ফুটবল এবং ফর্মেশন, খেলাটির সূচনালগ্ন থেকেই একে অপরের সাথে নিবিড়ভাবে জড়িত। আধুনিক ফুটবলে ম্যাচ কৌশলের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশ এই ফর্মেশন, যেখানে কোচের পরিকল্পনা অনুযায়ী আক্রমণ থেকে শুরু করে রক্ষণ দেয়াল গড়ার ভিত তৈরি হয়। শুরুর দিকে ফর্মেশন যে রূপ ছিল, শত বছরেরও বেশি সময়ে বিবর্তনে পর সেই রূপ অনেকটা বাংলা ভাষার আদিরূপের সাথে বর্তমান বাংলা ভাষাকে তুলনার মতোই।
ধাপে ধাপে ফুটবল ফর্মেশনে পরিবর্তন এসেছে ব্যাপকভাবে, তবে শুরুর দিকে পরিবর্তনের এই ধারায় সবচেয়ে বড় প্রভাবক হিসেবে কাজ করেছে ফুটবলের নিয়ম পরিবর্তন, পরিমার্জন ও পরিবর্ধন। ১-১-৮ ফর্মেশনের হাত ধরে শুরু হওয়ার পর আজকে তা এসে দাঁড়িয়েছে ৪-৩-৩ বা ৪-৩-২-১ এর মতো জনপ্রিয় ও বহুল ব্যবহৃত ফ্যাশনে। কৌশলের খাতিরে মাঝের দীর্ঘ এই সময়ে এসেছে আরও অনেক ফর্মেশন। সময়ের সাথে জনপ্রিয় সেই ফর্মেশনগুলো হারিয়ে গেলেও বর্তমান ধারার ফুটবলের জন্য তৈরি করে দিয়ে গিয়েছিল অসাধারণ এক পথ। আজকে সেসব হারিয়ে যাওয়া জনপ্রিয় ফর্মেশনগুলোর কথা তুলে ধরা হবে সংক্ষেপে।
১-১-৮ ফর্মেশন
প্রথম আন্তর্জাতিক ম্যাচে ১৮৭২ সালের ৩০ নভেম্বর মুখোমুখি হয় ইংল্যান্ড ও স্কটল্যান্ড, ম্যাচটিতে ইংল্যান্ডের ফর্মেশন ছিল ১-১-৮। যদিও ইংল্যান্ডের প্রতিপক্ষ ছিল তখন স্কটল্যান্ডের সবচেয়ে পুরনো ক্লাব কুইন্স পার্ক, কারণ স্কটল্যান্ডের ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন গঠিত হয় ম্যাচটির আরও তিন মাস পর। ম্যাচটিতে স্কটল্যান্ড ব্যবহার করেছিল ২-২-৬ ফর্মেশন, যা ১-১-৮ ফর্মেশনেরই পরিমার্জিত রূপ ছিল। উদ্ভট এই ফর্মেশনের পেছনে মূল কারণ ছিল অবশ্য তৎকালীন অফ-সাইডের নিয়ম।
তখন নিয়ম ছিলো, মাঠের যেকোনো স্থানেই যদি কোনো খেলোয়াড়কে বলের সামনে থাকা অবস্থায় পাস দেওয়া হয়, তাহলে তা অফ-সাইড হিসেবে বিবেচিত হবে! তাই অতিমাত্রায় এই আক্রমণাত্মক ফ্যাশনে খেলোয়াড়রা শারীরিক শক্তির পাশাপাশি ব্যক্তিগত নৈপুণ্যের দিকে বেশি নজর দিত, যেন ড্রিবলিং করে যত বেশি সংখ্যক প্রতিপক্ষের খেলোয়াড়দের কাটিয়ে গোলের সুযোগ তৈরি করা যায়। বর্তমানের আধুনিক ফুটবলের সাথে তুলনা করলে অদ্ভুত ঠেকলেও, শতাব্দী পুরনো এই ফ্যাশনে রক্ষণ ও মাঝমাঠে মাত্র একজন করে খেলোয়াড় ছিল এবং বাকি আটজন খেলোয়াড়ই থাকত আক্রমণভাগে!
নিয়মের বেড়াজালে আবদ্ধ থাকার কারণেই তখন ফুটবলে সৌন্দর্যের পরিবর্তে ছিল জগাখিচুড়ী ধরনের অবস্থা। তবে অবস্থার পরিবর্তন আসতে শুরু করে অফ-সাইডের নিয়ম বদলানোর সাথে সাথে এবং সেই সাথে ফুটবলে নতুন কৌশলের পাশাপাশি আবির্ভূত হয় নতুন ফর্মেশন, যা ফুটবলে খানিকটা সৌন্দর্য নিয়ে আসে।
২-৩-৫ (পিরামিড) ফর্মেশন
পূর্বসূরি ফর্মেশনের মতো একতরফা আক্রমণ কেন্দ্রিক না হয়ে এই ফর্মেশনে রক্ষণ ও আক্রমণের মধ্যে যথেষ্ট সঙ্গতিপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে ওঠে। ১৮৮০ সালের দিকে এই ২-৩-৫ বা পিরামিড ফর্মেশন ফুটবল মাঠে দেখা গেলেও, কৌশল বিবেচনায় ও অফ-সাইড নিয়মে পরিবর্তন আসার দরুন ১৮৯০ সালের মধ্যে গোটা ফুটবল দুনিয়ায় দারুণ জনপ্রিয়তা লাভ করে। শুধু জনপ্রিয়তাই নয়, ১-১-৮ ফর্মেশনের মতো সহসা হারিয়ে না গিয়ে একটা দীর্ঘ সময় ফুটবল মাঠে টিকে ছিল এই ফর্মেশন। এই ফর্মেশন ব্যবহার করেই ১৯২৪ ও ১৯২৮ সালের অলিম্পিকে স্বর্ণপদক এবং ১৯৩০ সালের প্রথম বিশ্বকাপ জিতে নিয়েছিল উরুগুয়ে।
১৯০৭ সালের পূর্ব-পর্যন্ত মাঠের যেকোনো স্থানেই অফ-সাইডের ফাঁদে পড়তো খেলোয়াড়েরা, এমনকি তারা যদি নিজেদের ডি-বক্সের ভেতরে বা গোললাইনের কাছাকাছিও থাকতো! এরপর অবশ্য অফ-সাইড প্রয়োগের সীমা নির্ধারণ করে দেওয়া হয় প্রতিপক্ষের অর্ধ থেকে এবং একইসাথে গোল-কিক ও কর্নারের সময় অফ-সাইড বাদ দেওয়া হয়। নতুন এই অফ-সাইডের নিয়ম প্রয়োগ করার ফলে আক্রমণ ও রক্ষণের মধ্যে একটা সামঞ্জস্য গড়ে তোলা জরুরি হয়ে পড়েছিল এবং এই কাজটিতে বেশ সফলতা এনে দেয় পিরামিড ফর্মেশন।
পিরামিড ফ্যাশনে একজনের পরিবর্তে দুজন ডিফেন্ডার ব্যবহার করা শুরু হয় এবং তাদের ঠিক উপরে থাকত তিনজন মিডফিল্ডার এবং সেন্টার ফরোয়ার্ডকে কেন্দ্র করে আক্রমণে থাকত মোট পাঁচজন খেলোয়াড়। দুজন ডিফেন্ডার মূলত রক্ষণ সামাল দিত রক্ষণের ঠিক কেন্দ্র দিয়ে এবং তাদের কাজ ছিল প্রতিপক্ষের কেন্দ্রে থাকা তিন ফরোয়ার্ডের (সেন্টার ফরোয়ার্ড ও দুজন ইনসাইড ফরোয়ার্ড) জোনালি মার্ক করা।
মাঝমাঠে থাকা মিডফিল্ডারদের বলা হতো হাফব্যাক, যারা প্রতিপক্ষের উইঙ্গার ও ইনসাইড ফরোয়ার্ডদের আটকানোর পাশাপাশি আক্রমণ গড়ে তুলতেও সাহায্য করতো। এক্ষেত্রে অবশ্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতো তিনজনের মাঝে থাকা হাফব্যাক বা সেন্টার মিডফিল্ডার, যার কাজ ছিল আক্রমণ শুরু করতে সাহায্য করার পাশাপাশি প্রতিপক্ষের সেন্ট্রাল ফরোয়ার্ড বা সবচেয়ে বিপদজনক খেলোয়াড়কে মার্ক করা।
৩-২-২-৩ ফর্মেশন বা W-M ফর্মেশন
প্রতিপক্ষকে পরাভূত করতে ফুটবলে শারীরিক ও ব্যক্তিগত নৈপুণ্যের পাশাপাশি বিভিন্ন কৌশলের আবির্ভাব হতে থাকে, যা ফুটবল নিয়ে আরও গভীরভাবে চিন্তা করার দুয়ার খুলে দেয়। অফ-সাইডের নিয়মের কারণে অফ-সাইডের ফাঁদ তৈরি করা জনপ্রিয় হতে শুরু করে, যেহেতু ফুটবলে ধীরে ধীরে রক্ষণ ও আক্রমণে একটা সামঞ্জস্য চলে আসতে শুরু করেছে। প্রতিপক্ষের আক্রমণভাগের খেলোয়াড়কে পেছনে ফেলে ডিফেন্ডাররা তড়িৎ গতিতে তাদের সামনে চলে আসায় এবং অফ-সাইডের নিয়মের কারণে ১৯২৫ পর্যন্ত খেলা অনেকটা মাঝমাঠে সংকুচিত হয়ে ছিল, যা কার্যকরী হলেও ফুটবলের স্বাভাবিক গতি নষ্ট করছিল। অসাধারণ নৈপুণ্যের সাথে এই কৌশলের পূর্ণ সুবিধা নিয়েছিল নিউক্যাসলের ডিফেন্ডার বিলি ম্যাকক্যারেন এবং মনে করা হয়, ১৯২৫ সালে অফ-সাইডের নিয়ম পরিবর্তনের জন্য তিনিই অনেকটা দায়ী।
১৯২৫ সালের নতুন অফ-সাইড নিয়মে বলা হয়, একজন খেলোয়াড়ের সামনে যদি প্রতিপক্ষের কমপক্ষে দুজন খেলোয়াড় (গোলরক্ষকসহ) থাকে, তাহলে বল পাস করার পর তা অফ-সাইড হিসেবে বিবেচনা করা হবে না। নতুন এই নিয়মের কারণেই ফুটবল কোচেরা নতুন করে ভাবতে বাধ্য হয় এবং তৈরি হয় নতুন ফর্মেশনের, যা কৌশলগতভাবে রক্ষণকে আরও সুদৃঢ় করেছিল।
১৯৩০ সালের দিকে আর্সেনালের দায়িত্বে থাকা কিংবদন্তি হার্বার্ট চ্যাপম্যানের হাত ধরে গড়ে ওঠে W-M বা ৩-২-২-৩ ফর্মেশন, যা ২-৩-৫ ফর্মেশনের সবচেয়ে অসাধারণ সংস্করণ। আর্সেনালের সোনালী যুগের শুরুর দিকে এই ফর্মেশন ব্যাপকতা লাভ করে এবং ফুটবলীয় চিন্তাভাবনার পাশাপাশি নতুন দিগন্তের উন্মোচন করে। এই ফর্মেশনেই প্রথমবারের মতো তিনজন ডিফেন্ডার দিয়ে রক্ষণভাগ সাজানো হয় এবং তাদের সামনের দুজন হোল্ডিং মিডফিল্ডার বা হাফব্যাক মিলে তৈরি হয় ‘M’। ‘M’ বা হোল্ডিং দুই মিডফিল্ডারের ঠিক উপরে দুই সেন্টার মিডফিল্ডার বা ইনসাইড ফরোয়ার্ড এবং তাদের উপরে আক্রমণভাগের তিনজন খেলোয়াড় (একজন সেন্টার ফরোয়ার্ড ও দুইজন উইঙ্গার) মিলে তৈরি হয় ‘W’। ২-৩-৫ ফর্মেশনের ইনসাইড ফরোয়ার্ডদের অনেকটা নিচে নামিয়ে মাঝমাঠে নিয়ে এসে দুজন মিডফিল্ডার দিয়ে দলকে সাজিয়েছিলেন চ্যাপম্যান।
এই ফ্যাশনে রক্ষণ, মাঝমাঠ ও আক্রমণভাগের সাথে নিরবচ্ছিন্ন যোগসূত্রের পাশাপাশি ফুটবলের দারুণ গতি এনে দিয়েছিল, যা ইংল্যান্ডে ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে। রক্ষণের সময় ডিফেন্ডার তিনজন কাছাকাছি থেকে রক্ষণভাগ সামাল দিলেও প্রতি-আক্রমণের সময় আটকাতে কিংবা প্রতি-আক্রমণ করতে দুই পাশে ছড়িয়ে যায়। ঠিক এই সময়ে তৈরি হওয়া তাদের ফাঁকা জায়গা পূরণ করতে সাহায্য করে দুই হোল্ডিং মিডফিল্ডার।
এই ৩-২-২-৩ ফর্মেশনেরই আরেকটু পরিমার্জিত সংস্করণ বলা যায় ৩-২-৫ ফর্মেশন, যেখানে আক্রমণভাগ শাণিত করা হয় পাঁচজন খেলোয়াড় দিয়ে। তিন ডিফেন্ডার ও দুই মিডফিল্ডারের উপরে আক্রমণভাগে একজন সেন্টার ফরোয়ার্ডের উভয় পাশেই ব্যবহার করা হয় দুজন করে উইঙ্গার। হাঙ্গেরির বিপক্ষে ওয়েম্বলিতে ৬-৩ গোলে পরাজিত হওয়ার পর ১৯৫০ সালের দিক W-M ফর্মেশন প্রায় বিলুপ্ত হতে শুরু করে।
২-৩-২-৩ (মেতোদো) ফর্মেশন
মেতোদো বা ২-৩-২-৩ ফর্মেশনের ব্যাপারে শুরু করার আগে বলে নেওয়া ভালো, এই ফর্মেশন ব্যবহার করেই ভিত্তোরিও পোজ্জোর ইতালি ১৯৩৪ ও ১৯৩৮ সালে টানা দুই বিশ্বকাপ জিতে নিয়েছিল। সেই সাথে ১৯৩৬ সালের অলিম্পিকে স্বর্ণজয়ী দলটিও ছিল এই ইতালি। পোজ্জো মেতোদো ফর্মেশনের শুরু করেন ইতালির দায়িত্ব নেওয়ার পর ১৯৩০ সালের দিকে, যা ২-৩-৫ ফর্মেশনের সামান্য পরিবর্তিত সংস্করণ।
পোজ্জো চেয়েছিলেন প্রতিপক্ষকে মাঝমাঠেই নিষ্ক্রিয় করে দিয়ে আক্রমণের ধার আগেই কমিয়ে দিতে, আর এই কাজ করার জন্য তিনি শুধুমাত্র ২-৩-৫ ফর্মেশনের মতো তিন হাফ ব্যাকের উপর নির্ভর করতে চাননি। হাফ ব্যাকদের সহযোগিতা করার জন্য তিনি ২-৩-৫ ফর্মেশনের আক্রমণভাগের দুই ইনসাইড ফরোয়ার্ডকে খানিকটা নিচে নামিয়ে হাফব্যাক ও আক্রমণভাগের মাঝে নিয়ে এসেছিলেন এবং আক্রমণভাগ সাজিয়েছিলেন একজন সেন্টার ফরোয়ার্ডের দু’পাশে দুজন উইঙ্গার দিয়ে। অসাধারণ এই দূরদৃষ্টির বদৌলতে খুবই সাধারণ পরিবর্তন এনেই ইতালিকে টানা দুটি বিশ্বকাপ এনে দিয়েছিলেন এই কিংবদন্তি। তবে পোজ্জো পরবর্তী ইতালিতে বা ফুটবল বিশ্বে এই ফর্মেশনের উল্লেখযোগ্য ব্যবহার দেখা যায়নি।
ফিচার ইমেজ- yourtacticalanalyst.com