রজার ফেদেরার, রাফায়েল নাদাল ও নোভাক জোকোভিচ তিনজনই দাবিদার পুরুষদের টেনিসের শ্রেষ্ঠতম হিসেবে বিবেচিত হওয়ার। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কার পাল্লা সবচেয়ে ভারী? নানা ধরনের পরিসংখ্যানের ভিত্তিতে সেই প্রশ্নেরই উত্তর খোঁজার চেষ্টা করেছেন দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমসের ভিক্টর মেথার। চলুন, আমরাও তার সঙ্গে সামিল হই এক আপাত অসম্ভব যাত্রায়!
প্রতিযোগিতামূলক টেনিস থেকে অবসরের ঘোষণা দিয়েছেন রজার ফেদেরার। তারপর থেকেই দর্শক, ভক্ত-সমর্থক ও বিশেষজ্ঞদের ভালোবাসার বৃষ্টিতে ভিজছেন এই সুইস মহাতারকা। অভিহিত হচ্ছেন পুরুষদের টেনিসের সর্বকালের অন্যতম সেরা হিসেবে।
কিন্তু তিনি কি কেবলই ‘সেরাদের একজন’ ছিলেন? নাকি তিনিই শ্রেষ্ঠতম?
কোনো প্রিয় বা পছন্দের খেলোয়াড়কে সর্বকালের সেরা হিসেবে ঘোষণা করে দেওয়া কঠিন কাজ নয়। বরং পরিসংখ্যান ঘেঁটে সেই দাবির পক্ষে যুক্তি-তর্ক দাঁড় করানোর চেয়ে তো ঢের সহজ। কিন্তু সেরকম আপাত সহজ পথ না ধরে, চলুন সংখ্যাতত্ত্বের হিসাব-নিকাশের মাধ্যমে বোঝার চেষ্টা করি, আসলেই সেরার লড়াইয়ে এগিয়ে আছেন কে।
গ্র্যান্ডস্লাম জয়
যদি কোনো বিশেষ সংখ্যার টেনিসে শ্রেষ্ঠত্ব বিচারের চূড়ান্ত একক হিসেবে পরিগণিত হওয়ার গ্রহণযোগ্যতা থাকে, তবে সেটি হলো খেলোয়াড়দের জেতা গ্র্যান্ডস্লাম টুর্নামেন্টের সংখ্যা। এবং তার পেছনে নিশ্চিতভাবেই প্রচুর যুক্তি রয়েছে।
অধিকাংশ খেলোয়াড়ের কাছে গ্র্যান্ডস্লাম শিরোপাজয়ই সাফল্যের শেষ কথা। অস্ট্রেলিয়ান ওপেন, ফ্রেঞ্চ ওপেন, উইম্বলডন ও ইউএস ওপেনের দিকেই লোকের নজর থাকে সবচেয়ে বেশি। সম্ভাব্য শ্রেষ্ঠ মাঠে এই প্রতিযোগিতাগুলো অনুষ্ঠিত হয়, এবং সর্বাধিক অর্থ পুরস্কারও বরাদ্দ থাকে এসব টুর্নামেন্টের বিজয়ীদের জন্য। তাছাড়া পুরুষদের টেনিসে গ্র্যান্ডস্লামগুলো আরো বেশি তাৎপর্যপূর্ণ “বেস্ট-অভ-ফাইভ-সেট” ফরম্যাটের জন্য। সাধারণ ট্যুর ইভেন্টগুলোতে তিন সেটের ম্যাচ অনুষ্ঠিত হলেও, কেবল গ্র্যান্ডস্লামেই পুরুষ খেলোয়াড়দের প্রতি ম্যাচে লড়তে হয় পাঁচ সেট অবধি (যদি না আগেই নির্ধারিত হয়ে যায় বিজয়ী)।
টেনিসে শ্রেষ্ঠত্ব বিচারের নিমিত্তে ভক্তদের সবচেয়ে বেশি পরিচিত টেবিলও এটিই:
পুরুষদের টেনিস ইতিহাসের অন্য অনেক ক্যাটাগরির মতো এখানেও সামনে থেকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন ‘বিগ থ্রি’ (ফেদেরার, নাদাল ও জোকোভিচ)।
গ্র্যান্ডস্লাম পারফরম্যান্স
গ্র্যান্ডস্লাম পারফরম্যান্সকে একটি বাইনারিতে নামিয়ে আনা — একজন খেলোয়াড় চ্যাম্পিয়ন হলেন নাকি হলেন না — অতিসাধারণীকরণ হয়ে যায়। একেকটি ম্যাচ জয় এবং টুর্নামেন্টে ক্রমশ কঠিনতর ধাপে অগ্রসর হওয়াও যথেষ্ট গুরুত্বের দাবিদার।
এই স্কোরিং সিস্টেম নিয়ে বিতর্কের অবকাশ থাকতে পারে। তারপরও, গ্র্যান্ডস্লাম চ্যাম্পিয়ন হলে ৬ পয়েন্ট, রানার-আপ হলে ৩ পয়েন্ট, এবং সেমিফাইনাল পর্যন্ত উঠলে ১ পয়েন্ট দিয়ে দেখা যাক:
এখানেও দেখা যাচ্ছে, ‘বিগ থ্রি’-র মধ্যকার ব্যবধান খুবই সামান্য। স্কোরিং সিস্টেমে অল্প খানিকটা পরিবর্তন আনলেও এই ক্রম পাল্টে যাওয়ার যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে।
উদাহরণস্বরূপ, অনেক ভক্তই প্রতি চার বছর অন্তর অলিম্পিকে আয়োজিত টেনিসকে গ্র্যান্ডস্লামের সমান, কিংবা প্রায় সমান মর্যাদার টুর্নামেন্ট হিসেবে বিবেচনা করে থাকে। ‘বিগ থ্রি’-র তিনজনই তাদের ক্যারিয়ারে একটি করে অলিম্পিক একক পদক জিতেছেন। নাদালের গোল্ডের জন্য ৬ পয়েন্ট, ফেদেরারের সিলভারের জন্য ৩ পয়েন্ট এবং জোকোভিচের সিলভারের জন্য ১ পয়েন্ট ধরলে দেখা যাচ্ছে — ফেদেরার ও জোকোভিচ পাচ্ছেন ১৭১ পয়েন্ট, আর নাদাল মাত্র ১ কম, ১৭০ পয়েন্ট!
মজার ব্যাপার, তিনজন খেলোয়াড়ই অলিম্পিকে অন্তত একবার করে ব্রোঞ্জ পদক হারিয়েছেন। জোকোভিচ তো আবার একবার নয়, দুবার হারিয়েছেন। কিন্তু ব্রোঞ্জ হারানো মানে তো অলিম্পিক টুর্নামেন্টে নিদেনপক্ষে সেমিফাইনাল পর্যন্ত ওঠা। সেটিকেও হিসাব করলে আবার নাদালের চেয়ে ২ পয়েন্ট, এবং ফেদেরারের চেয়ে ১ পয়েন্টে এগিয়ে যান জোকোভিচ।
অন্য অ্যাঙ্গেল থেকে গ্র্যান্ডস্লাম পারফরম্যান্সের হিসাব
আমরা যদি কেবলই গ্র্যান্ডস্লাম চ্যাম্পিয়ন, ফাইনালে ওঠা বা সেমিফাইনালে ওঠার হিসাব ধরি, তাহলে টুর্নামেন্টের গোড়ার দিককার পারফরম্যান্সের হিসাব বাদ পড়ে যায়। সেই সঙ্গে এই ব্যাপারটিও ঢাকা পড়ে যায় যে অন্য দুই খেলোয়াড়ের চেয়ে খানিকটা আগে থেকেই ফেদেরার গ্র্যান্ডস্লামে খেলছেন, তাই “ফাঁকা মাঠে গোল দেওয়ার” সুযোগও তার ছিল। হিসাবের এই বৈষম্যগুলো দূর করা সম্ভব স্রেফ গ্র্যান্ডস্লাম ইভেন্টগুলোর প্রতিটি ম্যাচের জয়-পরাজয়কে আমলে নিলে। সেক্ষেত্রে হিসাব দাঁড়ায়:
এখানে ফেদেরারের ক্যারিয়ারের ঈর্ষণীয় দীর্ঘস্থায়িত্বই তার জন্য কাল হচ্ছে। ক্যারিয়ারের শুরু ও শেষের দিকের কিছু হারের ফলে জয়ের শতাংশের হারে অন্য দুজনের চেয়ে পিছিয়ে পড়ছেন তিনি। তবে বলা যায় না, নাদাল ও জোকোভিচও যদি ফেদেরারের মতো এত লম্বা সময় ধরে খেলা চালিয়ে যান, তবে নিজেদের ক্যারিয়ারের গোধূলী লগ্নে তারাও হয়তো একই পরিস্থিতির শিকার হবেন!
বৈচিত্র্য
বৈচিত্র্যময়তা তথা ভিন্ন ভিন্ন ধরনের সারফেসে জেতা একজন খেলোয়াড়ের লিগ্যাসির জন্য খুবই জরুরি। তাই তো ফেদেরার যখন ২০০৯ সালে ফ্রেঞ্চ ওপেনের মাধ্যমে ক্লে কোর্টে তার একমাত্র গ্র্যান্ডস্লামটি জিতেছিলেন, সেটি মহা-গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ধরা দিয়েছিল ভক্তদের সামনে।
তাই এবার চলুন, শুধু গ্র্যান্ডস্লাম শিরোপাগুলোকে পর পর যোগ করে যাওয়ার বদলে, আমরা সেগুলোকে পরস্পরের সঙ্গে গুণ করে দেখি। তাহলে যেটি হবে তা হলো, ভিন্ন ভিন্ন গ্র্যান্ডস্লামে শিরোপা জেতা বৈচিত্র্যময় খেলোয়াড়রা লড়াইয়ে এগিয়ে যাবেন, আর নির্দিষ্ট গ্র্যান্ডস্লামের স্পেশালিস্টরা পিছিয়ে পড়বেন। তাছাড়া, কোনো খেলোয়াড় যদি নির্দিষ্ট গ্র্যান্ডস্লামে একবারও শিরোপা না জেতেন, তাহলে তার সামগ্রিক স্কোর হবে ‘০’! তবে সৌভাগ্যের বিষয়, ‘বিগ থ্রি’-র তিনজনই প্রতিটি গ্র্যান্ডস্লামে অন্তত একবার করে হলেও জিতেছেন।
সন্দেহাতীতভাবে, জোকোভিচ অন্য দুজনের চেয়ে অপেক্ষাকৃত বেশি বৈচিত্র্যপূর্ণ, যা তাকে বেশ খানিকটা এগিয়ে রেখেছে। কিন্তু প্যারিসে মাত্র একবার জয়ের ফলে পিছিয়ে পড়েছেন ফেদেরার। অন্যদিকে, নাদাল ফ্রেঞ্চ ওপেনে অবিশ্বাস্য ১৪ বার শিরোপা জিতলেও, বর্তমান মেথডের হিসাবে তার লাভের চেয়ে ক্ষতিই হয়েছে বেশি।
অন্যান্য টুর্নামেন্ট
টেনিস তো কেবল গ্র্যান্ডস্লামেই সীমাবদ্ধ নয়। তাই একজন খেলোয়াড়ের সামগ্রিক ক্যারিয়ারকে কেবল গ্র্যান্ডস্লাম পারফরম্যান্স দিয়ে বিচার করতে চাওয়াও বুদ্ধিমানের কাজ নয়।
সব ধরনের অফিশিয়াল ইভেন্টেই জয়-পরাজয়ের হিসাবকে আমলে আনলে যা দাঁড়াচ্ছে :
এখানে আরো একটি ব্যাপার বিবেচনায় রাখতে হবে : জোকোভিচ র্যাংকিংয়ের শীর্ষে কাটিয়েছেন ৩৭৩ সপ্তাহ, এবং ৭টি আলাদা আলাদা বছর এক নম্বরে থেকেই শেষ করেছেন। এদিকে, ফেদেরার শীর্ষে ছিলেন ৩১০ সপ্তাহ, বছর শেষে ৫ বার; আর নাদাল ২০৯ সপ্তাহ ও ৫ বার।
ফেদেরার ট্যুর সিঙ্গেল শিরোপা জিতেছেন ১০৩টি, নাদাল ৯২টি, এবং জোকোভিচ ৮৮। (বিস্ময়করভাবে, এখানে ত্রিরত্নকে হারিয়ে দিয়েছেন অন্য একজন খেলোয়াড়: জিমি কনর্স। তবে মনে রাখতে হবে, তিনি ছিলেন একদমই ভিন্ন যুগের খেলোয়াড়।)
কোনো কোনো খেলোয়াড় ও ভক্ত ডেভিস কাপকে নিতান্তই অকিঞ্চিৎকর বলে খারিজ করে দিতে চাইলেও, এমন অনেকেই আছে যাদের দৃষ্টিতে এটি টেনিস ক্যালেন্ডারের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এখানে নাদালের রয়েছে ২৯-১ এর অসাধারণ রেকর্ড, যার সুবাদে তার জয়ের হার .৯৬৭ শতাংশ। অন্যদিকে ৩৮-৭ রেকর্ড নিয়ে জোকোভিচের .৮৪৪ শতাংশ, আর ফেদেরারের ৪০-৮ রেকর্ড নিয়ে .৮৩৩ শতাংশ।
খুঁটিনাটি
সম্ভবত জয়-পরাজয় কিংবা গ্র্যান্ডস্লামের হিসাব-নিকাশ অতিমাত্রায় ফলাফলকেন্দ্রিক। কিন্তু এসবের বাইরেও খেলোয়াড়ি দক্ষতার খুঁটিনাটি আরো নানা দিক থেকেই একজন খেলোয়াড়কে বিচার করা যেতে পারে।
তবে এক্ষেত্রেও পরিষ্কারভাবে কোনো একজনকে এগিয়ে রাখা মুশকিল। সেরা সার্ভ করেন কে? ফেদেরার প্রথম সার্ভ পয়েন্টে জিতেছেন ৭৭ শতাংশ বার, জোকোভিচ ৭৪, এবং নাদাল ৭২।
কিন্তু স্রোতের বিপরীতে সেরা রিটার্নার? এখানে ক্রমটা আবার সম্পূর্ণ বিপরীত। নাদাল ৪৫ শতাংশ ব্রেক পয়েন্ট জিতেছেন, যেখানে জোকোভিচ ও ফেদেরার যথাক্রমে ৪৪ ও ৪১।
হেড-টু-হেড
নিতান্তই অপরিচিত বা স্বল্প পরিচিত খেলোয়াড়দের বিপক্ষে জয়-পরাজয়ের হিসাব এখন মুলতবি থাক। ‘বিগ থ্রি’ একে অপরের বিরুদ্ধে কেমন করেছেন?
এখানে এগিয়ে থাকছেন জোকোভিচ, যদিও সামান্য ব্যবধানে। নাদালের বিরুদ্ধে তার রেকর্ড ৩০-২৯, এবং ফেদেরারের বিরুদ্ধে ২৭-২৩। নাদাল অবশ্য ফেদেরারের চেয়ে এগিয়ে ২৪-১৬ ব্যবধানে।
এবং পরিশেষে…
‘বিগ থ্রি’-র মধ্যে কে সেরা, তা নির্ধারণের সম্ভবত আরো লক্ষ লক্ষ উপায় রয়েছে। কিন্তু আপনি যে মেথড অবলম্বনেই সেরা বের করার চেষ্টা করুন না কেন, কেউ না কেউ তার বিরোধিতা করবেই।
আমাদের এই ছোটখাট এক্সপেরিমেন্টে নাদাল এগিয়ে ছিলেন পাঁচটি ক্যাটাগরিতে, জোকোভিচ চারটিতে, এবং ফেদেরার তিনটিতে। কিন্তু অধিকাংশ ক্যাটাগরিই ছিল খুব বেশি আঁটসাঁট। আমরা যদি ভিন্ন কোনো মেথড অনুসরণ করতাম, তাহলে ফলাফলও আসতে পারত ভিন্ন। আপনি যদি নির্দিষ্ট একটি পরিসংখ্যানের গোঁড়া সমর্থক না হয়ে থাকেন, তাহলে নিশ্চয়ই স্বীকার করবেন, ‘বিগ থ্রি’-কে পরস্পরের থেকে পরিষ্কারভাবে আলাদা করার উপায় নেই।
হয়তো আপনি কোনো একজনের ভক্ত। যদি তা-ই হয়ে থাকেন, তাহলে আপনি যাতে বন্ধুদের সঙ্গে তর্কে জিততে পারেন, সেরকম কিছু রসদ তো আপনার হাতে আমরা তুলে দিলামই!
তবে আপনার প্রিয় যে-ই হয়ে থাকুন, একটি ব্যাপার দিনের আলোর মতোই পরিষ্কার যে, ফেদেরারের অবসরের ঘোষণার মাধ্যমে বিদায়ঘণ্টা বাজতে শুরু করে দিয়েছে পুরুষদের টেনিসের একটি স্বর্ণযুগের। হয়তো আজকের তরুণ কার্লোস আলকারাজ কিংবা অন্য কেউ ২০ বছর পর এসব পরিসংখ্যানকে চোখ রাঙাবেন। কিংবা হয়তো আমরা কখনোই আর দেখতে পাবো না রজার ফেদেরার, রাফায়েল নাদাল ও নোভাক জোকোভিচের মতো কাউকে। অন্তত একই সময়ে একই সঙ্গে এরকম তিনজনকে দেখাটা হবে সত্যিই বিরল সৌভাগ্যের ব্যাপার!