যদি এই মূহুর্তে কাউকে বলা হয় যে, মাত্র এক যুগ আগেও বরুশিয়া ডর্টমুন্ড নামের ক্লাবটি ব্যাংক দেউলিয়ার পথে ছিল, ছিল না কোনো আদর্শ ম্যানেজমেন্ট এবং তরুণ খেলোয়াড়দের সুযোগ দেয়ার নীতি, যে কেউই চমকে উঠবেন। কেননা, টুকটাক ফুটবল জগতে যাদের আনাগোনা, তাদের প্রায় সবাই জানেন, জার্মান জায়ান্ট এই ক্লাবটি বিখ্যাত তাদের সাংগঠনিক জোর আর তরুণদের সুযোগ দানের জন্য। এমনকি, আর্থিক এবং সাংগঠনিক দিক থেকেও এই ক্লাবটি বৈশ্বিক র্যাংকিংয়ে ১২তম। আর এখন যদি বলা হয় যে, ঋণভারে নত এই ক্লাবটিকে বাঁচাতে একসময় চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী বায়ার্ন মিউনিখ শর্তহীন ঋণ দিয়েছিল? চলুন আজ জেনে নেয়া যাক দেউলিয়াত্বের দ্বারপ্রান্ত থেকে বরুশিয়া ডর্টমুন্ডের রাজসিক প্রত্যাবর্তন।
বড় সাফল্যই ঠেলে দেয় বড় ব্যর্থতার দ্বারপ্রান্তে
১৯৯৭ সাল, জাপ হেইংকেসের জাদুর ছোঁয়ায় বরুশিয়া ডর্টমুন্ড জিতে নেয় তাদের ইতিহাসের প্রথম চ্যাম্পিয়ন্স লিগ। এর আগেপরে বাগিয়ে নেয় আরো দুইটি জার্মান লিগ শিরোপা এবং ঘরোয়া কাপ। বায়ার্ন মিউনিখের একাধিপত্যকে সরাসরি চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দিয়ে ক্লাবটি উঠে আসে জার্মানির সেরা ক্লাব হিসেবে। আর তখনই অপরিচিত বা স্বল্পপরিচিত খেলোয়াড়রা তারকাখ্যাতি পেতে থাকে আর দাবি করতে থাকে বড়সড় চুক্তির। ক্লাবও খুশি মনে বেতন বাড়াতে থাকে, আর একই সাথে ট্রান্সফার মার্কেট থেকে কিনে নিতে থাকে দামী খেলোয়াড়। এভানিসলন-রসিস্কিদের মতো খেলোয়াড়দের কিনতে খরচ হয় প্রায় ৬৫ মিলিয়ন, আর বিক্রির সময় পায় সাকুল্যে ১০ মিলিয়ন ইউরো! একই সময়ে রুহরের স্টক মার্কেটে বরুশিয়া ডর্টমুন্ড তখন ‘হটকেক’, বিনিয়োগও আসতে থাকে। এর ভরসায় ক্লাব কর্তৃপক্ষও দেদার বিনিয়োগ করতে থাকে।
সমস্যাটা শুরু হয় ২০০২ সালে। লিগ জেতার পরও দেখা যায় আর্থিক সংকট। স্থানীয় মন্দার কারণে শেয়ারবাজারে ধ্বস নামে, আর বিনিয়োগকারীরা মুখ ফিরিয়ে নিতে থাকে। দাম দিয়ে কেনা অনেক খেলোয়াড়ই আশানুরূপ খেলতে না পারায় অনেক ক্ষতিতে বিক্রি করে দেয়া হয়। ১৯৯৭ সাল থেকেই ক্রমাগত বেতন বৃদ্ধি করার দরুণ ক্লাবের ঋণ আকাশচুম্বী হয়ে দাঁড়ায়। এমন অবস্থা দাঁড়ায় যে, ক্লাবের পক্ষে খেলোয়াড়দের বেতন দেয়াও কষ্টসাধ্য হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু নিয়মানুযায়ী, ব্যাংক ঋণ আর অর্থাভাবের কারণে যদি কোনো ক্লাব খেলোয়াড়দের বেতন দিতে না পারে, এবং এতে যদি খেলোয়াড়দের সম্মতি না থাকে, তবে ক্লাবটিকে ব্যাংক দেউলিয়া ঘোষণা করা হতে পারে। আর কোনো ক্লাব যদি ব্যাংক দেউলিয়া ঘোষিত হয়, তবে পেশাদার লিগ থেকে তাদের বহিষ্কৃত করা হয়, এবং পাঠানো হয় অপেশাদার লিগে বা পঞ্চম ডিভিসনে। বরুশিয়া ডর্টমুন্ডের সামনে নেমে আসে পেশাদার লিগ থেকে বাদ পড়ার খড়্গ, আর এক অন্ধকার ভবিষ্যৎ। পদত্যাগ করেন ক্লাবের প্রেসিডেন্ট।
বায়ার্নের ঋণ এবং একটি ঝঞ্চাক্ষুব্ধ বৈঠক
২০০৩ সালে অভাবনীয়ভাবে স্বেচ্ছায় এগিয়ে আসে চিরপ্রতিদ্বন্দী বায়ার্ন মিউনিখ। নিজেদের কোষাগার থেকে ২ মিলিয়ন ইউরো ঋণ দেয়া হয় ডর্টমুন্ডকে। কোনো শর্ত দেয়া হয়নি, ধরা হয়নি বড় কোন সুদ। উদ্দেশ্য ছিল, ডর্টমুন্ডকে খেলোয়াড়দের বেতন পরিশোধে সাহায্য করা, যাতে তারা কিছুটা সময় পায় দেউলিয়াত্ব এড়াতে এবং বিনিয়োগকারীদের কাছে নিজেদের তুলে ধরতে।
অথচ এরই আগের কয়েক বছর বায়ার্ন শিরোপাবঞ্চিত ছিল এই ডর্টমুন্ডের জন্য। এর পেছনে আরেকটা মহৎ উদ্দেশ্য ছিল। বায়ার্ন চাচ্ছিল ডর্টমুন্ড লিগে টিকে থাক, টিকে থাক ‘ডার ক্লাসিকো’ খ্যাত তাদের বিখ্যাত দ্বৈরথ। কেননা, সার্বিক লিগের কথা বিবেচনায় এটাই ছিল সর্বোত্তম কাজ। এর আগেও সেন্ট পাউলি আর ১৯৬০ মিউনিখ নামের দুইটি ক্লাবকে এমন ঋণ দিয়েছিল বায়ার্ন মিউনিখ। জার্মানির সফলতম ক্লাবটি লিগের প্রতি নিজেদের দায়িত্ব বিবেচনাবোধ থেকে এমন একটি কাজ করলো, যা অন্য কোনো দেশে অকল্পনীয়। হয়তো মোট ঋণের তুলনায় তা ছিল নগণ্য, কিন্তু এটা ডর্টমুন্ডকে কিছুটা সময় জোগাড় করে দেয়। নির্ধারিত হয় সেই আসল বৈঠকের তারিখ, যেদিন উপস্থিত ছিলেন সব শেয়ার হোল্ডার, ব্যাঙ্ক প্রতিনিধি থেকে ধরে কর আইনজীবী – সবাই।
প্রায় ৪৫০০ জন বিনিয়োগকারী, অসংখ্য ব্যাংক কর্তা আর লীগ কর্তৃপক্ষের উপস্থিতিতে হওয়া সেই বৈঠককে বর্তমান ক্লাব কর্তা ওয়াৎজকা আজও স্পষ্ট মনে করতে পারেন। তার ভাষায়,
“আমি সেদিনের মতো এত ঝুঁকি আগে কখনো নেইনি। আমরা স্পষ্ট বলেছিলাম, আমরা কী কী আইন ভেঙেছি, আর আমাদের কী অবস্থা। সত্য বলায় কিছুটা আস্থা পেয়েছিলেন উপস্থিত সবাই।”
ডর্টমুন্ডের শেয়ার ৮০ শতাংশ মূল্যপতনের শিকার হওয়ায় খেলোয়াড়রা নিজেদের বেতন ছাড়ে রাজি হয়। ক্লাবকর্তারা সবার সামনে একটি মডেল দাঁড় করায় যে কিভাবে ক্লাবটি চলবে, দাঁড় করায় তাদের যুব দল থেকে তরুণদের উঠিয়ে এনে ব্যয় সংকোচন নীতি। আমূল বদলে যায় ক্লাবটি।
ওয়াৎজকা বলেছিলেন,
“২০০৬ সাল অবধি দেনাদাররা আমাদের পরিচালিত করার চেষ্টা করেছে। শত চাপের মধ্যেও আমরা আমাদের মডেল থেকে বিচ্যুত হইনি। আর কোনো কারণে ২০০৮ সালের বৈশ্বিক মন্দা যদি ২০০৮ সালে না হয়ে ২০০৬ সালে হতো, এতদিনে আমরা পঞ্চম ডিভিসনে থাকতাম!”
নতুন কাঠামো এবং একজন ক্লপ
কোনোমতে দেউলিয়াত্ব এড়ানো গেলেও শঙ্কা কিন্তু তখনো কাটেনি। যেকোনো সময় আবারো খড়্গহস্ত হতে পারে কর্তৃপক্ষ – এ বোধ থেকে ক্লাবটি ঝাঁপিয়ে পড়ে নিজেদের পুরনো অনেক কিছু সংস্কারে। বাদ দেয়া হয় বয়স্ক এবং বেশী বেতনধারী খেলোয়াড়দের, তুলে আনা হয় যুবদল থেকে অনেক তরুণ মুখ। নিয়োগ দেয়া হয় চৌকস স্কাউটিং দল, যারা পরবর্তী ১০ বছরে বেছে বেছে তুলে আনে বর্তমানে ইউরোপ কাঁপানো অনেক প্রতিভাকে। ২০০৬-২০০৮ সাল পর্যন্ত কিন্তু বরুশিয়ার লড়াই চলছিলই। ২০০৮ সালে টেবিলে ১৩তম স্থানে থেকে মৌসুম শেষ করার পর আনা হয় মেইঞ্জ থেকে জার্গেন ক্লপ নামের একজন উচ্চাকাঙ্ক্ষী তরুণ কোচকে, যিনি মেইঞ্জের মতো এক দলকে দ্বিতীয় ডিভিসন থেকে তুলে এনে বুন্দেসলিগায় টিকিয়ে রাখেন টানা তিন বছর। ক্লপের ভাষায়,
“আসার পর আমি ভেবেছিলাম, এত বড় ক্লাব, এত বড় স্টেডিয়াম, নিশ্চয়ই আমাকে কাড়িকাড়ি টাকা দেবে নতুন খেলোয়াড় কেনার জন্য। কিন্তু এসে বাজেট দেখে ভাবলাম, এর চেয়ে মেইঞ্জই বা খারাপ কী ছিল! কিন্তু স্কাউটিং দল ছিল দারুণ। ১৯-২০ বছরের কিছু খেলোয়াড়কে শীর্ষ লীগে খেলানোটা আমার কাছে ছিল দারুণ।”
ক্লপের অধীনে পরের দুই মৌসুমে ৬ষ্ঠ আর ৫ম হলেও ততদিনে শাহীন, লেওয়ান্ডস্কি, পিশচেকের মতো খেলোয়াড়রা নিজেদের মানিয়ে নিচ্ছিল। এরপর আর ফিরে তাকাতে হয়নি ক্লপের। টানা দুই মৌসুম জিতে নেয় বুন্দেসলিগা, জিতে নেয় ঘরোয়া কাপসহ অনেক শিরোপা। উঠে আসে চ্যাম্পিয়ন্স লিগের ফাইনালে। ২০১১ সালে যেবার ক্লপের দল লিগ জিতল, সেবার তাদের দলের ২৩ জন খেলোয়াড়ের মোট ট্রান্সফার মার্কেটে মূল্য ছিল মাত্র ৩৫ মিলিয়ন, আর গড় বয়স ছিল মাত্র ২২। সেই ২০০৫ সালের পর আর একবারের জন্যও বরুশিয়া ডর্টমুন্ড চড়া দামে কোনো খেলোয়াড় কেনে নি। তাদের স্কাউটিং দল খুঁজে বের করে নেয় সেরা প্রতিভাদের, এরাই আলো ছড়ায়, আর সময়মতো অন্য কোনো বড় দলের কাছে বিক্রি করে দেয় বড় অঙ্কের অর্থের বিনিময়ে।
এছাড়াও লেওয়ান্ডস্কি, শাহীন, কাগাওয়া, ম্যাট হামেলস, পিশচেকদের কিনতে সাকুল্যে খরচ হয়েছিল ৩১ মিলিয়ন ইউরো! ফলাফল, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে বরুশিয়া ডর্টমুন্ড তাদের আর্থিক হিসাবে ৩৩৪.৫ মিলিয়ন ইউরো লাভের কথা ঘোষণা করে।
২০০৫ সালে তাদের মোট দেনার পরিমাণ ছিল ১৯৮ মিলিয়ন ইউরো। এর ঠিক এক যুগ পর ক্লাব প্রায় সাড়ে তিনশত মিলিয়ন ইউরোর লাভ ঘোষণা করে। এই একযুগে ক্লাব সেই মিটিংয়ে উপস্থাপিত তাদের প্রস্তাবিত কাঠামো থেকে একচুলও সরেনি। এর মাঝে ফুটবলে এসেছে পেট্রোডলারের ঝনঝনানি, এসেছে ট্রান্সফার মার্কেটে অর্থের জোয়ার। কিন্তু ডর্টমুন্ড একটুও বিচ্যুত হয়নি তাদের মূলনীতি থেকে। এখনো ইউরোপের সেরা স্কাউটিং দল তাদের।
তাইতো জ্যাডন সাঞ্চো বা এরলিং হালান্ডের মতো খেলোয়াড়কে তারা বাগিয়ে নিতে পারে ২০ মিলিয়ন ইউরোরও কম দামে। ক্লাব চালনায় আজ বরুশিয়া ডর্টমুন্ড একটা রোল মডেল, বৈশ্বিক র্যাংকিংয়েও তাদের খুঁজে পাওয়া যায় উপরের দিকেই। করোনাভাইরাসের জন্য লিগ স্থগিতের আগে ভালোভাবেই টিকে ছিল শিরোপাদৌড়ে তাদের তরুণ তুর্কিদের নিয়ে।
খাঁদের কিনারা থেকে উঠে শক্তভাবে দল চালনার জন্য বরুশিয়া ডর্টমুন্ড আজ অনেক ক্লাবের জন্য এক অনুকরণীয় ক্লাব, হয়ত অনেকের ব্যক্তিজীবনের জন্যও অনুপ্রেরণাদায়ী।