লিস্ট-এ ক্রিকেটে শতক হাঁকিয়ে বিদায় জানানোর পর ‘বালখ লেজেন্ডস’-এর হয়ে আফগান প্রিমিয়ার লীগ খেলার জন্য শারজাহ পৌঁছান টি-টোয়েন্টির লেজেন্ড ক্রিস গেইল। ক্রিকেট ক্যারিয়ারের শেষের শুরুর দিনগুলো কাটাতে থাকা গেইল আসরের প্রথম তিন ম্যাচে যথাক্রমে ২০, ২০, এবং ১২ রান করে সাজঘরে ফেরেন। এরপরের ম্যাচ থেকেই নিজের দানবীয় রূপে ফিরে আসেন তিনি। টানা চারটি অর্ধশত রানের ইনিংস খেলে টুর্নামেন্ট শেষ করেন। তার দুর্দান্ত ব্যাটিং নৈপুণ্যে ‘বালখ লেজেন্ডস’ এপিএলের প্রথম শিরোপা ঘরে তোলে।
এপিএলের প্রথম শিরোপা ঘরে তোলার জন্য তার দল ‘বালখ লেজেন্ডস’-এর প্রয়োজন ছিল ১৩৩ রান। ব্যাট করতে নেমে প্রথম ওভারেই দুই উইকেট হারায় বালখ লেজেন্ডস। এরপর একাই ম্যাচ নিজেদের আয়ত্তে নিয়ে আসেন ক্রিস গেইল। মাত্র ৩৪ বলে চারটি চার এবং চারটি ছয়ের মারে ৫৬ রানের ইনিংস খেলেন তিনি, যার সুবাদে চার উইকেটের জয় পায় বালখ লেজেন্ডস। ৫৬ রানের ইনিংস খেলার পথে প্রথম ব্যাটসম্যান হিসেবে টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে ১২হাজার রানের মাইলফলক অতিক্রম করেছেন তিনি। টি-টোয়েন্টিতে তার বর্ণাঢ্য ক্যারিয়ার সম্পর্কে জেনে আসা যাক।
১.
অনেকেই ধরে নিয়েছে, টি-টোয়েন্টির ফেরিওয়ালা ক্রিস গেইলের সময় ফুরিয়ে এসেছে। ২০১৬ এবং ২০১৭ সালের আইপিএলে তার ব্যাটিং গড় ছিল যথাক্রমে ২২.২২ এবং ২২.২৭। তাই ৪০ বছরে পা দেওয়া এই মারকুটে ব্যাটসম্যানকে সর্বশেষ আইপিএলের নিলামে প্রথমে কোনো দলই দলে ভেড়াতে চায়নি। টি-টোয়েন্টির সেরা এই ব্যাটসম্যানকে শেষ পর্যন্ত কিংস ইলেভেন পাঞ্জাব ভিত্তিমূল্যেই নিজেদের করে নেয়। প্রথমে একাদশে সুযোগ না পেলেও পরবর্তীতে সুযোগ পেয়ে বুঝিয়ে দেন, তিনি এখনো ফুরিয়ে যাননি। প্রথম দুই ম্যাচেই ম্যাচজয়ী ইনিংস খেলেন তিনি। শেষ পর্যন্ত ২০১৮ মৌসুমে ১১ ম্যাচ খেলে ৪০.৮৯ ব্যাটিং গড়ে ৩৬৮ রান সংগ্রহ করেছিলেন তিনি।
বছরের শুরুতে নিষ্প্রভ থাকার পরও চলতি বছরে এখন পর্যন্ত টি-টোয়েন্টিতে প্রায় সহস্র ছুঁইছুঁই পরিমাণ রান সংগ্রহ করেছেন গেইল, ৩২ ম্যাচ খেলে আটটি অর্ধশতক এবং একটি শতক হাঁকিয়ে ৩৫.১৪ ব্যাটিং গড়ে ৯৮৪ রান সংগ্রহ করেছেন তিনি। তার তাণ্ডবলীলার ভাণ্ডার যে এখনো শেষ হয়ে যায়নি, সেটাই প্রমাণ করেছেন এপিএলে। ধ্বংসাত্মক ব্যাটিং করে এখনো বোলারদের রাতের ঘুম কেড়ে নেওয়ার সামর্থ্য রয়েছে তার।
২.
টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে ক্রিস গেইলের অভিষেক ঘটে ২০০৫ সালের ১৫ই সেপ্টেম্বর। এরপর থেকে এখন পর্যন্ত তিনি ২৪টি দলের হয়ে স্বীকৃত টি-টোয়েন্টি ম্যাচ খেলেছেন। সব জায়গাতেই ব্যাট হাতে সফল ছিলেন তিনি। এখন পর্যন্ত ৩৫৩টি টি-টোয়েন্টি ম্যাচ খেলে ৪০.৩০ ব্যাটিং গড় এবং ১৪৮.২৯ স্ট্রাইক রেটে ১২,০৫২ রান সংগ্রহ করেছেন। বিশ ওভারের ম্যাচে ৭৫টি অর্ধশতক হাঁকানোর পাশাপাশি একুশটি শতকও হাঁকিয়েছেন ওয়েস্ট ইন্ডিজের এই বাঁহাতি ব্যাটসম্যান।
বিশ্বের এই প্রান্ত থেকে ঐ প্রান্ত ঘুরে বেড়িয়ে খেললেও তার নৈপুণ্য ছিল একই রকমের। সব কন্ডিশনেই তিনি ব্যাট হাতে ঝড় তুলেছেন। আইপিএল, বিপিএল, সিপিএল, বিবিএল, এপিএল কিংবা ন্যাটওয়েস্ট টি-টোয়েন্টি ব্লাস্ট, যেখানেই খেলেছেন সেখানেই চার-ছক্কা হাঁকিয়ে দর্শকদের মনোরঞ্জন করেছেন। তিনি আইপিএলে ১১২ ম্যাচ খেলে ছয়টি শতক এবং ২৪টি অর্ধশতকের সাহায্যে ৪১.১৭ ব্যাটিং গড়ে এবং ১৫০.৭১ স্ট্রাইক রেটে ৩ হাজার ৯৯৪ রান সংগ্রহ করেছেন। বিদেশি ব্যাটসম্যানদের মধ্যে তিনি দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক, তার উপরে আছেন শুধুমাত্র ডেভিড ওয়ার্নার।
বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগে রান করতে যেখানে অন্যান্য ব্যাটসম্যানদের রীতিমত যুদ্ধ করতে হয়, সেখানেও হেসেখেলে চার-ছক্কা হাঁকান গেইল। বিপিএলে মাত্র ২৬ ম্যাচ খেলেই বিদেশি ব্যাটসম্যানদের মধ্যে সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক তিনি। ২৬ ম্যাচে তিনটি অর্ধশতকের বিপরীতে পাঁচটি শতক হাঁকিয়ে ৫৪.০৪ ব্যাটিং গড়ে এবং ১৭৩.৮১ স্ট্রাইক রেটে ১,১৩৫ রান সংগ্রহ করেছেন।
নিজ দেশে অনুষ্ঠিত সিপিএলেও সফল ক্রিস গেইল। এই টুর্নামেন্টে এখন পর্যন্ত সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক তিনি, ৬৬ ম্যাচ খেলে তিনটি শতক এবং ১৩টি অর্ধশতকের সাহায্যে ৪২.২২ ব্যাটিং গড়ে এবং ১৩২.৭৬ স্ট্রাইক রেটে ২,১১১ রান সংগ্রহ করেছেন। বিগ ব্যাশেও শতক হাঁকিয়েছেন এই মারকুটে ব্যাটসম্যান।
৩.
ক্রিস গেইল ৩৫৩টি টি-টোয়েন্টিতে ১২,০৫২ রান সংগ্রহ করেছেন। স্বীকৃত টি-টোয়েন্টিতে সর্বাধিক রান সংগ্রাহকদের তালিকায় দ্বিতীয় স্থানে থাকা ব্রেন্ডন ম্যাককালাম ৩৫৬ ম্যাচে ৩০.২৫ ব্যাটিং গড়ে ৯,৬২০ রান সংগ্রহ করেছেন। অন্যদিকে ম্যাককালামের চেয়ে তিন ম্যাচ কম খেলে ২,৪৩২ রান বেশি সংগ্রহ করেছেন গেইল। অথচ তালিকায় দশম স্থানে থাকা ব্র্যাড হজের চেয়ে মাত্র ২,২১৪ রানে এগিয়ে আছেন ম্যাককালাম।
সবচেয়ে বেশি শতক হাঁকানো কিংবা সবচেয়ে বেশি ছয় মারা ব্যাটসম্যানদের তালিকাতেও ক্রিস গেইল তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বীর চেয়ে বেশ বড় ব্যবধানে এগিয়ে আছেন। তিনি এখন পর্যন্ত টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে ২১টি শতক হাঁকিয়েছেন। দ্বিতীয় স্থানে থাকা মাইকেল ক্লিংগার ১৮০ ম্যাচে সাতটি শতক হাঁকিয়েছেন। ক্লিংগার ছাড়াও টি-টোয়েন্টিতে সাতটি করে শতক হাঁকিয়েছেন ব্রেন্ডন ম্যাককালাম এবং লুক রাইট। এছাড়া দুই অস্ট্রেলিয়ান ডেভিড ওয়ার্নার এবং অ্যারন ফিঞ্চ ছয়টি করে শতক হাঁকিয়েছেন।
গেইল এখন পর্যন্ত চার হাঁকিয়েছেন ৯১৯টি এবং ছয় হাঁকিয়েছেন ৮৯০টি। চার মারার দিক দিয়ে ব্রেন্ডন ম্যাককালাম খুব বেশি পিছিয়ে নেই। টি-টোয়েন্টিতে তিনিও ৯০২টি চার মেরেছেন। তবে ছয় হাঁকানোর দিক থেকে ক্রিস গেইলের ধারেকাছেও কেউ নেই। দ্বিতীয় স্থানে থাকা কাইরন পোলার্ড ৫৫১টি ছয় হাঁকিয়েছেন। পোলার্ডের চেয়ে ৩৩৯টি ছয় বেশি হাঁকিয়ে তালিকায় শীর্ষস্থানে আছেন গেইল। তালিকায় ষষ্ঠ স্থানে থাকা ক্রিকেট বিশ্বের আরেক বিধ্বংসী ওপেনার ডেভিড ওয়ার্নার তার টি-টোয়েন্টি ক্যারিয়ারে ৩২৩টি ছয় হাঁকিয়েছেন, যা গেইল এবং পোলার্ডের ছয়ের ব্যবধানের চেয়ে ১৬টি কম।
টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের রাজা ক্রিস গেইলের রেকর্ডগুলো যে অতি শীঘ্রই কোনো ব্যাটসম্যান টপকাতে পারবেন না, তা অনুমেয়। এই ব্যাটিং দানব একাই প্রতিপক্ষের হাতের মুঠো থেকে ম্যাচ ছিনিয়ে আনেন। এখন পর্যন্ত ৯৬ বার পঞ্চাশোর্ধ্ব রানের ইনিংস খেলা গেইল ৫৭ বার ম্যাচসেরার পুরস্কার জিতেছেন। ম্যাচসেরার পুরস্কার জয়ের ক্ষেত্রেও তিনি অন্যদের চেয়ে বড় ব্যবধানে এগিয়ে আছেন। দ্বিতীয় স্থানে থাকা শহীদ আফ্রিদি এখন পর্যন্ত ৩১ বার ম্যাচ সেরার পুরস্কার জিতেছেন, যা গেইলের চেয়ে ২৬ বার কম। সবচেয়ে বেশি ম্যাচ সেরার পুরস্কার জেতা ক্রিকেটারদের তালিকায় একাদশ স্থানে অবস্থান করা কাইরন পোলার্ড এখন পর্যন্ত ২৭ বার ম্যাচ সেরা হয়েছেন, যা দ্বিতীয় স্থানে থাকা আফ্রিদির চেয়ে মাত্র চারবার কম।
বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগের ফাইনালে রংপুরের হয়ে ম্যাচজয়ী ১৪৬ রানের ইনিংস খেলার পর সংবাদ সম্মেলনে তাকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, নিজেকে কি ‘টি-টোয়েন্টির ব্র্যাডম্যান’ বলবেন? তার উত্তরে তিনি বলেন,
‘নো, আই এম দ্য গ্রেটেস্ট অফ অলটাইম।’
অনেক ক্রিকেট বিশ্লেষক বলেন, ডন ব্র্যাডম্যানকে বাদ দিয়েই অন্যান্য ব্যাটসম্যানদের পরিসংখ্যান হিসাব করা উচিত। কারণ ‘দ্য ডন’ যেসব কীর্তি গড়ে গেছেন, তা টপকানো রীতিমতো অসম্ভব কাজ। তেমনি টি-টোয়েন্টিতে ক্রিস গেইল যেসব কীর্তি গড়েছেন, তা টপকানোও খুব একটা সহজ কাজ হবে না। এখন পর্যন্ত কোনো ক্রিকেটার সেই সম্ভাবনাই তৈরি করতে পারেননি।