এক কথায় উত্তর হলো, বিলাল আসিফ ৩৩ বছর বয়সী একজন দীর্ঘদেহী পাকিস্তানী অফস্পিনার।
কিন্তু এক কথায় তো আর সব বলে ফেলা যায় না। বিশেষ করে অভিষেকেই তুলকালাম বোলিং করে আলোড়ন ফেলে দেওয়া বিলাল আসিফকে এত সংক্ষেপে চেনার কোনো উপায় নেই। তাই একটু লম্বা পরিচয় তার নেওয়া দরকার।
অভিষেকেই ৩৬ রানে ৬ উইকেট নিয়ে অস্ট্রেলিয়ার ব্যাটিং ধ্বসিয়ে দিয়েছেন বিলাল। এটা পাকিস্তানের পক্ষে অভিষেকে তৃতীয় সেরা বোলিং পারফরম্যান্স। পাকিস্তানের পক্ষে অভিষেকে সেরা বোলিং মোহাম্মদ জাহিদের, ১৯৯৬ সালে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে রাওয়ালপিন্ডি টেস্টে ৬৬ রানে নিয়েছিলেন তিনি ৬ উইকেট।
অভিষেকে বিশ্বসেরা বোলিং কীর্তি অ্যালবার্ট ট্রটের, সেই ১৮৯৫ সালে অস্ট্রেলিয়ার এই বোলার নিজের অভিষেকে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ৪৩ রানে ৮ উইকেট নিয়েছিলেন। এ ছাড়া বব ম্যাসি, নরেন্দ্র হিরওয়ানি, ল্যান্স ক্লুজনার, আলফ ভ্যালেন্টাইন ও জেসন ক্রেজা যার যার অভিষেক টেস্টে ৮টি করে উইকেট নিয়েছেন। এর মধ্যে হিরওয়ানি ও ম্যাসি বিশেষভাবে স্মরণযোগ্য, কারণ তারা অভিষেক টেস্টের দুই ইনিংসেই ৮টি করে উইকেট নিয়েছেন!
এবার বরং আমরা রেকর্ড ছেড়ে বিলাল আসিফের খোঁজখবর নিতে শুরু করি।
বিলাল আসিফ উঠে এসেছেন ‘আলো মাহার শরীফ’ নামে একটা ছোট্ট গ্রাম থেকে। এই গ্রামটি পাঞ্জাবের ডাস্কা শহরের বাইরেই অবস্থিত। শিয়ালকোট থেকে খুব একটা দূরে নয় গ্রামটা, ৪৫ মিনিটের পথ। শিয়ালকোট ও ডাস্কা শহরের এই অঞ্চলটা থেকে পাকিস্তানের বেশ কিছু ক্রিকেটার উঠে এসেছেন, অন্তত দেশটির ঘরোয়া ক্রিকেটে এখানকার ক্রিকেটারের সংখ্যা কম নয়। এর মধ্যে বিলালের চাচা জাহিদ সাঈদও আছেন।
বাঁহাতি পেসার জাহিদ সাঈদ পাকিস্তানের ঘরোয়া ক্রিকেটের উজ্জ্বল এক নাম। ২০০৪ সালে ভারতের বিপক্ষে হোম সিরিজ খেলার জন্য ডাকা ট্রেনিং ক্যাম্পের প্রাথমিক দলে ছিলেন এই সাঈদ, কিন্তু শেষ অবধি চূড়ান্ত দলে জায়গা করে নিতে পারেননি। ঘরোয়া প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে ৭৫টি ম্যাচ খেলে ২৪.৫৪ গড়ে ২৯৯টি উইকেটে নিয়েছেন বিলালের চাচা সাঈদ।
বিলালের শুরুতে পড়াশোনা নিয়েই ব্যস্ততা ছিলো, আর্টসে তিনি স্নাতক ডিগ্রিও অর্জন করেছেন। তবে পাশাপাশি ক্রিকেটও খেলতেন। মূলত ছোটবেলায় তাকে তুলে আনার কাজটা করেন আমির ওয়াসিম। সাবেক পাকিস্তানী এই বাঁহাতি স্পিনার শিয়ালকোটের অনেক ক্রিকেটারকে তুলে এসেছেন। জীবনের এক স্তরে এসে বিলাল দারুণ সহায়তা পেয়েছেন সাবেক পাকিস্তানী অধিনায়ক শোয়েব মালিকের কাছ থেকেও। এখনও তার ক্যারিয়ারে মালিকের দারুণ প্রভাব আছে।
বিলাল আমির ওয়াসিমের অধীনে ‘টনি ক্রিকেট ক্লাব’ নামে একটা ক্লাবে ক্রিকেট খেলতেন। এখানে ২০০৮ সাল অবধি খেলার পর তাকে ক্রিকেট ছেড়ে, দেশ ছেড়ে চলে যেতে হয়। টানাপোড়েনের সংসারে তাকে হাত লাগাতে হয়েছিলো বাবার কাজে। তার বাবা তখন কুয়েতে বিদ্যুৎমিস্ত্রী হিসেবে কাজ করেন। সেখানে দু’বছর বাবার সাথে ওই কাজ করেছেন বিলাল। এরপর ২০১০ সালে পরিস্থিতি একটু স্বাভাবিক হলে আবার দেশে ফিরে আসেন বিলাল, আবার শুরু করেন ক্রিকেট।
২০১১ সালে ২৬ বছর বয়সে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে অভিষেক হয় বিলালের। একটু দেরি করেই শুরুটা হয়েছিলো, তার ওপর প্রথম দিকে সুযোগও পাচ্ছিলেন না। প্রথম দুই মৌসুমে মাত্র ৫টি ম্যাচ খেলার সুযোগ পেয়েছেন। ২০১৪-১৫ মৌসুমে এসে ৬ ম্যাচ খেলে ৩১০ রান করে ফেলেন। এর মধ্যে তার প্রথম সেঞ্চুরিও ছিল। ২০১৫ সালে সুপার নাইন টি-টোয়েন্টি কাপে ৪৮ বলে এক সেঞ্চুরি করে ফেলেন।
মজার ব্যাপার হলো, বিলাল তখন ব্যাটসম্যান হিসেবে পরিচিতি পেতে শুরু করেন। মারকুটে ব্যাটিং অলরাউন্ডার হিসেবে ২০১৫ সালে পাকিস্তান জাতীয় দলের হয়ে ওয়ানডেও খেলে ফেলেন বিলাল। ওয়ানডে খেলার এই সময়টার আগে ২০১৪-১৫ ওই মৌসুমে ২৭.৩৫ গড়ে ১৭টি প্রথম শ্রেণির উইকেট নিয়েছিলেন, ফলে তার বোলিংয়েরও একটা ভূমিকা ছিলো এই ডাক পাওয়ায়। এরপর পাকিস্তানের টি-টোয়েন্টি কাপে নিয়েছিলেন ৯ উইকেট। অভিষেকের আগেই বিলাল পাকিস্তান দলের সাথে ২০১৫ সালে শ্রীলঙ্কা সফর করেন। সেখানে অবশ্য ম্যাচ খেলার সুযোগ হয়নি। সেটা পেলেন গিয়ে জিম্বাবুয়েতে, ওই বছর অক্টোবর মাসে।
হারারেতে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে দু’টি ও আবুধাবিতে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে একটি ওয়ানডে খেলেন তিনি। জিম্বাবুয়েতে নিজের প্রথম ম্যাচে আজহার আলীর সাথে ওয়ানডেতে ইনিংস শুরু করেন বিলাল। প্রথম ম্যাচে শূন্য রানে ফিরে আসেন, সাথে ৮ ওভার বোলিং করে উইকেটশূন্য ছিলেন। একেবারে বাজে একটা শুরু হয়েছিলো। দ্বিতীয় ম্যাচেই অবশ্য বিলাল নিজেকে চিনিয়ে ফেলেন। ২৫ রানেই তুলে নেন ৫ উইকেট, সেই সাথে ব্যাট হাতে ৩৮ রানের একটা ইনিংস খেলেন ৩৯ বলে। ছোট রান তাড়া করে ম্যাচ জেতানোর পথে বড় ভূমিকা রাখেন। এই দ্বিতীয় ম্যাচটা খেলার পর পাকিস্তানের হয়ে তখনই তার ক্যারিয়ার লম্বা হওয়া উচিত ছিলো। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে ওই ম্যাচেই তার বোলিং সন্দেহজনক বলে রিপোর্ট করা হয়।
তবে চলতে থাকে বিলালের ব্যাটিং দাপট।
তাহলে বিলাল আসিফ কি মূলত একজন ব্যাটসম্যান?
নাহ, বিলাল নিজে অন্তত তেমনটা মনে করেন না। তিনি সাকলাইন মুশতাককে দেখে বড় হয়ে উঠেছেন, সাকলাইনের মতোই বিশেষজ্ঞ বোলার হতে চেয়েছেন সারাটা জীবন। কিন্তু তার হাতে যেহেতু শট আছে, বল পেটানোর ক্ষমতা আছে; সেটাই সে সময় নির্বাচকদের দৃষ্টি কেড়েছিলো। কিন্তু অবশ্যই তার আসল ক্ষমতা অফস্পিন বল করতে পারা।
পাকিস্তান দল যখন সাঈদ আজমল ও মোহাম্মদ হাফিজকে সন্দেহজনক বোলিং অ্যাকশনের কারণে হারিয়ে ফেললো, তখন বিলাল পাকিস্তানের জাতীয় দলের স্কোয়াডে একজন স্পিনার হিসেবেই জায়গা করে নিলেন। একজন স্পিনার হিসেবে ডাক পেয়ে ব্যাটসম্যান হিসেবে নাম করেছিলেন, এমন পাকিস্তানি বললে কার কথা মনে পড়ে?
হ্যা, শহীদ খান আফ্রিদি।
তবে বিলালের ‘আফ্রিদি’ হয়ে ওঠার পেছনে বাধা ছিলো ক্যারিয়ারের শুরুতেই রিপোর্টেড হওয়া। সেখান থেকে মুক্ত হতেও অবশ্য সময় লাগেনি। ঘটনার পরপরই তিনি চেন্নাইতে গিয়ে আইসিসির স্বীকৃত ল্যাব ‘শ্রী রামচন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়’-এ বোলিং পরীক্ষা দেন। আইসিসি এক বিবৃতিতে জানায়, বিলালের সব বলের সময় কনুই আইসিসির অনুমোদিত ১৫ ডিগ্রির মধ্যেই বাঁকা হয়। ফলে তার আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে তার বোলিং করতে বাধা নেই।
আসিফ দ্রুতই আবার পাকিস্তান দলে নিজের জায়গা করে নেন। ২০১৫ সালেই ইংল্যান্ডের বিপক্ষে আরব আমিরাতের সিরিজে তাকে ব্যাকআপ স্পিনার হিসেবে রাখা হয়। সাঈদ আজমল তখন দলে নেই, হাফিজও বোলিং থেকে ১২ মাসের জন্য নিষিদ্ধ। এ অবস্থায় ইয়াসির শাহ’র ব্যাকআপ ছিলেন বিলাল। ইয়াসির পিঠের ব্যথায় ভুগছিলেন। বলা হয়েছিলো, ইয়াসির সুস্থ হতে না পারলে বিলাল খেলবেন। কিন্তু ইয়াসির শেষ অবধি মাঠে নেমে পড়েন, তাই টেস্ট খেলা হয়নি বিলালের।
কিন্তু ওই সিরিজে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে একটা ওয়ানডে খেলেছিলেন বিলাল, যেখানে চার ওভারে ৩২ রান খরচ করে ফেলার পর আসলে বিলাল দলে নিজের জায়গা হারিয়ে ফেলেন।
দল থেকে বাদ পড়ার পর বিলাল কাজ শুরু করেন সাবেক গ্রেট পাকিস্তানী বোলার মুশতাক আহমেদের সাথে। এই সময়ে নিজের বোলিংয়ে বেশ কিছু পরিবর্তন আনেন এবং আরও অনেক বেশি ধারালো হয়ে ওঠেন। অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে দল ঘোষণার সময় এই ‘ধারালো’ বিলালকে তিন বছর পর আবার দলে ডাকা হয়। মূলত হাফিজের বল হাতে অফ ফর্ম বিলালের দরজা খুলে দেয়। প্রথম টেস্টে লেগ স্পিনার শাদাব খান যখন ছিটকে যান, তখন অভিষেকের দুয়ারও খুলে যায় বিলালের জন্য।
বিলাল এখন শুধু পাকিস্তান দলের একজন ভালো পারফরমার নন, তিনি সতীর্থদের কাছেও খুব জনপ্রিয় এক চরিত্র। তার গান ছাড়া নাকি পাকিস্তানের ড্রেসিংরুম সতেজই হয় না। একটু বেশি বয়সে শুরু করা বিলাল নিশ্চয়ই বল হাতেও দলের ওরকম প্রাণই হয়ে উঠতে চাইবেন।
Featured Image Credit : TWITTER/PCB