ক্রিকেটটা ছেড়েই দিতে চেয়েছিলেন সিকান্দার রাজা। ক্রিকেট তো বটেই, জীবনের ওপর থেকেই টান উঠে গিয়েছিলো জিম্বাবুয়ের এই অলরাউন্ডারের।
২০১৯ বিশ্বকাপের বাছাইপর্বটা পার হতে না পারা জিম্বাবুয়ের জন্য একটা জাতীয় দুর্যোগের মতো ব্যাপার ছিলো। এই ব্যর্থতার বলি হতে হয়েছে জিম্বাবুয়ের তখনকার অধিনায়ক গ্রায়েম ক্রেমার এবং দলের কোচ হিথ স্ট্রিক সহ টিম ম্যানেজমেন্টের সকলকে। সিকান্দার যদিও এই টুর্নামেন্টে নিজে দারুন সময় কাটিয়েছেন। ৩১৯ রান করার পাশাপাশি ৫ উইকেট নিয়ে বাছাইপর্বের সবচেয়ে দামী খেলোয়াড় হয়েছেন। কিন্তু এই পুরষ্কারও সিকান্দারকে সান্ত্বনা দিতে পারেনি।
ক্রিকেটের ওপর টান উঠে গিয়েছিলো তার। জিম্বাবুয়ের হয়ে ৮৫টি ওয়ানডে, ১০টি টেস্ট ও ২৮টি টি-টোয়েন্টি খেলা সিকান্দার বোর্ডকে জানিয়ে দিলেন, তিনি আর খেলবেন না। ফলে কেন্দ্রীয় চুক্তি হারালেন সিকান্দার। সেই সাথে পাকিস্তান ও অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে টি-টোয়েন্টি স্কোয়াড এবং পাকিস্তানের বিপক্ষে ওয়ানডে স্কোয়াডে রইলেন না তিনি। সিকান্দার এই সবকিছু ছেড়েছুড়ে চলে গেলেন ইংল্যান্ডে।
ইংল্যান্ডে একটা ক্লাব দলের হয়ে কিছু ক্রিকেট খেললেন। লাভ হলো না; সেই টানটা ফিরলো না। এরপর কানাডায় গেলেন গ্লোবাল টি-টোয়েন্টি খেলতে। আর এখানেই কোচ টম মুডির সাথে আলাপ করে একটা প্রেরণা খুঁজে পেলেন। আরেকবার যে নিজের জীবন ফিরে পেলেন ছোট দলের এই বড় তারকা।
সিকান্দার তার এই দুঃসহ সময় থেকে বের হওয়া সম্পর্কে বলছিলেন,
‘আমি জীবন উপভোগ করাই বন্ধ করে দিয়েছিলাম। ক্রিকেট তো দূরের কথা। আমার মনে একটা ঝড় বয়ে যাচ্ছিলো। লোকেরা কল্পনাও করতে পারে না, আমরা যখন বাছাইপর্ব পার হতে পারলাম না, তখন কী অবস্থার ভেতর দিয়ে গেছি এবং আমাদের সাথে কেমন ব্যবহার করা হয়েছে। এখনও সবকিছু ঠিক হয়ে গেছে, তা নয়। তবে অন্তত আমি আমার মানসিক শক্তিটা ফিরে পেয়েছি। আমি এখন ক্রিকেটটা উপভোগ করছি এবং পরিবারের সাথে থাকাটা উপভোগ করছি।’
‘সবচেয়ে বড় কথা হলো, আমি জীবন উপভোগ করা শুরু করেছি আবার। বন্ধুদের সাথে গলফ খেলছি। আপনি কল্পনা করতে পারেন, আমি বন্ধুদের সাথে দেখা করা বন্ধ করে দিয়েছিলাম? কারো সাথে দেখা করিনি। স্রেফ একা একা থাকতাম। কিচ্ছু করার ছিলো না আমার। টিভি দেখতাম না, সিনেমা দেখতাম না। ওরকম একটা সময়ে বসবাস করা স্রেফ একটা বিভৎস ব্যাপার। ওই সময় আমি কারো কাছে এটা বলিওনি। যদিও আমার মনে হয়, আমার পরিবার বুঝতে পারছিলো, আমি কিসের ভেতর দিয়ে যাচ্ছি।’
রাজা বলছিলেন, কানাডায় নেমেই এই অবস্থা নিয়ে মুডির সহায়তা চাইলেন তিনি। তার ধারণা, এই সহযোগিতা চাওয়াটা একটা বিরাট উপকার করেছে তার। এখন রাজা আবার ইংল্যান্ডে খেলার জন্য প্রস্তুত হচ্ছেন।
মুডির কাছে সহায়তা চাওয়ার ব্যাপারে রাজা বলছিলেন,
‘আমি টমকে বললাম, আমি আরেকবার খেলার জন্য আকর্ষণটা ফিরে পেতে চাই। আরেকবার ক্রিকেটটা উপভোগ করতে চাই। আমি শতভাগ দিতে না পারলেন জিম্বাবুয়ের ওই লাল জার্সিটা পরতে চাই না। জিম্বাবুয়ের জার্সি পরাটা একটা প্রাপ্তি, এটা অধিকার নয়। আমি এটা তখনই পরতে চাই, যখন আমি মানসিকভাবে, আবেগের জায়গায় এবং শারীরিকভাবে শতভাগ প্রস্তুত থাকবো।’
পাকিস্তানের শিয়ালকোটে জন্ম নেওয়া সিকান্দার রাজা হতে চেয়েছিলেন পাইলট। পরীক্ষাতেও উৎরে গিয়েছিলেন। কিন্তু চোখের সমস্যার কারণে বাদ পড়ে যান। সেখান থেকে অনেক লড়াই করে ক্রিকেটে এসেছেন, নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। তাই লড়াইটা সিকান্দার রাজার জন্য নতুন কিছু নয়।
তবে আরেকবার সিকান্দার জিম্বাবুয়ের ওই লাল জার্সি আসলেই পরবেন কি না, সেটা অনেক কিছুর ওপর নির্ভর করছে। জিম্বাবুয়ের ক্রিকেটাররা মাঝে ধর্মঘট শুরু করেছিলেন, তাদের বেতন কয়েক মাস বাকি পড়ায়। জিম্বাবুয়ে ক্রিকেট জুলাইয়ের ২৫ তারিখ টাকা দিয়ে দেবে বলেছিলো। সেটা হচ্ছে না। আরও পেছানো হয়েছে তারিখ। এ অবস্থায় জিম্বাবুয়ের ক্রিকেটারদের ভবিষ্যত অনিশ্চিত।
অন্য দিকে বিশ্বকাপ বাছাইপর্বের ব্যর্থতার ফলে অধিনায়ক, কোচকে বরখাস্ত করা এবং কোচ হিথ স্ট্রিকের বিপক্ষে বর্ণবাদী অভিযোগ আনা, এসব নিয়ে এখন রীতিমতো টলোমলো অবস্থা জিম্বাবুয়ের। এর মধ্যে আবার পাকিস্তানের কাছে একটার পর একটা বড় ব্যবধানে পরাজয়ে ভিত্তিই নড়ে গেছে দেশটির ক্রিকেটের।
কয়েকজন সহকারী কোচ আবার দলের কাজ ফিরে পেয়েছেন এবং তারা কাজ শুরুও করেছেন। কিন্তু ক্রেমার, রাজা, ব্রেন্ডন টেলর, ক্রেইগ আরভিন, শিন উইলিয়ামসের মতো খেলোয়াড়রা এখনও দলে যোগ দেননি। টটেন্ডো টাইবুর কাছ থেকে প্রধান নির্বাচকের পদ কেড়ে নেওয়া হয়েছে। ফলে ঘোর অনিশ্চয়তা এখন দেশটির ক্রিকেটে।
রাজা নিজেও নিজের ভবিষ্যত নিয়ে খুব একটা নিশ্চিত নন। তিনি বলছিলেন,
‘আমি জানি না আমার ভবিষ্যতে কী আছে। আমি তো এখন আর চুক্তিতে নেই। চুক্তি ৩১ জুলাই শেষ হওয়ার কথা ছিলো। কিন্তু আমাকে চুক্তি শেষ করে দিতে হয়েছে এক মাস আগে। কারণ, আমাকে এনওসি দেওয়া হচ্ছিলো না। আমি আশা করছি ৩১ জুলাইয়ের পর কোনো এক ধরনের যোগাযোগ আমার সাথে করা হবে। অন্তত আমি আর জাতীয় দলে খেলতে চাই কি না, এটা জানতে চাওয়া হবে। এটা (জাতীয় দলে খেলা) নির্ভর করছে চুক্তিটা কেমন হয়, তার ওপর। আমি দেখতে চাই, জেডসি (জিম্বাবুয়ে ক্রিকেট) আমাকে কেমন মূল্যায়ন করে। দেখি, তারা মনে করে কি না যে, আমি দলে কিছু যোগ করতে পারি।’
‘জুলাইয়ের ২৫ তারিখ আমাদের সব বকেয়া পাওনা পরিশোধ করার কথা ছিলো। সেই দিন তো খুব দূরে নেই। একবার পাওনা পরিশোধ হয়ে গেলে, আমি আশা করছি আমি ও জেডসি একটা আলোচনায় যেতে পারবো। আশা করি, আমি আমার জিম্বাবুয়ের ক্যারিয়ার ভবিষ্যতেও লম্বা করতে পারবো। আমি তো দীর্ঘ মেয়াদে যুক্ত থাকতে চাই। কিন্তু অতীত থেকে শিক্ষা নিতে হবে। আমাদের এখন থেকে সবকিছু সঠিক নিয়মে করতে হবে।’
রাজা আশা করছেন ভিন্স ভ্যান ডারের জেডসির উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগ পাওয়াটা একটা আলো দেখাতে পারে দুই পক্ষকেই। তিনি বলছিলেন,
‘বিশ্বকাপের পর জেডসির পক্ষ থেকে আমাদের খেলোয়াড়দের সাথে কোনো যোগাযোগ করা হয়নি। কোনো নিশ্চয়তা দেওয়া হয়নি আমাদের। আমাদের একটা অন্ধকারে রেখে দেওয়া হয়েছিলো। এটা মুখে একটা থাপ্পড় মারার মতো ব্যাপার ছিলো। ব্যাপারটা এরকম যে, তুমি বাছাইপর্ব পার হতে পারোনি, তাই তোমার আর দরকার নেই।’
‘যখন চেয়ারম্যান আমাদের সাথে যোগাযোগ করলেন, যা কিছু প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, কথা দিয়েছিলেন, কিছুই কাজে করা হয়নি। ফলে কতদিন অবধি এভাবে চলবে? আমরা এখন কোথায় যাবো? এখন ভিন্স ভ্যান ডার আছেন। ওনাকে উপদেষ্টা হিসেবে আনা হয়েছে। উনি খেলোয়াড় আর বোর্ডের ভেতর সেতু হিসেবে কাজ করবেন। আমি আশা করছি, উনি একজন কার্যকর সংযোগকারীতে পরিণত হবেন; দুই পক্ষের জন্যই। আশা করি, উনি সব ভুল ঠিক করে দিতে পারবেন। তবে পাওনা পরিশোধ হলে তবেই উনি কাজ শুরু করতে পারবেন।’
জিম্বাবুয়ের বর্তমান অবস্থা আর সবার মতো সিকান্দার রাজাকেও দারুন আহত করেছে। একটা সময় মনে হচ্ছিলো, জিম্বাবুয়ে দলটা স্থিতিশীল হয়েছে। সেই দলটাই হঠাৎ পথ হারিয়ে ফেলায় সিকান্দারও হতবাক,
‘আমি আসলে সব ম্যাচে (পাকিস্তান ও অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে) দেখতে পারিনি। কারণ, আমি ভ্রমণে ছিলাম। আমি দলের জন্য শুভকামনা ছাড়া আর কিছু করি না। কিন্তু যে অবস্থা হয়েছে এখন, তা সত্যিই বেদনাদায়ক।’
তারপরও সিকান্দার আশাবাদী হতে চান। নিজের জীবনে যেমন আবার আশাটা খুঁজে পেয়েছেন, তেমনই জিম্বাবুয়েকেও আবার স্বরূপে দেখতে চান,
‘আমি বিশ্বাস করি, আমরা আবার দ্রুত সেই উন্নয়নের মইটা বেয়ে উঠতে পারবো। আমরা স্রেফ বাছাইপর্ব পার হতে পারিনি বলে লোকেরা দুই বছরের পরিশ্রমটাকে ওভাবে বিচার করছে। জিম্বাবুয়ের ক্রিকেটের এখন যে অবস্থা, দেশের লোকেদের এর চেয়ে ভালো ফলাফল প্রাপ্য।’