পাঠক, জর্জ উইয়াহকে চেনেন? গুগলের শরণাপন্ন হলে প্রথমেই দেখাবে, তিনি বর্তমানে লাইবেরিয়ার প্রেসিডেন্ট। অথচ তার আরো বড় একটি পরিচয় রয়েছে, তিনি ১৯৯৫ সালের বর্ষসেরা খেলোয়াড়, একসময়ের মাঠ কাঁপানো স্ট্রাইকার। উইয়াহ একসময় পিএসজিতে খেলতেন। সেই সময়ে তার করা একটি গোলকে তিনি আজও সযত্নে মনে করেন। উয়েফা কাপের কোয়ার্টার ফাইনালে রিয়াল মাদ্রিদকে ৪-১ গোলে হারানোর ম্যাচে তার গোলটিকে। সেই ৪-১ শুধু একটা স্কোরলাইনই ছিল না, এটি ছিল এক ঐতিহাসিক কামব্যাক।
প্রথম লেগে ৩-১ গোলে মাদ্রিদের কাছে হেরে আসার পর হয় ২-০ জয় বা এর বেশি গোলের জয় লাগতো এই ফরাসি ক্লাবের। সেসময় খুব বেশি খ্যাতির আলোয় না থাকা পিএসজি হারিয়ে দিয়েছিল জায়ান্ট রিয়াল মাদ্রিদকে। এই ২০১৭-১৮ চ্যাম্পিয়ন্স লিগেও নক আউট পর্বের ম্যাচে রিয়ালের মাঠে রিয়াল জিতেছে ৩-১ গোলে। আবার কি হবে কামব্যাক, নাকি প্যারিসে উড়বে সাদা কেতন?
প্রথম লেগের আগে আমরা বারবার বলেছি, সেই সময়কার বা এখনকার ঘরোয়া ফর্মের বিবেচনায় পিএসজি পরিষ্কার ফেভারিট, কিন্তু খেলাটি চ্যাম্পিয়ন্স লিগে হওয়ায় রিয়ালকে হিসাবের বাইরে ফেলাটা অনুচিত। এই টুর্নামেন্টের আভিজাত্যের সাথে রিয়াল সমার্থক। সেটি তারা দেখিয়েও দিয়েছে এক গোলে পিছিয়ে পড়ার পর ফর্মের তুঙ্গে থাকা পিএসজিকে তিন গোল দিয়ে। কিন্তু চ্যাম্পিয়ন্স লিগের উত্তেজনার একটি বড় কারণ এর অনিশ্চয়তা আর সেটির মূল উৎস হলো ‘অ্যাওয়ে গোল’। ব্যাপারটি একটু বলে নেওয়া যাক। দুই ম্যাচ মিলিয়ে গোলসংখ্যা সমান হলে যে দল অপরের মাঠে বেশি গোল করেছে, সেই দল উঠে যাবে। সেই হিসাবে পিএসজি ২-০ গোলে জিতে গেলে ৩-৩ হবে স্কোর, কিন্তু রিয়ালের মাঠে পিএসজির গোল থাকায় পিএসজি উঠে যাবে। যেহেতু পিএসজির অ্যাওয়ে গোল আছে, প্রতিযোগিতায় এখনো পুরোপুরি প্রাণ রয়ে গিয়েছে। অর্থাৎ এখন অবধি মৌসুমের সেরা লড়াইয়ে শেষকথা বলার সময় আসেনি।
পিএসজির টুকিটাকি
এই ম্যাচের আগে পিএসজি পেয়েছে সম্ভাব্য সবচেয়ে বড় দুঃসংবাদ, নেইমারের ইনজুরি। দলের সেরা খেলোয়াড়কে হারানো তাদের জন্য কতটা খারাপ হয়েছে তা বোঝার জন্য নেইমারের এবারের মৌসুমের পরিসংখ্যান বললেই হবে। অর্ধেক মৌসুম যেতে না যেতেই তিনি করেছেন ২৮ গোল আর ১৬ অ্যাসিস্ট। রিয়ালের মাঠে পিএসজির একমাত্র গোলটি তারই বানিয়ে দেওয়া। সেই নেইমারের জায়গায় নামবেন ডি মারিয়া। দারুণ ফর্মে থাকা ডি মারিয়াকে মাদ্রিদের মাঠে প্রথম লেগে না খেলানোটা অনেকেরই চোখে ঠেকেছে বিশ্রীভাবে। ডি মারিয়াকে রিয়ালের সমর্থকগণ ভালোই চেনেন। ১২ বছরের অপেক্ষা ঘুচিয়ে দশম চ্যাম্পিয়ন্স লিগ এনে দেওয়ার অন্যতম প্রধান কারিগর এই ডি মারিয়া।
মারিয়াকে নিয়ে রিয়ালের সুখস্মৃতির অভাব নেই। সময়ের দাবিতে আজ ডি মারিয়া চাইবেন তাদের দুঃস্বপ্ন হয়ে দাঁড়াতে। আর তেমন কোনো বড় ইনজুরি সংবাদ নেই পিএসজি শিবিরে। ভেরাত্তি ও মার্কুইনহোস ইনজুরি কাটিয়ে ফিরে এসেছেন। আগের লেগে পুরো ফিট না থাকা মোত্তা ও লাসানা দিয়ারাও পুরোদমে প্রস্তুত। মার্শেইয়ের সাথে ম্যাচে আঘাত পাওয়ার পর ভাবা হচ্ছিল এমবাপ্পে না-ও খেলতে পারেন। আসলে এমন ক্ষেত্রে কোচ প্রায়ই মাইন্ডগেম খেলে থাকেন। ইউরোপিয়ান ফুটবলে মাইন্ডগেম নিয়ে আমাদের লেখাটি পড়লে সহজেই বুঝতে পারবেন, কেন ভুয়া ইনজুরির খবর দেওয়া হয় বা সত্যটা গোপন করা হয়।
রিয়ালের হালহকিকত
রিয়ালের হয়ে কেবলমাত্র জেসাস ভালেহো ইনজুরির জন্য মাঠের বাইরে, যেটি রিয়ালের জন্য তেমন বড় কোনো ধাক্কা না। কারণ, তরুণ এই ডিফেন্ডারকে কদাচিৎ মাঠে নামায় রিয়াল। ইনজুরি কাটিয়ে ফিরে এসেছেন প্রথম লেগের আসল নায়ক মার্সেলো। নিষেধাজ্ঞা কাটিয়ে ফিরে এসেছেন রাইটব্যাক দানি কারভাজালও। তাই রিয়াল পাচ্ছে প্রথম পছন্দের ডিফেন্সকেই। সমস্যা হলো গত দুইবারের টানা চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জয়ের মাঝমাঠ কাণ্ডারি ক্রুস ও মড্রিচের দুজনই পড়েন ইনজুরিতে। যদিও দুজনই ফিরে এসেছেন, তবে পুরো সুস্থ কিনা বোঝা যাচ্ছে না। সেক্ষেত্রে জিদান তাদের কথার উপরই নির্ভর করবে যে, তারা গোটা ম্যাচ খেলতে পারবে কিনা। যদি দুজনই সুস্থ থাকে পুরো, তবে ক্যাসেমিরোর সাথে দুজনই শুরু থেকে খেলবেন।
তবে অতীত অনুযায়ী এটি হওয়ার সম্ভাবনা কম। সাধারণত জিদান ইনজুরি থেকে ফেরার পর কাউকেই হুটহাট খেলান না। আবার ২০১৫-১৬ মৌসুমে বার্সার কাছে হোম ম্যাচে ৪-০ গোলে হারের দগদগে স্মৃতি রয়েছে, যে ম্যাচে রিয়াল সদ্য ইনজুরি থেকে আসা দুজনকে নামিয়েছিল মাঠে। বিভিন্ন উৎস থেকে পাওয়া খবর অনুযায়ী বড় সম্ভাবনা এমন যে, ক্রুস বা মড্রিচের মধ্যে যেকোনো একজন শুরু থেকে খেলবেন ও আরেকজন ম্যাচের অবস্থা বুঝে মাঠে নামবেন। সেক্ষেত্রে কোভাচিচ খেলবেন শুরু থেকেই।
কিছু চমকপ্রদ তথ্যে মহারণ
- নকআউট ম্যাচের প্রথম লেগ ৩-১ এ হারা দল মাত্র ৩৩ শতাংশ বার পরের রাউন্ডে যেতে পেরেছে।
- রিয়াল পিএসজির শেষ তিন দেখায় রিয়াল অপরাজিত (২টি জয় ও ১টি ড্র), রিয়াল গোল হজম করেছে মাত্র একটি।
- পিএসজির মাঠে গত তিন বছরের মধ্যে একমাত্র যে দলটি পিএসজিকে গোলবঞ্চিত করেছে সেটি রিয়াল মাদ্রিদ (২০১৫ সালে)।
- পিএসজি তার ঘরের মাঠে চ্যাম্পিয়ন্স লিগে সর্বশেষ ৪৬ ম্যাচের মধ্যে হেরেছে মাত্র একটি ম্যাচে।
- জিদানের অধীনে নকআউট ১৫টি ম্যাচের মধ্যে ১১টিতে জিতেছে রিয়াল।
- গত সাতবার রিয়াল মাদ্রিদ নিদেনপক্ষে সেমিফাইনাল খেলেছে টানা, যেখানে পিএসজি গত পাঁচ বছরে একবারও সেমিফাইনাল খেলেনি।
- পিএসজি ম্যানেজার উনাই এমেরি কখনোই তার ক্যারিয়ারে চ্যাম্পিয়ন্স লিগের শেষ ষোলোর বাধা পেরুতে পারেননি।
কেমন হতে পারে দুই দলের খেলার ধরন
পিএসজির জন্য ব্যাপারটা বলা খুবই সহজ। যেহেতু তাদের নিদেনপক্ষে দুই গোল দিতে হয় এবং সাথে কোনো গোল হজম না করে, তাই তাদের লক্ষ্য খুব সহজ- বল পায়ে রেখে একের পর এক আক্রমণ করা। রিয়ালের পায়ে বল থাকা মানেই গোলের সম্ভাবনা আর রিয়ালের প্রতিটি গোল পিএসজির স্বপ্নকে ঠেলে দেবে অনেক দূর।
রিয়ালেরই বরং খেলার ধরন নিয়ে ভাবার অবকাশ আছে। কোচ যদি মরিনহো বা সিমিওনে হতেন তবে এত ভাবতে হতো না। বলাই যেত যে, কড়া রক্ষণাত্মক কৌশলই নেবেন। কিন্তু জিদান এমন কোচ না। উপরন্তু রিয়ালে এমন ডিফেন্সিভ রসদ নেই, যা দিয়ে তারা শুধু ঠেকিয়ে খেলার উদ্দেশ্যে ডিফেন্স করে দুই গোল হজম না করে থাকতে পারে। তাই রিয়াল ইতিবাচক খেলাই খেলবে।
প্রশ্ন হচ্ছে, ফর্মেশন কী হবে? গত ম্যাচে পিএসজির সাথে শুরু করেছিল ৪-৩-৩ নিয়ে। ১-১ এ সমতার সময় লুকাস ও আসেনসিও নামলে ৪-৪-২ এ পরিণত হয় রিয়াল। আর সেই পরিবর্তনের কারণেই আসে ২ গোল। ক্রুস ও মড্রিচের একজনের না থাকার জন্য রিয়াল ৪-৪-২ এ খেলা শুরু করতে পারে, যেখানে কোভাচিচ ও ক্যাসেমিরো সামলাবে মাঝমাঠ। এই ফর্মেশনের সমস্যা হলো রিয়াল প্রচুর আক্রমণাত্মক খেলবে সত্য, কিন্তু ম্যাচে পুরো নিয়ন্ত্রণ থাকবে না। ৪৭,০০০ পিএসজি ফ্যানের গগণবিদারী আওয়াজকে ঠাণ্ডা করতে হলেও বল পজেশন দরকার হয়। বল পায়ে রেখে খেলানোয় ক্রুস-মড্রিচ অদ্বিতীয়। ক্যাসেমিরো বল পায়ে সাবলীল না।
কোভাচিচ বল পায়ে দারুণ, মূলত সব দিকেই তিনি নিখুঁত। কিন্তু সমস্যা হলো তার পছন্দের ধরণ হলো বল পায়ে দ্রুতগতিতে দৌড়ে কেবল সামনেই এগোনো। সাথে লুকাস ও আসেনসিওও আছে গতিশীল খেলার জন্য। সেখানেই সমস্যা, মাঝমাঠের নিয়ন্ত্রণ থাকবে না। যদি ফরোয়ার্ডরা সুযোগকে গোলে পরিণত করতে না পারে, তবে রিয়াল ৩-১ এর লিডকে হারাতে খুব বেশি সময় নেবে না। ঠিক এই কারণেই রিয়াল সম্ভবত ক্রুস বা মড্রিচের একজনকে খেলাবে একইসাথে পজেশন ও স্পিড পাওয়ার জন্য।
কে জয়ী হবে এই মহারণে? চ্যাম্পিয়ন্স লিগের গতিপ্রকৃতি বোঝা খুবই দুষ্কর। কে ভেবেছিল ৪-০ তে জেতার পর পিএসজি বার্সার কাছে ৬-১ গোলে হারবে? রিয়ালের দুঃসময় চলছে সত্যি, কিন্তু ওই যে বারবার বলা হয়, চ্যাম্পিয়ন্স লিগে রিয়ালকে ফেলনা ভাবা ভুল। লিডও তাদের পক্ষে, যদিও অ্যাওয়ে গোল থাকা মানে খেলা এখনো শেষ হয়নি। এই তো গতবার পিএসজি নিজের মাঠে বার্সাকে দিল চার গোল, এই মৌসুমে গ্রুপের খেলায় বায়ার্নকে হারিয়ে দিল ৩-০ তে। এই দুই স্কোরলাইনের যেকোনো একটি পিএসজিকে নিয়ে যাবে পরের রাউন্ডে। যে দলই জিতুক না কেন, সে দলকে এবারের চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জেতার জন্য ফেভারিট হিসেবেই ধরা হবে।
ও আচ্ছা! বলে রাখা যাক, সেই জর্জ উইয়ার ছেলে টিমোথি সম্প্রতি পিএসজির হয়ে চুক্তি স্বাক্ষর করেছেন, খেলেও ফেলেছেন পিএসজির হয়ে। ছেলে কি পারবে বাবার মতো ৩-১ এ হারের পর দারুণ প্রত্যাবর্তনের সাক্ষী হতে? গোটা ফুটবল বিশ্বই তো এই ধুন্ধুমার লড়াইয়ের শেষ পরিণতি দেখার অপেক্ষায়!
ফিচার ইমেজ: juventudrebelde.cu