বর্তমানে ফুটবলের বর্ণিল জগতে কোনো ক্লাব যখন কোনো খেলোয়াড়কে কিনতে আগ্রহী হয়, তার জন্য কাঁড়ি কাঁড়ি অর্থ ঢালতে একবারের জন্যও দ্বিধা বোধ করে না। নেইমারের জন্য পিএসজির ২২২ মিলিয়ন ইউরো বা রোনালদোর জন্য জুভেন্টাসের ১০০ মিলিয়ন ইউরো খরচ করা এরকমই কিছু উদাহরণ। কিন্তু মাঝে মাঝে শুধু অর্থ নয়, ক্লাবগুলো বা খেলোয়াড়দের নিজেদের ইচ্ছার কারণে আরো কিছু ক্লজ বা শর্ত যোগ করা হয়ে থাকে চুক্তিতে। এই শর্তগুলো নির্ধারণ করে ক্লাবটি পছন্দের খেলোয়াড়কে দলে ভেড়াতে পারবে কি না। ফলস্বরুপ অনেক খেলোয়াড় এমনকি ম্যানেজারদের চুক্তিতেও যোগ করতে হয়েছে উদ্ভট সব শর্ত। চলুন দেখে নেয়া যাক ফুটবল জগতের এমনই কিছু উদ্ভট চুক্তির শর্তাবলী।
ডেনিস বার্গক্যাম্প: দ্য নন-ফ্লায়িং ডাচম্যান
১৯৯৫ সালে আর্সেনালে যোগ দেয়ার সময় ডেনিস বার্গক্যাম্প তার চুক্তিতে যোগ করলেন উদ্ভট এক শর্ত, যেখানে বলা হয়- অন্য ক্লাবের মাঠে খেলতে যাওয়ার সময় তিনি প্লেন ব্যবহার করবেন না, কারণ তার প্লেনে ভ্রমণের ব্যাপারে ভীতি কাজ করে।
নিজের আত্মজীবনীতে বার্গক্যাম্প উল্লেখ করেন, তার এই প্লেনে ভ্রমণ-ভীতি শুরু হয় ইন্টার মিলানে খেলার সময়, কারণ তাদের প্লেনগুলো আকারে অনেক ছোট ছিল। যদিও অনেকের বিশ্বাস, তার এই ভীতি শুরু হয় ১৯৯৪ বিশ্বকাপে খেলার সময়, যখন নেদারল্যান্ড এর জাতীয় ফুটবল দলকে বহনকারী প্লেনের ইঞ্জিন মাঝ আকাশে অকেজো হয়ে যায় এবং একজন সাংবাদিক রসিকতা করে বলেন তার ব্যাগে বোমা আছে। ফলে আর্সেনালে যোগদানের সময় এই শর্ত যোগ করতে গিয়ে নিজের বেতন কমাতেও দুবার ভাবেননি তিনি। সাথে ‘দ্য নন-ফ্লায়িং ডাচম্যান’ তার ডাকনাম হিসেবেও যোগ হয়ে যায়।
রাফায়েল ভ্যান ডার ভার্ট: নিষিদ্ধ লাল বুট
২০১৫ সালে রিয়াল বেটিসে যোগ দেয়ার সময় ক্লাব কর্তৃপক্ষ রাফায়েল ভ্যান ডার ভার্টের চুক্তির শর্ত হিসেবে উল্লেখ করে, ম্যাচ চলাকালে মাঠে লাল রংয়ের বুট পরে তিনি খেলতে পারবেন না। অদ্ভুত এই শর্তের পেছনের কারণ অবশ্য চির প্রতিদ্বন্দ্বী ক্লাব সেভিলা, যাদের অফিসিয়াল রং লাল এবং সাদা। তবে এই শর্ত থেকে ভ্যান ডার ভার্টের লাভ হয়েছিল বটে, কেননা এর ফলে বোনাস হিসেবে প্রতিবছর অতিরিক্ত ১.৬ মিলিয়ন ইউরো পেয়েছিলেন তিনি!
স্টেফান শোয়ার্জ: মহাকাশ ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা
ভ্যালেন্সিয়া থেকে ইংলিশ ক্লাব সান্ডারল্যান্ডে যোগ দেয়ার সময় নিজের চুক্তি পড়তে গিয়ে অবাক হয়ে যান স্টেফান শোয়ার্জ। ক্লাব কর্তৃপক্ষের স্পষ্ট কথা, মহাকাশ ভ্রমণ করতে পারবে না বাপু! অবশ্য ক্লাবের এমন উদ্যোগ এবং উদ্বেগের কারণও স্পষ্ট। ২০০১ সালে পৃথিবী ছেড়ে যাওয়ার কথা ছিল কয়েকটি বাণিজ্যিক মহাকাশযানের। আর সেটিতেই শোয়ার্জের নামে একটি সিট রিজার্ভ করে রাখেন তার ব্যক্তিগত পরামর্শক। কিন্তু সান্ডারল্যান্ডের সাথে তার চুক্তি মেয়াদ ২০০৩ সাল পর্যন্ত থাকায় ক্লাব কর্তৃপক্ষ চায়নি যে তিনি খেলা ছেড়ে মহাকাশ ভ্রমণে যান। ২০০৩ সালে চুক্তির মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ার ফলে এবং সান্ডারল্যান্ড দ্বিতীয় বিভাগে অবনমন হয়ে যাওয়ার পরে শোয়ার্জ অবসরে চলে যান।
নেইল রুডক: অতিরিক্ত ওজনের জরিমানা
সাবেক ডিফেন্ডার নেইল রুডক ছিলেন অতিকায় দেহের অধিকারী। ওজনও মাঝেমধ্যেই লাগাম ছাড়া হয়ে যেত। তাই ২০০০ সালে লিভারপুল থেকে ক্রিস্টাল প্যালাসে যোগ দেয়ার সময় তার চুক্তিতে অতিরিক্ত শর্ত দিয়ে বলা হয়, তার ওজন ৯৯.৮ কেজির বেশি হতে পারবে না। যতবার ওজন বেধে দেয়া সীমা অতিক্রম করবে, ততবার গুনতে হবে বেতনের ১০% জরিমানা। সবকিছু মেনে নিয়ে চুক্তিতে সই করলেও খুব একটা লাভ হয়নি তার। উল্টো মাত্র ছয় মাসের ব্যবধানে মোট ৮ বার জরিমানা গুনতে হয়। স্বাভাবিকভাবেই এক মৌসুমের মধ্যে ক্লাব পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত নিয়ে নেন রুডক।
স্যাম হাম্মাম: দল নির্বাচন
নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি সময়ে উইম্বলডন ফুটবল ক্লাবের মালিক ছিলেন স্যাম হাম্মাম। দলের মালিকানা নেয়ার পর থেকেই উদ্ভট সব উপায়ে ক্লাবে নিজের আধিপত্য বিস্তারের জন্য একপ্রকার উঠে-পড়ে লাগেন তিনি। ফলে দলের ম্যানেজার হিসেবে ববি গোল্ডকে নিয়োগের সময়ও তার চুক্তিতে যোগ করেন নিজের প্রভাব। কী ছিলো সেটা? ম্যানেজার প্রতি ম্যাচের একাদশ ঘোষণার পরে ম্যাচ শুরুর ৪৫ মিনিট আগপর্যন্ত নিজের ইচ্ছামতো দলে খেলোয়াড় পরিবর্তন করতে পারবেন স্যাম। কোচের কোনো কথার মূল্য সেই সময়ে তিনি দেবেন না। যদিও অফিসিয়ালি কখনো জানা সম্ভব হয়নি যে স্যাম এই শর্তের বাস্তবায়ন কতবার করেছিলেন!
নেইমার: বার্সেলোনা
২০১৩ সালে ব্রাজিলের ক্লাব সান্তোস থেকে স্প্যানিশ ক্লাব বার্সেলোনাতে যোগ দেন নেইমার। কিন্তু আজ অবধি এই ট্রান্সফার নিয়ে জল কম ঘোলা করা হয়নি। এমনকি ক্লাবটিকে দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্তও হতে হয়। সাবেক ক্লাব প্রেসিডেন্ট রোসেল পদত্যাগ করেন। এতকিছুর পরেও আরো অদ্ভুত কয়েকটি শর্ত যোগ করা হয় তার চুক্তিতে।
প্রথমটি হলো, কোচ নেইমারকে যে পজিশনে খেলাবেন, সেই পজিশনেই খেলতে হবে, এর বিরোধিতা নেইমার করতে পারবেন না। কিন্তু নেইমারের এতে লাভ কী? এক লাফে ২ মিলিয়ন পাউন্ড বোনাস পাবেন তিনি!
দ্বিতীয় ক্লজটি হলো, কয়েক মাস অন্তর ব্রাজিল থেকে তার প্রিয় মানুষগুলোকে ক্লাবের খরচে বার্সেলোনাতে নিয়ে আসতে হবে, যেন নেইমার একাকী অনুভব না করেন। সাবেক প্রেসিডেন্ট রোসেলের দেয়া তথ্যানুযায়ী, শুধু নেইমারয়ের প্রেজেন্টেশন অনুষ্ঠানে ‘দ্য টইস’ নামে খ্যাত এই মানুষগুলোকে আনতে ৪.৫ লক্ষ ডলার খরচ করেন তিনি। পরে আর কতবার তারা কাতালুনিয়ায় আসেন, তা আর জানা সম্ভব হয়নি।
রোনালদিনহো: পার্টিময় জীবন
২০১১ সাল, রোনালদিনহো তার ক্যারিয়ারের ইউরোপিয়ান পর্বের পাট চুকিয়ে আবারো ব্রাজিলে ফিরে যাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করলেন। এসি মিলান থেকে বেছে নিলেন ফ্ল্যামেঙ্গোকে। একইসাথে ক্যারিয়ারের শেষের দিকে এসে জীবনকে আরো বেশি করে উপভোগ করা শুরু করতে চাইলেন। ফলস্বরুপ, পার্টিপাগল এই মানুষটির ফ্ল্যামেঙ্গো-চুক্তিতে যোগ হলো আরেকটি শর্ত, যেখানে রোনালদিনহো উল্লেখ করেন- ক্লাব থেকে তাকে প্রতি সপ্তাহে দুবার রাতে পার্টি করার অনুমতি দিতে হবে। রোনালদিনহোর মতো কিংবদন্তীর জন্য এই শর্তও কোনো বাধার মুখে পড়েনি। কোনো ধরনের দ্বিধা ছাড়াই ফ্ল্যামেঙ্গো রাজি হয়ে যায়।
আলেক্স অক্সলেড চেম্বারলিন: খরুচে ২০ মিনিট
সাবেক আর্সেনাল ম্যানেজার আর্সেন ওয়েঙ্গার কৃপণ হওয়া সত্ত্বেও তরুণ ফুটবলার আলেক্স অক্সলেড চেম্বারলিনের উপরে এতটাই মুগ্ধ ছিলেন যে যেকোনো মূল্যে তাকে নিজের দলে ভেড়ানোর চেষ্টা করতেই থাকেন। শেষ পর্যন্ত ১৩ মিলিয়ন পাউন্ডের বিনিময়ে সাউদাম্পটন থেকে তাকে দলে আনতে সক্ষম হন ওয়েঙ্গার। কিন্তু বিপত্তি শুরু হয় আরেক জায়গায়। সাউদাম্পটন অতিরিক্ত শর্ত যোগ করে বসে, যেখানে বলা হয়, যেকোনো ম্যাচে ২০ মিনিটের বেশি খেললেই সাউদাম্পটনকে দিতে হবে ১০ হাজার পাউন্ড। ফলে ২০ মিনিটের বেশি খেলার বা মূল একাদশে খেলার সুযোগ খুব কমই হয়ে ওঠে আলেক্সের!
জুসেপ্পে রেইনা: লেগো হাউজ
যেকোনো দলিলে সই করার আগে এর সবকিছু যাচাই-বাছাই করে নিয়ে নিজের দাবিগুলো স্পষ্টভাবে বলা কেন জরুরি, তা আপনারা আজ ভালোমতো বুঝবেন।
১৯৬৬ সালে জার্মান ক্লাব আর্মিনিয়া বিয়েলফিল্ডে যোগদানের সময় জুসেপ্পে রেইনা চুক্তিতে যোগ করলেন একটি ক্লজ, যার বদৌলতে যত বছর তিনি ক্লাবে থাকবেন, প্রতি বছর ক্লাব থেকে তাকে একটি বাড়ি কিনে দেয়া হবে। ক্লাব কর্তৃপক্ষ এই শর্তে রাজি হয়ে গেল। কিন্তু রেইনা জানতেন না, আগামী তিন বছর তার সাথে ক্লাব কীভাবে মজা নিবে। চুক্তিতে বাসার আকার-আকৃতি নিয়ে কিছু বলা না থাকায় পর পর তিন বছর ক্লাবের পক্ষ থেকে তাকে লেগো ব্রিক দিয়ে বানানো ছোট বাসা কিনে দেয়া হয়, যেখানে বসবাস করা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। জীবনের সবচেয়ে বড় শিক্ষাটা রেইনা ভালোমতোই সেদিন থেকে পান।