ভারতীয় ক্রিকেটের রূপকথার অংশ তিনি। সময়টা ছিল ১৯৮৮ সালের ফেব্রুয়ারি। শচীন টেন্ডুলকার তার সাথে মিলেই স্কুল ক্রিকেটে ৬৬৪ রানের অনন্য এক জুটি গড়েছিলেন। সেই জুটি গড়ার সময় শচীনের বয়স ছিল ১৫, আর তার বয়স ১৬।
তিনি হলেন বিনোদ কাম্বলি। ওই জুটিতে শচীন অপরাজিত ছিলেন ৩২৬ রানে। আর কাম্বলি অপরাজিত ছিলেন ৩৪৯ রানে। সেই ম্যাচের প্রসঙ্গ আসলেই এই জুটির কথা ওঠে। কিন্তু কেউ বলে না যে, এরপর বোলিংয়ে মাত্র ৩৭ রান দিয়ে ছয় উইকেট নিয়ে একাই সেন্ট জ্যাভিয়ার্সের ব্যাটিংয়ে ধ্বস নামান।
শুধু এখানেই নয়, কাম্বলি ক্যারিয়ারের শুরুর দিকে অনেক ক্ষেত্রেই শচীন টেন্ডুলকারের চেয়ে এগিয়েই ছিলেন। তবে, বিনোদ কাম্বলি যা হতে পারতেন, সেটা তার দ্বারা হয়নি। অন্যদিকে, শচীন টেন্ডুলকার প্রতিভার সাথে কাজে লাগিয়েছেন নিজের পরিশ্রমকে। ফলাফল, তিনি যখন ক্যারিয়ার শেষ করেন তখন ক্রিকেট ইতিহাসেরই অন্যতম সেরা তারকায় পরিণত হন।
শচীন যে কারণে পেরেছিলেন, ঠিক সেই কারণেই পারেননি কাম্বলি। এর মোক্ষম একটা ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন ভারতের প্রথম বিশ্বকাপজয়ী অধিনায়ক কপিল দেব। তিনি বলেন,
‘শচীন আর বিনোদ এক সাথেই খেলা শুরু করেছিল, একই রকম প্রতিভাধর ছিল। হয়তো কাম্বলির মধ্যে প্রতিভা একটু বেশিই ছিল। কিন্তু, সমস্যা ছিল তার সাপোর্ট সিস্টেমে। ও বাড়িতে যে পরিবেশ পেয়েছে, যেমন বন্ধুবান্ধবের সাথে মিশেছে, তা ছিল শচীনের চেয়ে একদমই আলাদা। পরে কী হয়েছে, সেটা আমাদের সবারই তো জানা। শচীন, ক্যারিয়ারকে ২৪ বছর লম্বা করেছে। আর কাম্বলি স্রেফ হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে, প্রথম জীবনে পাওয়া সাফল্যকে ধরে রাখতে পারেনি।’
কপিল দেব মনে করেন, একটি প্রতিভার বিকাশের জন্য আরো কয়েকটা বিষয়ের দরকার হয়। তিনি বলেন,
‘প্রতিভা অবশ্যই জরুরী। তবে, একজন ক্রীড়াবিদের তার চেয়েও বেশি কিছু দরকার। বন্ধুদের সমর্থন, বাবা-মা, ভাই, বোন, স্কুল-কলেজ… সব কিছুর সমর্থন চাই। সন্তানকে বড় হওয়ার সুযোগটা বাবা-মাকেই দিতে হবে। বাবা-মা’ই তো সন্তানকে মাঠে নিয়ে যাবেন, তাদের কাছ থেকেই তো সন্তান ভাল-মন্দ শিখবে।’
শচীনের চেয়ে তিন বছর পর টেস্ট অভিষেক হয়েছিল কাম্বলির। এর আগেই ১৯৮৯ সালে ছক্কা দিয়ে রঞ্জি ট্রফির ক্যারিয়ার শুরু করেছিলেন। টেস্টের অভিষেক সিরিজেই পেয়ে যান ডাবল সেঞ্চুরি। সেটা ছিল ১৯৯৩ সালের ফেব্রুয়ারি, ইংল্যান্ডের বিপক্ষে মুম্বাইয়ের ওয়াংখেড়ে স্টেডিয়ামে। খেললেন ২২৪ রানের মহাকাব্যিক এক ইনিংস। ঠিক এর পরের টেস্টেই জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে দিল্লীতে করলেন ২২৭ রান। প্রথম ভারতীয় ব্যাটসম্যান হিসেবে টানা দুই টেস্টে ডাবল সেঞ্চুরির দেখা পেলেন।
এর পরের সিরিজেই শ্রীলঙ্কা সফরে যায় ভারত। সেখানে গিয়ে আরো দু’টি সেঞ্চুরি। প্রথম আট ইনিংসে দু’টি সেঞ্চুরি আর দু’টি ডাবল সেঞ্চুরি। ভারতে ঐতিহাসিক ব্যাটসম্যানের আগমন হয়েছে – সংবাদমাধ্যমে এমন লেখালেখি হচ্ছিল। সমর্থকদের চোখের মণি হয়ে উঠছিলেন। দ্রুততম ভারতীয় ব্যাটসম্যান হিসেবে পৌঁছে গেলেন এক হাজার রানের মাইলফলকে। মাত্র ১৪টি টেস্ট লাগে তার এই মাইলফলকে পৌঁছাতে।
কিন্তু, রাতারাতি পাওয়া সেই স্টারডমের মাঝে তাল সামলাতে পারেননি কাম্বলি। তার মাঠের বাইরের জীবনটা ছিল বিশৃঙ্খলাপূর্ণ। মাদক আর নারীতে বুঁদ হয়ে ছিলেন। মাঠের জীবনে সেটা প্রভাব ফেলতে শুরু করে।
১৯৯৪ সালে যখন ভারত সফরে আসে ওয়েস্ট ইন্ডিজ, তখন ক্যারিবিয়ানদের পেসারদের সামনে তিনি দাঁড়াতেই পারছিলেন না। শর্ট বল ছিল তার প্রধান দুর্বলতা। আর সেটা শুধরানোর জন্য কোনোকালেই চেষ্টা করেননি তিনি। পার্টি থেকে ফুরসৎ মিললে না শুধরাবেন!
টেস্ট ক্যারিয়ারটা তাই দীর্ঘায়িত হয়নি তার, মাত্র ১৭ টেস্টেই থেমে যান। তখন তার বয়স মাত্র ২৪। এর মধ্যে শেষ সাত টেস্টে করেন মাত্র ১৪৭ রান। তারপরও ক্যারিয়ার শেষে তার ব্যাটিং গড় ছিল ৫৪.২০। একটু নিজেকে শুধরাতে পারলেই হয়তো কিংবদন্তি হতে পারতেন!
টেস্টে ভারতের হয়ে কমপক্ষে ২০ ইনিংস ব্যাট করেছেন, এমন ক্রিকেটারদের মধ্যে কাম্বলির ব্যাটিং গড় এখনো সবার ওপরে। এখানে তার চেয়ে পিছিয়ে আছেন শচীন, সুনীল গাভাস্কার, রাহুল দ্রাবিড়, সৌরভ গাঙ্গুলী, ভিভিএস লক্ষ্মণ, বীরেন্দর শেবাগ কিংবা বিরাট কোহলিরা।
টেস্টের চেয়ে ওয়ানডেটাই বেশি খেলেছেন। ২০০০ সালে সর্বশেষ তাকে ভারতের নীল জার্সিতে দেখা যায়। মোট ১০৪টি ওয়ানডে খেলেছেন, তাতে ৩২.৫৯ গড়ে দু’টি সেঞ্চুরি আর ১৪টি হাফ সেঞ্চুরিসহ করেন ২,৪৭৭ রান। তবে, ওয়ানডে দলেও তার জায়গাটাও কখনো পাকা ছিল না। এই ১০৪টা ওয়ানডে খেলতেই লেগেছে নয় বছর। এর মধ্যে নয় বার তিনি জায়গা হারিয়ে আবার ফিরেছেন।
ওয়ানডেতে অভিনব এক রেকর্ডের মালিক তিনি। ১৯৯৩ সালের ১৮ জানুয়ারি নিজের জন্মদিনে ৫০ ওভারের ক্রিকেটে নিজের জন্মদিনে সেঞ্চুরি করেন তিনি। জয়পুরে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে অপরাজিত ছিলেন ১০০ রানে। শচীন টেন্ডুলকার, রস টেলরদেরও একই রেকর্ড আছে।
ক্যারিয়ার শেষ করে অনেক কিছু করারই চেষ্টা করেছিলেন বিনোদ কাম্বলি। বলিউড, টেলিভিশন, রাজনীতি – কোনো কিছুই বাদ ছিল না। ২০০২ সালে তিনি সুনিল শেঠির ‘অনর্থ’ ছবিতে একটা চরিত্র করেছিলেন। এরপর ২০০৯ সালে আরেক ক্রিকেটার অজয় জাদেজার সাথে করেছিলেন ‘পাল পাল দিল কে সাথ’। কিন্তু কখনোই প্রশংসা কুড়ানোর মতো কোনো কাজ ছিল না সেগুলো। ২০০৯ সালে মহারাষ্ট্রে নির্বাচনে দাঁড়িয়েছিলেন। কিন্তু, লোক ভারতীয় পার্টির হয়ে মুম্বাই থেকে নির্বাচন করে বিরাট ব্যবধানে হেরেছিলেন।
২০০৯ সালে ‘সাচ কা সামনা’ নামের একটা টেলিভিশন অনুষ্ঠানে এসে সতীর্থদের অনেক বিষয়েই দোষারোপ করেছিলেন। তার দাবী ছিল, ১৯৯৬ সালের বিশ্বকাপে তিনি ম্যাচ পাতানোর গন্ধ পেয়েছিলেন। সন্দেহের তীর ছিল সাবেক অধিনায়ক আজহারউদ্দিনের দিকে। এমনকি তিনি এমন মন্তব্যও করেন যে, বন্ধু শচীনের সমর্থন পেলে হয়তো তিনি নিজের ক্যারিয়ারটা আরো লম্বা করতে পারতেন।
তবে, ক্রিকেট একদম ছেড়েছুড়ে দেওয়ার পরও নিজের ব্যক্তিগত জীবনটা তার স্বাভাবিক হয়নি। তার বিরুদ্ধে গৃহকর্মীকে পেটানোর অভিযোগ পাওয়া যায়। ২০১৩ সালে হার্ট অ্যাটাক করে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন, তখন বয়স মাত্র ৪১।
কাম্বলির ক্যারিয়ারের সবচেয়ে আইকনিক দৃশ্যে দেখা মিলেছিল ১৯৯৬ বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে। সেবার কোয়ার্টার ফাইনালে পাকিস্তানকে হারিয়ে আসার পর সেমিফাইনালে ভারতের সামনে ছিল ২৫২ রানের লক্ষ্য। তার জবাবে ওপেনিংয়ে নেমে শচীন টেন্ডুলকার ৬৫ রান করলেও ব্যর্থ হয় ভারতের টপ ও মিডল অর্ডার।
একটা সময় স্কোরটা দাঁড়ায় এমন – ১২০/৮। ১০ রান করে অপরাজিত আছেন কাম্বলি। ক্ষেপে যায় কলকাতার ইডেন গার্ডেনসের দর্শক। ম্যাচ রেফারি, আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য কেউই দর্শকদের সেই আক্রোশ থামাতে পারেননি। বিজয়ী ঘোষণা করা হয় শ্রীলঙ্কাকে। চোখে কান্না নিয়ে মাঠ ছেড়ে বের হয়ে যান কাম্বলি।
২০১১ সালে এক সাক্ষাৎকারে কাম্বলি বলেছিলেন,
‘আমরা পুরো টুর্নামেন্টে দারুণ খেলেছিলাম। কোয়ার্টার ফাইনালে পাকিস্তানকে হারিয়েছিলাম। পুরোনো ক্লিপিংয়ে আমাকে কাঁদতে কাঁদতে মাঠ থেকে বের হয়ে যেতে দেখা যায়। সত্যি কথা হলো, আজও আমার গাল বেয়ে অশ্রু ঝরছে!’
১৯৯৬ সালের সেই আক্ষেপ ঘোঁচে ২০১১ সালে এসে। ভারতকে দ্বিতীয়বারের মতো বিশ্বকাপ জয়ের আনন্দে ভাসায় মহেন্দ্র সিং ধোনির দল। প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপ ট্রফি হাতে নেন শচীন টেন্ডুলকার, কাম্বলির বন্ধু। এতগুলো বছরের পরিশ্রমের ফল এতদিনে এসে পেলেন শচিন। তার সমবয়সী কাম্বলি আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে অবসর নিয়েছেন ভারতের বিশ্বকাপ জয়ের বছর দুয়েক আগেই। আর ২০১১ সালেই বিদায় জানান সব ধরনের মাঠের ক্রিকেটকে। মানে, শচীনের বিশ্বকাপ জয় আর কাম্বলির বিদায়, দুটোই গাঁথা থাকলো একই সুতোয়।
একজন ক্রিকেটারের কী করা উচিৎ, আর কী এড়িয়ে যাওয়া উচিৎ – তাও যেন দেখিয়ে দিল চোখে আঙুল তুলে। শচীন ২৪ বছর জাতীয় দলকে সার্ভিস দিয়েছেন, আর বিনোদ কাম্বলি ২৮ বছর বয়সে শেষ খেলেছেন জাতীয় দলে – পার্থক্যটা এখানেই পরিস্কার!