রবার্তো লেভানডফস্কি বার্সেলোনার হয়ে খেলছেন এই ব্যাপারটা কি এক মৌসুম আগেও কল্পনা করার কোনো সুযোগ ছিল?
এই তো গত বছরই, ব্যালন ডি’অর রেসে মেসি এবং লেভানডফস্কির মধ্যকার প্রতিযোগিতা নিয়ে পুরো ফুটবল দুনিয়াতেই বড়সড় তোলপাড় বয়ে গেছে৷ মেসির কাছে ব্যালন ডি’অর শিরোপা হেরে যে খুশি ছিলেন না, লেভানডফস্কিও সেটা স্বীকার করেছেন বেশ অকপটেই।
সেখান থেকে বায়ার্ন মিউনিখ বোর্ডের সাথে দ্বন্দ্বের জের ধরে লেভানডফস্কি পাড়ি জমিয়েছেন কাতালান শিবিরে। শুধু তা-ই নয়, বার্সেলোনার ব্লাউগ্রানা জার্সিতে খেলে ফেলেছেন তিনটি প্রি-সিজন ম্যাচও। সবকিছু যেন একেবারেই স্বপ্নের মতো!
মেসির বিদায়ের পর বার্সেলোনা গত মৌসুমের পুরোটাজুড়েই গোলখরায় ভুগেছে। জাভি কোচ হয়ে বার্সেলোনার ডাগআউটে যোগদানের পর পরিস্থিতি অনেকটা পাল্টালেও আরো উন্নতির প্রয়োজন।
গত মৌসুমের শীতকালীন দলবদলে বার্সেলোনা আর্সেনাল থেকে দলে ভিড়িয়েছিল অবামেয়াংকে৷ অবামেয়াং অর্ধেক মৌসুম খেলে ১৩ গোল করলেও প্রচুর গোলের সুযোগ মিস করেছেন। তাই জাভির প্রয়োজন ছিল এমন একজন স্ট্রাইকার, গোল করাই হবে যার একমাত্র কাজ।
তাই জাভিও যত দ্রুত সম্ভব যেকোনো মূল্যে লেভানডফস্কিকে বার্সেলোনায় নিয়ে আসার জন্য বোর্ডকে চাপ দিচ্ছিলেন। শেষমেশ ৪৫ মিলিয়ন ইউরো এবং বাড়তি ৫ মিলিয়ন অ্যাড-অনের বিনিময়ে ৪ বছরের চুক্তিতে লেভানডফস্কিকে বার্সেলোনা কিনে নেয়।
লেভানডফস্কি বর্তমান সময়ের সেরা স্ট্রাইকার এবং অন্যতম সেরা ফুটবলারদের একজন। তার খেলার ধরন দেখে অনেকে তাকে গোল-পোচার ভাবলেও বাস্তবিকভাবে লেভানডফস্কি একজন অলরাউন্ডার স্ট্রাইকার। তার স্পিড, দুর্দান্ত পজিশনিং, টেকনিক্যাল দক্ষতা, এরিয়ালে দক্ষতা তাকে সময়ের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর স্ট্রাইকারে পরিণত করেছে।
লেভানডফস্কির পিজ্জা পার্সেন্টাইল চার্ট থেকে এটা পরিষ্কার, তার প্রোফাইলের সবচেয়ে আকর্ষণীয় দিক হচ্ছে তার দুর্দান্ত ফিনিশিং। গত মৌসুমে লেভানডফস্কি ৪৬ ম্যাচ খেলে ৫০ গোল করেছে, যা কি না ইউরোপের মধ্যে সর্বোচ্চ।
তবে, লেভানডফস্কি মূলত একজন ‘আউট-এন্ড-আউট’ স্ট্রাইকার। তাই দলের বিল্ডআপে অংশ নেওয়ার পরিবর্তে তিনি সাধারণত প্রতিপক্ষের বক্সের আশেপাশে অবস্থান করতেই বেশি পছন্দ করেন। এজন্য তাকে মিডফিল্ডে নেমে দলের বিল্ডআপে খুব একটা সাহায্য করতে দেখা যায় না। তার ম্যাচপ্রতি মাত্র ২৩.৪৯ পাস সেটারই প্রমাণ দেয়।
তবে গোলের সামনে লেভানডফস্কি বরাবরই দুর্দান্ত। আমরা যদি তার এক্সপেক্টেড গোলের চার্ট দেখি, ক্যারিয়ারের প্রায় সময়ই লেভানডফস্কি তার এক্সপেক্টেড গোলের ট্যালি ছাড়িয়ে গিয়েছেন। গত কয়েক মৌসুম ধরে ছিলেন ধারাবাহিক গোলস্কোরিং ফর্মে।
লেভানডফস্কির শট ম্যাপ থেকে এটা পরিষ্কার, তিনি বক্সের বাইরে থেকে হাফ চান্স থেকে গোলে শট নেওয়ার চেয়ে বক্সে গিয়ে গোলের চেষ্টা করতেই বেশি আগ্রহী। এ কারণে তার মোট শটের ৪৯%-ই ছিল অন টার্গেট।
বার্সেলোনার মিডফিল্ডাররা বলের দখল নিজেদের কাছে রাখতে যতটা পারদর্শী, প্রতিপক্ষ অর্ধে ডিফেন্সচেরা পাস দিয়ে গোলের সুযোগ সৃষ্টি করার দিক দিয়ে তারা ঠিক ততটা ভালো নয়। পেদ্রি, বুসকেটস, এবং ডি ইয়ংয়ের মধ্যে কেবলমাত্র পেদ্রিই পুরোপুরি সৃষ্টিশীল মিডফিল্ডার, বাকিরা মূলত নিজেদের মধ্যে বলের আদান প্রদান করে ম্যাচের দখল নিজেদের কাছে রাখতেই বেশি পছন্দ করেন। এ কারণে মেসির বিদায়ের পর বার্সেলোনা মাঠের মাঝের অংশ দিয়ে খুব একটা গোলের সুযোগ তৈরি করতে পারছে না। ফলে জাভি তার উইঙ্গারদের মাঠের দুই প্রান্তে খেলিয়ে পাসিং জোনকে বড় করে দিয়েছেন।
বার্সেলোনার উইঙ্গাররা প্রতিপক্ষের ফুলব্যাকদের সাথে ‘ওয়ান-অন-ওয়ান’ লড়াইয়ে বেশ শক্তিশালী। এজন্য প্রতিপক্ষের ফুলব্যাকদের বিট করে বক্সের কাছাকাছি গিয়ে গোলের সুযোগ তৈরি করাটা তাদের জন্য খুব কঠিন কোনো কাজ ছিল না। এজন্যই বার্সেলোনার বেশিরভাগ গোলের সুযোগই তৈরি হয়েছে ওয়াইড এরিয়া থেকে।
গত মৌসুমে বায়ার্নের হয়ে লেভানডফস্কির গোলের অ্যাসিস্ট ম্যাপ যদি খেয়াল করি, তার বেশিরভাগ গোলের পাসের উৎসই ছিল মাঠের দুই উইং। বেশিরভাগ সময় তিনি বায়ার্ন উইঙ্গারদের ক্রস অথবা কাটব্যাক থেকে সরাসরি বল জালে জড়িয়ে দিয়েছেন। বার্সেলোনার খেলার ধরনও যেহেতু প্রায় একই, তাই লেভানডফস্কি বার্সেলোনার জার্সিতেও গোলের ফুলঝুরি ফোটাবেন, সেটা এখন থেকেই বলে দেওয়া যাচ্ছে।
বার্সেলোনাকে গত মৌসুমে মাঠের মাঝের অংশ দিয়ে খুব একটা গোলের সুযোগ তৈরি করতে দেখা যায়নি। কিন্তু এর মধ্যেও বার্সেলোনা সেন্ট্রাল পিচে যেসব সুযোগ তৈরি করেছে, তার বেশিরভাগই এসেছে থার্ড ম্যান রান থেকে।
ফাইনাল থার্ডের বিল্ডআপের সময় অবামেয়াং তার পজিশন থেকে নিচে নেমে তার মার্কারকে ‘আউট অব পজিশনে’ নিয়ে আসতেন। তখন তার সাথে পেদ্রি বা বুসকেটস দ্রুতগতিতে ওয়ান-টু পাস খেলে সাথে সাথেই প্রতিপক্ষের ডিফেন্সলাইনের পেছনে রান নেওয়া ডি ইয়ং বা ফেরান তোরেস বরাবর পাস বাড়াতেন – এটাই ছিল বার্সেলোনার থার্ড ম্যান রানের মূল ভিত্তি।
কিন্তু এক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা ছিল অবামেয়াংয়ের বাজে ফার্স্ট টাচ৷ প্রতিপক্ষের প্রেসিংয়ের সামনে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অবামেয়াং ভুল পাস বাড়িয়েছেন, অথবা ফাঁকা জায়গায় রান নেওয়া সতীর্থকে পাস না দিয়ে তার কাছাকাছি থাকা সতীর্থকে পাস বাড়িয়েছেন; যে কারণে এই সিস্টেমে খুব বেশি গোলের সুযোগ বার্সেলোনা তৈরি করতে পারেনি।
লেভানডফস্কির প্রোফাইলের আরেকটি দুর্দান্ত দিক যেটা সম্ভবত জাভিকে সবচেয়ে আগ্রহী করে তুলবে, তা হচ্ছে তার দুর্দান্ত কুইক টাচ দেওয়ার সামর্থ্য।
এখানে লেভানডফস্কি তার লাইন ছেড়ে কিছুটা নিচে নেমে প্রতিপক্ষের প্রেসিংয়ের মুখে পাস রিসিভ করে এক টাচেই সরাসরি মুলারকে পাস বাড়ান।
লেভানডফস্কি প্রথাগত ফলস নাইনদের মতো তেমন সৃষ্টিশীল স্ট্রাইকার নন। কিন্তু এরপরেও গত মৌসুমে তিনি বায়ার্নের হয়ে ম্যাচপ্রতি ১.২২টি কী-পাস বাড়িয়েছেন, যা কি না বুন্দেসলিগার ৭৩% স্ট্রাইকারকেই অতিক্রম করেছে৷ তার কী পাসিং ম্যাপের দিকে যদি খেয়াল করি, তিনি বেশিরভাগ গোলের সুযোগই তৈরি করেছেন বামপাশের হাফস্পেস থেকে ইনসুইং ক্রস করে, অথবা কুইক টাচে টিমমেটের রান ট্র্যাক করে বাড়ানো পাসের মাধ্যমে।
হাফস্পেস থেকে সানে লেভানডফস্কিকে পাস বাড়িয়ে বক্সের দিকে রান নেয়। লেভানডফস্কি এক টাচে ফ্লিক করে সানের জন্য সরাসরি গোলে শট নেওয়ার চমৎকার একটি সেটআপ তৈরি করে দেয়।
লেভানডফস্কি সবসময় ফাঁকা জায়গা খুঁজে বের করে সেখানে অবস্থান করতে চেষ্টা করেন। এজন্য তিনি সবসময় প্রতিপক্ষের ডিফেন্সিভ লাইনে ফাঁকা জায়গা খুজে বের করে সেখান দিয়ে বক্সে রান নেন। তার ক্ষিপ্রগতি এবং দুর্দান্ত মুভমেন্ট তাকে দ্রুত সময়ে ফাঁকা স্থানে পৌছাতে বাড়তি সুবিধা দেয়।
ফাইনাল থার্ডে মিডফিল্ডার বাড়তি সময় বল পায়ে রাখলে প্রতিপক্ষের ডিফেন্ডাররা তাকে চার্জ করতে তার পজিশন ছেড়ে উপরে উঠে আসে। এতে করে তাদের ডিফেন্সিভ লাইনের পেছনে অনেকটা ফাঁকা জায়গা তৈরি হয়৷ লেভানডফস্কি এই সুযোগটারই অপেক্ষা করে ওই জায়গা বরাবর আড়াআড়ি দৌড় দিয়ে অবস্থান দখল করেন। তার দুর্দান্ত অফসাইড এড়ানোর ক্ষমতা তাকে বল রিসিভ করে স্কোর করতে সাহায্য করে।
ন্যাব্রি বল পায়ে সেন্ট্রাল এরিয়া ধরে বক্সের দিকে এগুতে থাকে। তখন প্রতিপক্ষের ডিফেন্ডার তাকে চার্জ করতে উপরে উঠে আসলে ডিফেন্সলাইনে একটা বড় গ্যাপ তৈরি হয়৷ সেই জায়গা ধরে লেভানডফস্কির পিনপয়েন্ট ইন-বিহাইন্ড-দ্য-ডিফেন্স রানে দুর্দান্ত গোলস্কোরিং সুযোগ তৈরি হয়।
গত বেশ কয়েক মৌসুম ধরেই প্রতিপক্ষ অর্ধে লেভানডফস্কির মাথে টমাস মুলারের রসায়ন প্রতিপক্ষের ডিফেন্ডারদের বেশ ভুগিয়েছে। গত মৌসুমেও লেভানডফস্কির গোলের একটা বড় অংশই এসেছে মুলারের অ্যাসিস্ট থেকে। মুলার যেহেতু ডানপাশে খেলে, তাই তিনি সাধারণত রাইট হাফস্পেস থেকে লেভানডফস্কিকে লক্ষ্য করে বক্সে আড়াআড়ি পাস বাড়ান। লেভানডফস্কিকেও সেই পাস থেকে বল জালে জড়াতে বামপাশে আড়াআড়ি রান নিতে হয়।
এতে করে বক্সের ভেতরে বল বেশিরভাগ সময়ই লেভানডফস্কির দুর্বল বামপায়ে এসে পড়ে। সাধারণত অন্যান্য স্ট্রাইকাররা এক্ষেত্রে নিজের ডানপায়ে শট নিতে চেষ্টা করবেন, এতে করে তাদের বলে আরো ২-৩টি বাড়তি টাচ দেওয়ার প্রয়োজন পড়বে। এদিক থেকেই লেভানডফস্কি ব্যতিক্রম। তিনি সরাসরি তার বামপায়েই গোলে শট নেন। এতে করে তার দু’টি সুবিধা হয়। প্রথমত প্রতিপক্ষের ডিফেন্ডাররা তাকে ব্লক করার মতো যথেষ্ট সময় পান না, এবং দ্বিতীয়ত তার এই অপ্রত্যাশিত মুভমেন্টের কারণে বেশিরভাগ গোলকিপাররাই বলের লাইন আন্দাজ করতে ভুল করে। ফলে এ ধরনের পরিস্থিতিতে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই লেভানডফস্কি বল জালে জড়িয়ে দেন।
বার্সেলোনার গোলের সুযোগ তৈরির একটা সাধারণ প্যাটার্ন ছিল দুই উইং থেকে ক্রমাগত ক্রস করে যাওয়া৷ কিন্তু ফরোয়ার্ডদের দুর্বল হেড করার সামর্থ্যের কারণে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই গোল করতে ব্যর্থ হয়েছে।
এরিয়াল প্লে’তে লেভানডফস্কি দুর্দান্ত, গত কয়েক বছরে হেডের মাধ্যমে তিনি প্রচুর গোল করেছেন। সাধারণত প্রতিপক্ষ বক্সে তাকে বেশ কয়েকজন ডিফেন্ডার কড়াভাবে মার্ক করে রাখে। বক্সের ভেতর তার বুদ্ধিদীপ্ত মুভমেন্টের কারণে এরিয়ালি তার বিরুদ্ধে ডিফেন্ড করা ডিফেন্ডারদের জন্য অন্যতম কঠিন কাজগুলোর একটি।
লেভানডফস্কি সাধারণত বক্সের ভেতরে দুই সেন্টারব্যাকের মাঝে অবস্থান করেন। তার টিমমেট ক্রস করার সাথে সাথে ডিফেন্ডারদের লাইনের পিছনে গিয়ে ম্যান-মার্কিং ফ্রি অবস্থায় হেড করেন অথবা তার সামনে থাকা ডিফেন্ডারকে ‘আউটজাম্প’ করে হেড অ্যাটেম্পট নেন।
প্রেসিংয়ের দিক থেকে বায়ার্ন মিউনিখ ইউরোপের অন্যতম শক্তিশালী দলগুলোর একটি। এরকম একটি দলে খেলেও লেভানডফস্কিকে প্রেসিংয়ে খুব একটা অংশ নিতে দেখা যায়নি। তবে বায়ার্নের প্রেসিং সিস্টেমে লেভানডফস্কির অবস্থান বেশ কার্যকর ভূমিকা রাখত।
প্রতিপক্ষের বিল্ডআপের সময় লেভানডফস্কি সরাসরি বলবাহককে প্রেস না করে দুই সেন্টারব্যাকের মাঝে পজিশন নিয়ে তাদের মধ্যকার পাসিং লাইন বন্ধ করে দিতেন। এতে করে তারা ওয়াইড এরিয়ায় নিজেদের ফুলব্যাককে পাস বাড়াতে বাধ্য হতো, যা তাদের পাসিং এরিয়াকে সংকুচিত করে দিত। লেভানডফস্কি তখন এমনভাবে পজিশন নিতেন, যাতে করে বায়ার্নের খেলোয়াড়রা বল পজেশন ফিরে পাওয়ার সাথে সাথে তাকে পাস বাড়িয়ে গোলের সুযোগ তৈরি করতে পারে।
জাভির অধীনে বার্সেলোনার প্রেসিংয়ের ধরনও প্রায় একই৷ তাই সরাসরি প্রেসিংয়ে অংশ না নিলেও এই ভূমিকাতে বার্সেলোনার হয়েও লেভানডফস্কি বেশ কার্যকর হবেন, সেটা আশা করাই যায়।
বার্সেলোনার জন্য লেভানডফস্কি নিঃসন্দেহে দুর্দান্ত একটি সাইনিং। বার্সেলোনার ফরোয়ার্ড লাইন এখন তারকায় পরিপূর্ণ। কিন্তু এরপরও নিশ্চিতভাবেই লেভানডফস্কিই হবেন গোলস্কোরিংয়ের ক্ষেত্রে জাভির সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য ‘আউটলেট’। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে মেসির বিদায়ের পর বার্সেলোনার আক্রমণভাগ আবারেও ভয়াবহ রূপে ফিরতে চলেছে, আর তার সিংহভাগ দায়িত্বই থাকবে লেভানডফস্কির কাঁধেই।