়েছে, মাদ্রিদের সাথে চুক্তিশেষে পুরোপুরিভাবেই বুট তুলে রাখার সম্ভাবনা রয়েছে। সেই সম্ভাবনা সত্যি হলে শুধু শেষ ইউরোই নয়, বরং ওয়েলসের হয়েই সর্বশেষ টুর্নামেন্টও হতে পারে গ্যারেথ বেলের জন্য।
বিদায় নেওয়ার আগে অধিনায়ক বেল চাইবেন, গত ইউরোর পুনূরাবৃত্তিই যাতে ঘটায় তার দল। বেল-রবসন কানুদের নৈপুণ্যে গত ইউরোর সেমিফাইনাল খেলা হয়েছিল ওয়েলসের। এক ধাপ এগিয়ে এইবার শিরোপাটাই চান গ্যারেথ বেল। টটেনহ্যামের হয়ে দুর্দান্ত এক মৌসুম কাটানো বেলের দিকেই তাকিয়ে ওয়েলসবাসী। আর লাস্ট ড্যান্স হিসেবে ডিফেন্ডার ছিটকে ভোঁ দৌড় দিতে নিশ্চয়ই তর সইছে না গ্যারেথ বেলের!
পেপে
রাফ এন্ড টাফ পেপে নিজের ক্যারিয়ার সেরা সময় পার করে এসেছেন অনেক আগেই। তবে ডিফেন্ডিং ভুলে যাননি এতটুকুও। সর্বশেষ ইউসিএলে জুভেন্টাসের বিপক্ষে এক মাস্টারক্লাস পারফরম্যান্স মনে করে দিয়েছে নিজের দিনে পেপে এখনো প্রতিপক্ষের জন্য ত্রাস।
মেঘে মেঘে পেপের বেলাও কম ফুরোয়নি। ৩৮ বছরে পা দিয়েছেন এই ডিফেন্ডার। নিশ্চিত করেই বলে দেওয়া যায় এটিই তার শেষ ইউরো। ৩৮ বছর বয়সে এসেও ডাক পেয়েছেন পর্তুগাল দলে, মূলত পোর্তোর হয়ে দুর্দান্ত এক মৌসুম কাটানোর পুরষ্কারস্বরূপ। গত ইউরোতেও পর্তুগালের আনসাং হিরো ছিলেন, ইউরো জিতলে সেটি হয়ে থাকতেও আপত্তি নেই পেপের। তবে এবার হয়তো সরাসরি মূল দলে জায়গা না-ও হতে পারে তার। আর হলেও নিজের শেষ ইউরোতে নিজেকে উজাড় করে দিয়েই খেলবেন, তাতে কোনো সংশয় নেই। পর্তুগালের হয়ে ১১৪ ম্যাচ খেলা পেপে দেশের হয়ে চতুর্থ সর্বোচ্চ ম্যাচ খেলা খেলোয়াড়, জিতেছেন ইউরো আর ন্যাশনস লিগও। নিজের বিদায়বেলায় আরেকটি শিরোপা পাওয়ার স্বপ্ন পেপে দেখতেই পারেন। সতীর্থ রোনালদোকে সঙ্গী করে সেটি পেপে পারবেন কি না, তা সময়ের হাতেই তোলা থাক।