চট্টগ্রামের জহুর আহমেদ চৌধুরি স্টেডিয়ামে সোমবার চলছিল বাংলাদেশ বনাম ইংল্যান্ডের তৃতীয় ওয়ানডে। সিরিজ আগেই হেরে বসেছিল টাইগাররা, ভেঙেছিল ঘরের মাঠে টানা সাত সিরিজ জয়ের রেকর্ড।
সেই ডেড রাবার ম্যাচও অবশ্য আলো করেছেন সাকিব আল হাসান। ৭৫ রান ও চার উইকেট নিয়ে বাংলাদেশের সর্বকালের সেরা ক্রিকেটার নিশ্চিত করেছেন, খালি হাতে ফিরতে হয়নি বাংলাদেশকে।
তবে চট্টগ্রামে বিস্ময় হয়ে থাকল অন্য কিছু। শুরু থেকেই দেখা গেল, জহুর আহমেদ চৌধুরি স্টেডিয়ামের গ্যালারি খাঁ-খাঁ করছে, শেষ পর্যন্ত মোস্তাফিজুর রহমান যখন ম্যাচের ইতি টানলেন, তখনও মাঠে হাজার পাঁচেকের বেশি দর্শক নেই।
অথচ, এই দৃশ্য দেখা যায়নি আগে কখনও। ঢাকার বাইরে বাংলাদেশের খেলা হলে সাধারণত গ্যালারি থাকে টইটম্বুর, টিকেটের জন্য হাহাকার। তবে এবার হয়নি তেমনটি, ছিল না টিকেটের লম্বা লাইন, কিংবা মাঠভর্তি দর্শক। সর্বশেষ বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগের চট্টগ্রাম পর্বেও দেখা যায়নি দর্শকের উন্মাদনা, সেই ধারাই বজায় থাকল ইংল্যান্ড সিরিজেও।
তবে কেন এরকম হলো চট্টগ্রামে? সে উত্তরই খোঁজার চেষ্টা করেছে রোর বাংলা।
ভরদুপুরে খেলা, নেই প্রচারণা
বাংলাদেশ বনাম ইংল্যান্ড সিরিজের প্রতিটি ম্যাচই শুরু হয়েছে দুপুর ১২টায়। মার্চের রোদের প্রভাব তাই পড়েছে দর্শক সমাগমে, ঢাকায় হওয়া প্রথম দুই ম্যাচেও প্রথম ইনিংসে শের-এ-বাংলার গ্যালারি প্রায় খালিই ছিল, তবে ভরতে শুরু করে বিকেল থেকে।
চট্টগ্রামে আর সেটি হয়নি, শুরুতে কাকপক্ষীশূন্য মাঠে পরে কেবল যোগ হয়েছে অল্প কিছু মানুষ।
চট্টগ্রামের বাসিন্দা আদনান জাহিদ রোর বাংলাকে বলেন, ১২টায় খেলা শুরুর কারণে অনেক দর্শকই মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন এই ম্যাচ থেকে।
“কোনো রকম উত্তেজনা চোখে পড়েনি (এই ম্যাচ নিয়ে)। এই ম্যাচের সবচেয়ে অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে এর সময়টা। কর্মদিবসের ১২টায় খেলা, এ সময়ে সাধারণত মানুষ কাজে ব্যস্ত থাকে। খেলা দুইটা বা তিনটায় শুরু হলে তারা সেকেন্ড ইনিংস দেখতে যেত। এই খেলার সময়টাও মানুষকে আগ্রহী করতে পারেনি। কারণ অন্য সময় আফগানিস্তান কিংবা জিম্বাবুয়ে সিরিজেও অনেক ভালো দর্শক হয়েছে চট্টগ্রামে।”
সঙ্গে যোগ করেন, প্রচারণার অভাব চোখে পড়েছে তার,
“চট্টগ্রামে যে ইংল্যান্ড এসেছে, ওদের এত বড় বড় তারকারা এসেছে, এ নিয়ে বিন্দুমাত্র প্রচারণা আমরা দেখিনি। স্টেডিয়ামটি শহরের একদম শুরুতে, মূল শহরে কোথাও আমরা কোনো ব্যানার দেখিনি। খুবই বাজে প্রচারণা হয়েছে। বিশ্বচ্যাম্পিয়নরা এসেছে, অনেক ভালো প্রচারণা করা যেত।”
দ্য ডেইলি স্টারের ক্রীড়া সাংবাদিক একুশ তাপাদার, যিনি বর্তমানে বাংলাদেশ বনাম ইংল্যান্ড সিরিজের জন্য চট্টগ্রামে অবস্থান করছেন, রোর বাংলাকে বলেন যে অনেকে খেলার ব্যাপারটি জানতোই না।
“কোনো উত্তেজনাই ছিল না (খেলাকে ঘিরে)৷ আমি এসেছি ৪ তারিখ। আমার বন্ধুদের একটা প্রোগ্রাম ছিল৷ তারা জানতোও না খেলা কবে। মানে নির্দিষ্ট দিন তারিখ আরকি। জানার আগ্রহও দেখিনি।”
আরও যোগ করেন, চট্টগ্রামের গ্যালারির অধিকাংশ অংশেই ছাদ নেই, ফলে ১২টা থেকে খেলা দেখতে হলে দর্শকদের সহ্য করতে হয় তীব্র দাবদাহ।
“চট্টগ্রামের বেশিরভাগ গ্যালারিতেই কোনো ছাদ নেই। গরমে খুবই সমস্যা হয়।”
সিরিজ হার, আগ্রহের মৃত্যু
চট্টগ্রামে হওয়া সর্বশেষ আন্তর্জাতিক ম্যাচগুলো পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, আগের দু’বার বাংলাদেশ এখানে যায় এগিয়ে থেকেই। সর্বশেষ ভারত সফরে বাংলাদেশ গিয়েছিল সিরিজ জিতে নিয়েই, অন্যদিকে আফগানিস্তানের বিপক্ষে ওয়ানডে সিরিজের পুরোটাই খেলা হয়েছিল এখানে।
তবে, ইংল্যান্ড সিরিজে প্রেক্ষাপট ছিল ভিন্ন। বাংলাদেশ আগেই হেরে বসে সিরিজ, তাতে দর্শকের আগ্রহ কমেছে অনেকটাই। চট্টগ্রামে বসবাসরত মোত্তাকিন আপনানি অনিক বলেন রোর বাংলাকে:
“ইংল্যান্ড যেহেতু আগেই ২ ম্যাচ জিতে সিরিজ জেতা নিশ্চিত করে ফেলেছিলো,তাই দর্শকদের মধ্যে এই ম্যাচ নিয়ে আগ্রহ স্বাভাবিকভাবেই কম ছিলো। হয়তো যদি সিরিজ ১-১ সমতা থাকতো বা বাংলাদেশ সিরিজ জিততো, তাহলে হয়তো চট্টগ্রাম শহরে আমরা ভিন্ন চিত্র দেখতাম।”
একই কথা মনে করছেন বিডিনিউজ২৪ এর সাংবাদিক শাহাদাৎ আহমেদ ভূঁইয়া, যিনি বর্তমানে এই সিরিজের জন্য চট্টগ্রামে আছেন। রোর বাংলাকে তিনি বলেন:
“ঢাকার বাইরে ম্যাচ হলে বরাবরই মাঠ ভরা থাকে। যে কারণে এবার খালি মাঠ দেখাটা খুবই অবাক করার মতো ছিল। একটা সময় তো মনে হচ্ছিল মাঠে ইংল্যান্ডের সমর্থকই বেশি! এর একটা কারণ হতে পারে দুপুর ১২টায় খেলা শুরু হওয়া। সাধারণ গ্যালারিতে তপ্ত রোদে বসে সারা দুপুর খেলা দেখা খুব সহজ কাজ নয়।
তবু মানুষের আগ্রহ থাকতে পারত যদি এই ম্যাচ থেকে পাওয়ার কিছু থাকত। সিরিজ আগেই হেরে যাওয়া এবং যেভাবে খেলে হারা, এ দু’টি কথা অনেক মানুষের মুখে শুনেছি। এমনকি খেলা দেখতে আসা দর্শকদের মাঝেও হতাশা ছিল প্রথম দুই ম্যাচের পারফরম্যান্সের কারণে।”
তবে স্রেফ এগুলোই নয়, বরাবরই সিরিজের শেষ ম্যাচ রাখা হয় চট্টগ্রামে, ফলে অনেক সময়ই দেখা যায় খেলার আগেই ফল নির্ধারিত, প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির হিসেবটা আর থাকে না সাগরিকায় খেলার সময়। অনিক দায়ী করছেন সেটিকেও।
“চট্টগ্রামে প্রায় প্রত্যেক সিরিজের শেষ ম্যাচ রাখা হয়। যা অনেক সময় গুরুত্বহীন ম্যাচে রূপ নেয়। যার ফলে দর্শকরাও খেলাটাকে সিরিয়াসলি নিতে পারে না৷ অন্যান্য শহরে অনেকদিন পর একটা ম্যাচ হলেও একটা উৎসবের আমেজ সৃষ্টি হয়। কিন্তু চট্টগ্রামে নিয়মিতভাবে তৃতীয় ম্যাচ রাখাতে দর্শকের আগ্রহ বা উত্তেজনা থাকে না। কারণ, সেই তৃতীয় ম্যাচের হয়তো গুরুত্ব কম থাকে।”
টিকেট নিয়ে নেই কাড়াকাড়ি
ঢাকার বাইরে খেলা হলেই টিকেট নিয়ে হইচইয়ের দৃশ্য বাংলাদেশ ক্রিকেটে এখন নিয়মিত। গেল বিপিএলের সিলেট পর্বেও সেটি দেখা গিয়েছে।
তবে, এবার চট্টগ্রামে দেখা যায়নি সেটা। প্রচারণার অভাব তো ছিলই, তবে বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতিও একটি কারণ বলে মনে করছেন শাহাদাৎ। তিনি বলেন,
“চড়া বাজারদর একটি কারণ হলেও হতে পারে। এখানে একটি ঘটনা না বললেই নয়। বিটাক মোড়ে টিকিট কাউন্টারের ঠিক পাশেই ওমএসের একটি ট্রাক দাঁড় করানো ছিল লম্বা সময়। সেই ট্রাকের পেছনে মানুষের লম্বা লাইন। কিন্তু টিকিট কাউন্টারে তখন স্রেফ শূন্যতা! খেলার বাইরের কারণ হলেও আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটও আসলে ওভারলুক করা যায় না।”
শেষ ওয়ানডেতে তাই জয় পেলেও আক্ষেপ রয়ে গিয়েছে সাগরিকার নিঃসঙ্গ গ্যালারিতে। তবে সকলেরই ধারণা, বৃহস্পতিবারের প্রথম টি-টোয়েন্টিতে দর্শক সমাগম থাকবে বেশি, কারণ একে তো সিরিজের প্রথম ম্যাচ, তার ওপর খেলা শুরু বিকেল তিনটায়। বাংলাদেশ দলও হয়ত তাই চাইবে। শূন্য গ্যালারি নিয়ে ঘরের মাঠে কে খেলতে চায়!