দলবদলের পর প্রিমিয়ার লিগের ক্লাবগুলোর চেহারা যেমন হলো

বিশ্বের সব থেকে জনপ্রিয় ও প্রভাবশালী ফুটবল লিগ হচ্ছে প্রিমিয়ার লিগ। বর্তমান ইউরোপে যে লিগগুলো বেশি জনপ্রিয়, তার মধ্যে একদম প্রথম নামটি অবশ্যই তাদেরই থাকবে। স্পেনের লা লিগা প্রধানত দুই দলের লড়াই, ইতালির সিরি আ জুভেন্টাসের দখলে, বায়ার্ন মিউনিখ ও পিএসজিও যথাক্রমে জার্মান বুন্দেসলিগা ও ফ্রান্সের লিগ ওয়ান-এর মুকুট দখল করে রেখেছে। কিন্তু এই ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগে লড়াই হয় কমপক্ষে ৬টি ক্লাবের মধ্যে। তাই মৌসুমের শুরুতে বলে দেওয়া কোনোভাবেই সম্ভব হয় না, কে জিততে যাচ্ছে লিগের ট্রফি। আর এখানে বড় দল বা ছোট দলের কোনো তারতাম্য নেই। সম্ভাব্য শিরোপাজয়ী দলকেও তালিকার সর্বশেষে থাকা দলটিও হারিয়ে দেবার ক্ষমতা রাখে।

Image Source : ESPN

গত মৌসুমের কথা ধরা যাক। ট্রফি লড়াইয়ে লিভারপুল আর ম্যানচেস্টার সিটির লড়াই হয়েছে লিগের একদম শেষ ম্যাচ পর্যন্ত। গতবার চ্যাম্পিয়নস লিগের ফাইনালের দুটো দলও ছিল প্রিমিয়ার লিগের। রিয়াল মাদ্রিদ বা বার্সেলোনার টানা রাজত্বে যে এখন প্রিমিয়ার লিগের দলগুলোও হানা দিতে প্রস্তুত, তা বিস্তরে বোঝাতেও হবে না।

তো, এই প্রিমিয়ার লিগের দলবদল মৌসুম শেষ হয়েছে গত ৮ আগস্ট, আড়াই মাসের বিরতি দিয়ে লিগের প্রথম সপ্তাহের ম্যাচও মাঠে গড়িয়েছে। ম্যানচেস্টার সিটি, আর্সেনাল অথবা টটেনহ্যাম হটস্পারের মতো বড় ক্লাবগুলো মাঠে নেমেছিল বড় অঙ্কের অর্থ নিয়ে। তারা অপ্রয়োজনীয় খেলোয়াড় বিক্রি করে যেমন অর্থ আয় করেছে, তেমনি যেকোনো মূল্যে কিনে নিয়েছে তাদের কাঙ্ক্ষিত খেলোয়াড়কে। শুধু বড় দল কেন? প্রিমিয়ার লিগে নতুন আসা অ্যাস্টন ভিলা পর্যন্ত খরচ করেছে ১০০ মিলিয়নের বেশি অর্থ। তাই এবারের দলবদলের মৌসুম ছিল ভীষণ জাঁকজমকপূর্ণ।

তো, এই দলবদল শেষে কোন দলের শক্তিমত্তা কেমন হলো, কোন দলের স্কোয়াড গভীরতা বাড়লো, অথবা মৌসুমশেষে ফল কী হতে পারে, সেসব বিশ্লেষণের শুরু গতবারের চ্যাম্পিয়ন দল ম্যানচেস্টার সিটিকে নিয়েই শুরু করা যাক।

ম্যানচেস্টার সিটি

দলবদলের মৌসুম শুরু মানে তো পেপ গার্দিওলার দলে রেকর্ডভাঙা ট্রান্সফার। এবারও প্রায় নীরব থেকে খেলোয়াড় কিনেছে দলটি। দলে ফার্নান্দদিনহোর বয়স হয়ে গিয়েছিল। তার সেই পুরনো ধার গত মৌসুম থেকেই মিইয়ে গেছে। তাই এ মৌসুমে তার বিকল্প প্রয়োজন ছিল ম্যানসিটির। পেপ গার্দিওলাও এনেছে একদম মোক্ষম খেলোয়াড়। অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদ থেকে কেনা রদ্রি যেমন ফার্নান্দদিনহোর মোক্ষম উত্তরসূরী, তেমনই ক্লাবের ইতিহাসের সব থেকে দামি খেলোয়াড়।

Image Source : football365

এ মৌসুম শুরুতে দল ছেড়ে গেছেন ভিনসেন্ট কোম্পানি। ফাবিয়েন ডেলফকে তো সিটি বিক্রি করে দিয়েছে এভারটনের কাছে। নিকোলাস ওটামেন্ডির উপর ভরসা গার্দিওলার আগে থেকেই নেই। তাই লাপোর্ত ও স্টোনসের বদলি খেলোয়াড় প্রয়োজন ছিল সিটির। তাই তারা দলে ফিরিয়ে এনেছে অ্যাঞ্জেলিনহোকে। আর স্কোয়াডে দানিলো এমনিতেও সুযোগ পেতেন না। তাকে দিয়ে হোয়াও ক্যান্সেলোর মতো রাইটব্যাক কেনার ক্ষেত্রে ম্যানসিটি একদম চমক দেখিয়েছে।

ক্যান্সেলো আসার কারনে কাইল ওয়াকার সেন্টারব্যাকেও খেলতে পারেন। এক্ষেত্রে তিনজন ডিফেন্ডার রেখে স্কোয়াড সাজানোর সুযোগ থাকবে গার্দিওলার। আর দলের বেঞ্চ যখন অনেক দলের মূল স্কোয়াড থেকেও শক্তিশালী, তখন খেলোয়াড়দের ইনজুরি এড়াতে এবং মৌসুমজুড়ে চাঙা রাখতে গার্দিওলা খেলোয়াড় অদলবদল করে খেলাতেই পারবেন। তাই প্রিমিয়ার লিগ জয়ের ক্ষেত্রে ম্যানসিটি এবারও ফেবারিট। তবে একদম যথাযথ স্কোয়াড নিয়ে গার্দিওলা বিশেষ নজর দেবেন চ্যাম্পিয়নস লিগ জিততে।

লিভারপুল

এবার আসা যাক গতবারের চ্যাম্পিয়নস লিগ চ্যাম্পিয়ন লিভারপুলকে নিয়ে। কাড়ি কাড়ি অর্থ দিয়ে গতবার খেলোয়াড় কিনেছিল তারা। কিন্তু এবার নীরব থেকে অদ্ভুত এক দলবদল মৌসুম পার করল। সিমন ম্যাগনোলিয়া’র বদলে ওয়েস্টহ্যাম থেকে বিনামূল্যে এসেছেন স্প্যানিশ গোলরক্ষক আদ্রিয়ান। আর এসেছেন ১৬ বছর বয়সী ডিফেন্ডার সেপ ভ্যান ডেন বার্গ ও ১৭ বছর বয়সী উইংগার হার্ভি এলিয়ট, যাদের কারো মূল দলে খেলার সম্ভাবনা শূন্য। অতএব, গতবারের চ্যাম্পিয়নস লিগ জেতা দলের উপরই ভরসা রাখতে যাচ্ছেন ক্লপ।

Image Source : CNN International

তবে গতবার প্রায় পুরো মৌসুমজুড়ে দলের বাইরে ছিলেন অ্যাডাম লালানা ও অ্যালেক্স অক্সলেড-চ্যাম্বারলেইন। এবার তারা প্রথম থেকে দলের সাথে থাকছেন। তাই লালানা ও চ্যাম্বারলিন যেমন ফাবিনহো ও ভাইনালদুমদের সহায়তা করবেন। তেমনই জেরদান শাকিরি, ডিভক অরিগি বা চ্যাম্বারলেইন লিগের ছোট ম্যাচগুলো খেলে চাপ কমাতে পারবেন সালাহ, ফিরমিনো ও মানেদের।

কিন্তু বেঞ্চে লালানা, অরিগি বা শাকিরি থাকলেও তারা সালাহ বা মানেদের মতো উচ্চ পর্যায়ের খেলোয়াড় নন। সেখানে প্রিমিয়ার লিগে তাদের প্রতিপক্ষ ম্যানচেস্টার সিটির বেঞ্চ দারুণ শক্তিশালী। সেক্ষেত্রে কি লিভারপুর পিছিয়ে যাবে? এক স্কোয়াড দিয়ে প্রায় টানা খেলিয়েছেন ক্লপ। এবার যদি সেটা না হয়? ইনজুরি যদি বাঁধা হয়ে দাঁড়ায়, তাহলে কীভাবে সমাধান করবেন তিনি? দলবদলের মৌসুমে সজাগ না থাকার পর লিভারপুলকে নিয়ে এসব প্রশ্ন তৈরি হয়েই যায়। তাই এ মৌসুমে লিভারপুলের ভাগ্যের সাহায্য বড় প্রয়োজন। নাহলে লিগ ও চ্যাম্পিয়নস লিগের পরিণতি ভয়াবহ হতে পারে।

টটেনহ্যাম হটস্পার

গতবারের চ্যাম্পিয়নস লিগের ফাইনাল খেলা ক্লাব টটেনহ্যাম বিগত অনেক মৌসুম যাবৎই দলবদলের সময়ে দর্শকের ভূমিকায় থাকতো। কিন্তু এবার তারা একদম ঘুরে দাঁড়িয়েছে। মরিসিও পচেত্তিনোও পেয়েছেন মনমতো খেলোয়াড়। গত জানুয়ারিতে মুসা দেমবেলের দল ছাড়ার পর একজন হোল্ডিং মিডফিল্ডারের প্রয়োজন ছিল স্পার্সের। এরিক ডায়ার, হ্যারি উইংকস বা ভিক্টর ওয়েনেমাদের ব্যবহার করে সেভাবে সুফল তারা পাচ্ছিল না। কারণ, এ পজিশনে পচেত্তিনোর দরকার শারিরীকভাবে শক্তিশালি ও ড্রিবলে পারদর্শী একজন ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডারকে। তাই এই পজিশনের ঘাটতি পুষিয়ে দিতে স্পার্স এনেছে ফরাসি মিডফিল্ডার টাঙ্গুয়ে এনদমবেলেকে, যিনি পচেত্তিনোর ট্যাকটিক্সে ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার পজিশনে একদম মিলেমিশে যাবেন।

Image Source : Getty Image

দলবদলের একদম শেষ দিনে স্পার্স কিনেছে জিওভানি লো সেলসো ও রায়ান সেসিনিয়োন। লো সেলসো আক্রমনাত্মক বিভাগের খেলোয়াড়দের সাথে যুক্ত হবেন। ডেলে আলি, এরিকসেনদের সাথে জায়গা ভাগাভাগি করে নেবেন তিনি। আর সেসিনিয়োন একাধারে উইঙ্গার ও লেফটব্যাক। যেহেতু পচেত্তিনোর ট্যাকটিক্সে উইঙ্গারের তেমন দরকার হয় না, তাই সেসিনিয়োন দলের বিকল্প লেফটব্যাক হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন।

দলে কেইন, আলি, এরিকসেন ও সনদের মতো প্রমাণিত খেলোয়াড়, রক্ষণে ডেভিনসন সানচেজ, ভার্তোনে ও অল্ডারভেইরেল্ড, এবং সাথে যুক্ত হলেন এনদমবেলে ও লো সেলসোর মতো খেলোয়াড়েরা। পর্যাপ্ত খেলোয়াড় না থাকার পরও পচেত্তিনো এই স্কোয়াড নিয়ে গতবার সাফল্য পেয়েছিলেন, স্পার্সকে তুলেছিলেন চ্যাম্পিয়নস লিগ ফাইনালে। এবার পূর্ণাঙ্গ স্কোয়াড নিয়ে পচেত্তিনো অবশ্যই নিজেকে উজাড় করে দেবেন। চ্যাম্পিয়নস লিগ তো আছেই, এতদিন স্পার্স সেরা চারে থাকার জন্য খেলে আসলেও এবার তারা লিগ শিরোপা জয়ের জন্যই লড়বে। লিগে প্রথম ম্যাচে বড় ব্যবধানের জয় তারই ইঙ্গিত দেয়।

আর্সেনাল

প্রিমিয়ার লিগে এবার সব থেকে বড় দাঁও মেরেছে গার্নাস। প্রত্যেক মৌসুমে ম্যান সিটি বা লিভারপুলের মতো ক্লাবরা বড় বড় ট্রান্সফার করতো, তারা থাকতো দর্শক হয়ে। কিন্তু তারাই এবার করেছে বড় অংক, কিন্তু পয়সা উসুলের মতো ট্রান্সফার।

গানার্সদের আক্রমণে লাকাজেট এবং অবামেয়াং তো ছিলেনই, এবার নতুন সংযোজন নিকোলাস পেপে। পেপে, লাকাজেট ও অবামেয়াংদের নিয়ে এবারের আর্সেনালের আক্রমণভাগ ত্রাস ছড়াবে পুরো মৌসুমজুড়েই। সব থেকে বেশি পরিবর্তন অবশ্য এসেছে রক্ষণভাগে। সেন্টারব্যাক থেকে লেফটব্যাক, যেখানে তাদের ঘাটতি ছিল, সব পূরণ করেছে তারা। প্রথমে ডিফেন্ডার উইলিয়াম সালিবাকে কিনেছে গানার্স বাহিনী। সালিবা বর্তমান ফুটবলের অন্যতম সেরা তরুণ তুর্কি। তবে সালিবা আর্সেনালে যোগ দেবেন পরের মৌসুমে। তাই এবারের মতো কাজ চালানোর জন্য চেলসি থেকে তারা কিনেছে ডেভিড লুইজকে। লেফটব্যাকেও এসেছেন তরুণ এক প্রতিভাবান কিয়েরান টিয়ের্নি। একের পর এক খেলোয়াড় দলে যেমন টেনেছে আর্সেনাল, পাশাপাশি ভালো দামে কয়েকজনকে বিক্রিও করেছে। আর যাদের কিনেছে, তাদের মূল্য পরিশোধের ব্যবস্থাও করেছে চমৎকার পদ্ধতিতে।

নিকোলাস পেপে; Image Source : FourFourTwo

তাদের আক্রমণভাগ এবার বিশ্বসেরা। অ্যারন রামসি চলে গেলেও মধ্যমাঠে নতুন সংযোজন দানি সেবায়েস আছেন মধ্যমাঠ নিয়ন্ত্রণ করতে। আর লুইস ও সক্রাটিসদের নিয়ে আশা করা যাচ্ছে, এবার গানার্সদের রক্ষণে শ্রী ফেরাতে সক্ষম হবেন। তবে রক্ষণ সমস্যা একদম সমাধান হবে বলাটা ঠিক হবে না। উইলিয়াম সালিবা এবার আসছেন না, সেখানে ডেভিড লুইস রক্ষণাত্মক হলেও মাঝেমাঝে ছেলেমানুষি ভুল করে বসেন। তবে আর যাই হোক, রক্ষণের রূপ বিগত বছরগুলো থেকে ভালো থাকবে, এই আশা করাই যায়।

আর্সেনাল এবার খেলবে ইউরোপা লিগ। চাহিদামতো একটি দল গঠন করার পর গানার্স সমর্থকেরা ইউরোপা ট্রফির আশা করতেই পারেন। কিন্তু প্রিমিয়ার লিগে সেরা ছয় দলের তুলনায় স্কোয়াডের শক্তিমত্তা বা খেলোয়াড়দের ফর্মের দিক থেকে কিছুটা পিছিয়ে তারা। কিন্তু বাজেভাবে পা হড়কানোর সুযোগ একদমই নেই।

চেলসি

নিষেধাজ্ঞার খড়্গে পড়ে চেলসি এবার কোনো খেলোয়াড় কিনতে পারেনি। নতুন কোচ ল্যাম্পার্ড কিছু করতে পারেননি, পারেনি ক্লাবটির বোর্ডও। ডর্টমুন্ড থেকে ক্রিশ্চিয়ান পুলিসিককে আগেই কিনে রেখেছিল ব্লুজরা। আর মাতেও কোভাসিচকে তারা কিনেছে ধারের চুক্তি শেষ হবার পর। এর বাইরে তারা নীরব হয়েই ছিল পুরো সময়জুড়ে। ক্লাবটি জানতো, নিষেধাজ্ঞার জন্য কোনো খেলোয়াড় কিনতে পারবে না। সেখানে তারা প্রয়োজনীয় খেলোয়াড়ও ধরে রাখতে পারেনি, হারিয়েছে দলের সেরা তারকাকে। পাশাপাশি মূল একাদশের রক্ষণদের একজনকেও।

তাই চেলসি নামবে অপরীক্ষিত, ফুরিয়ে যাওয়া বেশ কিছু খেলোয়াড় ও নতুন কোচকে নিয়ে। স্ট্রাইকার বলতে আছেন অলিভিয়ে জিরু ও লোন থেকে ফেরা ট্যামি আব্রাহাম। উইঙ্গার হিসেবে বয়সের জন্য গতি কমে যাওয়া বর্ষীয়ান খেলোয়াড় উইলিয়ান ও পেদ্রো। রক্ষণে রুডিগারের পাশে খেলবেন আনকোরা ক্রিটেনসেন ও কার্ট জুমা, যারা বিগত মৌসুমগুলোতো কখনও দলে নিয়মিত হতে পারেননি।

Image Source : AS English – Diario AS

ফ্রাঙ্ক ল্যাম্পার্ড তার পুরনো দলের দায়িত্ব নিয়ে লিগ শুরু করেছেন ৪ গোলের তিক্ত স্বাদ নিয়ে। প্রথম ম্যাচের হার থেকে শিক্ষা নিয়ে কিছুটা লড়াই করেছিলেন প্রধান খেলোয়াড় নিয়ে না নামা লিভারপুলের বিপক্ষে উয়েফা সুপার কাপের ফাইনালে। কিন্তু সেখানেও হারের তিক্ত স্বাদ পেতে হয়েছে তাকে। এভাবে শুরুর পর হয়তো মৌসুম শেষ হবেও তিক্ততায়। এই দলে যদি কেউ কিছু করতে পারেন, তা হলেন ক্রিশ্চিয়ান পুলিসিক ও ম্যাসন মাউন্ট। রস বাকরেলি ও কোভাসিচ মধ্যমাঠের হাল ধরলে হয়তো পরবর্তী মৌসুমে ইউরোপায় খেলতে পারবে ব্লুজরা। শেষ চারে থেকে মৌসুম শেষ করতে চাইলে চমকপ্রদ কিছু করে দেখাতে হবে ল্যাম্পার্ডের শিষ্যদের। আর চ্যাম্পিয়নস লিগ নিয়ে কোনো মন্তব্য না করাই শ্রেয়।

ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড

বেশ অনেক বছর পর রেড ডেভিল’রা খেলোয়াড় কিনতে ১২৫ মিলিয়ন ইউরোর মতো বড় অঙ্কের অর্থ খরচ করলো। কিন্তু সেই অর্থ তারা যে সব খেলোয়াড়ের পেছনে ঢাললো, তাতে তাদের ভাগ্য ফিরবে বলে মনে হয় না। রক্ষণ সমস্যা ছিল দীর্ঘ সময় ধরে। ডেভিড ময়েস থেকে হোসে মরিনহো, বা বর্তমানে ওলে গানার সলশায়েরের আমলে কোনো সময়ই ম্যানইউ-এর রক্ষণ দৃঢ় ছিল না। তাই ভরসাযোগ্য ও পরীক্ষিত একজন ডিফেন্ডারকে দরকার ছিল তাদের। তাই রেকর্ড পরিমাণ অর্থের বিনিময়ে তারা দলে ভিডিয়েছে হ্যারি ম্যাগুয়ের ও অ্যারন ওয়ান বিসাকাকে। হ্যারি ম্যাগুয়ের এখনও বিশ্বসেরা ফুটবলারের কাতারে নন, ম্যানইউ-এর রক্ষনে যে পরীক্ষিত একজনকে লাগবে, তাও নন। আর অ্যারন বিসাকা আনকোরা কিন্তু সম্ভাবনাময়ী খেলোয়াড়। তবে স্মলিং বা জোনসদের দিয়ে যে বেহুলার বাসর তৈরি করতো তারা, সে তুলনায় বিসাকা ও ম্যাগুয়েরকে দিয়ে যথেষ্ট শক্তিশালী রক্ষণ তৈরি করতে পারবেন সলশায়ের।

Image Source : talkSPORTS

দল ছেড়ে গেছেন অ্যান্দ্রে হেরেরা। পল পগবা শেষ পর্যন্ত ওল্ড ট্রাফোর্ডে থাকবেন কি না, তা সময় বলে দেবে। গত মৌসুমে দলে আসা ফ্রেডও আস্থা অর্জন করতে পারেননি। তাই লিনগার্ড, ম্যাতিচ, ফ্রেড ও বর্ষীয়ান মিডফিল্ডার হুয়ান মাতা কতটা পার্থক্য গড়ে দিতে পারবেন তা নিয়ে ফুটবলবোদ্ধারা সন্দিহান। রোমেলু লুকাকুও দল ছেড়ে গেছেন। সেখানে স্ট্রাইকার পজিশনে নতুন কেউ আসেনি। তাই স্ট্রাইকার পজিশনে মার্সিয়েল বা রাশফোর্ড কতটা উপযুক্ত হবেন তারও কোনো নিশ্চয়তা নেই। নতুন সাইনিং ড্যানিয়েল জেমস একদমই আনকোরা তরুণ। তাকে নিয়ে মন্তব্য করার সময় এখনও আসেনি। আর কোপা আমেরিকায় দুর্দান্ত খেলা সানচেজ এখনও খেলার জন্য ফিট না। যদিও ওলে গানার সলশায়েরের তাকে নিয়ে কোন পরিকল্পনা আছে কী না তা নিয়ে এখনও ধোঁয়াশা চলছে। তাই আক্রমণে আর বাকি থাকেন অল রেড’দের অ্যাকাডেমি একজন, ম্যাসন গ্রিনউডের বয়স তাও ১৭ বছর। এক্ষেত্রে, রক্ষণে রূপ ফিরলেও আক্রমণ নিয়ে মৌসুমজুড়ে রেড ডেভিলদের ভুগতে হতে পারে।

ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডও চেলসির মত এবার চ্যাম্পিয়নস লিগে খেলবে না। ওলে গানার সলশায়েরর শিষ্যরা গত মৌসুম যেভাবে শেষ করেছে ও নতুন মৌসুম যেভাবে শুরু করেছে তাতে ইউরোপার জন্য একটু কৌশলী হলেই সফলতা ধরা দিতে পারে। আর লিগে সেরা চারে থাকাই তাদের জন্য কষ্টকর হয়ে যাবে। সেখানে পরবর্তী মৌসুমে চ্যাম্পিয়নস লিগ নিশ্চিত করতে বেশ ভালো লড়াই করতে হবে তাদের। তবে এ ভাবনা আকাশ কুসুমও নয়। রক্ষণ কিছুটা দৃঢ হবার পাশাপাশি যদি মার্সিয়েল ও রাশফোর্ড নিয়মিত গোল এনে দিতে পারেন এবং শেষ পর্যন্ত পগবা থেকে যান, তাহলে ম্যানইউ নিয়ে আশাবাদী হওয়া যেতেই পারে।

এতক্ষণ বলা হচ্ছিল প্রিমিয়ার লিগের প্রথম দিকের ক্লাবগুলোর অবস্থা ও ভবিষ্যৎ নিয়ে, যে ক্লাবগুলো সবসময় চ্যাম্পিয়নস লিগে অংশগ্রহণ ও লিগের তালিকায় শেষ চারে থাকার জন্য লড়াই করে। এরপরের ক্লাবগুলোর মূল লড়াই সেরা দশে শেষ করা ও ইউরোপা লিগের মূলমঞ্চ নিশ্চিত করা।

লেস্টার সিটি

প্রিমিয়ার লিগে রূপকথা রচনা করা লেস্টার সিটি পরবর্তীতে বিশেষ কিছু করতে পারেনি। দল ছেড়ে গেছেন রিয়াদ মাহরেজ, এনগোলো কান্তে ও হ্যারি ম্যাগুয়ের। তবে এবার ম্যাগুয়েরকে বড় অংকে বিক্রি করে ভালো অর্থ আদায় করেছে তারা, সে অর্থ ব্যবহারও করেছে সঠিকভাবে।

মধ্যমাঠে তাদের সংযোজন বক্স-টু-বক্স মিডফিল্ডার ইউরি তিয়েলেমান্স। ম্যাডিনসন, এনদিদির পাশে খেলে তিনি আক্রমণে পার্থক্য গড়ে দিতে পারেন। ম্যাগুয়েরের মত ডিফেন্ডার চলে যাবার পরও তারা ডিফেন্ডার কেনার কথা ভাবেনি। তবে আইজো পেরেজ আক্রমনের ধার বাড়াতে সক্ষম। পেরেজ জুটি বাধঁবেন ভার্ডির সাথে, আর তাদের বিকল্প খেলোয়াড় হার্ভি বার্নেস।

Image Source : Getty Image

তবে রক্ষণ দুর্বল হয়ে যাওয়া এ দল নিয়ে ব্রেন্ডন রজার্স মনে হয় না ইউরোপা নিশ্চিত করতে পারবেন। মধ্যমসারির ক্লাব হবার কারণে তাদের চাওয়া-পাওয়াও অল্প। তাই সেরা দশে শেষ করতে পারা তাদের জন্য বেশ ভালো একটি মৌসুম হবে।

এভারটন

বেশ কয়েক মৌসুম ধরে এভারটন চেষ্টা করে যাচ্ছে তাদের ক্লাবকে এক ধাপ এগিয়ে নিতে। বেশ কয়েকটি দামি ট্রান্সফার ও কোচ বদল করলেও এভারটন তাদের চেষ্টাকে সফল করতে পারেনি। তবে বিগত বছরগুলো তুলনায় এবারও তারা সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছে। আর এবারের কেনা খেলোয়াড়গুলো ব্যর্থ হবার সম্ভাবনা বেশ কম।

রক্ষণে গত বছর তারা এনেছিল মিনা ও দিনিয়েকে। বার্সেলোনা তাদের বিক্রি করে দিয়েছিল স্বল্পমূল্যে, যার দরুণ মিনা ও দিনিয়েকে যোগ করে কোলমান ও কিনসহ তাদের রক্ষণ বেশ পোক্ত হয়েছে এবার। আর কোলমানের বিকল্পও এবার দলে যুক্ত হয়েছে। জিব্রিল সিদিবে বিশ্বমানের খেলোয়াড় হবার সুযোগ থাকলেও ইনজুরির কবলে পড়ে তার ক্যারিয়ারের কোনো অগ্রগতি নেই। এবারই মোনাকো ছেড়ে প্রথমবার ধারে ইংল্যান্ডের ক্লাবে আসলেন তিনি।

মইসে কিন; Image Source : AS English – Diario AS

লোনে থাকা আন্দ্রে গোমেজকে মৌসুমশেষে কিনে নেবার সুযোগ ছিল। তারা সে সুযোগ ব্যবহার করছে। স্কোয়াড গভীরতা বাড়ানোর জন্য আরও এসেছেন ফাবিয়ান ডেলফ, অ্যালেক্স ইয়োবি ও জানে ফিলিপে গ্যাবামিন। স্ট্রাইকার পজিশনে দীর্ঘদিন ধরে ধুঁকছিল তারা। সেখানে জুভেন্টাস থেকে নিয়ে এসেছে ইতালিয়ান তরুণ স্ট্রাইকার মইসে কিনকে, যার বিশ্বমঞ্চে সেরা হবার মতো যথেষ্ট প্রতিভা আছে।

এভারটনের কোচ মার্কো সিলভার হাতে এখন একটি সম্পূর্ণ দল। দলে গোল করা থেকে দল ঠেকানোর মতো খেলোয়াড়ের অভাব নেই। তবে একটা প্রবাদ আছে, ‘মোল্লার দৌড় মসজিদ পর্যন্ত’। সেখানে এখন পর্যন্ত এভারটনের দৌঁড়ও তালিকার পঞ্চম স্থান অব্দি। তবে এবার এই রীতি পাল্টানোর একটা সুযোগ আছে তাদের সামনে। কিন্তু যেখানে ম্যানসিটি, টটেনহ্যাম বা আর্সেনালের মতো তারকা খেলোয়াড়ে ভর্তি ক্লাবগুলো তাদের প্রতিপক্ষ, সেখানে সম্ভাবনা আগেই কিছুটা নড়বড়ে হয়ে যায়।

উলভারহ্যাম্পটন ওয়ান্ডার্স

গত মৌসুমে প্রিমিয়ার লিগে খেলতে এসে চমক দেখিয়েছিল উলভারহ্যাম্পারটন। এ দলের কাছে গতবার হেরেছিল ম্যানইউ, চেলসি বা স্পার্সের মতো বড় দলগুলো। এই মৌসুমেও তারা তাদের সেরা খেলোয়াড়গুলোকে ধরে রাখতে পেরেছে। আক্রমণের অবিচ্ছেদ্য অংশ ডিয়েগো জোটা, রুবেন নেভেস ও ম্যাট ডোহার্টিরা এবারও খেলবেন উলফদের হয়ে। লিয়েন্ডার ডেনডোনকার ও রাউল গিমেনেজকেও লোন চুক্তি শেষে কিনে ফেলেছে তারা। এছাড়াও মিলান থেকে এসেছে প্যাট্রিক কুত্রোনে ও রিয়াল মাদ্রিদ থেকে ধালে জেসুস ভালেহো।

Image Source : Getty Image

তাই নুনো এসপিরিতো সান্তোর শিষ্যরা যদি গত মৌসুমের মতোই চমকপ্রদ খেলা উপহার দিতে পারে, তবে এ মৌসুম শেষেও তারা ইউরোপা নিশ্চিত করতে পারবে। তবে অবিশ্বাস্য কিছু করলেও সেরা চারে ঢোকার সম্ভাবনা কম।

এবার প্রিমিয়ার লিগে প্রথমবার খেলতে আসা অ্যাস্টন ভিলা তাদের দল গোছাতে খরচ করেছে ১৪৩ মিলিয়ন ইউরো। টটেনহ্যামের বিপক্ষে হার দিয়ে লিগ শুরু করলেও প্রশংসনীয় খেলা উপহার দিয়েছে তারা। ওয়েস্টহ্যাম সেবাস্টিয়ান হলার ও পাবলো ফোর্নালাসকে কিনতে খরচ করেছে প্রায় ৭০ মিলিয়নের মতো অর্থ। হলার গত মৌসুমে বুন্দেসলিগায় ২৯ ম্যাচে করেছিলেন ১৫ গোল ও ৯ অ্যাসিস্ট। ইউরোপাতেও প্রায় একই ফর্ম। তাই হ্যামাররা বিরাট অঙ্ক খরচ করেছে এই ফরাসিকে দলে নেবার জন্য। হয়তো হলারও গত মৌসুমের আগুনে ফর্ম ধরে রাখতে পারবেন। নিউক্যাসল ইউনাইটেড তাদের সেরা খেলোয়াড়গুলো হারিয়েও প্রায় ৪০ মিলিয়ন খরচ করেছে জোয়েলিন্টনের মত স্ট্রাইকারের পেছনে। এছাড়াও সাউদাম্পটন থেকে ওয়াটফোর্ডের মত ক্লাবগুলোও তাদের সামর্থ্যমতো খরচ করেছে দল গোছাতে।

Image Source : talkSPORT

কেন প্রিমিয়ার লিগ তুলনামূলক কঠিন? এর উত্তর লিগের নিচের সারির দলগুলোকে দিয়ে উদাহরণ দেওয়া যাক। প্রথমত, অন্য সকল লিগের ক্ষেত্রে নামকরা দলগুলো বাদে নিচের দিকের দলগুলো তেমন সমস্যা করে না। কিন্তু প্রিমিয়ার লিগের কথা ভিন্ন, নিউক্যাসল ইউনাইটেড বা সাউদাম্পটনের ঘরের মাঠ থেকে জয় নিয়ে ফেরা বেশ কষ্টকর। তাই প্রথমদিকের বড় দলগুলো নিজেদের মাঠে জয় গেলেও অ্যাওয়ে লেগে পয়েন্ট হারিয়ে আসে। ফলে লিগের লড়াই আরও জমে যায়। ফলে ইচ্ছা করলেই সম্পূর্ণ দ্বিতীয় একাদশ নামানো সম্ভব হয় না। বিপরীতে ডমেস্টিক লিগ অথবা চ্যাম্পিয়নস লিগ তো আছেই। লিগে এমন চাপ সাথে বাকি ম্যাচগুলো খেলতে খেলোয়াড়দের ফর্ম হারানো বা ইনজুরির সমস্যা তো আছেই। এজন্য প্রিমিয়ার লিগের দলগুলো প্রধান একাদশ ছাড়াও বেঞ্চও শক্তিশালী রাখতে হয়, যে কারণে এবার ম্যানসিটি, টটেনহ্যাম ও লিভারপুল বেশি এগিয়ে থাকবে।

প্রিমিয়ার লিগ সবসময়ই অন্য সকল লিগের থেকে ব্যতিক্রম। এখানে তালিকার শেষের দিকে থাকা দলটিও বড় কোনো দলকে হারিয়ে দেবার ক্ষমতা রাখে, আবার তারাই হুট করে ঘটিয়ে ফেলে বড় দলবদল। অর্থের ঝনঝনানিও এ লিগে খুব বেশি। তাই নামে বড় বা ছোট ক্লাব হলেও মাঠের পারফর্মেন্সে ভিন্ন কথা বলে। আর এবার ৪ থেকে ৫টি ক্লাব প্রয়োজনীয় খেলোয়াড় কিনে হয়ে উঠেছে আরও বেশি শক্তিশালী। তাই প্রিমিয়ার লিগে লড়াই তো হাড্ডাহাড্ডি হবেই, দলগুলো শাসন করবে চ্যাম্পিয়নস লিগ বা ইউরোপা লিগেও। হয়তো দেখা যেতে পারে, মৌসুমশেষে আবারও হচ্ছে চ্যাম্পিয়নস লিগে ‘অল-ইংলিশ’ ফাইনাল, যেমনটা হয়েছে গতবার।

This article is in Bangla language. It is preview of English Premier League teams after closing the transfer window.

Feature Image Credit: OLI SCARFF/AFP/Getty Images

Related Articles

Exit mobile version