‘ধারাবাহিকতা’ শব্দটি কোনোকালেই তাঁর ক্যারিয়ারের সমার্থক ছিল না। ক্রিকেটের জনপ্রিয় ওয়েবসাইট ইএসপিএন ক্রিকইনফো তাঁর প্রোফাইল বর্ণনা শুরু করছে তাই এভাবে,
‘When all is well with Yuvraj Singh, he hits the ball as clean and long as it has ever been hit. When all is not well, he looks so awkward you forget he can hit the ball clean and long.’
ক্যারিয়ারজুড়ে তাঁর চরম অধারাবাহিকতার প্রমাণ পাওয়া যায় নিজের স্বপ্নের মতো সময়টাতেও। ২০১১ বিশ্বকাপের ঠিক আগে আগে পড়েছিলেন চরম বাজে ফর্মে। এতটাই যে, তাঁর বিশ্বকাপ স্বপ্নই পড়ে গিয়েছিল শঙ্কায়। অধিনায়ক মহেন্দ্র সিং ধোনির জোরাজুরিতে বিশ্বকাপ দলে টিকে গিয়ে পড়েছিলেন নিজেকে প্রমাণ করার চ্যালেঞ্জের সামনে। সে বিশ্বকাপে প্রায় ৯০ গড়ে ৩১৩ রান, সাথে কার্যকরী লেফট আর্ম অর্থোডক্স স্পিনে ১৫ উইকেট। ভারতকে একা হাতে বিশ্বকাপ জিতিয়েছিলেন বললেও কি বাড়িয়ে বলা হবে?
তারপর? পরের গল্পটা পরের জন্যই তোলা থাকুক, তার পূর্বেকার গল্পগুলো পড়ে আসা যাক।
১.
জন্মেছিলেন চন্ডিগড়ের এক শিখ পরিবারে, ১৯৮১ সালে। ভারতীয় ক্রিকেটের খোঁজ রাখা মানুষটি মাত্রই জানেন, তাঁর বাবা যোগরাজ সিংও ছিলেন একজন ক্রিকেটার, ভারতের হয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ম্যাচে প্রতিনিধিত্ব করার স্বপ্ন ভেঙে গিয়েছিল মাত্র সপ্তম ম্যাচেই। নিজের অপূর্ণ স্বপ্নপূরণের ভার তাই চাপিয়ে দিয়েছিলেন উত্তর প্রজন্মে, ছেলে যুবরাজের উপর। ছেলেকে ক্রিকেটার বানাতে এতটাই উঠেপড়ে লেগেছিলেন যোগরাজ সিং, জানা যায় একবার অনূর্ধ্ব-১৪ জাতীয় রোলার স্কেটিং চ্যাম্পিয়নশিপে পদক জিতে আনলেও নাকি যোগরাজ সিং সে পদক ঘরে উঠতে দেননি। পদক বাইরে ছুঁড়ে ফেলে যোগরাজ সিং বলেছিলেন,
‘আজ থেকে আমরা ক্রিকেট খেলবো, হুম?’
এমন ছোড়াছুঁড়ির ঘটনা অবশ্য নিয়মিতই ছিল যুবরাজ সিং আর যোগরাজ সিংয়ের মাঝে। যুবরাজ সিংয়ের আত্মজীবনী হতে জানা যায়, একবার তাঁর বাবা নাকি তার দিকে দুধভর্তি গ্লাসও ছুঁড়ে মেরেছিলেন। কারণ? স্কুল ক্রিকেটে সে ম্যাচে রান করতে পারেননি তিনি।
তবে বাবার এমন আচরণকে নিজের মাঝে যে ঠাঁই দেননি, তা বোঝা যায় ক্রিকেটে তাঁর তরতরিয়ে এগিয়ে যাওয়া দেখে। ১৯৯৫-৯৬ মৌসুমে যেবার পাঞ্জাবের অনূর্ধ্ব-১৬ দলে ডাক পেলেন, তখন তার বয়স সবে চৌদ্দ পেরিয়েছে। অনূর্ধ্ব-১৬ দলে খেলেছিলেন কেবল এক মৌসুম, পরের মৌসুমেই তিনি প্রমোশন পেয়ে সোজা অনূর্ধ্ব-১৯ দলে। পাঞ্জাবের রঞ্জি দলও যেন তার অপেক্ষাতেই ছিল, ১৭ বছর বয়সেই তিনি ফার্স্ট ক্লাস খেলা ক্রিকেটার।
২.
রঞ্জি ট্রফিতে অভিষেক ইনিংসে অবশ্য রান করতে পারেননি, আউট হয়েছিলেন শূন্য রানে। তবে রাঙিয়ে দিয়েছিলেন শেষটা।
১৯৯৯ সালের কুচবিহার ট্রফির ফাইনালে মুখোমুখি হয়েছিল বিহার আর পাঞ্জাব। প্রথমে ব্যাট করে বিহার তুলেছিল ৩৫৭ রান। জবাবে পাঞ্জাব কত করেছিল সেটা এখানে উহ্যই থাকুক, তিনে ব্যাট করতে নেমে যুবরাজ সিং একাই করেছিলেন ৩৫৮। ‘বড় মঞ্চের প্লেয়ার’, তার এমন নিয়তি যেন লেখা হয়ে গিয়েছিল জামশেদপুরের সে মাঠেই।
এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি খুব বেশি। রঞ্জি ট্রফিতে প্রথম মৌসুমে ব্যর্থ হলেও সফল হয়েছিলেন দ্বিতীয় মৌসুমে, ১৪৯ রানের ইনিংসও খেলেছিলেন হরিয়ানার বিপক্ষে। মাঝে ক্রিকেটটা তিনি কীভাবে খেলেন, সেটা জানিয়েছিলেন শ্রীলঙ্কা অনূর্ধ্ব-১৯ দলের বিরুদ্ধে ৫৫ বলে ৮৯ রানের বিধ্বংসী ইনিংসে। অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপ দলে জায়গা পাওয়া তাই নিশ্চিতই ছিল। মোহাম্মদ কাইফের নেতৃত্বে সেবার ভারত শিরোপা জিতেছিল, আর যুবরাজ সিং ‘ম্যান অব দ্যা টুর্নামেন্ট’ হয়েছিলেন।
পরের গন্তব্য? ভারত জাতীয় দল!
৩.
বয়সভিত্তিক দলের সাফল্য বড় মঞ্চে কতটা অনুদিত করতে পারেন, তাঁর সামনে তখন সেটাই প্রশ্ন। প্রশ্নের উত্তর দিতে সময় নিয়েছিলেন মোটে দুই ম্যাচ, প্রতিপক্ষ হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন অস্ট্রেলিয়ার বোলারদের।
২০০০ সালে আইসিসি নকআউট বিশ্বকাপের প্রথম ম্যাচে কেনিয়ার বিপক্ষে ব্যাটিং করবার সুযোগ পাননি, এক হিসেবে তাই অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ম্যাচটি ছিল তার অভিষেক ম্যাচ। প্রতিপক্ষ দলে গ্লেন ম্যাকগ্রা-লি ভ্রাতৃদ্বয়। তাদের সামনে ৮০ বলে রান করেছিলেন ৮৪, ম্যাচটি ভারত জিতেছিল ২০ রানে। এই ইনিংসে নিজের সামর্থ্যের জানান তো দিয়েছিলেন বটেই, তার সামনে প্রতিপক্ষ বোলারদের সাধ্যসামর্থ্যই তখন প্রশ্নের মুখোমুখি হয়েছিল। পরিসংখ্যান জানাচ্ছে, তাঁর অভিষেক ইনিংসের ৮৪ রান ভারতের হয়ে তৎকালীন সর্বোচ্চ। ইএসপিএন ক্রিকইনফো ঘোষণা দেয়, “ভারতীয় ক্রিকেটের যুবরাজ নন, হবু রাজা তিনি!”
পরের ম্যাচে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ৪১ রান আর নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ১৯ রানে ধরে রেখেছিলেন নিজের আগ্রাসী ব্যাটিংয়ের পরিচয়। আর যুবরাজ সিং ভালো খেললে কী হয়? খুব সহজ, ভারত সে আসরে চ্যাম্পিয়ন হয়!
৪.
এমন উড়ন্ত সূচনার পরও সে বছর তাঁর ব্যাটিং গড় ২১.৬৭ । তাঁর গোটা ক্যারিয়ারের চিত্রনাট্য যেন লেখা হয়ে যায় ওই বছরই। শ্রীলংকার বিরুদ্ধে অপরাজিত ৯৮ রানের ইনিংস খেললেও, তাই বাজে ফর্মের দরুন দল থেকে বাদ পড়াটাই ছিল নিয়তি। আইসিসি নকআউট বিশ্বকাপে অমন দারুণ কিছু মুহূর্ত উপহার দেবার পর যখন দলে জায়গা পাকা করবার কথা, পরের সিরিজগুলোয় বাজে খেলে তাকে নামতে হলো দলে জায়গা ফিরে পাবার সংগ্রামে।
অবশেষে ফিরেছিলেন জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে, ফিরেই জোড়া ফিফটি। এবারও যখন সাংবাদিকেরা লিখতে বসলেন, ‘যুবরাজ ফিরলেন রাজার মতোই’, তিনি বললেন, ‘রোসো বাছা।‘ ভারতের পরবর্তী প্রতিপক্ষ ছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজ, সে সিরিজে যুবরাজের গড় ছিল ৫.৫০।
সে ম্যাচ নিয়ে ভাববার অবকাশ খুব বেশি ছিল না। তার পরপরই যে এসে হাজির ২০০২ সালের গ্রীষ্মের সেই লর্ডস। ভারত-ইংল্যান্ড ম্যাচ না বলে ‘দাদার দাদাগিরির ম্যাচ’’ বললেই যে ম্যাচ আরও বেশি পরিচিত ঠেকে। ভারতের ৩২৬ রান তাড়া করার সে ম্যাচে যুবরাজ সিং খেলেছিলেন ৬৯ রানের ইনিংস, ভারত জিতেছিল ন্যাটওয়েস্ট সিরিজের শিরোপা। ২০০২ সালের ন্যাটওয়েস্ট সিরিজের প্রথম ম্যাচে অপরাজিত ৬৪ রানের ইনিংস খেলেও যা হয়নি, এ ম্যাচে অবশ্য তা হলো। দলে যুবরাজ সিংয়ের অন্তর্ভুক্তি নিয়ে সমস্ত প্রশ্নই উবে গেলো।
৫.
তার ক্যারিয়ারের মতোই ভালো-মন্দ মিলিয়ে কেটেছিল ২০০৩ সালের বিশ্বকাপ। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে এনে দিয়েছিলেন জয়, কেনিয়ার বিরুদ্ধে করেছিলেন অর্ধশতক। ততদিনে যা করেননি, সেই শতকের দেখাও পেয়ে গেলেন সে বছরের এপ্রিলে বাংলাদেশের বিপক্ষে, ঢাকারই বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে। অভিষেকের পর ততদিনে খেলে ফেলেছেন ৭১টি আন্তর্জাতিক ম্যাচ।
এই পারফরম্যান্সের পুরস্কারই যেন পেয়েছিলেন টেস্ট দলে ডাক পেয়ে। তার মতো স্ট্রোকপ্লেয়ারের ক্রিকেটের অভিজাত ফরম্যাটটা ঠিক মনে ধরবার কথা নয়। পরিসংখ্যানের দিকে তাকালে দেখা যাচ্ছে, যদিও বা তার মনে ধরে, কিন্তু ব্যাটে ধরেনি। তাই ২০০৩ সালের শেষভাগে অভিষেক হবার পরও ২০১২ অব্দি টেস্ট খেলেছিলেন মোটে ৪০টি, এ সময়কালে ভারতের খেলা টেস্টের মাত্র ৩৮.৮৩ শতাংশ। গড়টাও বড্ড সাদামাটা, মাত্র ৩৩.৯৩ , সেঞ্চুরি ৩টি।
৬.
তবে জাদু দেখানোর জন্য একদিনের আন্তর্জাতিক ক্রিকেট তো ছিল। তা তিনি দেখিয়েছিলেনও, অন্ততপক্ষে ২২ জানুয়ারি, ২০০৪ সালে সিডনি ক্রিকেট গ্রাউন্ডে উপস্থিত দর্শকেরা এ কথাই বলবেন। সেঞ্চুরিটা এসেছিল ব্যাটের কানায় লেগে, আর বাকি সময়টায় একের পর এক সুইপ-পুল-ড্রাইভে লি-গিলেস্পি-সাইমন্ডসদের ব্যতিব্যস্ত করে তুলে নিয়েছিলেন ১৩৯ রান, বল খেলেছিলেন ১২২টি। রানের চেয়ে রান করার ধরণের কারণে এসেছিলেন আলোচনায়, এতটা আয়েশী ভঙ্গিমায় চার-ছক্কার মার যে বিস্ময় জাগায়!
এরপর আবারও শীতনিদ্রা, আবারও কিছু হাফ সেঞ্চুরি, আবারও কিছু ব্যর্থতা। তবে এত কিছুর মাঝে ধ্রুব সত্য, তার ছোঁয়ায় ভারত ওয়ানডে দলের বদলে যাওয়া।
মহেন্দ্র সিং ধোনির ওয়ানডে অভিষেক ২০০৪ সালে। প্রায় সমবয়সী ধোনি আর যুবরাজ মিলে ভারতের একদিনের ক্রিকেট দলকে এনে দেন আধুনিক ক্রিকেটের তরিকা, ক্রিকেট তাদের কারণে হয়ে যায় রান-বলের পাল্লা দেবার খেলা। দু’জনের আক্রমণাত্মক ক্রিকেটে ভারত খুঁজে পায় জয়ের দিশা। এক পরিসংখ্যান জানাচ্ছে, এ দু’জনের কারণে ভারত রান তাড়া করে একটানা সবচেয়ে বেশি ম্যাচ জিততে সক্ষম হয়েছিল। দু’জনে একত্রে ব্যাট করেছেন ৬৪বার, এর মাঝে ৪০বারই জয়ী দল ছিল ভারত। সেই ৪০ ম্যাচে তারা জুটি বেঁধে রান তুলেছিলেন ২০৮০, গড় ৬৩.০৩। বরাবরই অধারাবাহিক যুবরাজও তখন খুঁজে পান কিছুটা ধারাবাহিকতা। তার ওয়ানডে ক্যারিয়ারের দিকে তাকালেও সে সাক্ষ্যই পাওয়া যায়, ২০০৫-০৭ সালের মাঝে ৪৫ ছুঁইছুঁই গড়ে রান তুলেছিলেন ২,৯৭৫।
অন্য আরেক পরিসংখ্যানের আশ্রয় নিয়ে জানা যায়, যুবরাজের ক্যারিয়ারের প্রথম ১৪ হাফ সেঞ্চুরির ১৩টিতেই জয়ী দলের নাম ছিল ভারত। ভারতীয় ক্রিকেট দল বদলে যাওয়ার কারিগর হিসেবে যুবরাজকে তাই দাঁড় করানোই যায়।
৮.
২০০৭ ওয়ানডে বিশ্বকাপ ভারতের জন্যে ছিল রীতিমতো এক বিভীষিকা। বাংলাদেশ আর শ্রীলংকার বিপক্ষে হেরে গ্রুপপর্বেই বিদায়। ফলাফল: কোচের বিদায়, অন্তর্দ্বন্দ্ব, অধিনায়কত্বের পালাবদল, সব মিলিয়ে যেন ভারতের ক্রিকেটে জ্বলছিল ক্ষোভের অনল। তবে সে আগুনে পানি ঢালতেই যেন এসেছিল ক্রিকেটের তৎকালীন ক্ষুদ্রতম সংস্করণ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ। প্রথমে ‘খেলব না, খেলব না’ গোঁ ধরা ভারতই যে আসরে চ্যাম্পিয়ন।
যে আকাঙ্ক্ষায় টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের শুরু, সে আসরে এর সবই ছিল। ভারত-পাকিস্তানের দু’টি নখ কামড়ানো উত্তেজনাকর ম্যাচ, চার-ছক্কার মার, স্ট্রোকপ্লে, দর্শক, অর্থের ঝনঝনানি, ক্রিকেটের দারুণ এক বিজ্ঞাপনই যেন। তবে এর মাঝেও যদি ব্যক্তিগত কীর্তি খুঁজে নিতে হয়, তখন আর যুবরাজ সিং ছাড়া ভরসা কী!
সেমিফাইনালে প্রিয় প্রতিপক্ষ অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ৩০ বলে ৭০ রানের ইনিংস খেলেছিলেন, ভারতও উঠেছিল ফাইনালে। অনেকের চোখে, তার ক্যারিয়ারের অন্যতম সেরা হয়ে থাকবে এই ইনিংস। কিংসমিডে যে সেদিন বিধ্বংসী যুবরাজের দেখা মিলেছিল।
তবে প্রসঙ্গ যখন বিধ্বংসী ব্যাটিং, তখন নজর দিতে হচ্ছে এর দিন তিনেক আগের ম্যাচে। ছয় ছক্কার ওভার , ১২ বলে ফিফটি, ৩৬২ স্ট্রাইকরেটের ইনিংস তো যুবরাজের ক্যারিয়ার হাইলাইটই হয়ে থাকবে। আহা, স্টুয়ার্ট ব্রড বেচারাকে কি বেদম মারটাই না দিয়েছিলেন সেদিন!
৯.
মাঝে ২০০৭ সালে সহ-অধিনায়কত্বও পেয়েছিলেন কিছুদিন। কিন্তু গোটা ক্যারিয়ারের সঙ্গী অধারাবাহিক ফর্মের দরুন তা হারিয়েও ফেলেছিলেন দ্রুতই।
নিজ দেশে অনুষ্ঠিত ২০১১ বিশ্বকাপের আগে পড়েছিলেন চূড়ান্ত বাজে ফর্মে। ২০১০ সালে খেলা ১৪ ইনিংসে ফিফটি মোটে ২টি, সে পঞ্চাশও যে ঠিক ‘যুবরাজসুলভ’ পঞ্চাশ ছিল না, ৬৬.৬৭ স্ট্রাইকরেটই সে সাক্ষ্য দেবে। সব মিলে বিশ্বকাপে যাওয়াই ছিল অনিশ্চিত, দুয়ারে যে দাঁড়িয়ে রোহিত শর্মার মতো তরুণেরা।
তবে ঢাল হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন মহেন্দ্র সিং ধোনি। তার অনুরোধেই নির্বাচকেরা যুবরাজকে জায়গা দিয়েছিলেন বিশ্বকাপগামী দলে। ভাগ্যিস, দিয়েছিলেন! বিশ্বকাপে খেলা ৭ ম্যাচে ৩১৩ রান, সাথে কার্যকরী অফ স্পিনে ১৫ উইকেট, বিশ্বকাপে এমন অলরাউন্ড কৃতিত্ব ছিল না আর কারও। অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপে ম্যান অব দ্য টুর্নামেন্ট হওয়ার পর সিনিয়রদের বিশ্বকাপেও টুর্নামেন্টসেরা, এ কীর্তিই বা আর কার আছে!
এ কীর্তি আরও মাহাত্ম্য পায়, যখন জানা যায়, এই পুরো বিশ্বকাপটাই তিনি খেলেছিলেন ক্যান্সারকে সঙ্গী করে।
১০.
অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে কোয়ার্টার ফাইনাল ম্যাচে ব্রেট লি’র বিপক্ষে চার মেরে তার বুনো উল্লাসের ছবি তো ভারতীয় ক্রিকেটেরই গৌরবগাঁথার অংশ হয়ে গিয়েছে। তবে কিছুদিন পরই জানা যায়, এ কেবল জয়োল্লাস ছিল না, পেছনে লুকিয়ে ছিল মুক্তভাবে শ্বাস নেবার আকুতিও। জনপ্রিয় ক্রীড়া বিশেষজ্ঞ হার্শা ভোগলে তার কলামে বলছেন, যুবরাজ সে সময়ে হার্ট অ্যাটাকে মারাও যেতে পারতেন, এবং কেউ জানতোও না যে তিনি ক্যান্সার আক্রান্ত ছিলেন। তিনি তখন শ্বাসকষ্টে ভুগছিলেন, তার ভেতরে বেড়ে ওঠা ১৫ × ১১ × ১৩ সেন্টিমিটারের এক টিউমারের সঙ্গে বাস করছিলেন।
বিশ্বকাপের পরপরই তাঁর ক্যান্সার ধরা পড়ে। তাকে অবশ্য একদিক থেকে সৌভাগ্যবানই বলতে হবে, তার ক্যান্সার যে লেভেল-১ মাত্রার ছিল। বেশ কয়েক মাসের চেষ্টায় তার ক্যান্সার নিয়ন্ত্রণে আনা হয়, মাথার চুল পড়ে যায়, এবং ক্যান্সার থেকে ফিরে তিনি ঘোষণা দেন,
‘মাঠের ক্রিকেটে ফিরতে চাই, আবারও!’
তিনি কথা রেখেছিলেন, আবারও ফিরেছিলেন সবুজ গালিচায়। ফিরে পাকিস্তানের বিপক্ষে ৭২ রানের ইনিংসে, কিংবা রাজকোটে অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে ৩৫ বলে ৭৭ রানের ইনিংসে নিজের ঝলকও দেখিয়েছিলেন। তবে সেটা সাময়িক। ক্যান্সার যেন কেড়ে নিয়েছিল সেই চিরপরিচিত যুবরাজকে। ২০১৪ সালের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ফাইনালে তাঁর ধীরগতির ব্যাটিংকেই তো ভারতের হারের কারণ হিসেবে দাঁড় করান অনেকে। যুবরাজ নিজেই তখন বলেছিলেন,
‘আমি বোধহয় শতভাগ তৈরি নই।’
নিজেকে তৈরি করে, ঘরোয়া ক্রিকেটে ফর্ম দেখিয়ে আবার ফিরেছিলেন ২০১৭ সালের গোড়ার দিকে। বছরের শুরুতেই ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ১৫০ রানের ইনিংস খেলে যেন বোঝাতে চাইলেন, ‘ফিরেছি!’
ওই পর্যন্তই। দলে জায়গা হারিয়েছিলেন অনেক দিন ধরেই, এই ভারত দলে যে অনেক যুবরাজের ভিড়। সবাই যে রান আর বলে পাল্লা দিতে জানেন! ক্যারিয়ারজুড়েই চলা ফর্মের লুকোচুরি, সাথে বেড়ে চলা বয়সের কারণে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটকে যেকোনো সময় বিদায় জানানো তাই নিয়তিই ছিল।
অবশেষে থামলেন তিনি, ২০১৯ সালের ১০ জুন। কি আশ্চর্য দেখুন, ওই বিশ্বকাপের সিজনেই! বিশ্বকাপের সঙ্গে যুবরাজের সম্পর্ক যে ‘বেটার লাভ স্টোরি দ্যান টোয়ালাইট’, এ তো সকলেরই জানা।