কেনিংটন ওভালে চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির উদ্বোধনী ম্যাচে বাংলাদেশের প্রতিপক্ষ স্বাগতিক ইংল্যান্ড। বড় মঞ্চে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে বাংলাদেশের পূর্বের রেকর্ড বেশ সুখকর। শেষ দুই বিশ্বকাপেই ইংল্যান্ডের বিপক্ষে জয় পেয়েছিল বাংলাদেশ। সুদূর ইংল্যান্ডে খেলা হলেও ম্যাচের শুরু থেকেই বাংলাদেশি সমর্থকদের উপস্থিতি ছিলো উল্লেখযোগ্য। নিজ দেশের ক্রিকেটারদের উজ্জীবিত করতে মাঠে এসেছিল প্রবাসীরাও। রৌদ্রোজ্জ্বল দিনে টসে জিতে বাংলাদেশকে ব্যাটিংয়ের আমন্ত্রণ জানান ইংলিশ অধিনায়ক ইয়োন মরগান। ভারতের বিপক্ষে প্রস্তুতি ম্যাচে ব্যাটিং ব্যর্থতার কারণে দল নির্বাচনে কিছুটা রক্ষণাত্মক সিদ্ধান্ত নেয় বাংলাদেশ। তিন পেসারের বিপরীতে ৮জন ব্যাটসম্যান নিয়ে দল সাজিয়ে একাদশ ঘোষণা করে। সৌম্য সরকারকে সাথে নিয়ে ইনিংসের গোড়াপত্তন করেন অভিজ্ঞ তামিম ইকবাল। দুই ওপেনারই উইকেটে সেট হতে কিছুক্ষণ সময় নেন। তামিম ইকবাল নিজের খেলা প্রথম ১৭ বলের মধ্যে মাত্র ৩ রান করেছিলেন। দিনের শুরুতে ইংলিশ দুই পেসার ক্রিস ওকস এবং মার্ক ওডের বল দেখেশুনে খেলেন দুই ওপেনার। ক্রিস ওকস সাইড স্ট্রেইন ইনজুরির কারণে মাত্র দুই ওভার বল করেই মাঠ ত্যাগ করেন। এরপর আর তার মাঠে ফেরা হয়নি।
ওকসের বদল বল করতে আসেন আরেক পেসার জ্যাক বল। তার করা প্রথম ওভার থেকে ৮ রান নিয়ে খোলস ছেড়ে বেরিয়ে আসেন সৌম্য সরকার।
দুর্দান্ত এক কাভার ড্রাইভে চার হাঁকিয়ে ভালো কিছু করার ইঙ্গিত দিচ্ছিলেন তিনি। জ্যাক বলের প্রথম ওভারে দুটি চার হাঁকানো সৌম্য বলের করা দ্বিতীয় ওভারে মঈন আলীর হাতে সহজ ক্যাচ দিয়ে রক্ষা পেয়ে যান।
নতুন জীবন পেয়েও নিজের ইনিংসকে বড় করতে পারেননি সৌম্য। বলের চতুর্থ ওভারে ১৬ রান আসার পরেও স্টোকসের বলে আপার কাট করতে গিয়ে বদলি ফিল্ডার বেয়ারস্টোর হাতে ব্যক্তিগত ২৮ রানের মাথায় ক্যাচ দিয়ে প্যাভিলিয়নে ফিরেন। তামিম ইকবাল তখনও সাবলীলভাবে ব্যাট করছিলেন। নতুন নাম্বার থ্রি ব্যাটসম্যান ইমরুল কায়েসের সাথে আরও একটি জুটি গড়েন তিনি। ইমরুল কায়েস ২০ বলে ১৯ রান করে প্লাঙ্কেটের বলকে ওডের দুর্দান্ত ক্যাচে পরিণত করে যখন বিদায় নেন তখন বাংলাদেশের সংগ্রহ ২ উইকেটে ৯৫ রান। বাংলাদেশের ইনিংসের এরপরের গল্পটা তামিম-মুশফিক জুড়ে। এই দুই অভিজ্ঞ ব্যাটসম্যান ইংল্যান্ডকে কোনো সুযোগ না দিয়ে রানের চাকা সচল রাখেন। ৩১ ওভার শেষে বাংলাদেশের সংগ্রহ ২ উইকেটে ১৬৩ রান। ৩২তম ওভার করতে বল হাতে নেন বর্তমান সময়ের সবচেয়ে আলোচিত ক্রিকেটার বেন স্টোকস। তামিম এবং মুশফিকের দুর্দান্ত সব দৃষ্টিনন্দন শটে তিনিও মেজাজ নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারলেন না। ঐ ওভারের তৃতীয় বলে তামিমের দুর্দান্ত এক শট বল গড়িয়ে সীমানা ছাড়া হলে তামিমের সাথে কথা কাটাকাটি করেন তিনি। ওভার শেষে তামিমকে হালকা ধাক্কাও দিয়ে বসেন তিনি।
তামিম ইকবাল এবং মুশফিকুর রহিম স্বাচ্ছন্দ্যে ব্যাট করে যাচ্ছিলেন। ৩৭তম ওভারের ৫ম বলে চার হাঁকিয়ে ৪৮ বলে নিজের অর্ধশতক তুলে নেন মুশফিকুর রহিম। অন্যদিকে তামিম ইকবাল ৩৯তম ওভারের শেষ বলে সিঙ্গেল নিয়ে ক্যারিয়ারের ৯ম এবং ইংল্যান্ডের বিপক্ষে দ্বিতীয় শতক তুলে নেন। ১২৪ বলে ১১টি চার এবং ১টি ছয়ের মারে তিনি চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির ৮ম আসরের প্রথম শতক হাঁকান।
শতক হাঁকানোর পর দ্রুত রান তোলার দিকে মনোযোগী হন তিনি। শেষপর্যন্ত প্লাঙ্কেটের বলে বাটলারের হাতে ক্যাচ দিয়ে অসাধারণ ইনিংসের ইতি টানেন তামিম। ১৪২ বলে ১২টি চার এবং ৩টি ছয়ের সাহায্যে ১২৮ রানের ইনিংস খেলেন তিনি। চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে এটি বাংলাদেশি ক্রিকেটারের সর্বোচ্চ ব্যক্তিগত ইনিংস।
২০১৫ সালের বিশ্বকাপের পর তামিম ইকবালের ক্যারিয়ারে এসেছে আমূল পরিবর্তন। এসময়ে তিনি ২৮টি ওডিআই ইনিংসে ৫টি শতক হাঁকিয়েছেন। এর আগের ১৪০ ইনিংসের মধ্যে শতকের সংখ্যা মাত্র ৪টি! এসময়ে তিনি ৫৮.১২ ব্যাটিংয়ে গড়ে ১৪৫৩ রান করেছেন।
ইনিংসের ৪৫ তম ওভারে তামিম ফেরার পরের বলেই মুশফিকও প্লাঙ্কেটের বলে হেইলসের হাতে ক্যাচ দিয়ে সাজঘরে ফিরেন। মুশফিকুর রহিম খেলেন ৭২ বলে ৭৯ রানের ইনিংস।
এই দুই ব্যাটসম্যান তৃতীয় উইকেট জুটিতে ১৫১ বলে ১৬৬ রান যোগ করেছিলেন। তৃতীয় উইকেট জুটিতে চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির ইতিহাসে এটি যেকোনো দলের জন্যই সর্বোচ্চ রান। একপর্যায়ে মনে হচ্ছিলো বাংলাদেশ ৩২০ বা এর বেশি রান স্কোরবোর্ডে জমা করবে। কিন্তু শেষদিকে সাকিব, রিয়াদ, সৈকতরা ঝড়ো ইনিংস খেলতে ব্যর্থ হলে বাংলাদেশ নির্ধারিত ওভার শেষে ৬ উইকেটে ৩০৫ রান করতে সক্ষম হয়। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে এটিই বাংলাদেশের সর্বোচ্চ সংগ্রহ। এর আগের সর্বোচ্চ সংগ্রহ ছিল গতবছর মিরপুরে ২৮৮ রান। লিয়াম প্লাঙ্কেট ৫৯ রানে ৪ উইকেট নিয়ে বাংলাদেশকে ৩০৫ রানে বেঁধে রাখতে বড় ভূমিকা পালন করেন।
বাংলাদেশের দেওয়া ৩০৬ রানের লক্ষ্যে ব্যাট করতে নেমে শুরুতেই ধাক্কা খায় ইংল্যান্ড। অফ ফর্মে থাকা উদ্বোধনী ব্যাটসম্যান জ্যাসন রয় মাত্র ১ রান করে মাশরাফির বলে মুস্তাফিজের দুর্দান্ত ক্যাচে আউট হয়ে প্যাভিলিয়নে ফিরেন। বাংলাদেশের সাফল্য এটুকুই। ম্যাচের বাকিটা সময় রুট, হেইলস এবং মরগানরা ম্যাচের নিয়ন্ত্রণ নিজেদের কাছেই রাখেন।
ইংল্যান্ডের দুই ডানহাতি ওপেনারের কথা চিন্তা করে ইনিংসের দ্বিতীয় ওভারেই সাকিবের হাতে বল তুলে দেন মাশরাফি বিন মর্তুজা। খুব একটা সুবিধা করতে পারেননি সাকিব। মাশরাফির বলে দলীয় ৬ রানের মাথায় রয় ফিরে গেলেও অ্যালেক্স হেইলস অপরপ্রান্তে বাংলাদেশি বোলারদের উপর চড়াও হন। দ্বিতীয় উইকেট জুটিতে রুটকে সাথে নিয়ে কোনো প্রকার বিপদ ছাড়াই জয়ের দিকে এগোতে থাকেন হেইলস।
একে তো মাত্র তিনজন স্পেশালিষ্ট বোলার, তার উপর কেউই ব্রেক থ্রু এনে দিতে পারছিলেন না। তাই অধিনায়ক মাশরাফি বল তুলে দেন পার্টটাইম বোলার সাব্বির রহমানের হাতে। নিজের করা প্রথম ৫ বল থেকে ১৩ রান দিলেও ওভারের শেষ বলে হেইলসকে আউট করে কাজের কাজটুকু করে দিয়ে যান তিনি! হেইলস ৮৬ বলে ৯৫ রান করে আউট হন। রুট এবং হেইলস ২য় উইকেট জুটিতে ১৫৯ রান করে ম্যাচ ততক্ষণে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসেন।
হেইলস আউট হওয়ার পর ক্রিজে আসেন অধিনায়ক ইয়োন মরগান। এই উইকেটে যে বোলারদের জন্য বেশি কিছু নেই সেটা তিনি নিজের ইনিংসের দ্বিতীয় বলেই বুঝিয়ে দিয়েছেন। আস্তে আস্তে রুট এবং মরগান মিলে প্রতিদ্বন্দ্বীহীন এক সমাপ্তির দিকে নিয়ে যাচ্ছিলেন। বাংলাদেশী বোলাররা কোণঠাসা। অধিনায়ক মাশরাফি একের পর এক বোলিং চেঞ্জ করেও কোনো সাফল্যের মুখ দেখছিলেন না। ৩৬ তম ওভারে বল নিজের হাতে তুলে নেন অধিনায়ক নিজেই। ওভারের চতুর্থ বলে সুযোগও তৈরি করেছিলেন তিনি। মরগানের লফটেড শটে তামিম ইকবাল লং-অন থেকে দৌড়ে এসে বল লুফে নেন। কিন্তু অনফিল্ড আম্পায়ার নট আউট দিলে থার্ড আম্পায়ার দ্রুতই নিজের সিদ্ধান্ত জানিয়ে নট আউট দেন। এই সিদ্ধান্তে তামিম ইকবাল মোটেও খুশি ছিলেন না। ঐ একটি সুযোগের পর বাংলাদেশের আর কোনো বোলার রুট এবং মরগানকে বিপাকে ফেলতে পারেননি। এই দুইজন তৃতীয় উইকেট জুটিতে মাত্র ১১৬ বলে ১৪৩* রান যোগ করেন। জো রুট ১১৫ বলে ছয়টি চারের মারে নিজের ১০ম শতক তুলে নেন। শেষপর্যন্ত ১২৯ বলে ১১টি এবং একটি ছয়ের সাহায্যে ক্যারিয়ার সেরা ১৩৩* রানের ইনিংস খেলে ১৬ বল এবং আট উইকেট হাতে রেখে ইংল্যান্ডের জয় নিশ্চিত করেন রুট। সেইসাথে ম্যাচ সেরার পুরস্কারও জিতে নেন তিনি।
অপরপ্রান্তে অধিনায়ক মরগানও ৬১ বলে আটটি চার এবং দুটি ছয়ের মারে ৭৫* রানের ঝড়ো ইনিংস খেলেন। এই দুই অভিজ্ঞ ক্রিকেটারের ব্যাটে চড়ে চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির ইতিহাসে সর্বোচ্চ রান তাড়া করে জয়ের রেকর্ড গড়ে ইংল্যান্ড। এর আগে গত আসরে ইংল্যান্ডের বিপক্ষেই শ্রীলঙ্কা ২৯৪ রান তাড়া করে জয় পেয়েছিল।
বাংলাদেশের পরবর্তী ম্যাচ ৫-ই জুন অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে।