ক্রিকেটের আধুনিক যুগে অনেক ক্রিকেটারই পাঁচদিনের টেস্ট ম্যাচ খেলতে অনীহা প্রকাশ করেন। দর্শকরাও স্বল্পদৈর্ঘ্যের ম্যাচের প্রতি বেশি ঝুঁকে পড়েছে। তবু এখনও অনেক ক্রিকেটারেরই প্রথম পছন্দ টেস্ট ক্রিকেট। এমনই একজন ছিলেন অ্যালেস্টার কুক। গত এক যুগ ধরে অভিষেকের পর ইংল্যান্ডের হয়ে সব ক’টি টেস্ট ম্যাচে তিনি প্রতিনিধিত্ব করেছেন, ক্যারিয়ারজুড়ে একের পর এক দুর্দান্ত ইনিংস খেলার পর সাম্প্রতিক সময়ে ‘ফর্মহীনতা’র কারণে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটকে বিদায় জানান গত মাসে।
অ্যালেস্টার কুকের বিদায়ের পর দলে ডাক পান দীর্ঘদিন ধরে কাউন্টি ক্রিকেট খেলা জো ডেনলি। ৩৩ বছর বয়সী কুক আন্তর্জাতিক ক্রিকেটকে বিদায় জানানোর পর টেস্ট দলে প্রথমবারের মতো ডাক পান ৩২ বছর বয়সী জো। এর আগে ইংল্যান্ডের হয়ে সীমিত ওভারের ম্যাচ খেললেও কখনও টেস্ট দলে জায়গা পাননি তিনি।
কেন্টে তার সাবেক সতীর্থ এবং বর্তমানে ইংল্যান্ডের নির্বাচক এড স্মিথ তাকে প্রথমবারের মতো টেস্ট দলে ডাকেন। কুকের বিদায়ের পর তার চেয়ে মাত্র এক বছরের ছোট জো ডেনলি’র দলে ডাক পাওয়া নিয়ে কম কানাঘুষা চলছে না। অবশ্য এড স্মিথ এবারই প্রথম দল ঘোষণা নিয়ে সমালোচনার মুখে পড়েননি, জস বাটলার এবং আদিল রশিদকেও টেস্ট দলে অন্তর্ভুক্ত করে সমালোচনার মুখে পড়েছিলেন তিনি।
১.
প্রফেশনাল ক্রিকেটার্স অ্যাসোসিয়েশনের মতে, বর্তমানে কাউন্টিতে সবচেয়ে দামি ক্রিকেটার জো ডেনলি। তাই অনেকেই ধরে নিয়েছিলো, খুব শীঘ্রই সীমিত ওভারের ক্রিকেটে পুনরায় ডাক পাবেন তিনি। ডাক পাওয়াটাই অনুমেয়, গত কয়েক বছর কাউন্টি ক্রিকেটের পাশাপাশি বিশ্বের নানা প্রান্তে ব্যাট হাতে দুর্দান্ত সময় কাটিয়েছেন তিনি।
জো ডেনলিকে ২০১৯ সালের বিশ্বকাপে মঈন আলীর বিকল্প হিসাবে অনেকেই ভেবে রেখেছেন। কোনো কারণে যদি মঈন না খেলতে পারেন, তাহলে তার জায়গায় ডেনলিই উপযুক্ত। ব্যাট হাতে যেমন রান পাচ্ছেন, তেমনি তার পার্টটাইম লেগস্পিন বোলিংও বেশ কার্যকরী। কাউন্টিতে তার আগের দুই অধিনায়ক রব কি এবং স্যাম নর্থইস্ট তার লেগস্পিনকে খুব একটা গুরুত্ব দিতেন না, তবে কাউন্টিতে বর্তমান অধিনায়ক স্যাম বিলিংস আইপিএল খেলার জন্য যাওয়ার পর তিনি নিজেই নিজের লেগস্পিন সত্ত্বাকে জাগিয়ে তোলেন। তার সাম্প্রতিক পারফরম্যান্সই বলছে, লেগ স্পিনটা তিনি ভালোই রপ্ত করেছেন।
উপমহাদেশের মাটিতে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে পাঁচ ম্যাচ ওয়ানডে সিরিজে তার অলরাউন্ড নৈপুণ্য পরখ করার অন্যতম উপলক্ষ হিসাবে সবাই দেখেছিল। কিন্তু ইংল্যান্ডের নির্বাচকরা তাকে টেস্ট দলের জন্যও বিবেচনায় রেখেছেন। অ্যালেস্টার কুকের বিদায়ের পর ভঙ্গুর উদ্বোধনী জুটি সামাল দেওয়ার জন্য তাকে পরিকল্পনায় রেখেছে টিম ম্যানেজমেন্ট। শুধুমাত্র কীটন জেনিংসের নড়বড়ে ক্যারিয়ারের উপর ভরসা না করে নির্বাচকমণ্ডলী ডেনলির পাশাপাশি সারির ওপেনার রোরি বার্নসকেও প্রথমবারের মতো টেস্ট দলে ডাক দিয়েছেন।
২.
এত দ্রুত উপমহাদেশের মাটিতে তাদের সর্বকালের সেরা ব্যাটসম্যান অ্যালেস্টার কুকের অভাব পূরণ করা সম্ভব নয়। কিন্তু এখানেই তো আর থেমে থাকা যায়না। সবকিছুরই শেষ রয়েছে, কুকও বিদায় নিয়েছেন। শ্রীলঙ্কার মাটিতে তার অভিজ্ঞতার অভাব পূরণ করার জন্যই ডাক পেলেন ৩২ বছর বয়সী জো ডেনলি। এই কন্ডিশনে গত কয়েক বছরে অনেক ক্রিকেট খেলেছেন তিনি। বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগ, পাকিস্তান প্রিমিয়ার লিগে খেলার পাশাপাশি দেশের বাইরে বিগ ব্যাশেও খেলেছেন।
বিপিএলে ঢাকা ডায়নামাইটসের হয়ে ছয় ম্যাচে ৩১.১৬ ব্যাটিং গড়ে ১৮৭ রান করেছিলেন। পিএসএলেও দ্যুতি ছড়িয়েছেন তিনি, সেখানে করাচি কিংসের হয়ে ১২ ম্যাচে ৩২.৩০ ব্যাটিং গড়ে ৩২৩ রান সংগ্রহ করেছিলেন। বিগ ব্যাশের শুরু থেকে না খেললেও জেসন রয়ের অনুপস্থিতিতে সিডনি সিক্সার্সের হয়ে মাত্র চার ম্যাচ খেলেই শিরোনামে এসেছিলেন ডেনলি। চার ম্যাচে ৭৩.০০ ব্যাটিং গড়ে ১৪৬ রান করেছিলেন। ইংল্যান্ডের বাইরের লিগগুলোর পাশাপাশি ন্যাটওয়েস্ট টি-টোয়েন্টি ব্লাস্টেও তার ব্যাটে রানের ধারা অব্যাহত ছিলো। টুর্নামেন্টের সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক হিসাবে ১৪ ম্যাচে দু’টি শতকের সাহায্যে ৪৩.৬১ ব্যাটিং গড়ে ৫৬৭ রান করেছিলেন। রয়্যাল লন্ডন ওয়ানডে কাপেও রান পেয়েছেন, কেন্টের হয়ে ১১ ম্যাচে ৭০.২৮ ব্যাটিং গড়ে ৪৯২ রান সংগ্রহ করেছিলেন।
সীমিত ওভারের ক্রিকেটে দুর্দান্ত সময় কাটানোর পর তার ইংল্যান্ডের হয়ে রঙিন পোশাকে ডাক পাওয়াটা সময়ের ব্যাপার ছিলো। তবে সাদা পোশাকে ডাক পাওয়ার পর অনেকেই অবাক হয়েছিলেন। ডেনলি অবশ্য পুনরায় কেন্টে যোগ দেওয়ার পর কাউন্টি চ্যাম্পিয়নশিপেও দুর্দান্ত ব্যাটিং করেছেন। সর্বশেষ কাউন্টি চ্যাম্পিয়নশিপে ১৪ ম্যাচে তিনটি শতক এবং তিনটি অর্ধশতকের সাহায্যে ৮২৮ রান করেছিলেন, ২০১৭ মৌসুমেও কাউন্টি চ্যাম্পিয়নশিপে ২২৭ রানের ইনিংস খেলে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে নিজের সর্বোচ্চ রানের ইনিংস খেলেছিলেন। গত ২৪ মাসে প্রতিযোগিতামূলক ক্রিকেটের তিন ফরম্যাটে সাকুল্যে ১৪টি শতক হাঁকিয়েছেন।
৩.
জো ডেনলিকে দলে ডাক দেওয়ার প্রসঙ্গে এড স্মিথ বলেন,
“ফ্যান্টাসটিক অ্যাথলেট, ব্রিলিয়ান্ট মুভার, টাচ অফ ক্লাস। ডেনলি এমন একজন ক্রিকেটার হতে পারেন, যার সন্ধানে ইংল্যান্ড এতদিন ছিল। তার লেগস্পিন বোলিংয়েরও অনেক উন্নতি ঘটেছে। যদি জিজ্ঞেস করা হয় তাকে কেন দলে নেওয়া হয়েছে, তাহলে বলবো ক্রিকেটার হিসাবে তিনটি ডিপার্টমেন্টেই তার দক্ষতা রয়েছে।”
অন্তত এতটুকু পরিষ্কার, তাকে খুব সম্ভবত শুধুই ওপেনার হিসাবে দলে নেওয়া হয়নি। ওপেনিংয়ে ব্যাট করার জন্য রোরি বার্নস এবং কীটন জেনিংস রয়েছেন। তাকে তিন নাম্বারেও ব্যাট করতে দেখা যেতে পারে, সেই সাথে কার্যকরী লেগস্পিন তো আছেই। এই সম্পর্কে জো ডেনলি বলেন,
“আমি আমার ক্যারিয়ারটা শুরু করেছিলাম ওপেনার হিসাবে। এরপর তিনে নেমে গিয়েছিলাম, চার নাম্বারেও ব্যাট করেছি। আমি মনে করি, আমার এখন যেকোনো পজিশনে ব্যাট করার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। আমি যদি মূল একাদশে জায়গা পাই, তাহলে যেকোনো পজিশনে ব্যাট করি না কেন, আমার সুযোগটা কাজে লাগাতে হবে।”
ইংল্যান্ড একাদশ সাধারণত চারজন পেসার এবং দুইজন স্পিনার নিয়ে সাজানো হয়। কিন্তু উপমহাদেশের মাটিতে পেসারদের তুলনায় স্পিনাররা বেশি কার্যকরী, সে কথা মাথায় রেখেই টেস্ট দল ঘোষণা করা হয়েছে। টেস্ট দলে স্বীকৃত লেগ স্পিনার আদিল রশিদ এবং অফ স্পিনার মঈন আলী রয়েছেন, বাঁহাতি অর্থোডক্স বোলার জ্যাক লিচ এবং পার্টটাইম দুই স্পিনার জো ডেনলি ও জো রুট দলে রয়েছেন। বেশ কয়েকজন ভালো মানের অলরাউন্ডার থাকার কারণে তাদের দল সাজাতে হিমশিম খেতে হয় না। জো ডেনলি, জো রুট, মঈন আলীর পাশাপাশি আদিল রশিদও ব্যাট হাতে কার্যকরী। তাদের তিন পেসার বেন স্টোকস, ক্রিস ওকস এবং স্যাম কারেনও ব্যাট হাতে ফর্মে আছেন।
৪.
জোসেফ লিয়াম ডেনলি ১৯৮৬ সালের ১৬ই মার্চ কেন্টের ক্যান্টারব্যুরিতে জন্মগ্রহণ করেন। তার ক্রিকেট ক্যারিয়ার আচমকা সফলতার মুখ দেখেনি। তিনি অনুর্ধ্ব-১৭, ১৮ এবং ১৯ ক্রিকেট খেলে কাউন্টিতে এসেছেন। কেন্টের হয়ে ২০০৪ সালে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে এবং ২০০৫ সালে কাউন্টি চ্যাম্পিয়নশিপে অভিষেক ঘটে তার। ২০০৭ সালে ক্যান্টারব্যুরিতে হ্যাম্পশায়ারের বিপক্ষে দলীয় ১৯৯ রানের মধ্যে অপরাজিত ১১৫ রান করে ইংল্যান্ড লায়ন্স দলে সুযোগ পেয়ে যান। সেই যাত্রায় ভারতের বিপক্ষে ৮৩ রানের ইনিংস খেলেছিলেন। ঐ বছর প্রথমবারের মতো এক মৌসুমে সহস্রাধিক রান পূর্ণ করেছিলেন তিনি। জো ডেনলি ২০০৪ সাল থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত টানা ‘ডেনিস কম্পটন অ্যাওয়ার্ড’ জিতেছেন।
২০০৮ সালে সমারসেটের বিপক্ষে ক্যারিয়ারসেরা ১৪৯ রানের ইনিংস খেলার পর ২০০৯ সালে ইংল্যান্ড জাতীয় দলে ডাক পান ডেনলি। সবকিছুই চলছিলো ঠিকঠাক, ওয়ানডে দলে সুযোগ পেয়ে দু’টি অর্ধশতকও হাঁকিয়েছিলেন। কিন্তু অভিষেকের মাত্র এক মাসের মাথায়ই তাকে ওয়ানডে দল থেকে বাদ দেওয়া হয়।
এরপর প্রায় এক দশক পর আবারও ডাক পেয়েছেন। ২০০৯ সালে নয়টি ওয়ানডেতে ২৯.৭৭ ব্যাটিং গড়ে ২৬৮ রান করেছিলেন। পাঁচটি টি-টোয়েন্টিও খেলার সুযোগ পেয়েছেন, তবে নিজেকে প্রমাণ করতে ব্যর্থ হয়েছিলেন। পাঁচ ম্যাচে মাত্র ২০ রান সংগ্রহ করেছিলেন তিনি।
দল থেকে বাদ পড়ার পর কাউন্টিতেও ছন্দে ছিলেন না ডেনলি। তবে যখন নিজের ক্লাব কেন্টকে ছাড়ার সিদ্ধান্ত মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিলো, তখনই ক্যারিয়ারসেরা ১৯৯ রানের ইনিংস খেলেছিলেন ডার্বিশায়ারের বিপক্ষে। তবুও কেন্ট ছেড়ে নামীদামী ক্লাব মিডলসেক্সে যোগ দেন তিনি। তার মতে, ক্যারিয়ারের সবচেয়ে ভুল সিদ্ধান্ত ছিল এটি। মিডলসেক্সে গিয়ে রানখরায় ভোগার পাশাপাশি সাইডবেঞ্চেও বসে থাকতে হতো। তাই ২০১৫ সালে আবারও কেন্টে ফিরে আসেন তিনি।
কেন্টের হয়ে ২০১৬ সালে ২০৬ রানের ইনিংস এবং ২০১৭ সালে ২২৭ রানের ইনিংস খেলে আবারও শিরোনামে। সেই সাথে সীমিত ওভারের ক্রিকেটেও নিয়মিত পারফর্ম করছিলেন।
চলতি মৌসুমে তো তিনি সীমিত ওভারের ক্রিকেটে অসাধারণ ব্যাটিং করে নিজের পূর্বের সব রেকর্ড ভেঙে দিয়ে নতুন রেকর্ড গড়েছেন। এই মৌসুমে তিনি লিস্ট-এ ক্যারিয়ারের সর্বোচ্চ ১৫০* রানের ইনিংস খেলেছেন। সেই সাথে ন্যাটওয়েস্ট টি-টোয়েন্টি ব্লাস্টে প্রথম ক্রিকেটার হিসাবে একই ম্যাচে শতক এবং হ্যাটট্রিকের কীর্তি গড়েন তিনি।
জো ডেনলি এখন পর্যন্ত ১৮৯টি প্রথম শ্রেণির ম্যাচে ২৭টি শতক এবং ৫৪টি অর্ধশতকের সাহায্যে ৩৬.৩৭ ব্যাটিং গড়ে ১০,৯৮৬ রান করেছেন এবং বল হাতে ৬২ উইকেট শিকার করেছেন।
তিনি টি-টোয়েন্টি লিগগুলোতে বেশ পরিচিত মুখ। এখন পর্যন্ত ১৯১টি টি-টোয়েন্টিতে চারটি শতক এবং ২৯টি অর্ধশতক হাঁকিয়ে ২৮.৪৯ ব্যাটিং গড়ে ৪,৮৪৪ রান এবং ২৫ ইনিংসে বোলিং করে ২৪ উইকেট শিকার করেছেন। লিস্ট-এ ক্রিকেটেও তার রান সংখ্যা পাঁচ হাজার ছুঁইছুঁই।
শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে আসন্ন টেস্ট সিরিজে ইংল্যান্ডের দুশ্চিন্তার কারণ হলো টপ থ্রি। আর জো ডেনলি জানিয়েছেন, তিনি টপ থ্রি-এর মধ্যে যেকোনো পজিশনে ব্যাট করতে পছন্দ করবেন। যদিও কীটন জেনিংস, রোরি বার্নস এবং জেমস ভিন্সের এই তিন পজিশনে ব্যাটিং করার সম্ভাবনাই বেশি। তবে জো ডেনলি খুব শীঘ্রই ইংল্যান্ডের হয়ে সাদা পোশাকে ক্রিকেট খেলতে নামলে তিনিই প্রথম ক্যান্টারব্যুরিতে জন্মগ্রহণ করে কেন্টের ব্যাটসম্যান হিসাবে ইংল্যান্ড টেস্ট দলে খেলতে যাচ্ছেন।
Featured Image Credit: Getty Images