ব্যাটিং অর্ডার ক্রিকেটে খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয়। ব্যাটসম্যানরা সব পজিশনে খেলতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন না। ওপেনিং ব্যাটসম্যানকে যদি ৬ নম্বর পজিশনে পাঠানো হয়, তাহলে তার কাছ থেকে স্বাভাবিক খেলা না পাওয়া গেলে তাকে দোষ দেওয়া যাবে না। ঠিক তেমনিভাবে কোনো লোয়ার অর্ডারের ব্যাটসম্যানকে যদি ওপেন করতে পাঠানো হয়, তাহলে নতুন বলে সেই ব্যাটসম্যানের খাবি খাওয়াটাও প্রত্যাশিত। কিন্তু দলের চাহিদার কারণেই হোক, কিংবা পছন্দের পজিশনে সুযোগ না থাকার কারণেই হোক- অনেক সময়েই অনেক ব্যাটসম্যানকে পছন্দের বাইরে এসে ব্যাটিং করতে হয়। এদের কেউ কেউ হয়তো সফল হয়েছেন, আবার কেউ কেউ হয়তো ব্যর্থ।
কোনো কোনো খেলোয়াড় ব্যাটিং অর্ডারের ওপেনিং থেকে শেষ পজিশন পর্যন্তও ব্যাটিং করেছেন। তাদের নিয়েই সাজানো হয়েছে আজকের লেখাটি।
রবি শাস্ত্রী (ভারত)
ক্যারিয়ার শুরু করেছিলেন স্পিনার হিসেবে। প্রথম ১৩ টেস্টে ২০.৫৭ গড়ে মাত্র ২৮৮ রান কিংবা অভিষেকেই ১০ নম্বরে ব্যাট করতে নামা সেই সাক্ষ্যই দেয়। তবে ধীরে ধীরে এই বহুমুখী প্রতিভাধর ব্যাটসম্যান অন্যান্য পজিশনেও খেলা শুরু করেন এবং সফলতাও পান। টেস্টে একমাত্র ১১ নম্বর পজিশন ব্যতীত সব পজিশনেই ব্যাটিং করেছেন এই অলরাউন্ডার। ক্যারিয়ারের শেষ ১১টি টেস্টে ব্যাট হাতে ওপেন করেছেন। এই পজিশনে খেলেই পেয়েছেন ক্যারিয়ারের একমাত্র ডাবল সেঞ্চুরী। তবে সবচেয়ে বেশি খেলেছেন ৬ নম্বর পজিশনে, যা কিনা ধরা হয় একজন আদর্শ অলরাউন্ডারের জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত পজিশন। সর্বোচ্চ ৬টি সেঞ্চুরিও করেছেন এই পজিশনেই খেলে।
৮০ টেস্টে ১১টি সেঞ্চুরি আর ১২টি হাফসেঞ্চুরির সাহায্যে ৩৫.৭৯ গড়ে ৩,৮৩০ রানের পরিসংখ্যান একজন আদর্শ টেস্ট ব্যাটসম্যানের জন্য কিছুটা মলিন মনে হবে। তবে আপনি যখন জানবেন যে এর সাথে ১৫১টি টেস্ট উইকেটও তার আছে, তখন তাকে অলরাউন্ডারের মর্যাদা দিতে আপনার মনে তেমন দ্বিধা থাকার কথা না।
এই সব্যসাচী খেলোয়াড় ওয়ানডে ক্রিকেটেও বহু পজিশনে ব্যাটিং করেছেন। ৪ আর ১১ নম্বর পজিশন ব্যতীত প্রতিটিতেই ব্যাটিং করার কীর্তি আছে এই অলরাউন্ডারের। খেলা ছেড়ে দেবার পরে তিনি বহুদিন ধারাভাষ্যের কাজে জড়িত ছিলেন। এছাড়া ভারতীয় জাতীয় ক্রিকেট দলের পরিচালক হিসেবেও সফলতার সাথে দায়িত্ব পালন করে আরেকটি দিক থেকে নিজেকে সব্যসাচী প্রমাণ করেছেন রবি শাস্ত্রী।
নাসিম-উল-গনি (পাকিস্তান)
২৯ টেস্টে ১৬.৬০ গড়ে ৭৪৭ রান কিংবা ৩৭.৬৭ গড়ে ৫২ উইকেট- কোনো বিচারেই একজন টেস্ট ক্রিকেটারের জন্য আহামরি পারফর্মেন্স নয়। ক্যারিয়ারের ৫০টি ইনিংসের মাঝে ৯টিতেই স্কোর শুন্য। কে শুনতে চাইবে এই টেস্ট ক্রিকেটারের গল্প! তবে টেস্ট খেলার কীর্তি বাদেও তার আলাদা একটা রেকর্ড ছিল। মাত্র ১৬ বছর বয়সেই তার পাকিস্তানের টেস্ট ক্রিকেটে অভিষেক হয় এবং সেই সময় সর্বকনিষ্ঠ টেস্ট ক্রিকেটারের রেকর্ডটি তারই ছিল। বর্তমানে সর্বকনিষ্ঠ টেস্ট ক্রিকেটারের তালিকায় তার অবস্থান সপ্তম।
কিন্তু নাসিম উল গনিকে ক্রিকেটপ্রেমীরা মনে রাখে ভিন্ন কারণে। এই স্বল্প ক্যারিয়ারেও তিনি দশটি ভিন্ন পজিশনে ব্যাটিং করার কীর্তিটা করে ফেলেছেন। ওপেনিং থেকে ১১ নম্বর প্রতিটি পজিশনেই খেলেছেন। শুধু মাত্র ওপেনিংয়ে কখনোই বোলারকে ফেস করেননি, নন স্ট্রাইকার প্রান্তে ছিলেন। এই কারণে ১ নম্বর পজিশনটা বাদ পড়ে গিয়েছে।
জীবনের শেষ টেস্টে ওপেনিংয়ে নেমেও ৬৪ রানের একটা ইনিংস খেলেছেন। বেশিরভাগ সময়েই খেলেছেন ৮ নম্বর পজিশনে, যদিও ক্যারিয়ারের একমাত্র সেঞ্চুরিটা পেয়েছিলেন ৬ নম্বরে খেলে। খেলা ছাড়ার পর তাকে ম্যাচ রেফারি, জাতীয় দলের নির্বাচক এমনকি আইসিসির ডেভেলাপমেন্ট অফিসারের ভূমিকাতেও দেখা গিয়েছে।
আবদুল রাজ্জাক (পাকিস্তান)
তালিকার এই খেলোয়াড়টি একটু আলাদা। কারণ, তার কীর্তিটা ওয়ানডে ক্রিকেটে। ওপেনিং থেকে ১১ নম্বর প্রতিটি পজিশনেই খেলেছেন, কিন্তু কখনোই ইনিংসের শুরুর বলটা ফেস করেননি। এই কারণে তারও ১ নম্বর পজিশনটা বাদ পড়ে গেছে। ৫০০০ + রানের সাথে ২৬৯টি উইকেট- ওয়ানডে ক্রিকেটের দুর্দান্ত অলরাউন্ডারের তালিকায় তার নামটা চোখ বন্ধ করেই এনে ফেলা যাবে।
সিড গ্রেগরি (অস্ট্রেলিয়া)
ক্রিকেট খেলার আদি যুগের খেলোয়াড় তিনি, ক্যারিয়ারের ৫৮টি টেস্টের মাঝে ৫২টিই খেলেছেন ইংল্যান্ডের বিপক্ষে। তিনিই প্রথম ব্যাটসম্যান, যিনি কিনা টেস্ট ক্রিকেটের ১ নম্বর থেকে ১১ নম্বর প্রতিটি পজিশনে ব্যাটিং করেছেন। তবে তিনি মূলত মিডল অর্ডার ব্যাটসম্যান ছিলেন। ৫ নম্বর আর ৬ নম্বর পজিশনে তার দুটো করে সেঞ্চুরিও আছে।
৬ নম্বর পজিশনে খেলে তার ২০১ রানের ইনিংসটা অস্ট্রেলিয়ার মাঠে কোনো একজন ব্যাটসম্যানের করা প্রথম ডাবল সেঞ্চুরি। তার অধিনায়কত্বে অস্ট্রেলিয়া দল খেলেছে ৬টি টেস্ট, ২টি জয় আর ১টি হারের সাথে সাথে ড্র হয়েছে ৩টি ম্যাচ। ১৮৯৭ সালের উইজডেন দ্বারা নির্বাচিত বর্ষসেরা ৫ জন ক্রিকেটারের মাঝে একজন ছিলেন তিনি।
কাভার পয়েন্টের একজন দুর্দান্ত ফিল্ডার ছিলেন তিনি। এই প্রসঙ্গে নিউজিল্যান্ডের ক্রিকেটার ডান রেসির একটা বক্তব্য শোনা যাক:
“রয়েল থেকে হবস- ইংল্যান্ড দলের অনেক ফিল্ডার ছিলেন যারা কাভার পয়েন্টে ভালো ফিল্ডিং করতে পারতেন। তবে তাদের কেউই গ্রেগরির মতো ছিলেন না। লর্ডসের একটা ম্যাচে মিড অফ এবং পয়েন্টের মাঝে বল ফেলে স্ট্রাইকিং এন্ড থেকে ব্যাটসম্যানের কল ছিল দুই রানের, কিন্তু গ্রেগের দূর্দান্ত ফিল্ডিং এ এক রান নেওয়ার আগেই ব্যাটসম্যান রান আউট।”
১৯১২ সালে গ্রেগরি যখন অবসর নেন, তখন তার ৫৮টি টেস্ট ছিল সেই আমলে সবচেয়ে বেশি টেস্ট ম্যাচ খেলার রেকর্ড।
উইলিয়াম রোডস (ইংল্যান্ড)
প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে একমাত্র বোলার হিসেবে ৪,০০০ উইকেট পাওয়ার রেকর্ড এই রোডসের। সাথে ব্যাটসম্যান হিসেবেও ৩৯,৯৬৯ রান! প্রথম শ্রেণীর তার চেয়ে বেশি রান করার কীর্তি আছে আর মাত্র ১৬ জনের। ইংলিশ এই ব্যাটসম্যানের ১ নম্বর থেকে ১১ নম্বর প্রতিটি পজিশনে ব্যাটিং করার কীর্তি রয়েছে।
ইংল্যান্ডের পক্ষে টেস্ট খেলা শুরু করেছিলেন লোয়ারর অর্ডারে ১০ নম্বরে। ধীরে ধীরে নিজেকে তুলে নিয়ে আসেন ওপেনিংয়ে। ওপেন করতে নেমে দুটো সেঞ্চুরিও আছে তার। এছাড়া বোলিংয়ে ১২৭টি উইকেটের পাশাপাশি ম্যাচে ১০ উইকেট নেবার কীর্তিও গড়েছেন।
সেই সাথে সবচেয়ে বেশি সময় আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে খেলার রেকর্ডটিও তার। ৩০ বছর ৩১৫ দিনের সেই রেকর্ডের কাছাকাছিও যেতে পারেনি পরবর্তী কোনো ক্রিকেটার। সবচেয়ে বেশি বয়সে টেস্ট খেলার রেকর্ডও রোডসের। সর্বশেষ টেস্ট খেলার দিন তার বয়স ছিল ৫২ বছর ১৬৫ দিন। ‘রেকর্ড হয় ভাঙার জন্য’- এই কথাটি যিনি বলবেন, তার কাছে রেকর্ড দুটোর কথা চাইলে শুনিয়ে দিতে পারেন।
বিনু মানকড় (ভারত)
ভারতের ক্রিকেটের প্রথম দিকের সুপারস্টার তিনি। টেস্ট খেলেছেন ৪৪টি, ১৯৪৬ থেকে ১৯৫৯ সালের মধ্যবর্তী সময়ে। ক্যারিয়ার শুরু করেছিলেন ওপেনার হিসেবে। সেখানেই খেলেছেন ২১টি টেস্ট, ক্যারিয়ারের ৫টি সেঞ্চুরিই করেছেন ওপেনিংয়ে, যার মাঝে দুটো ডাবল সেঞ্চুরির ইনিংসও ছিল।
তবে তার ১৬২টি টেস্ট উইকেট সাক্ষ্য দেয় যে তিনি বোলার হিসেবেও ভালো ছিলেন। ক্যারিয়ারে দুবার ১০ উইকেটও পেয়েছেন এক ম্যাচে। প্রথম এশিয়ান খেলোয়াড় হিসেবে একই টেস্টে শতরান আর ইনিংসে ৫ উইকেট নেবার কৃতিত্ব তার।
লর্ডসে সেঞ্চুরি করলে কিংবা ইনিংসে ৫ উইকেট পেলে অনার্স বোর্ডে নাম লেখা হয়। মানকড় সেই তিনজন বিদেশি খেলোয়াড়ের একজন যাদের কিনা ব্যাটিং এবং বোলিং দুটোতেই লর্ডসের অনার্স বোর্ডে নাম আছে। বাকি দুজন হচ্ছেন অস্ট্রেলিয়ার কিথ মিলার এবং ওয়েস্ট ইন্ডিজের স্যার গ্যারিফিল্ড সোবার্স।
এরা ছাড়াও আরো কয়েকজন ক্রিকেটার টেস্টের ১০টি বিভিন্ন পজিশনে ব্যাটিং করেছেন। যেমন- অস্ট্রেলিয়ার জ্যাক ব্ল্যাকহ্যাম (অনুপস্থিত ৪ নম্বর পজিশন), স্যামি জোন্স (অনুপস্থিত ১১ নম্বর পজিশন), হিউজ ট্র্যাম্বল (অনুপস্থিত ৫ নম্বর পজিশন), আর্মস্ট্রং (১০ নম্বর পজিশন), ইয়ান জনসন (অনুপস্থিত ৪ নম্বর পজিশন ) এবং পাকিস্তানের সাজুউদ্দিন (অনুপস্থিত ৫ নম্বর পজিশন)।
এছাড়া ওয়ানডে ক্রিকেটের কথা বিবেচনা করলে আরো কয়েকজন ক্রিকেটারের তালিকা পাওয়া যায় যারা ১০ টি বিভিন্ন পজিশনে ব্যাটিং করেছেন। যেমন- পাকিস্তানের শোয়েব মালিক (অনুপস্থিত ১১ নম্বর পজিশন), শহীদ আফ্রিদি (অনুপস্থিত ১১ নম্বর পজিশন), সাউথ আফ্রিকার ক্লুজনার (অনুপস্থিত ১১ নম্বর পজিশন) আর শ্রীলঙ্কার হাসান তিলকারত্নে (অনুপস্থিত ১১ নম্বর পজিশন)।
আনন্দের বিষয় হচ্ছে এই তালিকায় একজন বাংলাদেশী ক্রিকেটারের নামও আছে। সবার প্রিয় মোহাম্মদ রফিক ওয়ানডেতে ১০টি বিভিন্ন পজিশনে ব্যাটিং করেছেন।
শুধুমাত্র ৪ নম্বর পজিশনটাতে ব্যাটিং করা হয়নি তার। মূলত বোলার হিসেবে খেললেও ওয়ানডেতে বাংলাদেশের প্রথম জয়ের রূপকার ছিলেন ব্যাটসম্যান রফিক, যিনি কেনিয়ার বিপক্ষে সেই ম্যাচে ওপেন করতে নেমে ৭৭ রানের একটি অনবদ্য ইনিংস খেলেছিলেন।
ফিচার ইমেজ: Cricfit