বার্সেলোনার মতো বড় ক্লাবে খেলার সুযোগ পাওয়া যেকোনো খেলোয়াড়ের জন্য ক্যারিয়ারে শীর্ষে পৌঁছানোর মতো। কিন্তু সবাই পারে না বার্সেলোনার মতো বড় ক্লাবের সাথে খাপ খাইয়ে নিতে, ক্যাম্প ন্যু’তে প্রায় ৯০ হাজার দর্শকের সামনে স্নায়ুচাপ ধরে রেখে নিজের স্বাভাবিক খেলা খেলতে। যারা এই সকল বাধা পেরিয়ে যেতে পারেন, তাদের বার্সেলোনার সাথে সময়গুলো হয় চিরদিন মনে রাখার মতো। আর যারা পারেন না, তারা সেই দুর্বিষহ স্মৃতি কখনোই ভুলতে পারেন না। এরকম একটি কথাই কিছুদিন আগে বলেছিলেন বার্সেলোনায় এসে সফলতার দেখা না পাওয়া পর্তুগীজ খেলোয়াড় আন্দ্রে গোমেজ।
যাই হোক, ক্যাম্প ন্যু’তে এসে নিজের ক্যারিয়ারের নতুন মোড় নিতে গিয়ে অনেকেই তাদের ক্যারিয়ার খাদের কিনারায় এনে ফেলেছিলেন, অনেকের ক্যারিয়ার তো শেষই হয়ে গেছে। এই আর্টিকেল এমনই কয়েকজন খেলোয়াড় আর তাদের গল্প বলবে, যারা বার্সেলোনায় এসে নিজেকের ক্যারিয়ারকে সায়াহ্নের মুখে এনে দাঁড় করিয়েছেন।
অ্যালেক্স সং
প্রথম হতাশার গল্প অ্যালেক্স সং-এর। আর্সেনালের হয়ে দারুণ খেলে নজর কেড়েছিলেন তিনি। বার্সেলোনাতেও তখন ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডারের প্রয়োজন ছিল, তাই তারা আগ্রহী হয় অ্যালেক্সের উপর। ২০১২ সালে ১৫ মিলিয়ন ইউরোর বিনিময়ে এই ক্যামেরুনিয়ান মিডফিল্ডার আসেন বার্সেলোনায়। কিন্তু অ্যালেক্স সং কোনো শৈল্পিক ধাঁচের খেলোয়াড় ছিলেন না, নিজের পজিশন ছাড়া অন্য পজিশনে তিনি খুব একটা সুবিধা করতে পারতেন না। ফলে ট্রান্সফারের পরই বোঝা যায়, তিনি ঠিক বার্সেলোনার জন্য নন। তবুও ৬৫ ম্যাচ চেষ্টা করেছেন বার্সেলোনার ফুটবল দর্শনের সাথে নিজেকে মেশাতে, কিন্তু পারেননি।
বার্সেলোনা তাকে লোনে পাঠায় ওয়েস্টহ্যামে। সেখানে স্যাম অ্যালারডাইসের পুরোপুরি ভিন্ন ধরণের ফুটবল ট্যাকটিক্সের সঙ্গে তিনি ঠিকই মানিয়ে নিতে পেরেছিলেন। কিন্তু তার ইনজুরিজনিত সমস্যা ছিল বলে থিতু হতে পারেননি। দুই মৌসুম লোনে কাটানোর পর ফ্রি ট্রান্সফারে অ্যালেক্স সং রাশিয়ান প্রিমিয়ার লিগের দল রুবিন কাজানে যোগ দেন।
সবকিছু না ভেবে বার্সেলোনার আগ্রহ দেখেই তার দল বদলের সিদ্ধান্ত ভুল ছিল। আর্সেন ওয়েঙ্গারের দলে থাকলে হয়ত অ্যালেক্স সং এর ক্যারিয়ারের এভাবে সমাপ্তি ঘটতো না।
অ্যালেন হ্যালিলোভিচ
অ্যালেক্স সং-এর ক্যারিয়ার নষ্ট করার পেছনে তার নিজের সিদ্ধান্তই দায়ী হলেও অ্যালেন হ্যালিলোভিচকে বার্সেলোনা যেন নিজ হাতে নষ্ট করেছে। একটা সময় এই ক্রোয়েশিয়ান ফুটবল বিশ্বের অন্যতম সেরা তরুণ খেলোয়াড় ছিলেন। ডায়নামো জাগরেবে অ্যাকাডেমিতে বেড়ে ওঠা হ্যালিলোভিচের মূল দলে অভিষেক হয় মাত্র ১৬ বছর বয়সে। এরকম একজন উঠতি তরুণকে বার্সেলোনা খুব দ্রুত ‘লা মাসিয়া’তে নিয়ে আসে। তখন অনেকেই ভেবেছিলো, হ্যালিলোভিচকে লা মাসিয়ায় তৈরি করে ফুটবলকে আরেকটি রত্ন উপহার দিতে যাচ্ছে কাতালানরা।
কিন্তু বার্সেলোনা সেদিকে পা বাড়ায়নি। বার্সেলোনা ‘বি’ দলের কোচের সাথে তার বাবার কোনো একটা সমস্যা হয়েছিলো বলে হ্যালিলোভিচের মূল একাদশে খেলার সৌভাগ্য হয়েছে মাত্র একটি ম্যাচে। লোনে বিভিন্ন দলে খেলে অনেকটাই নিভে গেছে তার ক্যারিয়ার। স্পোর্টিং গিহন, লাস পালমাস, হামবুর্গের মতো দলে বিভিন্ন সময়ে লোনে কাটিয়েই পার করেছেন তিনি। অথচ তার বয়স মাত্র ২২ বছর। বার্সেলোনাতে তো হয়নি, চলতি বছরই ইতালির মিলানে ফ্রি ট্রান্সফারে যোগ দিয়েছেন তিনি। সময় এখনও অনেক বাকি আছে। যদি নতুন করে ভাগ্যদেবতা ফিরে তাকান হ্যালিলোভিচের ক্যারিয়ারের দিকে!
অ্যালেক্সান্ডার হ্লেব
আর্সেনাল থেকে গত কয়েক বছরে বার্সেলোনা বেশ কয়েকজন খেলোয়াড় কিনেছে। অ্যালেক্স সং, সেস্ক ফ্যাব্রিগাস, মার্ক ওভারমার্স, থিয়েরি অঁরি, টমাস ভারমায়েলেন তার উদাহরণ। এর ভেতরই অন্যতম সংযোজন অ্যালেক্সান্ডার হ্লেব।
আর্সেন ওয়েঙ্গারের দলের হয়ে প্রতিভা ছড়ানো এ বেলারুশ মিডফিল্ডারকে বার্সেলোনা কেনে ২০০৮ সালে। কিন্তু বার্সেলোনার কোচ তো আর্সেন ওয়েঙ্গার ছিলেন না। কাতালানরা তখন টিকিটাকায় বিশ্ব মাত করছে। কিন্তু দ্রুতগতির ফুটবলে অভ্যস্ত হ্লেব তো পাস দিয়ে খেলা পরিচালনার জন্য প্রস্তুত নন। অতএব, আর্সেনাল থেকে আরও একটি ভুল সাইনিং বার্সেলোনার জন্য।
অ্যালেক্সান্ডার হ্লেব কাতালান দলে খেলেছেন মাত্র ৩৬ ম্যাচ। স্টুটগার্ট বা উলফসবার্গের মতো ক্লাবে লোনে খেলে ফিরে এসেও তিনি বার্সেলোনাতে স্থায়ী হতে পারেননি। বাঁচাতে পারেননি তার ক্যারিয়ারও। প্রিমিয়ার লিগে জ্বলে উঠে স্পেনে এসে ব্যর্থ হয়ে ফিরে যাবার পর তাকে আর ইউরোপিয়ান ফুটবলেই দেখা যায়নি।
আর্দা তুরান
অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদ থেকে আর্দা তুরানকে যখন বার্সেলোনা কেনে, তখন তাদের নতুন খেলোয়াড় কেনার নিষেধাজ্ঞা চলছিলো। তাই তুরান যদি বার্সেলোনায় আসেন, তবে প্রথম ৬ মাস মাঠে নামতে পারবেন না। এমন বাধা জেনেও তুরান বার্সেলোনাকে উপেক্ষা করতে চাননি। কাতালানদের জার্সিতে খেলার জন্য দীর্ঘ ৬ মাস অপেক্ষা করার জন্য প্রস্তুত ছিলেন বলেই এই ট্রান্সফারে রাজি হন।
তুর্কি এই অ্যাটাকিং মিডফিল্ডার ডিয়েগো সিমিওনের দলে হয়ে উঠেছিলেন লা লিগার অন্যতম সেরা মিডফিল্ডার। কিন্তু শুধুমাত্র ভালো মিডফিল্ডার দেখেই বার্সেলোনা তুরানের প্রতি আগ্রহী হয়েছিলো, তুরানের খেলার ধরণ যে বার্সেলোনার সাথে যায় না, বা তাদের ট্যাকটিক্সের সাথে তুরানের জন্য কোনো পজিশন দলে নেই, এমনটা কেউ ভাবেনি। অতএব, অবস্থা তথৈবচ। বার্সেলোনার জার্সিতে তুরান কখনও প্রথম একাদশে জায়গাই করে নিতে পারেনি। আর নতুন কোচ আর্নেস্তো ভালভার্দে তাকে এক ম্যাচও সময় দিতে রাজি হননি।
তুরান বার্সেলোনার হয়ে নিজের ফর্ম এবং পুরো ক্যারিয়ার হারানোর পর বর্তমানে লোনে তার জন্মভূমির এক ক্লাবে আছেন। তবে সেখানেও হাজারো সমস্যার জন্য বর্তমানে তিনি ফুটবল থেকেই সম্পূর্ণ দূরে।
আন্দ্রে গোমেজ
পর্তুগীজ এ মিডফিল্ডার ভ্যালেন্সিয়ার হয়ে কয়েক মৌসুমেই বেশ নাম কুড়িয়েছিলেন। বার্সেলোনা প্রায় রিয়াল মাদ্রিদের সাথে যুদ্ধ করে তাকে ন্যু ক্যাম্পে এনেছিলো।
আন্দ্রে গোমেজের ভ্যালেন্সিয়ায় থাকাকালীন পারফরম্যান্স, খেলার ধরণের জন্য তাকে ভাবা হচ্ছিলো জাভি হার্নান্দেজের উত্তরসূরী। যদিও জাভির শূন্যতা পূরণের জন্যই তাকে কিনেছিলো কাতালানরা, কিন্তু প্রথম থেকেই বার্সেলোনার পরিবেশের সাথে নিজেকে মেলাতে পারেননি গোমেজ। প্রথম একাদশে জায়গা না পেলেও লুইস এনরিকে প্রায় প্রতি ম্যাচেই তাকে খেলার সুযোগ করে দিতেন। বার্সেলোনার হয়ে ৭৮ ম্যাচ খেলেছেন তিনি। কিন্তু তার প্রতিভার সম্পূর্ণ ব্যবহার কখনোই করতে পারেননি। ধারাবাহিক ব্যর্থতায় একসময় ন্যু ক্যাম্প তাকে মাঠে নিয়মিত দুয়ো দিতে শুরু করে। তার আত্মবিশ্বাসের শেষ বিন্দুর মৃত্যু ঘটে তখনই।
লুইস এনরিকের পর আর্নেস্তো ভালভার্দের অধীনেও এক মৌসুম বার্সেলোনাতে ছিলেন তিনি। কিন্তু আর্থুর মেলো আসার পর তার স্থান যেন আরও পিছিয়ে যেতে থাকে। বার্সেলোনাতে জায়গা হারিয়ে বর্তমানে গোমেজ ধারে খেলছেন এভারটনের হয়ে। যদিও ইনজুরিজনিত কারণে এখনও প্রিমিয়ার লিগে অভিষেকই হয়নি তার।
ইব্রাহিম আফিলেই
ডাচ ক্লাব পিএসভির হয়ে জ্বলে ওঠা ইব্রাহিম আফিলেই’র উপর নজর পড়েছিলো পেপ গার্দিওলার। তিনি খুব দ্রুতই ক্যাম্প ন্যুতে নিয়ে আসেন তাকে। কিন্তু বার্সেলোনাতে ৫ মৌসুম কাটানো আফিলেই স্পেনের ক্লাব ছেড়েছিলেন সুপার ফ্লপের তকমা নিয়ে। ৫ মৌসুমের ভেতর মাত্র ৩ বছর আফিলেই বার্সেলোনার মূল দলে ছিলেন, আর ৩ বছরে খেলেছেন মাত্র ৩৬ ম্যাচ। অলিম্পিয়াকোস ও শালকেতে ধারে গেলেও সেসব ক্লাবে খেলার সুযোগই পাননি, উন্নতি তো দূরের কথা।
আফিলেই যখন পিএসভি থেকে বার্সেলোনায় এসেছিলেন, সামনে উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ ছিল তার। যদিও হেলাফেলা করে নয়, বরং তিনি নিজেই বার্সেলোনার আস্থা অর্জন করতে সক্ষম হননি। ন্যু ক্যাম্প থেকে যখন প্রিমিয়ার লিগের দল স্টোক সিটিতে গেলেন, সুযোগ এসেছিলো ক্যারিয়ারের অন্তিম সময়ে আরেকবার নিজেকে তুলে ধরার। কিন্তু এক মৌসুম পরই চিরতরে নিভে যান তিনি।
কেরিসন
সর্বশেষে এই লিস্টের বাইরে একজনের কথা বলি। কর্থিবা ও পালমেইরাসের হয়ে কয়েক মৌসুম ধরে টানা গোল করে কেরিসন নিজেকে আলোচনার টেবিলে নিয়ে এসেছিলেন। কিন্তু অখ্যাত এ স্ট্রাইকার ইউরোপের বড় ক্লাবে খেলার মতো দক্ষ ছিলেন না। অথচ বার্সেলোনা হুট করে ২০০৮ সালে তার পেছনে খরচ করলো ১৪ মিলিয়ন ইউরো।
যদিও বার্সেলোনা তাকে ব্যবহার করেনি, মূল দলে তার অভিষেকই হয়নি কখনো। ইউরোপে খেলার অভিজ্ঞতা যেন বৃদ্ধি পায়, সে কারণে তাকে যে মৌসুমে কেনা হয় সে মৌসুমেই ধারে পাঠানো হয় বেনফিকাতে। কিন্তু এই ধারের এক বছর কেরিসনের জন্য কোনো আনন্দের বার্তা আনতে পারেননি। এর পরের দুই বছর ফ্লোরেন্টিনা, সান্তোস, কর্থিবা বা ক্রুইজেরোতে ধারে কাটানোর পরও কেরিসনের কোনো উন্নতির লক্ষণ দেখা যায়নি। তার খেলার ধরণই বলে দিয়েছিলো, ইউরোপের জন্য তিনি যোগ্য নন। যদিও ইউরোপের ভয়াল স্মৃতির কারণে ব্রাজিলে গিয়েও কেরিসন আর ফর্মে ফিরতে পারেননি।
বার্সেলোনা কেরিসন ছাড়াও ডগলাস পেরেইরা, হেনরিখের মতো ল্যাটিন আমেরিকান খেলোয়াড়দের পেছনে অর্থ নষ্ট করেছে, সাথে শেষ করেছে তাদের ক্যারিয়ারও। অথচ এসব সাইনিংয়ের আগেই পরিষ্কার ধারণা ছিল কেরিসন বা ডগলাসদের মতো খেলোয়াড় কখনোই ইউরোপিয়ান ফুটবলের চাপ নিতে পারবেন না। এতে খেলোয়াড়দের দায় যেমন রয়েছে, দায় এড়ানোর উপায় নেই বার্সেলোনারও।