আন্দ্রে রাসেল কি মাশরাফির সঙ্গে কথা বলে নিয়েছেন? কিংবা মুশফিকুর রহিম? দু’জনের সামনেই যখন অধিনায়ক হিসেবে প্রথমবার বিপিএল জয়ের হাতছানি, তখন মাশরাফির পরামর্শ তো তারা চাইতেই পারেন। ছয় আসরের মধ্যে চার-চারবার শিরোপা উঁচিয়ে ধরার কৃতিত্ব যার দখলে, তার কথা তো এ মুহূর্তে বেদবাক্যই মনে হবার কথা মুশফিক কিংবা রাসেলের কাছে!
ফাইনালের লড়াইয়ে মাশরাফি কোন অধিনায়ককে পরামর্শ দেবেন, বিধাতা কার দিকেই বা মুখ তুলে চাইবেন, সে উত্তর এখনো অজানা। তবে বঙ্গবন্ধু বিপিএলের ফাইনালের এ লগ্নে দাঁড়িয়ে আগের বিপিএলের আসরের ফাইনালগুলো নিয়ে দু-চার কথা জানা তো যেতেই পারে!
১ম আসর
বিজয়ী: ঢাকা গ্ল্যাডিয়েটর্স
প্রথম বিপিএল ফাইনাল। উত্তেজনার পারদ তাই চড়াই ছিল। মাঠের খেলায় অবশ্য উত্তেজনার প্রমাণ পাওয়া যায়নি বিন্দুবিসর্গও। টস জিতে ব্যাটিংয়ে নেমেছিল বার্নার্স। সেবারের আসরের সর্বোচ্চ রানসংগ্রাহক আহমেদ শেহজাদ ব্যর্থ হয়েছিলেন ফাইনালের মঞ্চ রাঙাতে। একপাশে অধিনায়ক ব্র্যাড হজ ছাড়া শেহজাদের সাথী হয়েছিলেন আর সবাই। ফলাফল, আগের ম্যাচেই ১৮৪ রান তাড়া করে জেতা দলটি ফাইনালে আটকে গিয়েছিল মোটে ১৪০ রানে।
আহমেদ শেহজাদের সঙ্গে সেবার দুর্দান্ত ফর্মে ছিলেন পাকিস্তানেরই আরেক উদ্বোধনী ব্যাটসম্যান ইমরান নাজির। গ্ল্যাডিয়েটর্সের হয়ে খেলতে আসা এই বিস্ফোরক ওপেনার জ্বলে উঠেছিলেন ফাইনালেও। ২৬ রানে নাজিমউদ্দীন প্যাভিলিয়নে ফিরলেও আনামুল হক বিজয়কে সাথে নিয়ে ইমরান নাজির গড়েছিলেন ১১০ রানের জুটি। বরিশালের দেয়া লক্ষ্যও ঢাকা পেরিয়ে গিয়েছিল ২৬ বল বাকি থাকতেই।
বিপিএলের শিরোপার সঙ্গে মাশরাফির সখ্যতার শুরুটাও সেদিন থেকেই।
২য় আসর
বিজয়ী: ঢাকা গ্ল্যাডিয়েটর্স
মাশরাফি, আশরাফুলরা ছিলেন প্রথম আসর থেকেই, দ্বিতীয় আসরের উন্মুক্ত নিলামে গ্ল্যাডিয়েটরস দলে ভিড়িয়েছিল সাকিব আল হাসান, পোলার্ড, দিলশানের মতো বিশ্ব ক্রিকেটের নামজাদা সব তারকাদেরও। বিপিএলের দ্বিতীয় আসর শুরুর আগেই তাই শিরোপা তুলে দেয়া যেত ঢাকা গ্ল্যাডিয়েটর্সের ঘরে।
ঢাকা সেবার খেলেছিলও ফেভারিটের মতোই। গ্রুপপর্ব শেষ করেছিল পয়েন্ট টেবিলের শীর্ষে থেকে, জয় পেয়েছিল ১২ ম্যাচের ৯টিতেই। প্রথম কোয়ালিফায়ারে সিলেট রয়্যালসকে হারিয়ে সবার আগে ফাইনালের টিকেট নিশ্চিত করেছিল ঢাকাই।
এলিমিনেটর আর দ্বিতীয় কোয়ালিফায়ার, দু’টিতেই জিতে ফাইনালে ঢাকার মুখোমুখি হয়েছিল চিটাগং কিংস।
ফাইনালের টস যদিও জিতেছিল চিটাগং, ম্যাচে তাদের জয়ের গল্পের ইতিও ঘটেছিল সেখানেই। ব্যাটিংয়ে নেমে এনামুল হক বিজয়ের অর্ধশতক এবং সাকিব আল হাসান আর মোহাম্মদ আশরাফুলের ছোট্ট দু’টি ঝড়ে ঢাকা ইনিংস শেষ করেছিল ১৭২ রানে। রান-তাড়ায় এক জেসন রয় আর অধিনায়ক মাহমুদউল্লাহ ছাড়া স্বচ্ছন্দ্য মনে হয়নি কিংসের আর কাউকেই। আগের দিনই দ্বিতীয় কোয়ালিফায়ার খেলার ক্লান্তি ফুটে উঠেছিল কিংসের বাদবাকি ব্যাটসম্যানদের ব্যাটে। ১৯ বল বাকি থাকতেই চিটাগং কিংস গুটিয়ে গিয়েছিল ১২৯ রানে।
আবারও বিপিএল জয়ী দল ঢাকা গ্ল্যাডিয়েটরস, বিজয়ী অধিনায়ক মাশরাফি বিন মর্তুজা।
৩য় আসর
বিজয়ী: কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ান্স
মিথটা গড়ে উঠতে শুরু করেছিল দ্বিতীয় আসর শেষেই, ৩য় আসর শেষে যা রূপ নিল বিশ্বাসে। টানা তিন আসরে কেউ শিরোপা উঁচিয়ে ধরলে, বিশ্বাস তো করতেই হবে, ‘বিপিএলের শিরোপাটা মাশরাফিরই সম্পত্তি’!
দ্বিতীয় এবং তৃতীয় আসরের মাঝে ব্যবধান ছিল প্রায় আড়াই বছরের। ফিক্সিং ইস্যুতে খোলনলচে বদলে গিয়েছিল বিপিএল, বাদ পড়েছিল আগের দুই আসরের চ্যাম্পিয়ন ঢাকা গ্ল্যাডিয়েটরস, বিপিএলের দলও একটি বেড়ে দাঁড়িয়েছিল সাতটিতে, ঢাকা ছেড়ে মাশরাফি ঠাঁই নিয়েছিলেন কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ান্সে।
এত বদলের মাঝেও অবশ্য বদলায়নি বিজয়ী অধিনায়কের নাম। গ্রুপপর্বে শীর্ষে থেকেই কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ান্স এসেছিল ফাইনালে, প্রতিপক্ষ ছিল মাহমুদউল্লাহ রিয়াদের বরিশাল বুলস। ফাইনালের মতো ফাইনাল, বিপিএল এমন কিছুর সাক্ষী হয়েছিল সেবারই।
মিরপুরের ধীরগতির উইকেটে টস হেরে বরিশাল তুলেছিল ১৫৬ রান, জয়ের জন্যে এই স্কোরকেই মানা হচ্ছিল ঢের। ইমরুল কায়েসের ব্যাটে অবশ্য ভিক্টোরিয়ান্সরা জবাবও দিতে শুরু করেছিল সমানে সমান, ইমরুল করেছিলেন ৩৭ বলে ৫৩। তবে ইমরুল বিদায় নিতেই খেলার চরিত্র গিয়েছিল পাল্টে। বলসংখ্যা কমলেও লক্ষ্যমাত্রা কমেনি সে অনুপাতে, উইকেটও পড়তে শুরু করেছিল সেই চাপে। বরিশালের হয়ে মোহাম্মদ সামি তাই যখন শেষ ওভার করতে এলেন, জয়ের জন্যে কুমিল্লার চাই ১৩ রান!
শেষ ওভারে দুই চার মেরে কুমিল্লার নায়ক বনে গিয়েছিলেন অলক কাপালি। অধিনায়ক তো ওই একজনই, মাশরাফি!
৪র্থ আসর
বিজয়ী: ঢাকা ডাইনামাইটস
এক আসর বাদে বিপিএলের শিরোপা ফিরেছিল ঢাকার ঘরেই। তবে এর চাইতেও বড় খবর তো জানা গিয়েছিল গ্রুপপর্ব শেষেই, বিপিএলের শিরোপা যাচ্ছে মাশরাফি ছাড়া অন্য কারও হাতে।
সেই অন্য কেউটা হয়েছিলেন সাকিব আল হাসান। আন্দ্রে রাসেল, ডোয়াইন ব্রাভো আর কুমারা সাঙ্গাকারাদের সাথে নিয়ে সাকিবের দল খেলেছিলও চ্যাম্পিয়নদের মতোই।
রাজশাহী কিংসের সঙ্গে ফাইনালের লড়াইয়েও এগিয়ে ছিল ঢাকা ডাইনামাইটসই। টস হেরে প্রথমে ব্যাট করে এভিন লুইস আর সাঙ্গাকারার দুটো ত্রিশোর্ধ্ব ইনিংসে ঢাকা থেমেছিল ১৫৯ রানে। জয়ের জন্যে তাই ছিল যথেষ্ট। ড্যারেন স্যামির ব্যাটে এলিমিনেটরের বাধা টপকালেও সেদিন স্যামি ছিলেন ব্যর্থ, ব্যর্থতার মিছিলে তার সঙ্গী হয়েছিলেন সাব্বির রহমান থেকে শুরু করে বাকি সবাই। স্কোরকার্ড ম্যাচের ব্যাপ্তি রাজশাহীর ইনিংসের ১৭.৪ ওভার অব্দি জানালেও সেদিনের ফাইনাল আদতে শেষ হয়ে গিয়েছিল এর বহু আগেই।
৫ম আসর
বিজয়ী: রংপুর রাইডার্স
আগের আসরে শিরোপা ফিরেছিল ঢাকাতে, এক আসর বাদেই শিরোপা পুনরায় ফিরল মাশরাফির হাতে। দল বদলে তখন যিনি রংপুর রাইডার্সের কাপ্তান।
টুর্নামেন্টের প্রায় শুরু থেকেই মাশরাফি দলে পেয়েছিলেন গেইলকে, আসরের মাঝপথে যোগ দিয়েছিলেন ব্রেন্ডন ম্যাককালাম। যে আশা নিয়ে রংপুর দলে ভিড়িয়েছিল তাদের, তা পূরণের জন্যে সবাইকে শেষ পর্যন্ত অপেক্ষায় রেখেছিলেন দু’জন। ফাইনালের মঞ্চে তাদের দু’জনের ব্যাটেই কচুকাটা হয়েছিল ঢাকা ডাইনামাইটসের বোলিং আক্রমণ।
অথচ, টস জিতে ঢাকা শুরুটা করেছিল দুর্দান্ত। আগের ম্যাচের সেঞ্চুরিয়ান জনসন চার্লসকে সাকিব প্যাভিলিয়নের পথ ধরিয়েছিলেন দ্বিতীয় ওভারেই। কিন্তু, কে জানত, ওয়ান ডাউনে নামা ‘বাজ’ ম্যাককালামকে সাথে নিয়ে গেইল এমন ছেলেখেলায় মেতে উঠবেন!
২৬ ছক্কার ম্যাচে গেইল একাই ছয় মেরেছিলেন ১৮টি, দ্বিতীয় সর্বোচ্চ তিনটি ছয় এসেছিল ম্যাককালামের ব্যাটে। দশ ওভার শেষে ৬৩ রানে থাকা রংপুরের ইনিংসশেষে সংগ্রহটা ছিল ২০৬, আউট হননি গেইল কিংবা ম্যাককালামের কেউই!
এভিন লুইস, কাইরন পোলার্ডদের নিয়ে গড়া ঢাকার ব্যাটিং লাইনআপের বিপক্ষেও এই রান অনতিক্রম্য ছিল। খুব বেশি অবশ্য নয়, রংপুরের সংগ্রহটা মাত্র ৫৭ রানই বেশি ছিল!
৬ষ্ঠ আসর
বিজয়ী: কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ান্স
জয়ের খুব কাছে এসে স্বপ্নভঙ্গের অনুভূতি কেমন? জানতে চাইলে জিজ্ঞাসা করে দেখতে পারেন সাকিব আল হাসানকে। টানা তিনবার কোনো শিরোপা নাকের ডগা থেকে মিইয়ে গেলে, এই প্রশ্নের উত্তরটা ওই অধিনায়কের জানবারই কথা।
আগের আসরে ঢাকার হন্তারক হয়েছিলেন ক্রিস গেইল। ৬ষ্ঠ আসরে ক্রিস গেইলের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন তামিম ইকবাল। তার ৬১ বলে ১২২ রানের টর্নেডো ইনিংসের পরেই আদতে নিশ্চিত হয়ে যায়, বিপিএলের শিরোপা ঢাকার পাওয়া হচ্ছে না এবারেও।
অপর প্রান্তে ব্যাটসম্যানরা ধুঁকলেও তামিমের ইনিংসটিই মূলত গড়ে দেয় ব্যবধান। কুমিল্লাও তাই ঢাকার সামনে ছুঁড়তে পারে ২০০ রানের লক্ষ্যমাত্রা। উপুল থারাঙ্গার ২৭ বলে ৪৪, কিংবা রনি তালুকদারের ৩৮ বলের ৬৪ রানের ইনিংস যে কেবল ব্যবধানই কমাবে, ম্যাচ প্রত্যক্ষকারী সব দর্শক তা জানতেন প্রথম ইনিংস শেষে। শেষমেশ ব্যবধানটা ঠিকই থেকে যায় ১৭ রানের। মাশরাফি, সাকিবের পর বিপিএলজয়ী তৃতীয় অধিনায়ক বনে যান ইমরুল কায়েস।
৭ম আসরের শেষ দৃশ্যের মঞ্চায়নে ক্রিস গেইল কিংবা তামিম ইকবালের ভূমিকায় কেউ দেখা দিয়েছেন কি না, সেটা নিশ্চয়ই এতক্ষণে জানা। শেষ ওভারের রোমাঞ্চে কেউ অলক কাপালির ভূমিকায় দেখা দিলে অবশ্য এই লেখকের মন্দ লাগবে না!