সাম্পদোরিয়া ক্লাবটি ইতালির উত্তর-পশ্চিমের ঐতিহ্যবাহী জেনোয়া শহরে অবস্থিত। ইতালিয়ান ফুটবলে তারা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে (১৯৪৬) নিয়মিত অংশগ্রহণ করে আসছে। ক্লাবটির ইতিহাসে ইতালিয়ান ফুটবলের সর্বোচ্চ শিরোপা জয়ের ঘটনা ঘটেছে মাত্র একবার, ১৯৯০-৯১ মৌসুমে। এরপরে আর কখনোই তারা স্কুদেত্তো জয় করতে পারেনি, ইউরোপীয় সাফল্য তো অনেক দূরের কথা।
যেবার তারা তাদের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো স্কুদেত্তো জিতে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিয়েছিল, তার পরের মৌসুমেই (১৯৯১-৯২) তাদের ইউরোপসেরা হওয়ার সুবর্ণ সুযোগ এসেছিল৷ কিন্তু ফাইনালে ডাচ কিংবদন্তি ইয়োহান ক্রুইফের বার্সেলোনার কাছে হেরে তাদের সেই স্বপ্নের বেদনাবিধুর সমাপ্তি ঘটে। তাই ইউরোপীয় মঞ্চে এখন পর্যন্ত তাদের সর্বোচ্চ সাফল্য বলতে গেলে উয়েফা ইউরোপা লিগে একবার চ্যাম্পিয়ন হওয়া।
যে কারণে শুরুতেই ইতালির একটি অখ্যাত ক্লাবের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস টেনে আনা হলো, তা খোলাসা করা যাক। সাম্পদোরিয়ার ইউরোপীয় মঞ্চের সর্বোচ্চ সাফল্য কিংবা ইতালির জাতীয় পর্যায়ের সর্বোচ্চ সাফল্য — দুটোই এসেছিল একজন দুর্দান্ত প্রতিভাবান তরুণ খেলোয়াড়ের হাত ধরে, রবার্তো মানচিনি। ১৯৯২ সালের পর থেকে সাম্পদোরিয়া ক্লাবটি তার জৌলুস হারাতে শুরু করে, অপরদিকে রবার্তো মানচিনি তখন ইতালিয়ান ফুটবলের সবচেয়ে মেধাবী, নিয়মিত পারফর্ম করা খেলোয়াড়দের একজন। ক্লাবের আর্থিক দৈন্যদশার কারণে তিনি চাইলেই ইতালির সবচেয়ে নাম করা ও ঐতিহ্যবাহী ক্লাবগুলোতে যেতে পারতেন; সাম্পদোরিয়া তাকে যা দিত, তার চেয়ে অনেক বেশি কামাতে পারতেন। কিন্তু তিনি থেকে যান। ইতালিয়ান খেলোয়াড়দের ক্লাবের প্রতি আনুগত্যের যে গল্প প্রচলিত রয়েছে, সেটিকেই তিনি ভিন্নমাত্রা দান করেছিলেন।
পড়তে পারেন: মাইন্ডগেম ইন ফুটবল: জোসে মরিনহোর ক্লান্তিহীন ‘উদ্ভট’ মন্তব্যের নেপথ্যের গল্প
রবার্তো মানচিনির খেলোয়াড়ি জীবনের গল্পের ইতি টানা যাক এখানেই। এবার তার ‘ডাগআউটের জীবন’ নিয়ে একটু আলোচনায় বসা যাক।
প্রথমে ফিওরেন্টিনা ও পরে লাৎসিও দিয়ে কোচিং ক্যারিয়ার শুরু। দুটো ক্লাবেই তাকে অভিন্ন সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়েছিল, আর্থিক দৈন্যদশা। এতই খারাপ অবস্থার সম্মুখীন হয়েছিলেন যে তিনি নিজে বিনা পয়সায় কাজ করতে শুরু করেন, তার প্লেয়ারদের ‘স্যালারি-কাট’ নিতে হয়েছিল প্রায় ৮০ শতাংশ পর্যন্ত! দুটো ক্লাবেই আর্থিক কারণে তিনি তার প্রধান খেলোয়াড়দের ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছিলেন। তাই খুব বেশি কিছু অর্জন করা হয়নি এই দুই ক্লাবের হয়ে।
রবার্তো মানচিনির উত্থানটা শুরু হয় ইন্টার মিলানে যোগদানের মাধ্যমে। এখানে আগের দুই ক্লাবের মতো আর্থিক সমস্যা তেমন ছিল না, তার পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করার মতো খেলোয়াড়ও ক্লাব দিয়েছিল। তিনিও ক্লাবের দেয়া সুবিধা কাজে লাগিয়ে তার পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করেছিলেন ভালোভাবেই। ১৫ বছরের সিরি-আ শিরোপাখরা কাটিয়ে ইন্টার মিলানকে টানা তিনটি স্কুদেত্তো জিতিয়েছিলেন রবার্তো মানচিনি। এর পাশাপাশি ইতালিয়ান সুপার কোপা ও কোপা ইতালিয়া শিরোপাও ইন্টার মিলানের ট্রফি ক্যাবিনেটে যোগ হয়েছিল তার সময়ে। কিন্তু ইউরোপীয় টুর্নামেন্টে তেমন সাফল্য না পাওয়ায় তাকে বরখাস্ত করা হয়, এরপর তিনি ম্যানচেস্টার সিটিতে যোগ দেন।
ইতালিয়ান ফুটবলে তিনি নিজেকে প্রমাণ করেই এসেছিলেন। ম্যানচেস্টার সিটিতে এসে ২০১১ সালের এফএ কাপ জয় করে দীর্ঘ ৩৪ বছরের শিরোপাখরার অবসান ঘটান।
২০১১-১২ মৌসুমে প্রিমিয়ার লিগে স্যার অ্যালেক্স ফার্গুসনের ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের সাথে রবার্তো মানচিনির ম্যানচেস্টার সিটির প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছিল দেখার মতো। ২০১১ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত ম্যানচেস্টার সিটি পয়েন্ট টেবিলে শীর্ষে থাকলেও পরবর্তীতে তারা পয়েন্ট হারাতে শুরু করে। মৌসুম শেষ হতে ৬ ম্যাচ বাকি থাকতে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের হাতে ৮ পয়েন্টের লিড ছিল। কিন্তু এরপর স্যার অ্যালেক্স ফার্গুসনের শিষ্যদের ছন্দপতন ঘটে, তিন ম্যাচের মধ্যে দুই হার ও একটি ড্রয়ের কারণে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড ও তাদের নগর প্রতিদ্বন্দ্বী ম্যানচেস্টার সিটির পয়েন্ট সমান হয়ে যায়। একেবারে শেষ দিনের গিয়ে দুই দল জয় লাভ করলেও গোল ব্যবধানে ম্যানচেস্টার সিটি শিরোপা জয় করে নেয়, কার্লো আনচেলত্তির পর দ্বিতীয় ইতালিয়ান কোচ হিসেবে প্রিমিয়ার লিগের ইতিহাসে নাম লেখান রবার্তো মানচিনি৷
২০১১-১২ মৌসুমে ম্যানচেস্টার সিটির প্রিমিয়ার লিগ শিরোপা জয়ের ক্যাম্পেইনের দিকে তাকালে রবার্তো মানচিনির মাইন্ডগেমের কৌশল বুঝতে পারা যাবে।
শুরুর দিকে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডকে টপকে শীর্ষস্থানে থাকার সময়ে তাকে বেশ কয়েকবার সাংবাদিকরা জিজ্ঞেস করেছিলেন, এবার প্রিমিয়ার লিগের শিরোপা জয়ের জন্য ম্যানচেস্টার সিটি ‘ফেভারিট’ কি না। সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি সরাসরি ম্যানচেস্টার সিটির শিরোপা জয়ের সম্ভাবনাকে নাকচ করে দিয়েছিলেন,
“নাহ! ইউনাইটেড তো দুর্দান্ত, ওরাই ফেভারিট!”
প্রতিটা কোচকেই নিজ স্কোয়াড নিয়ে আশাবাদী থাকতে হয়, মিডিয়ার সামনে তার দলকে যেন কোনোভাবে ছোট করা না হয়, সেটি নিশ্চিত করতে হয়। এতে করে খেলার মাঠে নিজ দলের খেলোয়াড়দের আত্মবিশ্বাস বাড়ে। রবার্তো মানচিনির মতো অভিজ্ঞ কোচ যখন একদল প্রতিভাবান খেলোয়াড় নিয়ে গড়া নিজ স্কোয়াডের উপর আস্থা না রেখে প্রতিপক্ষকে আগেই শিরোপা জয়ের দাবিদার হিসেবে গণমাধ্যমের সামনে ঘোষণা করেন, তখন সেটি আলোচনার দাবি রাখতেই পারে।
পড়তে পারেন: মাইন্ডগেম ইন ফুটবল: স্যার অ্যালেক্স ফার্গুসনের ‘আগ্রাসী’ নীতি
‘রিভার্স সাইকোলজি’ নামের একটি বিষয় আছে মনোবিজ্ঞানে। সহজভাবে বিষয়টি বোঝানো যাক। ধরুন, আপনি একজন দোকানদার। ক্রেতার সাথে কোনো একটা পণ্য নিয়ে দামাদামির পর ক্রেতার বলে দেয়া দাম আপনার পছন্দ হলো না, আপনি সাফ জানিয়ে দিলেন সেই দামে পণ্যটি দিতে পারবেন না। সামনাসামনি ক্রেতাকে না জানিয়ে দিলেও মনে মনে আপনি চাইছেন, ক্রেতা আরেকটু দামাদামি করুক, তারপর না হয় পণ্যটি ছেড়ে দেবেন। এটাই আসলে রিভার্স সাইকোলজি।
রবার্তো মানচিনি আসলে মনোবিজ্ঞানের এই বিষয়টিরই প্রয়োগ ঘটিয়েছিলেন। তিনি সামনাসামনি ম্যানচেস্টার সিটির শিরোপা জয়ের সম্ভাবনাকে নাকচ করে দিলেও মনে মনে চাচ্ছিলেন তার শিষ্যরা তাকে ভুল প্রমাণ করে প্রিমিয়ার লিগ শিরোপা অর্জন করুক।
মানচিনির এই ‘রিভার্স সাইকোলজি’ নীতি অবলম্বন করার কারণটিও খুব সহজ। কথার লড়াইয়ে নগর প্রতিদ্বন্দ্বী ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের ম্যানেজার বিখ্যাত স্যার অ্যালেক্স ফার্গুসনের সাথে পেরে ওঠা সম্ভব নয়। তিনি আগ্রাসী কৌশলে মাইন্ডগেম খেলতে ভালোবাসেন। তাই সরাসরি তার সাথে জড়িয়ে পড়লে মাইন্ডগেমে আগেই হেরে বসে থাকা সুনিশ্চিত।
এরপর এক ম্যাচে আর্সেনালের বিপক্ষে ০-১ গোলে পরাজিত হয় সিটি। দুই দলের মধ্যে পয়েন্টের তফাৎ গিয়ে দাঁড়িয়েছে আটে। প্রেস কনফারেন্সে অপ্রীতিকর এক প্রশ্ন ধেয়ে আসে, তবে কি লিগ শিরোপা হাতছাড়াই হয়ে গেল? উত্তরটা বেশ শক্ত গলায় দিয়েছিলেন স্মিত হেসে,
“গাণিতিক হিসেবে যদি দেখেন, আমাদের সম্ভাবনাটা উড়িয়ে দেওয়া যায় না কিন্তু! হ্যাঁ, খুব কঠিন। তিনদিনের মাথায় আমাদের আরেকটা ম্যাচ আছে, সেটায় জিততেই হবে আমাদের। ফুটবলে কখনো ‘নেভার’ বলে কিছু হয় না, বুঝলেন!”
মানচিনির এই কৌশল ফার্গুসন বুঝতে উঠতে পারেনি, উল্টো ‘শিরোপা জয়ের ফেভারিট’ ট্যাগ পাওয়ায় তার শিষ্যরা চাপে পড়ে যায়। উইগানের কাছে হঠাৎ হেরে বসে ইউনাইটেড, তফাৎ নেমে আসে পাঁচ পয়েন্টে। ওদিকে রবার্তো মানচিনি নিজেদের শিরোপার রেস থেকে প্রত্যাহার করার ঘোষণা দেয়ার পর থেকে ম্যানচেস্টার সিটির খেলোয়াড়েরা একেবারে চাপমুক্ত হয়ে খেলতে শুরু করেন। সিটি পরপর দুই ম্যাচে নরউইচ আর উলভসের বিপক্ষে সহজ জয় পায়। ওদিকে মনস্তাত্ত্বিক চাপে পড়ে যাওয়া ইউনাইটেড হারাতে থাকে পয়েন্ট। এক পর্যায়ে ম্যানচেস্টার ডার্বিই হয়ে আসে শিরোপা-নির্ধারক।
মানচিনি এবারও ফেভারিট মেনে নেন স্যার অ্যালেক্সের ইউনাইটেডকেই। এরপর সেন্ট জেমস পার্কে ঠাণ্ডা মাথায় চালেন পাকা হাতের চাল। জয় তো দূরের কথা, ইউনাইটেড টার্গেটে একটা শটও নিতে পারেনি; তবে ভিনসেন্ট কোম্পানির দারুণ এক হেডারে শেষ অবধি ১-০ ব্যবধানে জয় পায় সিটি।
বলাই বাহুল্য, তার এই কৌশল কাজে দিয়েছিল এবং শেষ পর্যন্ত অনেক নাটকীয়তার পর ম্যানচেস্টার সিটিই সেই মৌসুমে প্রিমিয়ার লিগ শিরোপা জিতেছিল।
রবার্তো মানচিনি একটি আলাদা নাম হয়ে থাকবে, কারণ তিনি মাইন্ডগেম খেলা সবচেয়ে পারদর্শী কোচদের মধ্যে একজন, যিনি শেষ অবধি স্যার অ্যালেক্স ফার্গুসনের সাথে মাঠের খেলায় জিতেছিলেন। মাইন্ডগেম খেলেই অসংখ্য ফর্মের তুঙ্গে থাকা দলকে হারানোর কৃতিত্ব রয়েছে স্যার অ্যালেক্স ফার্গুসনের, তাকে হারানো মোটেও সহজ কাজ ছিল না। সেই অসাধ্য সাধন করেছিলেন ইতালিয়ান কোচ রবার্তো মানচিনি, রিভার্স সাইকোলজির সফল প্রয়োগ ঘটিয়ে।