একটু উদ্ধত, স্টাইলিশ, উইকেটে দারুণ আত্মবিশ্বাসী, বেপরোয়া ব্যাটিং; এ-ই ছিল তুষার ইমরানের প্রথম বিজ্ঞাপন। কৈশোর পার হওয়ার আগেই বাংলাদেশে তারকা হয়ে গিয়েছিলেন। তার মধ্যে ভবিষ্যৎ দেখেছিল বাংলাদেশের ক্রিকেট। কেবল ভবিষ্যৎ তারকা নয়, অনেকেই মনে করতেন, তুষার ইমরান হবেন বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নেতা।
আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের শুরুটাও হয়েছিল দারুণ। প্রথম ম্যাচে মাত্র ৬ রান করে আউট। কিন্তু পরের চার ম্যাচে যথাক্রমে ২১, ৬৫, ৪৩ ও ৬১ রান। তুষারকে নিয়ে তখন স্বপ্ন দেখতে কোনো বাঁধা ছিল না। কিন্তু স্বপ্নটা স্বপ্নই থেকে গেল। নিজেকে কখনোই স্থায়ী সেই ভরসায় পরিণত করতে পারলেন না। একটু একটু করে যেন মিলিয়ে গেলেন।
আমাদের মতো সাধারণ মানুষেরা ধরে নিয়েছিলেন, তুষার হারিয়েই গেছেন। কিন্তু তুষার অন্য ধাতু দিয়ে গড়া মানুষ। তিনি হারিয়ে যেতে আসেননি। ৩৪ বছর বয়সে আর সব ক্রিকেটাররা যখন ব্যাগ গোছাতে শুরু করেন, তখন তুষার ইমরান আবার প্রবল প্রতাপে ফিরে এসেছেন। একের পর এক মৌসুম জুড়ে রান বন্যা বইয়ে দিচ্ছেন। বাংলাদেশের প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটের সব রেকর্ড একটির পর একটি নিজের করে নিচ্ছেন। কৈশোরে যে আলো ছড়াতে পারেননি, শেষ সময়ে এসে সেই আলোতে দেশের ক্রিকেটকে আলোকিত করে ফেলছেন সেই তুষার ইমরান।
তুষারের উঠে আসার গল্পটাও এক লড়াইয়ের এক গল্প। যশোর শহরের খড়কি নামের এলাকায় জন্ম। পারিবারিক সূত্রে তিনটি খেলার সাথে পরিচিত হয়ে গিয়েছিলেন। বাবা ফুটবল খেলতেন; চাইতেন ছেলে ফুটবলার হোক। ভাইয়েরা একজন হকি ও অন্যজন খেলতেন ক্রিকেট। তুষার তিন খেলাতেই মজেছিলেন। স্কুলের চেয়ে এই তিন খেলার মাঠেই বেশি খুঁজে পাওয়া যেত। তবে কীভাবে যেন ক্রিকেটের প্রতি টানটা একটু বেশি হয়ে গেল।
বিকেএসপিতে এসেছিলেন ক্রিকেটে ভর্তি হবেন বলে। কিন্তু ক্রিকেটে সুযোগ হলো না। সুযোগ পেলেন হকিতে। তখন তুষার একটা দোটানার মধ্যে পড়ে গেলেন, হকি নাকি ক্রিকেট? সেই সময় এক নাটকীয় ঘটনা ঘটল। ১৯৯৭ সাল। বিকেএসপি থেকে তুষাররা ফিরছেন ঢাকায়। পথে হঠাৎ তাদের গাড়ি থেমে গেল। সামনে রং নিয়ে খুব খেলা হচ্ছে। তুষাররা গাড়ি থেকে মাথা বের করে জিজ্ঞেস করলেন, কী হয়েছে? কেউ একজন উত্তর দিলো, “বাংলাদেশ আইসিসি চ্যাম্পিয়ন হয়েছে ক্রিকেটে।”
তারপর সারাদিন ধরে দেখলেন লোকেরা আকরাম, পাইলট, রফিকদের নামে কেমন স্লোগান দিচ্ছে। সেই দেখে তুষার ভবিষ্যৎ ঠিক করে ফেললেন। সেই গল্প বলতে বলতে তুষার হাসছিলেন, “আমি ভাবলাম, হকি খেললে কেউ আমার নামে কোনোদিন এভাবে স্লোগান দেবে না। এমন ভালোবাসা পেতে গেলে ক্রিকেটই খেলতে হবে।” ব্যস। যশোরে ফিরে মনে মনে ঠিক করে নিলেন, আর হকি নয়! ক্রিকেটই খেলবেন।
কিন্তু হকি তুষারের পিছু ছাড়ে না। যশোরে একটি টুর্নামেন্ট খেলছিলেন হকির। সেখানে তুষারদের প্রতিপক্ষ দলে ঢাকা আবাহনী থেকে ৭ জন খেলোয়াড় নেওয়া হলো। আর তুষাররা একেবারে আঞ্চলিক খেলোয়াড়ের দল। এই ৭ তারকার বিপক্ষে সেদিন জ্বলে উঠলেন তুষার। সেই খেলা আবার দেখতে গিয়েছিলেন তখনকার ঢাকা আবাহনীর কোচ। তুষারকে একরকম জোর করেই নিয়ে এলেন ঢাকায়। আবাহনীর হয়ে প্রিমিয়ার লিগ খেলতে নেমে গেলেন তুষার ইমরান। ভাগ্য তাকে তখন হকি খেলোয়াড় বানিয়ে ফেলেছিলই প্রায়। কিন্তু তুষার হাল ছাড়তে নারাজ; তাকে ক্রিকেটার হতেই হবে।
হকির ফাঁকে ফাঁকে তাই ঢাকায় খোজ করেন কোনো ক্রিকেট ক্লাবে সুযোগ মেলে কি না। আবাহনী ধানমন্ডিতে; তাই ধানমন্ডি ক্লাবে একদিন ট্রায়ালে দাড়িয়ে পড়লেন ক্রিকেটের জন্য। আর সেখানেই চোখে পড়ে গেলেন জালাল আহমেদ চৌধুরীর। বাংলাদেশের জহুরী এই ক্রিকেট কোচ ও ক্রীড়া বিশ্লেষক লুফে নিলেন তুষারকে। তুষারও হকি ছেড়ে লাফ দিয়ে চলে গেলেন ক্রিকেটে। শুরু হলো তুষারের আসল লড়াই।
এই লড়াইয়ে অবশ্য খুব একটা বেগ পেতে হয়নি তাকে। ধানমন্ডি ক্লাবকে প্রথম বিভাগ থেকে তিনি ও তার বন্ধুরা মিলে চ্যাম্পিয়ন করে তুলে আনেন প্রিমিয়ারে। সেখানে চোখে পড়ে যান বাংলাদেশের। ২০০০-০১ মৌসুমে প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে অভিষেক। প্রথম মৌসুমেই দারুণ এক সেঞ্চুরি হাঁকিয়ে দৃষ্টি কেড়ে ফেলেন নির্বাচকদের। তারপর আর খুব একটা অপেক্ষা করতে হয়নি।
২০০১ সালেই জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ওয়ানডে অভিষেক। পরের বছর টেস্ট অভিষেক এবং সে বছরই ওয়ানডেতে দারুণ শুরু। সবমিলিয়ে তুষার তখন উড়ছিলেন। কিন্তু সেই তুষার হারিয়ে ফেললেন নিজেকে। বলা উচিৎ, বাংলাদেশ হারিয়ে ফেলল তুষারকে।
বলা হয়, তিনি ধারাবাহিক হতে পারেননি। বড় স্কোর করতে পারেননি বলে বছর ছয়েক পর জাতীয় দল থেকে ছিটকেই গেছেন। হ্যাঁ, প্রথম নজরে পরিসংখ্যান দেখলে এটা সত্যি কথা বলে মনে হবে। মনে হবে, আসলেই তুষার পারেননি। ৪১টি ওয়ানডেতে ১৪.৩৫ গড়ে ৫৭৪টি মাত্র রান করেছেন। নিজের শেষ ৩৬টি ম্যাচে কোনো ফিফটি নেই। এই ব্যাটসম্যানের বিপক্ষে অধারাবাহিকতার অভিযোগ বিশ্বাস না করার কোনো কারণ নেই।
কিন্তু ঘটনা কি আসলেই তা-ই? তুষার ৪১টি ওয়ানডে খেলেছেন। ২০০১ সালের ২৩ নভেম্বর তার অভিষেক হয়েছে এবং এখন অবধি শেষ ম্যাচ খেলেছেন ২০০৭ সালের ৩১ ডিসেম্বর। মানে ৬ বছরের একটু বেশি সময়ে তিনি ৪১টি ওয়ানডে খেলেছেন। এবার দেখতে হবে, এই সময়কালে বাংলাদেশ কতোটি ওয়ানডে খেলেছে। ১২২টি। বাংলাদেশ দল ১২২টি ওয়ানডে খেলেছে তুষারের ক্যারিয়ারের সময়কালে। জাতীয় দলের হয়ে ৪১টি ম্যাচ খেলার বিপরীতে বাইরে বসে থাকতে হয়েছে ৮১টি ম্যাচে। মজার ব্যাপার হলো, এই ১২২ ম্যাচের বেশিরভাগ সময়ই তুষার দলের সাথে থেকেছেন। একাদশে স্থান হয়নি তার। অথচ বলা হয়ে থাকে, তুষার নাকি যথেষ্ট সুযোগ পেয়েছেন!
যাদের স্মৃতিশক্তি ভালো, এবং তখনকার খেলাগুলো দেখেছেন তারা তুষারের ‘সুযোগ পাওয়ার’ প্যাটার্নটা একটু মনে করে দেখুন। বিভিন্ন সিরিজে তুষারের ভাগ্যে সাধারণত শেষ ম্যাচটা জুটতো। মানে, তখনকার বাংলাদেশ দল নিয়মিতই সিরিজের এক ম্যাচ হাতে রেখে হেরে বসতো; তখন ওই অর্থহীন ম্যাচ খেলতে নামানো হতো। আবার কখনো সিরিজ নির্ধারণী ম্যাচে নামিয়ে পরের ম্যাচেই আবার নেই। ক্যারিয়ারে কখনোই টানা ১০ ম্যাচ খেলার সুযোগ পাননি তিনি।
তিনি অবশ্য এসব নিয়ে অভিযোগ করেন না। নিজেই বলেন, তিনি পারেননি। তিনি বলেন, সেই সময়ে আসলে নিজের গুরুত্বই বুঝে উঠতে পারেননি, “তখন আমার বয়স খুব কম ছিল। হ্যাঁ, ওয়ানডের জন্য হয়তো ঠিক ছিল। কিন্তু টেস্টের জন্য আমি একেবারেই উপযুক্ত ছিলাম না। আমি তখন অনেক কিছুই বুঝতাম না। ফলে কীভাবে ধারাবাহিক হওয়া যায়, কীভাবে বড় ইনিংস খেলা যায়; সেটা বুঝতে পারিনি। এখন বলতে পারি, আমি সেটা অন্তত বুঝি।”
তুষার এখন উঠে গেছেন অনন্য এক উচ্চতায়। বাংলাদেশের হয়ে প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে একমাত্র ব্যাটসম্যান হিসেবে ১০ হাজার রান করেছেন এবং বাংলাদেশের হয়ে প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে সর্বাধিক সেঞ্চুরি করেছেন। একের পর এক রেকর্ড নিজের করে নিয়েছেন। এখন অপেক্ষায় আছেন আবার আন্তর্জাতিক ক্রিকেটকে কিছু দেওয়ার। নিজের অপেক্ষাটা মোটেও অবাস্তব নয়। তুষার দৃঢ় কণ্ঠে বলেন, “আমার এখন যা বয়স, এটাই সেরা খেলার পারফেক্ট সময়। আমি মনে করি, সুযোগ পেলে আরো অনেক দিন খেলতে পারব। আমাকে যেখানেই বলা হোক, আমি পারফর্ম করতে প্রস্তুত।
তুষার ইমরান, বাংলাদেশও আপনাকে আরেকবার দেখতে প্রস্তুত।
Featured photo: BCB