চ্যাম্পিয়নস লিগের মহারণে আজ মুখোমুখি হবে লিভারপুল এবং টটেনহাম হটস্পার। চ্যাম্পিয়নস লিগ এর আগে শেষ এরকম অল-ইংলিশ ফাইনাল দেখেছিল সেই ২০০৮ সালে। মাদ্রিদের ওয়ান্ডা মেট্রোপলিটানো স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া এই ফাইনালটি থেকে তাই প্রিমিয়ার লিগের ফ্লেভার আসছে বলে মনে হচ্ছে। আজ বাংলাদেশ সময় রাত ১টা থেকে শুরু হওয়া এই ম্যাচটির জন্য দারুণ আগ্রহ আর উত্তেজনা নিয়ে অপেক্ষা করছেন ফুটবলামোদীরা।
গতবারের চ্যাম্পিয়নস লিগের ফাইনালে রিয়াল মাদ্রিদের কাছে হেরে দ্বিতীয় স্থানে থেকে মৌসুম শেষ করেছিল রেডরা, হটস্পারের অবস্থান ছিল তাদের থেকে ২৬ পয়েন্ট নিচে। এই মৌসুমে তাদের খেলার ধাঁচও দারুণভাবে প্রশংসিত হয়েছে। সেই ২০১৫ সালের অক্টোবরে ম্যানেজারের দায়িত্ব নেবার পর থেকেই লিভারপুলের জন্য সুসময় নিয়ে এসেছেন ইয়ুর্গেন ক্লপ। এ মুহূর্তে তাকে সেরা ম্যানেজার বলতেও দ্বিধা করছেন না অনেকে। তবে এই জার্মান ম্যানেজারের অধীনে ছয় ছয়টি ফাইনাল খেলে ফেললেও দুর্ভাগ্যবশত একটি ট্রফিও ঘরে তুলতে পারেনি তারা।
প্রথম পর্বে লিভারপুল দুই লেগ মিলিয়ে অনায়াসেই বায়ার্ন মিউনিখকে হারিয়েছিল ৪-১ ব্যবধানে। কোয়ার্টার ফাইনালে তারা মুখোমুখি হয় পোর্তোর। নিজেদের মাঠে ২-০ ব্যবধানে এবং ফিরতি লেগে ৪-১ ব্যবধানে জয়লাভ করে তারা। তবে চ্যাম্পিয়নস লিগের এবারের মৌসুমের সেরা আকর্ষণ ছিল বার্সেলোনার সাথে লিভারপুলের দ্বৈরথ।কাতালান ক্লাবটির কাছে প্রথম পর্বে ৩-০ ব্যবধানে হারার পরে লিভারপুলের বাদ পড়াটা একপ্রকার নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিল। প্রবল চাপ নিয়ে নিজেদের মাঠ অ্যানফিল্ডে খেলা ম্যাচটিতে দুর্দান্তভাবে ফিরে আসে তারা। অবিশ্বাস্য এই ম্যাচে বার্সেলোনাকে ৪-০ গোলে হারিয়ে তারা উঠে যায় ফাইনালে।
ফাইনালে ওঠার পথে টটেনহাম হটস্পারের পথটাও বেশ দুরুহ ছিল। প্রথম পর্বে তারা দুই লেগ মিলিয়ে বরুশিয়া ডর্টমুন্ডকে হারায় ৪-০ ব্যবধানে। কোয়ার্টার ফাইনালের প্রথম লেগে ম্যানচেস্টার সিটির সাথে ১-০ গোলে জিতলেও ফিরতি লেগে ৪-৩ গোলে হেরে যায় তারা। দুই লেগ মিলিয়ে ফল ৪-৪ হলেও অ্যাওয়ে গোলের সুবাদে সেমিফাইনালে উঠে যায় হটস্পার। আর নিজেদের মাটিতে দুর্দান্তভাবে ম্যাচ জিতেও স্বপ্নভঙ্গের বেদনায় পুড়তে হয় ম্যানসিটিকে। সেমিফাইনালেও এ অবস্থার পুনরাবৃত্তি ঘটে কিছুটা। তবে এবার পরিস্থিতি ছিল হটস্পারের বিরুদ্ধে। আয়াক্সের কাছে প্রথম লেগে ১-০ গোলে হারলেও ফিরতি লেগে ৩-২ গোলে জেতে তারা। এবারও আয়াক্সকে নিজেদের মাটিতে হারিয়ে অ্যাওয়ে গোল বেশি থাকার সুবাদে ফাইনালে উঠে যায় ক্লাবটি। এমনিভাবেই ১৩৬ বছরের ক্লাব ইতিহাসে প্রথমবারের মতো ফাইনালে উঠলো টটেনহাম হটস্পার।
সাধারণত উইনিং কম্বিনেশন পরিবর্তন করতে চায় না কেউই। কিন্তু সমস্যা হলো, যে কম্বিনেশন গত তিন ম্যাচে লিভারপুলকে জিতিয়েছে, সেই কম্বিনেশনে ফিরমিনো ছিলেন না। প্রায় ছয় সপ্তাহ পরে দলে ফিরছেন তিনি। এই ব্রাজিলিয়ানের প্রতিভা নিয়ে সংশয় নেই কারো, তাই অবশ্যম্ভাবীভাবেই তাকে দিয়ে ম্যাচ শুরু করবেন ক্লপ। জেমস মিলনারকে দুর্ভাগ্যবশত ম্যাচটি বেঞ্চে বসেই কাটাতে হবে। ফিরমিনোর সাথে থাকবেন মোহাম্মদ সালাহ এবং সাদিও মানে। মাঝমাঠে দলের হাল ধরবেন অধিনায়ক জর্ডান হেন্ডারসন। তাকে যোগ্য সাহচর্য দেবেন ফাবিনহো এবং উইজনালডাম। রেডদের অধিনায়ক বার্সেলোনার বিরুদ্ধে দারুণ দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। এ ম্যাচেও তার কাছ থেকে এরকম পারফরম্যান্স আশা করা হচ্ছে।
লিভারপুলের সম্ভাব্য একাদশ
(৪-৩-৩)
অ্যালিসন বেকার, আলেক্সান্ডার-আরনল্ড, জোয়ের মাটিপ, ভ্যান জিক, অ্যান্ড্রু রবার্টসন, সাদিও মানে, জর্ডান হেন্ডারসন, ফাবিনহো, জেওরজিনিও উইজনালডাম, মোহাম্মদ সালাহ ও রবার্তো ফিরমিনো।
টটেনহাম হটস্পারকেও পড়তে হয়েছে মধুর সমস্যায়। সেমিফাইনালে তাদের মহাকাব্যিক প্রত্যাবর্তনের নায়ক লুকাস মউরাকে জায়গা ছেড়ে দিতে হচ্ছে ইংল্যান্ড ক্যাপ্টেন হ্যারি কেনের জন্য। হ্যারি উইংকস, হ্যারি কেন, ড্যাভিনসন সানচেজ- সবাই আজকের ম্যাচের জন্য পুরোপুরি প্রস্তুত। হটস্পারকে প্রেরণা যোগাতে পারে বছর দেড়েক আগে ওয়েম্বলিতে খেলা ম্যাচটি। সেই ম্যাচে হ্যারি কেনের জোড়া গোলের ওপর ভর করে ৪-১ ব্যবধানে তারা হারিয়েছিল লিভারপুলকে।
টটেনহাম হটস্পারের সম্ভাব্য একাদশ
(৪-৩-৩)
হিউগো লোরিস, কাইরান ট্রিপিয়ার, টবি অ্যাল্ডারউইরেল্ড, জ্যঁ ভার্টোনগেন, ড্যানি রোজ, হ্যারি উইঙ্কস, মোউসা সিসোকো, ডেলে অ্যালি, ক্রিশ্চিয়ান এরিকসেন, সন হিউং-মিন ও হ্যারি কেন।
মরিসিও পচেত্তিনোর দলের মূল ভরসা অবশ্যই ইংলিশ অধিনায়ক হ্যারি কেন। পাঁচ মৌসুমে ১৬৯ গোল করা কেন গত বিশ্বকাপে জিতে নিয়েছেন গোল্ডেন বুট। কিন্তু গোড়ালির ইনজুরিতে পড়ার কারণে দুই মাস খেলতে পারেননি তিনি, ফলে ধার কিছুটা হলেও কমে গেছে তার। কোনো কারণে ফাইনালে জ্বলে উঠতে না পারলে লুকাস মউরাকে বাদ দেবার জন্য অনুতাপে ভুগতে হবে পচেত্তিনোকে। কেনের সাহচর্য পেলে দুই ফুলব্যাক আলেক্সান্ডার-আরনল্ড আর রবার্টসনকে কাজে লাগিয়ে লিভারপুলকে ভালোভাবেই চাপিয়ে রাখবে হটস্পার।
গত চ্যাম্পিয়নস লিগের ফাইনালে গোল করেছিলেন লিভারপুল উইঙ্গার সাদিও মানে। তারপর থেকে নিজেকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে গেছেন তিনি। গত ১৬ মাসে যেকোনো প্রতিযোগিতার নকআউট পর্বে গোল করার ক্ষেত্রে তার চেয়ে এগিয়ে আছেন কেবল ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো। আজকে মাঝমাঠের দখল নিয়ে তার সাথে লড়াই হবে কাইরান ট্রিপিয়ারের। বিশ্বকাপে এই রাইট ব্যাক অসাধারণ খেললেও তারপর থেকে কিছুটা নিষ্প্রভ হয়ে আছেন তিনি, জায়গা হারিয়েছেন জাতীয় দলের স্কোয়াডেও। তাকে ঠেকানোর জন্য মানে এবং রবার্টসনের কম্বিনেশনকে ভালোভাবেই কাজে লাগাতে পারবে লিভারপুল।
এছাড়াও আছেন লিভারপুলের মধ্যমণি মোহাম্মদ সালাহ। গোল করতে না পারলেও তাকে কাজে লাগিয়ে ডানদিক থেকে আক্রমণ করার সুযোগ পাবে লিভারপুল। গত মৌসুমের মুখোমুখি ম্যাচটির একমাত্র গোলটিও এসেছিল তার পা থেকেই। তবে আজকে তার মূল উদ্দেশ্য থাকবে সম্পূর্ণ ম্যাচটি খেলা। গত বছরের রিয়াল মাদ্রিদের বিরুদ্ধে ফাইনালটি দুর্দান্তভাবেই শুরু করেছিল লিভারপুল। প্রথম আধঘন্টায় এগিয়ে ছিল তারাই। কিন্তু ম্যাচের ২৯ মিনিটের মাথায় রিয়াল ক্যাপ্টেনের সার্জিও রামোসের সাথে সংঘর্ষে কাঁধের ইনজুরিতে মাঠ ছাড়তে বাধ্য হন সালাহ।
ম্যাচের মোড় কিছুটা ঘুরে যায় তখনই। অবশেষে লিভারপুল ম্যাচটি হারে ৩-১ ব্যবধানে। পুরো মৌসুম উজ্জ্বল থাকা সালাহর জন্য শেষটা হয় খুবই কষ্টকর। মরার ওপর খাঁড়ার ঘায়ের মতো বিশ্বকাপেও ঠিকমতো খেলতে পারেননি তিনি। ফলে তার দেশ মিশর বাদ পড়ে প্রথম রাউন্ড থেকেই। দুই দলের গোলরক্ষকের মধ্যে তুলনা করলে অবশ্যই এগিয়ে থাকবেন ব্রাজিলিয়ান অ্যালিসন বেকার। বর্তমানে বিশ্বের সেরা গোলরক্ষকদের একজন হিসেবে বিবেচনা করা হয় তাকে।
ট্রফি জেতার ক্ষেত্রে মরিসিও পচেত্তিনো এবং ইয়ুর্গেন ক্লপ, দুই ম্যানেজারই একই ভাগ্যের ভাগীদার। ফাইনালে ওঠার পথে দুই দলই বার্সেলোনা আর ম্যানসিটির মতো জায়ান্টদের মোকাবেলা করে এসেছে। পরপর দুই রাতে তারা চ্যাম্পিয়নস লিগ ইতিহাসের সেরা দুটি ম্যাচ উপহার দিয়েছে দর্শকদের। ম্যাচ শেষ হবার আগেই হাল না ছাড়ার অদম্য আত্মবিশ্বাসই এই দুটি দলকে নিয়ে এসেছে এখানে। এই মৌসুমে তাদের মুখোমুখি দুটি ম্যাচই গড়িয়েছে ইনজুরি টাইম পর্যন্ত। আজও সেরকমই একটি প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ ম্যাচ আশা করছেন সবাই।