২০০৮ সালের কথা। বাংলাদেশ তখন শ্রীলঙ্কা সফরের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। শ্রীলঙ্কা সফরে তখন মুত্তিয়া মুরালিধরনের পাশাপাশি নতুন এক চ্যালেঞ্জ যোগ হয়েছেন লাসিথ মালিঙ্গা। তার ভয়ে দুনিয়া তখন কম্পমান। একদিন অনুশীলন দেখতে গেলে আফতাব আহমেদ মজা করে বললেন, “এবার আর আমাদের শ্রীলঙ্কা সফরে ভয় নেই। আমাদের নেটেই এক মালিঙ্গা আছে।”
পাশ থেকে আশরাফুল জানালেন, নেটে ঠিক মালিঙ্গার মতো যে বোলারকে পাওয়া গেছে, তিনি সেদিন আফতাবকে আহতও করেছেন। একটু আগ্রহ হলো, কে এই মালিঙ্গা? বোলিং কোচ সারোয়ার ইমরানকে জিজ্ঞেস করতে দেখিয়ে দিলেন, “ওই যে ছেলেটা। বাড়ি বাগেরহাটে।”
আগ্রহটা আরেকটু বাড়লো। নেটে দেখা গেলো আসলেই মালিঙ্গার মতো সিলিং অ্যাকশন। একটু কথা বলার জন্য ডেকে নিলাম। লজ্জায় কথা প্রায় বলতেই পারে না। জিজ্ঞেস করলাম, জীবনের লক্ষ্য কী? মাথা নিচু করে বললো, “শুনেছি আন্ডার নাইনটিনে চান্স পাবো। সেটা হলে জাতীয় দলে খেলতে চাই। বাংলাদেশকে ম্যাচ জেতাতে চাই।” হ্যাঁ, সেদিনের সেই স্বপ্নটা অনেকবার পূরণ করেছেন সেদিনের সেই‘মালিঙ্গা’, আজকের রুবেল হোসেন।
বাংলাদেশকে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে সিরিজ জেতানোর অন্যতম নায়ক, বাংলাদেশকে বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালে তোলা বোলার রুবেল হোসেন, জাতীয় দলের হয়ে অবিশ্বাস্য অনেক ওভার করা রুবেল হোসেন। কিন্তু সেই রুবেল হোসেন এখন আলোচনায় ভারতের বিপক্ষে নিদাহাস ট্রফির ফাইনাল হারানো এক ওভার বল করার জন্য। শেষ দুই ওভারে ভারতের জয়ের জন্য দরকার ছিলো ৩৪ রান। সেখান থেকে ১৯তম ওভারে রুবেল একাই খরচ করে ফেলেছিলেন ২২ রান। আর এই ওভারটার কারণেই ম্যাচটা হাতছাড়া হয়ে গেছে।
রুবেলের এই ওভার নিয়ে আলোচনা-সমালোচনার শেষ নেই। নিজে এতদিন চুপ করে ছিলেন। খেলা শেষেই ফেসবুকে একটা স্ট্যাটাস দিয়ে ক্ষমা চেয়েছিলেন জাতির কাছে। তারপর থেকে চুপ করে থাকা রুবেল অবশেষে নীরবতা ভাঙলেন। বললেন, এখনো নিজে বিশ্বাস করতে পারেন না এই ওভারটার কথা। রুবেল হোসেন ভরসা করার মতোই বোলার। সেদিনও প্রথম ৩ ওভারে মাত্র ১৩ রান খরচ করেছিলেন। তাই তার ওপর ভরসা রেখেছিলেন সাকিব আল হাসান। কিন্তু ভরসাটার সম্মান রাখতে না পারায় রুবেলেই কষ্টটা সবচেয়ে বেশি পেয়েছেন-
“আমার ওপর সবাই ভরসা রেখেছিল। সেদিন আগের তিন ওভার ভালো বল করেছিলাম। আমার নিজেরও বিশ্বাস ছিল যে, একটা ভালো ওভার করবো। চেষ্টাও করেছিলাম। কিন্তু পারলাম না। সেই ২০০৯ সালে একটা ম্যাচ হারিয়েছিলাম। আবার একটা ম্যাচ হারালাম। এই দুঃখ আমার যাবে না।”
এই কষ্টের যাত্রায় রুবেল অবশ্য অনেককে পাশে পেয়েছেন। তার সতীর্থরা বুক আগলে পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন। সাকিব আল হাসান বলেছেন, তার এখনো রুবেলের ওপর আগের মতোই বিশ্বাস আছে। যদি আবারো কোনো ম্যাচে এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়, সাকিব ওই রুবেলকেই বল দেবেন। রুবেলের পাশে দাঁড়িয়েছেন পেস বোলারদের কিংবদন্তী ব্রেট লি স্বয়ং। রুবেল ওই ম্যাচের পর টুইটার ও ফেসবুকে লিখেছিলেন,
“আমি জানি এর পুরোটাই আমার ভুলে হয়েছে। সত্যি বলতে কখনো ভাবিনি আমার কারণে জয়ের এত কাছে এসেও বাংলাদেশ দল ম্যাচ থেকে এভাবে ছিটকে যাবে। এজন্য আমি দেশবাসীর কাছে ক্ষমা চাইছি। দয়া করে সবাই আমাকে ক্ষমা করে দেবেন।”
এই টুইটের জবাবে ব্রেট লি লিখেন,
“রুবেল মাথাটা উঁচু রাখো। তুমি তোমার সেরাটা দিয়ে চেষ্টা করেছ। আমি নিশ্চিত, তোমার দেশের মানুষ তোমাকে নিয়ে গর্বিত।”
এরপর ব্রেট লি ব্যাখ্যা করে এক সাক্ষাতকারে বলেছেন, এই টুর্নামেন্টে তার দেখা সেরা বোলার রুবেল হোসেনই, “রুবেলই খুব সম্ভবত এই প্রতিযোগিতার একমাত্র বোলার, যে বলের সিম সোজা রেখে বোলিং করেছে। স্বল্প রানআপে দারুণ দারুণ সব ইয়র্কার দিয়েছে।”
ব্রেট লির এই পাশে দাঁড়ানোটা রুবেলকে মুগ্ধ করেছে। এত বড় একজন বোলারের কাছ থেকে এই সমর্থন পেয়ে একটু হলেও সান্ত্বনা পেয়েছেন। বলছিলেন,
“তার মতো একজন কিংবদন্তী এভাবে পাশে এসে দাঁড়িয়েছে, এটা আমার বড় পাওয়া। তিনি আমার প্রশংসা করেছেন, সান্ত্বনা দিয়েছেন; এজন্য আমি খুব খুশি হয়েছি। ম্যাচের কষ্ট তো ভোলা যাবে না। তবে একটু হলেও ভালো লেগেছে। বিশেষ করে তিনি আমার ইয়র্কার নিয়ে প্রশংসা করায় খুশি হয়েছি।”
ইয়র্কার নিয়ে প্রশংসা না করে উপায় নেই। ক্যারিয়ারের একটা বড় সময় জুড়ে রুবেল ইয়র্কার দেওয়ায় দারুণ পারদর্শী হয়ে উঠেছেন। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ২০১৫ বিশ্বকাপের সেই ম্যাচেও বাংলাদেশের জয় এসেছিল রুবেলের দুটি ইয়র্কারের হাত ধরে। এবারও ফাইনালে পরিকল্পনাটা ছিল ইয়র্কারেই। ইয়র্কারের মাধ্যমে দিনেশ কার্তিকদের ব্যস্ত রাখা। কিন্তু পরিকল্পনাটা ঠিকমতো কাজে দিল না। পরিকল্পনা নিয়ে রুবেল বলছিলেন, “প্রথম থেকেই পরিকল্পনা ছিল ইয়র্কার লেন্থে বল করবো। প্রথম বলটা তাই করতে গিয়ে লো ফুলটস হয়ে গেল। ওটাকে ছক্কা হওয়ার পর সব এলোমেলো হয়ে গেছে। কার্তিক ভালো বলেও মেরেছে।”
রুবেলের জীবনের গল্পটাই এমন। সবসময় একটু উত্থান, একটু পতন। অল্পের জন্য মিস হয়ে যাওয়া কিংবা হঠাৎ করে সুযোগ পাওয়া। বাগেরহাটের কিশোর রুবেল হোসেন ছিলেন একজন জোরে ছক্কা মারতে পারা ব্যাটসম্যান ও জোরে বল করতে পারা বোলার। নানা জায়গায় ক্রিকেট খেলে বেড়াতেন। ইচ্ছে ছিল গ্রামীণফোন পেসার হান্টে বাগেরহাট থেকে পরীক্ষা দেবেন। কিন্তু দিন-তারিখ না জানায় সেটা মিস হয়ে গেল। পরে সাতক্ষীরা গিয়ে পরীক্ষা দিয়ে হলেন দেশের সবচেয়ে দ্রুতগতির বোলার।
সেখান থেকে পড়লেন কোচ সারোয়ার ইমরানের চোখে। তারই সুপারিশে অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপ খেললেন। সুযোগ পেয়ে গেলেন জাতীয় দলে। শ্রীলঙ্কা ও জিম্বাবুয়েকে নিয়ে আয়োজিত ত্রিদেশীয় টুর্নামেন্টে নিজের প্রথম ম্যাচেই নিয়েছিলেন ৪ উইকেট। পরের ম্যাচটাই ছিল ফাইনাল। আর সেখানেই মুরালিধরন ব্যাট হাতে এই রুবেল হোসেনকে পিটিয়ে বের করে নিলেন ম্যাচ। সেই ম্যাচটার দুঃখ আজও ভুলতে পারেন না রুবেল। বলা ভালো, লোকেরা তাকে ভুলতে দেয় না,
“লোকজন ভালোটা খুব একটা মনে রাখে না। ইংল্যান্ড, নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে কী করেছি, সেটা অনেকেই ভুলে গেছে। কিন্তু শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে সেই ম্যাচটা ভুলতে পারি না। সবসময় ভাবি, ওই ম্যাচটার সান্ত্বনা কীভাবে পাওয়া যায়। সেজন্য আরেকটা ম্যাচ হলেও জেতাতে হবে দলকে। কিন্তু এর মধ্যে আরেকটা ম্যাচ দল হেরে গেল আমার কারণে!”
রুবেলের অবশ্য বিশ্বাস ছিল, এদিনও পারবেন। অন্তত তেমনটাই চলছিল সময়টা। এই তো ঢাকায় অনুষ্ঠিত ত্রিদেশীয় টুর্নামেন্টের ফাইনালেও নিয়েছেন ৪ উইকেট। তাই নিজের ওপর ভরসা ছিল, “আমি এই টুর্নামেন্টেও কিন্তু ভালো বল করছিলাম। ভারতের বিপক্ষে আগের দুই ম্যাচে ২৪ ও ২৭ রান দিয়ে ২টি করে উইকেট নিয়েছি। তাই এদিনও খারাপ করার কথা ছিল না। ওই ফাইনালেও তো প্রথম ৩ ওভারে মাত্র ১৩ রান দিলাম। কিন্তু ওই ওভারটায় যে কী হলো।”
যা হওয়ার হয়ে গেছে। এখন সামনে তাকানোর সময়। রুবেল এখন সামনেই তাকাতে চান। তিনি জানেন, এখান থেকে সামনে এগোনোর একটাই পথ- দলকে আবার জয় এনে দেয়া। তাই বলছিলেন, “আমি বাংলাদেশকে ম্যাচ হারিয়েছি, আবার ম্যাচ জিতিয়েছি। আমাকে শক্ত হতে হবে। এখান থেকে শিক্ষা নিলাম। নিজেকে বলেছি, এরকম জায়গা থেকে বাংলাদেশকে আবার জিতিয়ে তবে শান্তি পাবো।”
Featured Image- ESPNCricinfo