ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো – সময়ের সেরা দুই খেলোয়াড়ের একজন। সর্বকালের সেরা খেলোয়াড়ের তালিকা করলে তাতেও তার নামটা নিশ্চিতভাবেই প্রথম দিকে থাকবে। ইউরোপের শ্রেষ্ঠ আসরে এই সেরা খেলোয়াড়ের পারফরম্যান্সটাও নিশ্চয়ই ভালো হবার কথা। পরিসংখ্যান এবং পরিসংখ্যানের বাইরে গিয়ে দেখে আসা যাক ইউরোতে ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদোর অর্জন।
ইউরো ২০০৪
গ্রিস, স্পেন আর রাশিয়ার সাথে গ্রুপপর্বে লড়াই হয় স্বাগতিক পর্তুগালের। সেটাই ছিল ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর প্রথম ইউরো। টুর্নামেন্টে সেবার গোল করেছিলেন দুইটি, অ্যাসিস্টও ছিল সমানসংখ্যক।
গ্রিসের বিপক্ষে ২-১ গোলে হারা ম্যাচে পর্তুগালের পক্ষে একটি গোল করেন ৪৬ মিনিটে বদলি হিসেবে মাঠে নামা ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো। ম্যান অফ দ্য ম্যাচ গ্রিসের অধিনায়ক জাগোরাকিস।
রাশিয়ার বিপক্ষে ২-০ গোলে জেতা ম্যাচে একটি অ্যাসিস্ট করেন ৭৮ মিনিটে মাঠে নামা ক্রিস্টিয়ানো। ম্যান অফ দ্য ম্যাচ ম্যানিশ।
স্পেনের বিপক্ষে ১-০ গোলে জেতা ম্যাচে কোনো গোল কিংবা অ্যাসিস্ট নেই। ম্যান অফ দ্য ম্যাচ ডেকো।
কোয়ার্টার ফাইনালে পর্তুগাল মুখোমুখি হয় ইংল্যান্ডের। নির্ধারিত সময়ে ২-২ গোলে ড্র হওয়া ম্যাচটা তারা জেতে টাইব্রেকারে। ম্যাচে কোনো গোল কিংবা অ্যাসিস্ট নেই রোনালদোর, তবে টাইব্রেকারে গোল পান। ম্যান অফ দ্য ম্যাচ রিকার্ডো কারভালহো।
সেমিফাইনালে পর্তুগাল মুখোমুখি হয় শক্তিশালী এবং ঐ আসরের ফেভারিট নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে। ম্যাচটা ২-১ গোলে জিতে নেয় পর্তুগাল, ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো একটি গোল করেন ও একটি গোলে অ্যাসিস্ট করেন। ম্যান অফ দ্য ম্যাচ লুইস ফিগো।
ফাইনালে ফেভারিট হওয়া সত্ত্বেও গ্রিসের কাছে ১-০ গোলে ম্যাচটা হেরে যায় পর্তুগাল।
ইউরো ২০০৮
প্রথমবারের মতো সুপারস্টার হয়ে টুর্নামেন্ট খেলতে আসেন রোনালদো। গ্রুপে ছিল চেক রিপাবলিক, তুরস্ক আর সুইজারল্যান্ড। খুব কঠিন গ্রুপ নয়, ফলে গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হয়েই দ্বিতীয় পর্বে যায় পর্তুগাল। চেক রিপাবলিকের বিপক্ষে ম্যাচটাতে একটি গোলও করেন ক্রিস, ফলত সেই ম্যাচের ম্যান অফ দ্য ম্যাচ নির্বাচিত হন।
দ্বিতীয় পর্বে পর্তুগাল মুখোমুখি হয় জার্মানির। ৩-২ গোলে হেরে যাওয়া ম্যাচটিতে ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো কোনো গোল করতে পারেননি।
ইউরো ২০১২
পর্তুগাল জায়গা পায় গ্রুপ অফ ডেথে। গ্রুপের অন্য সদস্যরা হচ্ছে ডেনমার্ক, নেদারল্যান্ডস এবং জার্মানি।
জার্মানির সাথে প্রথম ম্যাচেই ১-০ গোলে হেরে যায় পর্তুগাল। পরের ম্যাচে গ্রুপের সবচেয়ে সহজ প্রতিপক্ষ ডেনমার্কের সাথে ৩-২ গোলে জেতে পর্তুগাল। ম্যান অফ দ্য ম্যাচ হন পেপে। নেদারল্যান্ডসের সাথে শেষ ম্যাচটা হয়ে যায় খুবই গুরুত্বপূর্ণ, এককথায় ক্রুশিয়াল।
শেষ ম্যাচের আগে সমীকরণ ছিল অনেক। যদি পর্তুগাল নেদারল্যান্ডসের সাথে হারে আর ডেনমার্ক জার্মানির সাথে জেতে, তাহলে অনেক হিসেব উলটে যাবে। এমনকি পর্তুগাল যদি নেদারল্যান্ডসের সাথে বড় ব্যবধানে হারে, তাহলেও পর্তুগালের পরিবর্তে নেদারল্যান্ডস হবে পরের পর্বে জার্মানির সঙ্গী।
ম্যাচের শুরুটা তেমনই ছিল। ১১তম মিনিটেই ভ্যান ডার্টের গোলে এগিয়ে যায় নেদারল্যান্ডস। কিন্তু এরপরই ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো মোটামুটি এক হাতে ম্যাচটা বের করে নেন। ২-১ গোলে জেতা ম্যাচের দু’টি গোলই করেন ক্রিস্টিয়ানো, ম্যান অফ দ্য ম্যাচ হন তিনিই।
কোয়ার্টার ফাইনালে মুখোমুখি হয় চেক রিপাবলিকের। এখানেও ক্রিস্টিয়ানো ম্যাচের একমাত্র গোলটি করে ১-০ গোলে জেতান পর্তুগালকে এবং ম্যান অফ দ্য ম্যাচ নির্বাচিত হন।
সেমিতে পর্তুগাল মুখোমুখি হয় স্পেনের। ফেভারিট স্পেনের সাথে টাইব্রেকারে পর্তুগাল হেরে যায়। সেই স্পেনই পরবর্তীতে ইউরো চ্যাম্পিয়ন হয়।
ইউরো ২০১৬
প্রথমে আইসল্যান্ড বনাম পর্তুগালের খেলায় ক্রিস কোনো গোল পাননি। ম্যাচটা ১-১ গোলে ড্র হয়, নানি ম্যান অফ দ্য ম্যাচ হন।
এর পরের ম্যাচ হয় অষ্ট্রিয়ার বিপক্ষে। এখানে তিনি ভালো খেলা তো দূরে থাক, উলটো একটা পেনাল্টি মিস করে দলকে বিপদে ফেলে দেন। গোলশূন্য ড্র হয় ম্যাচটি। হাঙ্গেরির বিপক্ষে শেষ ম্যাচটা তাই হয়ে যায় বাঁচা-মরার ম্যাচ।
জিততেই হবে, এমন ম্যাচগুলোর অর্থই যেন ম্যাচ শুরুর আগেই এক গোলে পিছিয়ে থাকা। এই ধরনের ম্যাচগুলোতে অনেক বড় দলও তুলনামূলক ছোট দলের কাছে হোঁচট খেয়েছে। ২০০২ বিশ্বকাপের কথা মনে আছে? ডেনমার্কের বিরুদ্ধে জিততেই হবে, এমন সম্ভাব্যতায় খেলতে নেমে তার আগের বিশ্বকাপজয়ী দল ফ্রান্স হারে ২-০ গোলে। একই বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনাও গ্রুপের শেষে গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচে সুইডেনের সাথে ১-১ গোলে ড্র করে টুর্নামেন্টের প্রথম রাউন্ড থেকে ছিটকে পড়ে।
হাঙ্গেরির সাথে পর্তুগালের ম্যাচটা হয়ে যায় তাই নকআউটের মতো। ম্যাচ শুরুর আগে পর্তুগাল মানসিকভাবে খানিকটা পিছিয়ে থেকেই খেলা শুরু করে। এরপর ম্যাচের ১৯ মিনিটেই গোল খেয়ে আরো পিছিয়ে পড়ে। ৪২ মিনিটে নানি গোল দিয়ে সমতা আনার পর ৪৭ মিনিটে আবার গোল হজম করে পর্তুগাল। এরপর রোনালদোর গোলে ৫০ মিনিটে সমতায় ফেরে পর্তুগাল। কিন্তু ৫৫ মিনিটে আবার পিছিয়ে পড়ার পর ৬২ মিনিটে সেই রোনালদোর গোলেই সমতা ফেরায় পর্তুগাল। ম্যাচটি ৩-৩ সমতায় শেষ হয়।
গোটা গ্রুপপর্বেই কোনো জয় না নিয়েই দ্বিতীয় পর্বে ওঠে পর্তুগাল। এবার ক্রোয়েশিয়ার বিপক্ষে রোনালদোর অ্যাসিস্টেই অতিরিক্ত সময়ে ম্যাচের একমাত্র গোল করেন কোয়ারেজমা।
কোয়ার্টার ফাইনালে পোল্যান্ডের সাথে ১-১ গোলে ড্র হওয়া ম্যাচে কোনো গোল করতে পারেননি রোনালদো, তবে টাইব্রেকারের প্রথম গোলটি তিনিই করেন। তবু ধরে নেওয়া যাক, এই ম্যাচেও তার অবদান তেমন নেই।
সেমিফাইনালে ওয়েলসের সাথে ২-০ গোলে জেতা ম্যাচে একটি গোল করেন, আরেকটা অ্যাসিস্ট করেন। তার ম্যাজিকেই গ্যারেথ বেলের ওয়েলসের স্বপ্নযাত্রা থামে সেমিতেই।
ফাইনালের আগে পর্যন্ত পর্তুগাল গোল করেছে ৮টি। এর মধ্যে রন নিজে করেছেন ৩টি, যার দু’টি দল পিছিয়ে যাওয়ার পর, আর একটি সেমিফাইনালে। সাথে অ্যাসিস্ট ছিল ৩টি। ফাইনালে রোনালদো খেলতে পারেননি খুব বেশিক্ষণ, ইনজুরির কারণে উঠে যেতে বাধ্য হন মাঝপথেই। তবে সাইডলাইন থেকে অনুপ্রেরণা দিয়ে গেছেন প্রতিনিয়ত, দলের প্রতি নিবেদনটা ছিল চোখে লাগার মতো। দলও তাকে প্রতিদান দিয়েছে দারুণভাবে, এডারের গোলে প্রথমবারের মতো ইউরো-সেরার শিরোপা ওঠে রোনালদোর হাতেই।
পরিসংখ্যানের বাইরের কিছু কথা
পরিসংখ্যানের বাইরেও কিছু কথা থাকে। ম্যাচ-পূর্ববর্তী পরিস্থিতি কিংবা প্রতিপক্ষের উপরও পারফরম্যান্স নির্ভর করে অনেকাংশেই। দুই গোলে এগিয়ে থাকার পর গোল করা আর ২ গোলে পিছিয়ে থাকার পর গোল করে ফিরে আসার মাঝে পার্থক্য অনেক। পরিসংখ্যান যে বিষয়গুলো তুলে আনতে পারেনি, সেগুলোর দিকেও তাই একটু দৃষ্টি দেওয়া যাক।
ইউরো ২০০৪ টুর্নামেন্টে সেই সময়ের পর্তুগাল যথেষ্ট শক্তিশালী দল ছিলেন। সবচেয়ে বড় কথা, ঘরের মাঠে হওয়া সেই টুর্নামেন্টে পর্তুগাল ফেভারিটও ছিল। এমনকি ফাইনালেও গ্রিসের চেয়ে তুলনামূলক ভালো খেলেই তারা দুর্ভাগ্যজনকভাবে হেরেছে। ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো দলের মূল খেলোয়াড় হিসেবে খেলেননি, দলের একটা অংশ হয়ে খেলেছিলেন। তবুও আনকোড়া খেলোয়াড় হিসেবে যথেষ্ট ভালো খেলেছিলেন, সেরা তরুণ খেলোয়াড়ের পুরষ্কারও পেয়েছিলেন। পুরো টুর্নামেন্টে এবং গুরুত্বপূর্ণ কিছু ম্যাচেও রোনালদোর পারফরম্যান্স ছিল দেখার মতো।
ইউরো ২০০৮ আসরে পর্তুগালের গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হয়ে পরের পর্বে ওঠার জন্য ক্রিস্টিয়ানোর ভূমিকা আহামরি কিছু ছিল না। দ্বিতীয় পর্বে জার্মানি কঠিন প্রতিপক্ষ ছিল, তিনি পারেননি সেই ম্যাচটা বাঁচিয়ে ‘স্পেশাল’ হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে। তবে এটাও মনে রাখতে হবে, পরের পর্বে ওঠার জন্য সতীর্থদের যথেষ্ট সাহায্যও তিনি পাননি। মাথায় রাখতে হবে এটাও, জার্মানি ছিল আগুনে ফর্মে। সেই টুর্নামেন্টে তারা ফাইনাল খেলেছে এবং রানার্সআপ হয়েছিল।
২০১২ ইউরোতে গ্রুপ অফ ডেথ থেকে পরের পর্বে উঠার জন্য ক্রিসের অবদান ছিল অনস্বীকার্য। যে পর্তুগালের গ্রুপপর্বেই বাদ পড়ার কথা ছিল, সেই পর্তুগালকে পরের পর্ব পর্যন্ত এনেছেন তিনিই। কোয়ার্টার ফাইনালের ম্যাচেও ম্যান অফ দ্য ম্যাচ হয়েছেন। সেমিফাইনালে স্পেনের বিপক্ষে ম্যাচটা পর্তুগালের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ছিল। ম্যাচটা টাইব্রেকারে হারে পর্তুগাল। স্পেন সেই ইউরোতে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল।
২০১৬ ইউরোতে পর্তুগালের পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে চলে গিয়েছিল যে রোনালদো না থাকলে পর্তুগাল গ্রুপপর্বই পার হতে পারতো না। সেমিফাইনালেও দুরন্ত ওয়েলসের বিপক্ষে ১ গোল আর ১ অ্যাসিস্ট করে পর্তুগালকে জেতানো ম্যাচে ম্যান অফ দ্য ম্যাচ রোনালদো। ফাইনালে অবশ্য ইনজুরির জন্য মাঠে থাকতে পারেননি।
শেষ কথা
পরিসংখ্যান কখনোই একটা বিষয়কে পুরোপুরিভাবে তুলে ধরতে পারে না। পরিসংখ্যান আপনাকে বলবে, ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো চারবার ইউরো খেলে একবার চ্যাম্পিয়ন আর একবার রানার্সআপ দলে ছিলেন। কিন্তু পরিসংখ্যান আপনাকে এটা বলবে না, রোনালদো আসার আগের ১১টি আসরের মাঝে পর্তুগাল মূল পর্বে খেলতে পেরেছে মাত্র তিনটি আসরে। রোনালদো আসার পরের প্রতিটি আসরেই পর্তুগাল মূল আসরে খেলা নিশ্চিত করেছে, এমনকি খেলেছে ফেভারিট হিসেবেই। এর আগে কখনোই ফাইনালে খেলতে না পারা পর্তুগাল একবার চ্যাম্পিয়ন আর একবার রানার্সআপ হয়েছে এই ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর আমলেই। এমনকি যে দুইবার ফাইনাল খেলেছে, সেই দুইবারও সেমিফাইনালে পর্তুগালের করা চারটি গোলের মাঝে তিনটি সরাসরি গোল করেছেন, আর একটিতে সহায়তা করেছেন তিনি। যে দুইবার ফাইনাল খেলতে পারেননি, সেই দুইবারও যাদের কাছে হেরেছে পর্তুগাল, তারাই ফাইনাল খেলেছে।
এবারের আসরটাই সম্ভবত ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর শেষ ইউরো আসর। আরেকটা গোল করতে পারলেই এককভাবে ইউরোর সর্বকালের সেরা গোলদাতা হয়ে যাবেন, এমন সম্ভাবনা নিয়েই এসেছিলেন ইউরোতে। শুরুটা করেছেন দুর্দান্ত; প্রথম ম্যাচেই হাঙ্গেরির বিপক্ষে জোড়া গোল করে আরেকবার জানিয়ে রেখেছেন নিজের সামর্থ্য। তবে ব্যক্তিগত অর্জনের চেয়েও বেশি এবার হয়তো দলগত অর্জনের দিকেই মূল নজর থাকবে তার। ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়ন হিসেবে খেলতে আসা পর্তুগালকে নিয়ে আরেকটাবার কাপ উঁচিয়ে ধরার প্রত্যাশাটা পূরণ করতে পারবেন কি না, সেটা আপাতত সময়ের হাতেই ছেড়ে দেওয়া যাক!