টানা তিনবার চ্যাম্পিয়নস লিগ জেতায় স্বপ্নের ভুবনে থাকা মাদ্রিদিস্তারা মে মাসের শেষ দিনের সন্ধ্যায় হঠাৎ বাস্তবে ফিরে এলো। রিয়ালের সাম্প্রতিক সাফল্যের নেপথ্য নায়ক জিদান পদত্যাগ করেছেন! অধিকাংশ ফুটবল ভক্তই হয়তো বিশ্বাস করতে পারেননি। বাকরুদ্ধ হয়ে যাওয়া কি অস্বাভাবিক নয়? যাকে ঘিরে রিয়াল ফ্যানরা ভাবতেন নিজেদের ফার্গুসন পেতে চলেছেন, সেই জিদান এভাবে চলে গেলেন? চারিদিকে শুধু কেন আর কেন?
জিদান যখন দায়িত্ব নেন, রিয়াল তখন কোপা থেকে ছিটকে গেছে, লিগে দশের বেশি পয়েন্ট পিছিয়ে বার্সার চেয়ে, দলে প্রচণ্ড অন্তর্দ্বন্দ্ব। জিদান কোচ হতে চাননি। মাত্র ছয় মাস আগে কোচিং ব্যাজ নিয়ে রিয়াল যুব দলের দায়িত্ব নেওয়া জিদানকে যখন প্রেসিডেন্ট বললেন মূল দলের দায়িত্ব নিতে, তখন তিনি ছিলেন নারাজ। অনিচ্ছাসত্ত্বেও দায়িত্ব নিলেন। পেরেজের তখনো অন্য কোচ নেওয়ার পরিকল্পনা অটুট। জিদান ১৬ পয়েন্টের ব্যবধান নিয়ে এলেন ১ এ! আগের কোচ একটু ভাল করে গেলে সেবারই লিগ জিতে নিতেন হয়তো। জেতালেন চ্যাম্পিয়নস লিগ! পেরেজের নতুন কোচ আনার সাধ মিটে গেল। এরপরের মৌসুমে উয়েফা সুপার কাপ, ক্লাব বিশ্বকাপ, লিগ ও পুনরায় চ্যাম্পিয়নস লিগ জেতালেন। প্রথম কোচ হিসেবে টানা দু’বার চ্যাম্পিয়নস লিগ। এবার স্প্যানিশ সুপার কোপা, উয়েফা সুপার কাপ আর টালমাটাল লিগ মৌসুম শেষেও চ্যাম্পিয়নস লিগ। মাদ্রিদিস্তাদের কাছে নয়নের মণি হয়ে উঠা এই কিংবদন্তী কেন চলে গেলেন? আপাতত সবই অজানা। কিছু অনুমান উপস্থাপন করা হলো এই লেখায়।
বীরবেশে প্রস্থান
যেকোনো বড় যোদ্ধাই জানেন কখন পিছু হটতে হয়। পেরেজ সাম্প্রতিক কোনো কোচকে তিন বছরের বেশি রাখেননি। এবারের ঘরোয়া বাজে মৌসুমটা কোনোভাবে ভুলিয়ে দিয়েছে চ্যাম্পিয়নস লিগ জয়, কিন্তু এমন আরেকটা ঘরোয়া মৌসুম কাটালে পেরেজের খড়্গ নেমেই আসতো জিদানের উপর, অন্তত পেরেজের অতীত তাই-ই বলে। জিদান তার বক্তব্যেও এটাই বলেছেন, “এভাবে জিততে থাকা খুবই কঠিন। এবারের ঘরোয়া মৌসুমটাও বাজে গেল, যা হতে পারে না।” জিদান এমন এক কাজ করলেন, যা পেরেজের অধীনে কোনো কোচ করতে পারেননি- পদত্যাগ করা, যখন কিনা পেরেজ তাকে রাখতে চাইছিলেন। প্রত্যেক মাদ্রিদিস্তা তাকে রাখতে চাইছে, এই ব্যাপারে সর্বৈক্য। জিদান কারো করুণার ভাগীদার হতে চাননি হয়তো।
পাহাড় সমান চাপ
আমরা যতই ভাবি না কেন, সাফল্য তো আসছেই তো থেকে যাক। ব্যাপারটা রিয়াল-বার্সায় এমন সহজ না। এই দুই ক্লাবের আর্থিকসহ অনেক ব্যাপারে কোচকে প্রচুর চাপে থাকতে হয়। বার্সায় পেপ গার্দিওলা যখন যান, তখনো হয়তো ১% বার্সা ভক্তও চাননি তিনি সরে যাক। তবুও তিনি সরে দাঁড়ান। ঠিক সেই সময় তাকে পেতে এক গাদা বড় ক্লাব লাইন দিয়ে প্রস্তুত, কিন্তু পেপ গার্দিওলা নিলেন এক বছরের বিরতি। রিয়াল থেকে বরখাস্ত হওয়ার পর আঞ্চেলত্তিও এক বছরের বিরতি নেন। জিদানও সে ইঙ্গিত দিয়েছেন, “আমি মোটামুটি টানা তিন বছর রিয়ালে, যেটা আমার জন্য কঠিনই বটে।” অনিচ্ছুক একজনের সরাসরি রিয়ালে এসে এই পাহাড়সম চাপে তিন বছর কাটানো আসলে বিশাল ব্যাপার। আর তেতো সত্য হলো, জিদানের সাথে অন্য কোচের হিসেব এত সহজে মেলে না। মরিনহোর খেলোয়াড়ি জীবন প্রায় নেই বললেই চলে, কার্লো বা পেপ দারুণ ফুটবলার হলেও জিদান পর্যায়ের নন। জিদান ইতিহাসের সবচেয়ে সেরাদের একজন, কোচ হিসেবে আধুনিক চ্যাম্পিয়নস লিগের সফলতম। তিনি চাইলেই ইচ্ছেমতো ছেড়ে দিতে পারেন, কারণ তিনি জিদান!
শেষ অভিযাত্রার টান
একজন ফুটবলার সম্ভাব্য যত জায়গায় অমর হতে চান, জিদান তার সবই পূরণ করে ফেলেছেন। কোচ হিসাবে এখনও তার বাকি আছে নিজ দেশের হয়ে বিশ্বকাপ জেতানো। ফ্রান্সের উঠতি প্রজন্ম এই মুহূর্তে বিশ্বের সেরাদের মধ্যে আছে। বর্তমান কোচ দেশমের কাজ তেমন একটা আহামরি কিছু নয়। যদিও বা খেলোয়াড়দের জোরে ফ্রান্স জিতেও যায় এবার, দেশম থাকছেন না সেটা নিশ্চিতপ্রায়। জিদানের হয়তো সুপ্ত অভিপ্রায় থাকতেই পারে, ডাগআউটে থেকে নিজের দেশকে বিশ্বকাপ এনে দেওয়া, ঠিক যেভাবে খেলোয়াড়ি জীবনে নিজের দেশের মাটিতে শক্তিশালী ব্রাজিলকে হারিয়ে এনে দিয়েছিলেন এই শিরোপা।
কিছু মতবিরোধ
রিয়াল মাদ্রিদ যখন ঝামেলা জর্জরিত, শিরোপা খরায় ছিল, তখনও রিয়াল বিশ্বে অন্যতম সেরা দল ছিল আর্থিকভাবে। এই ভিত্তি পেরেজের এনে দেওয়া, আর এর পেছনে রয়েছে তার বড় টাকা সাইনিং। বড় অংকের দাম দিয়ে কেনা খেলোয়াড় সবসময়ই বাণিজ্যিকভাবে প্রচুর লাভ এনে দেয় ক্লাবকে। জিদান আসার পর কোনো বড় টাকার খেলোয়াড় কেনা হয়নি। এবার ক্লাবের পরিকল্পনা ছিল নেইমার সহ কয়েকটা বড় সাইনিংয়ের। হয়তো জিদানের কিছু দ্বিমত ছিল। তবে পেরেজ বলে দিয়েছেন, “আমার ক্যারিয়ারে পাওয়া সব খেলোয়াড় ও কোচের মধ্যে জিদান সবচেয়ে প্রিয়, এটা সে জানে। আমি এই ধাক্কার জন্য প্রস্তুত ছিলাম না।” হয়তো পেরেজ জিদানকে রেখেই বড় অংকের সাইনিং চাচ্ছিলেন, যাতে জিদানের দ্বিমত ছিল।
ভবিষ্যৎ আঁচ করতে পারা
দলের রোনালদো, রামোস, মার্সেলো, বেনজেমা, নাভাস, মড্রিচ সবাই ত্রিশোর্ধ্ব বা ক্যারিয়ারের অন্তিম লগ্নে। এবারের ঘরোয়া মৌসুমে কিছু প্রমাণ পাওয়া গেছে যে, তারা ৭টি নক আউট চ্যাম্পিয়নস লিগ ম্যাচের চাপের জন্য অপ্রতিরোধ্য হলেও, ৩৮ ম্যাচের লিগের জন্য যথেষ্ট না। আবার কিছু কোচ থাকেন যারা ব্যক্তিগত আবেগকে দলেও পৌছে দেন, ব্রাজিলের কোচ তিতের মতো। জিদান হয়তো আঁচ করেছিলেন আশু পতন। হয়তো তার নিজের হাতে তাদের ছাঁটাই করা সম্ভব ছিল না, যাদের হাত ধরেই তার সাফল্য এসেছে। অযৌক্তিক মনে হতে পারে, কিন্তু ফুটবল ইতিহাসে এমন আবেগী কোচিংয়ের উদাহরণ আগেও আছে। জিদান এমনই কিছু কারণে তার সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। রামোস এবছরের শুরুতে বলেছিলেন যে, চ্যাম্পিয়নস লিগে যা-ই হোক না কেন, জিদান চলে যেতে পারেন। তবে কি এটা আগে থেকেই তার মাথায় ছিল? আবার মাত্র মাস দুই আগেই জিদানই বলেছিলেন, “আমি থাকতে চাই। আমি যা করছি তাতে ভালোই বোধ করছি।” নাকি এটা নিজের খেলোয়াড়দের বিভ্রান্ত না করার এক অভিপ্রায় ছিল মাত্র?
কারা হতে পারেন তার উত্তরসূরি
প্রথমেই নাম আসছে টটেনহ্যাম কোচ পচেত্তিনোর। টটেনহ্যামে দারুণ উপভোগ্য ফুটবল খেলানো এই কোচ আগে থেকেই রিয়ালের গুডবুকে। এস্পানিওলে কোচিং করিয়েছেন বিধায় লা লিগাও তার সুপরিচিত, উপরন্তু তিনি পুরোদস্তুর বার্সা-বিরোধী হিসেবে পরিচিত। কিন্তু তার বিরুদ্ধে অভিযোগ, প্রতিযোগিতার শেষান্তে এসে উদগ্রতা দেখাতে পারেন না। স্পার্সের হয়ে তার অর্জন একদম শূন্য বলা চলে।
এরপর আছে আলেগ্রির নাম। আলেগ্রি গত দশকে ইতালিয়ান লিগের সফলতম কোচ। জুভেন্টাসকে নিয়ে জিতেছেন টানা তিনটি লিগ। খেলার ধাঁচও বেশ ভাল। উঠেছেন দুইবার চ্যাম্পিয়নস লিগের ফাইনালে। একবার রিয়াল, আরেকবার বার্সার কাছে হেরেছেন।
আছে নাপোলির সাবেক ম্যানেজার সাররির নামও। গত মৌসুমে সীমিত অর্থের সেরা দল ছিল নাপোলি, নাপোলির খেলা ছিল ইউরোপের সবচেয়ে উপভোগ্যদের একটি। প্রায় লিগ জিতেই গিয়েছিল নাপোলি। গত দুই বছরে তার কাজ অসাধারণ। তার ট্যাকটিকস, খেলার ধরন তাকে ভাল প্রার্থী বানায়।
আরেক জিদানের কাহিনী হবে যদি মাদ্রিদ লিজেন্ড গুতিকে নিয়োগ দেয়। খেলা ছাড়ার পর গুতি কোচিং এ আসেন। গত মৌসুমে ছিলেন মাদ্রিদের যুব দলের কোচ। সেই রিয়াল সি দল সম্ভাব্য সকল ট্রফি জিতে নেয়, যুব চ্যাম্পিয়নস লিগ সহ। গুতির ছেলেদের খেলার ধরনও দারুণ। গুতির কথা হচ্ছিল লা লিগার ক্লাব লেগানেসের দায়িত্ব নেওয়ার। কিন্তু রিয়াল যদি জিদানের মতোই কাউকে চায়, যার দ্বারা ক্লাবের ইগো সমস্যা পাশ কাটানো সম্ভব হবে, গুতিই সেরা পছন্দ হতে পারে। গুতি মাদ্রিদ লিজেন্ড আর একসময় রামোস মার্সেলোদের সতীর্থও ছিলেন।
শোনা যাচ্ছে ওয়েঙ্গার, কোন্তের নাম। কোন্তের প্রচণ্ড শারীরিক শ্রম ভিত্তিক ডিফেন্সিভ খেলার ধরন রিয়ালের সাথে যাবে না নিশ্চিত। ওয়েঙ্গারের দর্শন, খেলার ধরন সবই ঠিক আছে। হয়তো এত বড় ক্যারিয়ারে চ্যাম্পিয়নস লিগের অভাব আর বয়সই তার বাধা হয়ে দাঁড়াবে।
পরিণতি কী হতে পারে রিয়ালের?
দেল বস্ককে এই ট্রান্সফার বোঝাপড়ার অভাবের কারণে পেরেজ বরখাস্ত করেছিলেন লিগ জেতার মাত্র সপ্তাহ খানেকের মাথায়। এরপরে রিয়ালে শুরু হয় অন্ধকার অধ্যায়। দুটো লিগ, দুটো চ্যাম্পিয়নস লিগ এনে দেওয়া ম্যানেজারের বিদায়ের পর রিয়াল দলের কাঠামো ভেঙে যায়। ম্যাকলেলের মতো মাঝমাঠের ইঞ্জিনকে বিক্রি করে দেয়া হয়। আনা হয় ওয়েন, বেকহ্যামদের। সেই আঞ্চেলত্তির আগ অবধি রিয়ালের চ্যাম্পিয়নস লিগের ফর্ম ছিল বাজে, লিগে মাঝে কিছুদিন বাদে গড়পড়তা। মেসি বার্সায় থাকাকালীন যেভাবে জয় পাচ্ছিল রিয়াল, সে ধারা বজায় রাখলে মেসি যাওয়ার পর হয়তো ঘরোয়া আধিপত্য পাওয়াও সম্ভব ছিল। রিয়ালকে ভাবতে হবে আবার শুরু থেকে।
সমর্থকদের মাঝে যেমন শূন্যতা, খেলোয়াড়দের মাঝে আরো বেশি। বলাই হচ্ছিল, জিদান একটা উইনিং মেন্টালিটি দাঁড় করিয়ে ফেলেছিলেন। নতুন কোচের ড্রেসিংরুমের মন প্রথমে জয় করতে হবে। জিদানের কিংবদন্তী মর্যাদা ছিল তার অস্ত্র। ড্রেসিংরুমের কারোরই খেলোয়াড়ি জীবন তার চেয়ে বেশি ভাল ছিল না, তাই তিনি সম্মান আদায় করতে পারতেন। নতুন কোচ যেই-ই হন না কেন, তার চ্যাম্পিয়নস লিগ ট্রফির সংখ্যা এই দলের ২১ বছরের আসেনসিওর চেয়েও কম! এই দলের অধিকাংশ সদস্যই ৪টি চ্যাম্পিয়নস লিগ জয়ী, নিদেনপক্ষে ৩টি। যিনি কোচ আসবেন, তাকে তার লো-প্রোফাইল ঢাকতে হবে জ্ঞানের মহিমা দিয়ে। ভগ্ন মনোরথ, তৃপ্ত একগাদা খেলোয়াড়কে জাগিয়ে তোলাটা অসম্ভব কষ্টের কাজ। যিনি কোচ হয়ে আসবেন, সমূহ সম্ভাবনা থাকবে তার ক্যারিয়ারে বড় একটি ব্যর্থতার দাগ লেগে যাওয়ার।
জিদান একটি উদাহরণ তৈরি করে দিয়ে গেলেন। কেবল কি একটি? তার ক্যারিয়ারটাই যে উদাহরণময়। হয়তো রিয়ালে জিদানের অধ্যায় শেষ, যদিও তার বক্তব্যে স্পষ্ট ইঙ্গিত ছিল প্রয়োজনে ফিরে আসার। ৭৫ মিলিয়নে যখন খেলোয়াড় জিদানকে পেরেজ কেনেন, তখন পেরেজকে সহ্য করতে হয়েছিল এত বয়েসী এক খেলোয়াড়ের জন্য এত টাকা কেন- এমন সব প্রশ্ন। আজ যাওয়ার পর আবার পেরেজের দিকে প্রশ্নবাণ। মাঝখানে সক্রিয়ভাবে ক্লাবকে দিয়ে গেছেন পাঁচটি চ্যাম্পিয়নস লিগ। তার প্রস্থান কি দেল বস্কের প্রস্থানের মতোই রিয়ালে আবার অন্ধকার অধ্যায় শুরু করবে? এত বড় আলোকচ্ছটা কি এত সহজে প্রতিস্থাপন করে ফেলা যায়? সব উত্তর সময়ই বলে দেবে।
তিনবার টানা চ্যাম্পয়নস লিগ জেতার পর, সবাইকে স্তব্ধ করে দিয়ে মাদ্রিদের কোচ হিসেবে পদত্যাগ করলেন রিয়াল মাদ্রিদ কিংবদন্তি জিনেদিন জিদান। কিন্তু কেন?
Roar বাংলা ಅವರಿಂದ ಈ ದಿನದಂದು ಪೋಸ್ಟ್ ಮಾಡಲಾಗಿದೆ 31 ಮೇ 2018
ফিচার ইমেজ: CNN International