পেলেকে কে না চেনেন? তর্কাতীতভাবে বিশ্বের ইতিহাসের সেরা খেলোয়াড়দের একজন তিনি। খেলোয়াড় হিসেবে তাঁর দেশ ব্রাজিলকে জিতিয়েছেন ১৯৫৮, ১৯৬২ ও ১৯৭০ সালের বিশ্বকাপ। ঝুলিতে রয়েছে হাজারের বেশি গোল। তাঁর ফুটবলার সত্ত্বাকে সন্দেহ করার মতো কেউ নেই। কিন্তু বিপত্তি ঘটলো তিনি যখন বুট জোড়া তুলে রাখার পর পায়ের বদলে মুখ চালাতে শুরু করলেন! স্বভাবতই সাংবাদিকগণ যেকোনো তরতাজা ইস্যুতে পেলের কাছে যান তাঁর মতামত বা ভবিষ্যৎবাণীর জন্য। সেখানেই শুরু যত ঝামেলা। রোমারিও একবার বলেছিলেন, “পেলে যখন তাঁর মুখটা বন্ধ রাখেন তখন তিনি একজন কবি!” এই কথার মাহাত্ম্যই দেখা যাবে আজকের লেখায়।
ব্রাজিলের ২০০২ সালের বিশ্বকাপজয়ী কোচ লুই ফেলিপে স্কোলারি পেলেকে নিয়ে একবার সরাসরিই বলে ফেলেছিলেন,
“আমার মনে হয়, পেলে ফুটবলের কিছুই জানেন না, যদিও খেলোয়াড় হিসেবে তিনিই সেরা! তাঁর বিশ্লেষণগুলো অখাদ্য। আপনি যদি শিরোপা জিততে চান তবে মন দিয়ে পেলের কথা শুনুন আর ঠিক তার উল্টো কাজগুলো করুন, ব্যস হয়ে যাবে!”
পেলে নিয়মিত ভবিষ্যৎবাণী করা শুরু করেন মোটামুটি আশির দশকের শুরু থেকে। তখনো লোকজন বুঝে উঠতে পারেনি তাঁর আসল ‘মহিমা’। কিন্তু নব্বইয়ের মাঝামাঝিতে এসে এর একটা নামই হয়ে যায় ‘পেলে কার্স’। মানে, পেলে যাকে নিয়ে ইতিবাচক কিছু বলেছে, তাঁর কপালে শনির দশা শুরু হলো বলে! নিচে দেখে নেয়া যাক পেলের ‘বিখ্যাত’ কিছু ভুল ভবিষ্যৎবাণী।
যুগোস্লাভিয়া বিশ্বকাপ ১৯৯০ ও ইউরো ১৯৯২
যুগোস্লাভিয়া দলটাকে পেলের মনে ধরে গেল। বলে দিলেন যে, যুগোস্লাভিয়া ’৯০ বিশ্বকাপে সেমিফাইনাল খেলবেই। প্রথম ম্যাচেই জার্মানির কাছে ১-৪ গোলে হার আর নকআউট পর্বে আর্জেন্টিনার কাছে পরাজয়। কিন্তু পেলের যুগোস্লাভিয়া মোহ কাটেনি। ১৯৯২ সালের ইউরো কাপের জন্য তিনি তাঁদের ফেভারিট ঘোষণা দিয়ে দিলেন। সেবার কপালে আরো বড় ‘খারাবি’ হলো, রাজনৈতিক কারণে যুগোস্লাভিয়া ফুটবল থেকেই বহিষ্কৃত হয়!
ব্রাজিল ১৯৯০
পেলের কাছে মনে হলো, ব্রাজিলের ১৯৯০ সালের দলটা দারুণ, যদিও ব্রাজিলিয়ান গণমাধ্যম এই দল নিয়ে সন্তুষ্ট ছিল না। পেলে বলে দিলেন, কাপ ব্রাজিলই জিতবে। ফলাফল? ব্রাজিল দ্বিতীয় রাউন্ড থেকেই বাদ!
কলম্বিয়া ১৯৯৪
রীতিমতো বোমাই ফাটালেন পেলে। রোমারিওর ব্রাজিল, ব্যাজ্জিওর ইতালি বা আর্জেন্টিনা- সবাইকে টপকে তিনি সম্ভাব্য বিশ্বকাপ বিজয়ী হিসেবে বেছে নিলেন কলম্বিয়াকে। কলম্বিয়ানরাও রীতিমতো অবাক! সেবার বিশ্বকাপে কলম্বিয়া গ্রুপপর্ব থেকেই বাদ পড়ে যায় আর দেশে ফিরে আততায়ীর হাতে নিহত হন সেই কলম্বিয়া দলের ডিফেন্ডার এস্কোবার। কপাল ভালো বলতে হয় ব্রাজিলের। পেলে ব্রাজিলকে নিয়ে অতটা আশাবাদী ছিলেন না। ব্রাজিলের জন্য তা হয়ে এল আশীর্বাদ হয়েই! ১৯৯৪ সালে ২৪ বছর পর বিশ্বকাপ জিতে নেয় ব্রাজিল।
তুরস্ক ও ইতালি ১৯৯৬ ইউরো
১৯৯৬ সালের ইউরো কাপের আগে পেলে বলে দিলেন ইতালি হবে চ্যাম্পিয়ন আর তুরস্ক কমপক্ষে সেমি ফাইনাল অবধি যাবে! তাঁর মনে হয়েছিল একটা কারণে যে, তুরস্কের অধিকাংশ খেলোয়াড় ইউরোপেই খেলেন এবং তাঁরা অভিজ্ঞ। সেবার তাঁর ভবিষ্যৎবাণীর ‘সুনাম’ এর আরো শ্রীবৃদ্ধি হয়। তুরস্ক ও ইতালি দুই দলই বাদ পড়ে যায় গ্রুপপর্ব থেকেই। ‘পেলে কার্স’ স্থায়ীরুপ ধারণ করে সেই থেকে।
১৯৯৮ বিশ্বকাপ
১৯৯৮ সালের বিশ্বকাপে পেলের ‘কুনজর’ পড়লো স্পেনের দিকে। রাউল, পেপ গার্দিওলাদের স্পেনকে পেলে ঘোষণা দিয়ে দিলেন সম্ভাব্য বিজয়ী হিসেবে। স্পেন দলটা নেহায়েত মন্দ ছিল না, কিন্তু তাঁদের ধারাবাহিকতা ও চাপ সামলানোর সক্ষমতা বরাবরই ছিল প্রশ্নের মুখে। তার উপর পেলের ভবিষ্যৎবাণী! স্পেনের পত্রপত্রিকায় ব্যাপক লেখালেখি হলো এ নিয়ে। স্পেন বাঁচতে পারেনি। লজ্জাজনকভাবে বাদ পড়তে হয় তাদেরকে গ্রুপপর্ব থেকেই। শুরুতেই নাইজেরিয়ার কাছে পরাজয় আর প্যারাগুয়ের সাথে ড্র তাঁদের বিদায় নিশ্চিত করে দেয়।
সেবার ব্রাজিলে রীতিমতো হাহাকার চললো যাতে পেলে ব্রাজিলের পক্ষে কোনো ভবিষ্যৎবাণী না দেন। পেলেও সবার কথা মেনেই মুখ বন্ধ করে রেখেছিলেন। ব্রাজিলও উঠে গেল ফাইনালে। কিন্তু রোনালদোদের খেলা দেখে উচ্ছ্বসিত পেলে ফাইনালের দুইদিন আগে বলে দিলেন ব্রাজিলই হবে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন। ফলাফল, আশ্চর্যজনকভাবে ফাইনালের আগে রোনালদো অসুস্থ হয়ে পড়েন। উড়তে থাকা ব্রাজিলকে ৩-০ গোলে হারিয়ে কাপ জিতে নেয় ফ্রান্স। ৩টি বিশ্বকাপ এনে দেয়া পেলে ব্রাজিলে পরিণত হন ‘কুফা’ পেলেতে!
২০০২ বিশ্বকাপ
২০০২ বিশ্বকাপের আগে ব্রাজিলের অবস্থা তথৈবচ। তবুও ব্রাজিলিয়ানরা একদিন হাফ ছেড়ে বাঁচল। কেন জানেন? পেলে ভবিষ্যৎবাণী করেছেন যে, সেবারের বিশ্বকাপের ফাইনাল খেলবে আর্জেন্টিনা ও ফ্রান্স এবং তাঁর কাছে ব্রাজিলের কোনো সম্ভাবনাই নেই। যা হওয়ার তাই-ই হলো। ফ্রান্স ও আর্জেন্টিনা উভয়ই বাদ পড়ে যায় প্রথম রাউন্ডেই আর ব্রাজিল জিতে নেয় পঞ্চমবারের মতো বিশ্বকাপ ট্রফি।
২০০২ সালের বিশ্বকাপে পেলের আরেকটি ভবিষ্যৎবাণী ছিল চীন গ্রুপপর্ব পার করবে। তিনি চীনের মাঝে সেই আগুন দেখতে পেয়েছেন। সেবার চীন পুরো গ্রুপপর্বে কোনো গোলই করতে পারেনি। নয় গোলের ব্যবধান নিয়ে বিদায় নেয় গ্রুপপর্ব থেকেই।
খেলোয়াড়দের চিনতে ভুল করা
১৯৯১ সালের অনুর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপে ঘানার নিল ল্যাম্পটি দারুণ আলো ছড়ান। তাঁর খেলায় মুগ্ধ হন পেলে নিজেও। বলে বসেন, ল্যাম্পটিই হবেন ‘ভবিষ্যৎ পেলে’। সেই ছোকরার আর পেলে হওয়া হয়নি। পিএসভি, এস্টন ভিলা, কভেন্ট্রি, ব্রেন্টফোর্ডের মতো ছোট ছোট ক্লাবেই কেটে গেছে তাঁর ক্যারিয়ার। আফ্রিকানরা কালো জাদুতে খুব বিশ্বাস করে। ল্যাম্পটিও একদিন বলেছিলেন যে, কোনো এক অভিশাপ তাঁকে শেষ করে দিচ্ছে। কে জানে ‘পেলে কার্স’-ই কিনা!
নিকি বার্ম্বি নামে এক ইংলিশ খেলোয়াড়কে তিনি বলেছিলেন ‘ভবিষ্যৎ জিদান’। বেচারা হয়েছিলেন গড়পড়তা এক খেলোয়াড়। ২০০৮ সালে ব্রাজিলের রোনালদো যখন আবার ইনজুরিতে পড়েন, পেলে বলেই দিলেন যে রোনালদোর পক্ষে আর ফিরে আসা সম্ভব না। সেই রোনালদো লম্বা সময় মাঠের বাইরে কাটিয়ে ফিরে ১৮ ম্যাচে ১৪ গোল করে করিন্থিয়ান্সকে পাউলিস্তাও কাপও জেতান!
২০০৬ বিশ্বকাপ
২০০৪ ইউরোতেও পেলের পছন্দ ছিল ইংল্যান্ড, যারা পর্তুগালের সাথে হেরে বাদ পড়ে যায়। কিন্তু পেলে তাঁর মত বদলান নি। ২০০৬ সালের জন্যও তাঁর পছন্দের তালিকায় প্রথমেই ছিল ইংল্যান্ড। তাঁর ভাষ্যমতে, রুনিই ইংল্যান্ডকে পৌঁছে দেবেন ১৯৬৬ সালের পর বিশ্বকাপ ট্রফির দোড়গোড়ায়। সেবার রুনি ছিলেন বেশ অনুজ্জ্বল আর ইংল্যান্ড পর্তুগালের কাছে হেরে বাদ পড়ে যায়! তাঁর আরো এক ভবিষ্যৎবাণী ছিল যে, ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনা কমপক্ষে সেমি ফাইনালে যাবে। বিধি বাম! দুই দলই কোয়ার্টার ফাইনালেই বাদ পড়ে যায়।
২০১০ বিশ্বকাপ
২০১০ বিশ্বকাপে পেলে নাইজেরিয়াকে নিয়ে বলেছিলেন যে, ‘সুপার ইগল’রা সেমিফাইনাল খেলবে। সেই নাইজেরিয়া নিজেদের গ্রুপে সর্বশেষ স্থানে থেকে বাদ পড়ে যায় বিশ্বকাপের গ্রুপপর্ব থেকেই। সেবার ফেভারিট হিসেবে পেলের মনে ধরেছিল স্পেন আর ব্রাজিলকে। ব্রাজিলের উপর ‘পেলে কার্স’ লাগলেও স্পেন ঠিকই বিশ্বকাপ জিতে নেয়।
আফ্রিকান দল হবে বিশ্বচ্যাম্পিয়ন!
পেলে একবার বলেছিলেন, ২০০০ সালের মধ্যেই কোনো না কোনো আফ্রিকান দল বিশ্বকাপ জিতবে। ২০১৮ বিশ্বকাপও এলো বলে, কিন্তু সেই দিন আর আসেনি!
২০১৪ বিশ্বকাপ
২০১৩ সালের কনফেডারেশন কাপে স্কলারি যখন এক ভগ্নদশায় থাকা ব্রাজিলকে শিরোপার স্বাদ দেন, অনেকের মতোই পেলেও অনেকবার বলেছেন, ২০১৪ সালে ঘরের মাটিতে ব্রাজিলই হবে চ্যাম্পিয়ন। বাকিটা তো সবার জানা, ৭-১ গোলে হারের লজ্জায় ডুবতে হয় ব্রাজিলকে।
কী পাঠক, রোমারিও কি খুব ভুল বলেছিলেন যে, মুখ বন্ধ রাখলে পেলে একজন কবি?
ফিচার ইমেজ: w-dog.ne