“ভাই আমি এডা এডা করবো নড়াইলে। একদম চেহারা বদলায় দেব। আপনারা দেইখেন। কারো কাছ থেকে একটা পয়সা নিচ্ছি না। নিজে যা পারছি, তাই দিয়ে চেষ্টা করছি।”
মিরপুর শেরে বাংলা জাতীয় ক্রিকেট স্টেডিয়ামের একাডেমি মাঠে বসে এভাবেই নিজের নড়াইল এক্সপ্রেস প্রজেক্ট নিয়ে বলছিলেন মাশরাফি বিন মুর্তজা। বাংলাদেশ জাতীয় দলের এই ওয়ানডে অধিনায়ক ৫০ ওভারের ক্রিকেটে বাংলাদেশ দলকে নিয়ে গেছেন অন্য রকম উচ্চতায়। তার অধীনেই প্রথমবারের মতো চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতে খেলেছে বাংলাদেশ। প্রথমবারেই সেমিফাইনালে পৌঁছেছে। তারও আগে ২০১৫ ওয়ানডে বিশ্বকাপে জায়গা করে নিয়েছিলো কোয়ার্টার ফাইনালে। এছাড়া ঘরের মাঠে পাকিস্তান, দক্ষিণ আফ্রিকা, ভারতের বিপক্ষে সিরিজ জয়; সবই হয়েছে মাশরাফির অধীনে।
২০১৭ সালে টি-টোয়েন্টি থেকে অবসর নেওয়ার আগপর্যন্ত ২০ ওভারের ফরম্যাটেও চেষ্টা করেছেন দলকে সামনে এগিয়ে নেওয়ার। কিন্তু অবসর নেওয়ার পর সেই পরিকল্পায় ছেদ পড়েছে। আপাতত ওয়ানডে নিয়েই ভাবনা। সঙ্গে চেষ্টা করছেন সাদা পোশাকের টেস্টে আবারও ফেরার। সবমিলিয়েই এক সাক্ষাৎকারে ইংরেজি দৈনিক নিউজ এইজের মুখোমুখি হন মাশরাফি। সেখানে নিজের ক্যারিয়ার, বর্তমান দলের অবস্থা, টেস্ট ক্রিকেট ও ২০১৯ ওয়ানডে বিশ্বকাপ নিয়ে নিজের ভাবনার কথা জানিয়েছেন তিনি। সেই সাক্ষাৎকারটি তুলে ধরা হলো রোর বাংলার পাঠকদের জন্য।
২০১৯ বিশ্বকাপ এখনও অনেক দূরে। আপনার কি মনে হয় এখনই এই টুর্নামেন্টের জন্য বাংলাদেশের পরিকল্পনা করা উচিত?
মাশরাফি: আমরা করবো (পরিকল্পনা), কিন্তু একইসঙ্গে আমাদের উইন্ডিজ, অস্ট্রেলিয়াসহ আরও কিছু বিদেশ সফর নিয়ে ভাবতে হবে, সেখানে ভালো করতে হবে। সেটা না হলে খুব কঠিন হয়ে যাবে বিশ্বকাপ। অবশ্যই ২০১৯ বিশ্বকাপ অনেক দূরে। সম্ভবত বছর দেড়েক দূরে। হ্যাঁ, এজন্য আমাদের এখন থেকেই পরিকল্পনা রাখতে হবে; আমাদের কোচিং স্টাফরা অবশ্যই এটা করবেন। কিন্তু তার আগে আমাদের সামনের সফরগুলো নিয়ে পরিকল্পনা নিয়ে ভাবতে হবে। তাছাড়া বিশ্বকাপ অনুষ্ঠিত হবে ইংল্যান্ডে। তাই বিদেশের যেসব সিরিজগুলো আমরা খেলবো এই সময়ের মধ্যে, সেগুলোর উপর জোর দিতে হবে।
ওয়ানডেতে আপনি দলের অধিনায়ক। তো আপনার ব্যক্তিগত পরিকল্পনা তো অবশ্যই আছে?
মাশরাফি: দেখুন, ভবিষ্যতে কি হবে সেটা কেউ বলতে পারে না। যেকোনো খেলোয়াড়ের সাথে যেকোনো কিছু হতে পারে। কিন্তু এই মুহূর্তে, হ্যাঁ আমি ওয়ানডে দলের অধিনায়কত্ব করছি। এই মুহূর্তে আমি কেবল উইন্ডিজ সফরের দিকেই মন দিচ্ছি। হয়তো তার আগে আমাদের আফগানিস্তানের বিপক্ষে খেলতে হবে। তো আমার মনে হয় আমাদের এই দুটি সিরিজের দিকে এখন ফোকাস করা উচিত। যেন আমরা নিজেদের সেরা খেলাটা খেলতে পারি এবং ওই ম্যাচগুলো জিততে পারি। তারপর… হ্যাঁ, অবশ্যই বিশ্বকাপের জন্য পরিকল্পনা থাকতে হবে। কিন্তু আমি যেটা বললাম, ওই ম্যাচগুলো খেলার আগে বিশ্বকাপের জন্য পরিকল্পনা করা খুব কঠিন। কারণ এর মধ্যে আপনাকে নির্ধারণ করতে হবে কোন খেলোয়াড়গুলো ইংল্যান্ডে দলের জন্য কার্যকর হবে। আমাদেরকে আগে ওই খেলোয়াড়গুলোকে খুঁজে পেতে হবে। এই মুহূর্তে এটা খুঁজে বের করা খুব কঠিন।
আর কতদিন খেলতে চান?
মাশরাফি: এটা বলা খুব কঠিন। আমি কখনই এভাবে আমার লক্ষ্য নির্ধারণ করিনি। ঠিক যেভাবে আমি টি-টোয়েন্টি থেকে বিদায় নিয়েছি। ওয়ানডের জন্যও একই কাজ হবে। একবার যখন আমার মনে হবে আমি খেলতে চাই না, তখনই আমি খেলা ছেড়ে দেব। আমার খেলা ছাড়া নিয়ে কোনো পরিকল্পনা নেই, এ নিয়ে আমি এখনও কোনোকিছু ভাবিনি।
আপনি সবসময় বলেন টেস্টে ফিরতে চান, এ নিয়ে আপনার আসলে পরিকল্পনা কী?
মাশরাফি: টেস্টের জন্য আমাকে আরও কিছু চারদিনের (প্রথম শ্রেণির) ম্যাচ খেলতে হবে। হতে পারে জাতীয় লিগ কিংবা বাংলাদেশে আরও এমন যেসব টুর্নামেন্টগুলো আছে সেখানে খেলা। তার আগে এ নিয়ে মন্তব্য করা কঠিন। আমি এই ফরম্যাটে খেলার জন্য তৈরি এটা বোঝাতে আমার মনে হয় আমাকে নির্বাচকদের সামনে আরও একটু প্রমাণ করা বাকি আছে। তারপর তারা যদি ভাবে আমি জাতীয় দলের জন্য কাজে লাগবো তাহলে হয়তো হবে। কিন্তু এখন আমার কাছে যেটা মনে হয়, আমাকে আরও এক বছর প্রথম শ্রেণির ম্যাচ খেলতে হবে।
আপনার বর্তমান ফিটনেস নিয়ে কি সেটা সম্ভব মনে হয়?
মাশরাফি: সবকিছু সম্ভব। আপনার কিছুটা সাহস প্রয়োজন। আমি যেটা বলছি, আপনাকে আরও কিছুটা ধৈর্য্য ধরতে হবে, সেটা আমার আছে। কিন্তু তারপরও যদি আমি খেলি, আমাকে অবশ্যই প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটের মধ্যে দিয়ে যেতে হবে। কারণ বিশ্বকাপ খুব গুরুত্বপূর্ণ টুর্নামেন্ট আমাদের জন্য। দেখা যাক কী হয়। আমার এই মুহূর্তে বিশ্বকাপের দিকেই পুরো মনোযোগ। এর মধ্যে যদি আমি সুযোগ পাই, নির্বাচকরা যদি মনে করেন আমি পারবো, অবশ্যই তাহলে আমি পারবো। কিন্তু এই মুহূর্তে যদি জিজ্ঞেস করেন, তাহলে আমি বলবো বিশ্বকাপই এখন আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
আপনার হাঁটুতে সাতবার অস্ত্রোপচার হয়েছে। খুব বেশি খেলোয়াড় এমন অবস্থায় খেলা চালিয়ে যেতে পারে না। আপনি কিভাবে পারছেন?
মাশরাফি: খুব সহজ ব্যাপার, আমি ক্রিকেট খেলতে ভালোবাসি, আমি খেলাটাকে ভালোবাসি; এটাই পিছনের গল্প। আর সত্যি বলতে আমি প্রতিবার ইনজুরিতে পড়ে কখনই ভাবি না যে আমি আর ফিরতে পারবো না। আমি ইনজুরিতে পড়ি, ভাবি আচ্ছা এটা আসলে আমার জন্য বিশ্রামের সময়। হয়তো ৬-৮ মাস। আমাকে তারপর ফিট হতে হবে এবং খেলায় ফিরতে হবে। এই সাহসটা আমার মধ্যে, আমার মনের মধ্যে ছিল। আমি কখনই হাল ছাড়িনি কারণ আমি খেলাটাকে ভালোবাসি। কখনও কখনও আপনার এই গল্পগুলো অন্যদের অনুপ্রাণিত করে। যেমন এক ফুটবলার বলছিলেন মাশরাফি যদি সাতটা অস্ত্রোপচার নিয়ে খেলতে পারে তাহলে আমি কেন পারবো না।
আপনার কি মনে হয় অন্যান্য খেলোয়াড়দেরও আপনার থেকে ইনজুরি ‘ম্যানেজমেন্ট’ নিয়ে শিক্ষা নেওয়া উচিত?
মাশরাফি: অন্যদের থেকে শেখার অনেক অনেক ব্যাপার আছে। কেউ যদি আমার থেকে শিক্ষা নিতে চায়, এটা আমার জন্য বিশাল ব্যাপার, তার জন্যও তাই। আমি মনে করি আমি যেগুলো ঠিক কাজ করেছি সে ব্যাপারে যদি আমার কাছ থেকে কেউ জানতে চায়, আমি তাদেরকে ব্যাখ্যা করতে রাজি আছি, তাদের সঙ্গে শেয়ার করতে পারবো। কিন্তু এগুলো আসলে একেকজন মানুষের মধ্যে একেকভাবে কাজ করে। আপনি আসলে কী শিখতে চান আর চান না, সেই ব্যাপারগুলো কাজ করে। হ্যাঁ, কেউ যদি মনে করে আমি তার শেখার অংশ, অর্থাৎ আমি গেল ১৪-১৫-১৬ বছরে যা করেছি সেগুলো থেকে কেউ যদি কিছু শিখতে চায়, জানতে চায়; তারা আমার কাছে আসতে পারে, কথা বলতে পারে।
আপনি ২০১৫ সালে দলের অধিনায়কত্ব পেয়েছেন। গেল কয়েক বছরে আপনার অধীনে দলের চেহারা বদলে গেছে। আলাদা কি এমন করেছেন?
মাশরাফি: খুব সাধারণ একটা কাজ করেছি আমরা। সবাই একসঙ্গে থেকেছি। মাঠে, মাঠের বাইরে একে অন্যকে সাহায্য করার চেষ্টা করেছি। আমরা এটা নিশ্চিত হতে চেয়েছি যে আমরা স্বাধীনভাবে খেলতে চাই, কেউ অন্যের ঘাড়ে দোষ চাপায়নি; আরও একটা ছোট্ট কাজ করেছি আমরা। যেটা আমাদের জন্য কঠিন, সেখানে আমররা একটা দল হিসেবে সেই কঠিন ব্যাপারটার মোকাবেলা করেছি। অবশ্যই আমাদের কোচিং স্টাফ, বিসিবি আমাদেরকে অনেক সাহায্য করেছে। আমি মনে করি এটা একটা যৌথ চেষ্টা ছিলো। এমন নয় যে আপনি একজনের দিকে আঙুল তুললেন আর বলে দিলেন এই লোকটা আমাদের অনেক সাহায্য করেছে যে কারণে দল আজকের অবস্থানে এসেছে। আমি মনে করি সবাই মিলেই এটা সম্ভব হয়েছে।
আপনার অধীনে বাংলাদেশের এই সফলতার সঙ্গে সঙ্গে আপনার জনপ্রিয়তাও আকাশ ছুঁয়েছে। আপনি কিভাবে এটা দেখেন?
মাশরাফি: আমি যা করেছি সেটা কিছুই না। আমি ছোটবেলা থেকে যেভাবে বড় হয়েছিলাম, সেভাবেই বেড়ে উঠতে চেয়েছি। আমি যখন খেলি তখনও এমনই থাকি। আমি স্পেশাল কিছুই করিনা। আমি খুব সাধারণ একজন মানুষ হিসেবে বাস করি। এটা নিশ্চিত করার চেষ্টা করি যে আমি কী ধরনের পরিবার থেকে এসেছি, আমি কি ছিলাম, আমার পরিবার কী, এগুলো যেন মাথায় থাকে।
অনেক তরুণ খেলোয়াড় আছেন যারা জনপ্রিয়তার তুঙ্গে উঠে নিজেদের ফোকাস হারিয়ে ফেলেন। তাদের প্রতি আপনার পরামর্শ কী?
মাশরাফি: আমি কোনো নির্দিষ্ট ক্রিকেটারের দিকে আঙ্গুল তুলে এ অভিযোগ করতে পারবো না, আসলে আমি জানিই না কোন খেলোয়াড় এটা করছেন। আমি মনে করি এটা লোকভেদে নির্ভর করে। একেবারে শুরুতে যখন আমি খেলতে আসি তখন আমি দেশের জন্য খেলতে এসেছিলাম। এমন নয় যে একটা সুন্দর জীবন পাওয়া যাবে। অবশ্যই এখানে চাপ আছে। আরও অনেক চাপ আসছেও। সবমিলিয়ে একজনের জন্য সবসময় একই মানুষ হিসেবে চলা আসলেও খুব কঠিন। কিন্তু আমি মনে করি তারা যেটা করতে পারে, সাধারণ থাকতে পারে। তারা আগে যেভাবে চলতো, সেভাবে চলতে পারে। তাহলে অনেক চাপমুক্ত হওয়া যায়।
ফিচার ইমেজ- AFP