চ্যাম্পিয়নস লিগ নকআউটের সাথে অ্যাওয়ে গোল শব্দ দুটি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। ১৯৬০ সালে সর্বপ্রথম অ্যাওয়ে গোলের নিয়মের সাথে পরিচিত হয় ফুটবল বিশ্ব। সেই থেকে অ্যাওয়ে গোল ফুটবলকে রোমাঞ্চকর করে তোলার পাশাপাশি দিয়েছে শ্বাসরুদ্ধকর কয়েকটি ফিরে আসার ম্যাচও। প্রতিপক্ষের মাঠে গিয়ে প্রথম লেগে ৪-১ ব্যবধানে হারের পরও আশা হারায় না এখনো অনেক দলই। কারণ ঐ একটি অ্যাওয়ে গোল।
চলুন তাহলে দেখে আসা যাক অ্যাওয়ে গোলে নির্ধারিত হওয়া কয়েকটি ক্লাসিক চ্যাম্পিয়নস লিগ ম্যাচ।
রোমা – বার্সেলোনা – ২০১৭/১৮ (কোয়ার্টার ফাইনাল)
প্রথম লেগে ন্যু ক্যাম্পে ৪-১ ব্যবধানে হেরে আসার পর হয়তো রোমার কট্টর সমর্থকও সেমিফাইনালে যাওয়ার আশা ছেড়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু প্রথম লেগের শেষ দিকে করা এডিন জেকোর মূল্যবান একটি এওয়ে গোলই আশীর্বাদ হয়ে এসেছে রোমার জন্য।
পরবর্তী লেগে কমপক্ষে ৩ গোল দিতে হবে, সাথে গোল খাওয়া যাবে না- এই সমীকরণে ম্যাচ শুরু করে রোমা। এবারও গোলের খাতা খুললেন জেকোই। প্রথমার্ধ শেষে ১-০ গোলের লিড নিয়ে ড্রেসিংরুমে যায় রোমা। দ্বিতীয়ার্ধের শুরুতেই রসির পেনাল্টি গোলে আশায় বুক বাঁধতে শুরু করে রোমা সমর্থকেরা। সেই আশাকে উল্লাসে পরিণত করেন গ্রিক ডিফেন্ডার কস্তাস মানোলাস। ৮২ মিনিটে পাওয়া কর্নারে মাথা ছুঁইয়ে মহামূল্যবান গোলটি করেন মানোলাস। সেই গোলে চেপে সেমিফাইনালে পৌঁছে যায় ইতালিয়ান ক্লাবটি। ৪-৪ গোলে খেলা শেষ হলেও অ্যাওয়ে গোলের নিয়মের বেড়াজালে বাড়ির টিকেট কাটতে হয় মেসিবাহিনীর।
মোনাকো – ম্যানচেস্টার সিটি – ২০১৬/১৭ (দ্বিতীয় রাউন্ড)
মোনাকোকে প্রতিপক্ষ পেয়ে কিছুটা খুশিই ছিলেন পেপ গার্দিওলা। কিন্তু মোনাকোতেই পা হড়কায় সিটিজেনরা। প্রথম লেগে ঘরের মাঠে একটা সময় ৩-২ গোলে পিছিয়ে পড়লেও সার্জিও আগুয়েরো ত্রাতা হয়ে আসেন। শেষপর্যন্ত ইতিহাদে সেই ম্যাচটি ম্যানসিটি জিতে নেয় ৫-৩ গোলে। কিন্তু মোনাকো পেয়ে যায় তিনটি গুরুত্বপূর্ণ অ্যাওয়ে গোল।
পরের লেগে প্রথমার্ধেই এমবাপ্পে ও ফাবিনহোর গোলে ২-০ গোলে এগিয়ে গিয়ে কোয়ার্টার ফাইনালে এক পা দিয়ে রাখে মোনাকো। কিন্তু ৭১ মিনিটে লেরয় সানে গোল করে সবমিলিয়ে স্কোরলাইন করে ফেলেন ৬-৫। কিন্তু সেই সুখ বেশিক্ষণ থাকেনি সিটিজেনদের। ৭৭ মিনিটে বাকোয়োকোর গোলে স্কোরলাইন ৬-৬ করে মোনাকো। এই স্কোরলাইনেই খেলা শেষ হলে ৩টি অ্যাওয়ে গোলের সুবাদে কোয়ার্টার ফাইনালে পৌঁছায় মোনাকো।
বায়ার্ন মিউনিখ – অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদ – ২০১৫/১৬ (সেমি ফাইনাল)
অ্যাটলেটিকোর মাঠে প্রথম লেগে ১-০ ব্যবধানে হেরে আসলেও দ্বিতীয় লেগের শুরুতেই সেই চাপ থেকে বায়ার্নকে মুক্ত করেন জাবি আলোনসো। প্রথমার্ধেই মুলার স্পটকিক থেকে গোল করতে ব্যার্থ হলে লিড নেওয়ার সুযোগ হারায় বাভারিয়ানরা।
সেই মাশুল বায়ার্ন দেয় দ্বিতীয়ার্ধের শুরুতেই। গ্রিজম্যানের ৫৩ মিনিটের গোলে অ্যাওয়ে গোল পেয়ে যায় অ্যাটলেটিকো। ৭৪ মিনিটে লেওয়ানডস্কির গোলে ২-২ স্কোরলাইন হলেও সিমিওনের অ্যাটলেটিকো বাকি সময় দাঁতে দাঁত চেপে খেলে বায়ার্নকে আটকে দেয়।
পাশাপাশি গ্রিজম্যানের অ্যাওয়ে গোলের সুবিধা নিয়ে আবারও ফাইনালে পা রাখে দিয়েগো সিমিওনের শিষ্যরা।
চেলসি – প্যারিস সেইন্ট জার্মেই – ২০১৪/১৫ (দ্বিতীয় রাউন্ড)
প্রথম লেগে প্যারিসের মাঠে ১-১ এ শেষ হওয়া ম্যাচে এত উত্থান পতন হবে কে জানতো? ম্যাচের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকা জ্লাতান ইব্রাহিমোভিচ ম্যাচের মাঝেই লাল কার্ড খেয়ে মাঠ ছাড়েন। কিন্তু নাটকের তখনো অনেক কিছু বাকি। ৮১ মিনিটে গ্যারি কাহিলের গোলে স্ট্যামফোর্ড ব্রিজের দর্শকেরা যখন জয়োৎসব করছিলো, ঠিক সেই সময়েই নিজের আগের ক্লাবের বিপক্ষে গোল করে সবাইকে স্তব্ধ করে দেন ডেভিড লুইজ।
দ্বিতীয় লেগও ১-১ ব্যবধানে শেষ হওয়ায় খেলা গড়ায় অতিরিক্ত সময়ে। অতিরিক্ত সময়ের শুরুতে হ্যাজার্ডের পেনাল্টিতে চেলসি এগিয়ে গেলে সবাই ধরেই নেয় ১০ জনের পিএসজি এবার ছিটকে পড়ছে। কিন্তু ১১৪ মিনিটে থিয়াগো সিলভার গোলে অবিশ্বাস্য কীর্তি গড়ে পিএসজিই যায় পরবর্তী রাউন্ডে। ৩-৩ এ শেষ হওয়া খেলায় অ্যাওয়ে গোলের সুবিধা নিয়ে কোয়ার্টার ফাইনালে পাড়ি জমায় পিএসজি।
বার্সেলোনা – পিএসজি – ২০১২/১৩ (কোয়ার্টার ফাইনাল)
শেষদিকের কয়েকটি গোলে প্রথম লেগে পিএসজির মাঠে গিয়ে ২-২ গোলে ড্র করে আসে বার্সেলোনা। কিন্তু মেসির ইনজুরিই অস্বস্তিতে ফেলে দেয় বার্সেলোনাকে।
দ্বিতীয় লেগে মেসিবিহীন বার্সাকেই মাঠে দেখা যায়। শুরুতেই পাস্তোরের গোলে সবমিলিয়ে এগিয়ে যায় পিএসজি। কিন্তু পেদ্রো রদ্রিগুয়েজের ৭১ মিনিটের গোলই বার্সার সেমি ফাইনালের রাস্তা খুলে দেয়। অ্যাওয়ে গোলের সুবাদে সেমি ফাইনালে পৌঁছায় স্প্যানিশ ক্লাবটি।
বার্সেলোনার সাথে সেই ম্যাচটিই ডেভিড ব্যাকহামের ক্যারিয়ারের সর্বশেষ চ্যাম্পিয়নস লিগ ম্যাচ হয়ে থাকে।
ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড – বায়ার্ন মিউনিখ – ২০০৯/১০ (কোয়ার্টার ফাইনাল)
১৯৯৯ সালের চ্যাম্পিয়নস লিগ ফাইনাল হারের হিসাব এবার কড়ায় গন্ডায় তুলে নেয় বাভারিয়ানরা। প্রথম লেগে এলিয়াঞ্জ অ্যারেনায় ২-১ গোলে জিতলেও ওল্ড ট্রাফোর্ড এসে শুরুতেই নাকানিচুবানি খায় বায়ার্ন মিউনিখ। ৪১ মিনিটেই ৩-০ পিছিয়ে পড়ে তারা। প্রথমার্ধে ইভিকা ওলিচ একটি গোল শোধ করেন। দ্বিতীয়ার্ধে রক্ষণ গুছিয়ে উঠে আক্রমণ শুরু করে বায়ার্ন। ম্যাচের প্রায় শেষ দিকে রিবেরির কর্নার থেকে ভলি করে স্কোরলাইন ৪-৪ করেন আরিয়েন রোবেন। আর ২টি অ্যাওয়ে গোলের জন্যই সেমি ফাইনালে পৌঁছে যায় বায়ার্ন।
চেলসি – বার্সেলোনা – ২০০৮/০৯ (সেমি ফাইনাল)
প্রথম লেগ গোলশূন্য ড্র হওয়ার পর সব নাটক জমে ছিলো স্ট্যামফোর্ড ব্রিজের জন্য। আন্দ্রেস ইনিয়েস্তার শেষ মূহুর্তের গোল ছাড়াও রেফারি টম ওভারবোর জন্যও ম্যাচটি স্মরণীয় হয়ে থাকবে। চেলসির তিনটি পেনাল্টি আবেদন বাতিল করলেও এসিয়েনের নয় মিনিটের গোলে বেশ স্বস্তিতেই ছিলো ব্লুজরা।
অন্যদিকে ইতো-মেসিদেরও ভালোভাবেই বোতলবন্দী করে রাখে চেলসির রক্ষণ। কিন্তু অতিরিক্ত সময়ের শেষ মূহুর্তে আন্দ্রেস ইনিয়েস্তার গোলে কপাল পুড়ে চেলসির। ১-১ গোলে ম্যাচ শেষ হলেও ইনিয়েস্তার একমাত্র অ্যাওয়ে গোলের বদৌলতে ফাইনালে পৌঁছায় বার্সেলোনা।
বায়ার্ন মিউনিখ – রিয়াল মাদ্রিদ – ২০০৬/০৭ (দ্বিতীয় রাউন্ড)
প্রথম লেগে বার্নাব্যুতে ৩-২ গোলে হেরে আসে বায়ার্ন। দ্বিতীয় লেগে মাদ্রিদের বাস পার্কের চিন্তাভাবনা বায়ার্ন উবে দেয় মাত্র ১০ সেকেন্ডেই। চ্যাম্পিয়নস লিগের সবচেয়ে দ্রুততম গোল করে রয় ম্যাককেয় বায়ার্নকে অ্যাওয়ে গোলে এগিয়ে দেন শুরুতেই। ৬৬ মিনিটে ব্রাজিলিয়ান ডিফেন্ডার লুইসাওর গোলে ২-০ গোলে লিড নেয় বায়ার্ন। শেষ দিকে বায়ার্নের ভ্যান বোমেল ও মাদ্রিদের দিয়ারা লাল কার্ড খেয়ে বের হয়ে যায়। সেই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে পেনাল্টি পায় রিয়াল মাদ্রিদ। স্পট কিক থেকে নিস্টরলয় গোল করলেও অ্যাওয়ে গোলের সুবাদে পরের রাউন্ডে যায় বাভারিয়ানরাই।
মোনাকো – রিয়াল মাদ্রিদ – ২০০৩/০৪ (কোয়ার্টার ফাইনাল)
প্রথম লেগে বার্নাব্যুতে ৪-২ গোলে জয়ের পর দ্বিতীয় লেগে শুরুতেই মোনাকোর মাঠে এগিয়ে যায় রিয়াল মাদ্রিদ। ৩৫ মিনিটে রাউল গঞ্জালেসের গোলে ৫-২ গোলে এগিয়ে যায় রিয়াল মাদ্রিদ। সেই সময় রিয়ালের সেমি ফাইনালে যাওয়া ছিলো সময়ের ব্যাপার মাত্র। কিন্তু মুহূর্তেই পাশার দান উল্টে যায়।
লুডিউক গুলির প্রথম গোলে ব্যবধান কমলেও তখনো মোনাকো প্রত্যাবর্তনের কথা ভাবেনি। এর কিছুক্ষণ পরই নিজের আগের ক্লাব রিয়াল মাদ্রিদের বিপক্ষে গোল করে আশা জাগিয়ে তোলেন মরিয়েন্তেস। ৬৬ মিনিটে গুলির দ্বিতীয় গোলে অসাধারণ প্রত্যাবর্তনের গল্প লেখে মোনাকো। গুলির দ্বিতীয় গোলে স্কোরলাইন ৫-৫ হলেও বার্নাব্যুতে করা দুই গোলই মোনাকোকে সেমি ফাইনালের রাস্তা খুলে দেয়। হতভম্ব রাউলরা বিদায় নেন কোয়ার্টার ফাইনালেই।
ইন্টার মিলান – এসি মিলান – ২০০২/০৩ (সেমি ফাইনাল)
মিলান ডার্বি – সবচেয়ে আকাঙ্ক্ষিত সেমি ফাইনাল ছিলো সেটিই। যে-ই জিতুক, অল ইতালিয়ান ক্লাব ফাইনাল যে হতে যাচ্ছে তা আগেই নিশ্চিত করে জুভেন্টাস।
দুটি ম্যাচই সান সিরোতে হলেও কাগজে-কলমে প্রথম লেগটি ছিলো এসি মিলানের হোম ম্যাচ। সেটিতে গোলশূন্য ড্র করে দুই দল।
দ্বিতীয় লেগের শুরুতেই ক্লারেন্স সিডর্ফের দুর্দান্ত পাসে শেভোচেঙ্কোর গোলে প্রথমে লিড নেয় রোজানেরিরা। তবে দ্বিতীয়ার্ধেই ওবাফেমি মার্টিন্সের গোলে সমতায় ফেরে ইন্টার। কিন্তু অ্যাওয়ে গোলের সুবিধা যায় এসি মিলানের পক্ষে। তাই দ্বিতীয় গোলের জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে ইন্টার মিলান। কিন্তু রোজানেরিদের রক্ষণ ভেদ করতে সক্ষম হয়নি ইন্টার মিলান। ফলাফল ১-১ ড্রয়ের হলেও ফাইনালে যায় এসি মিলান। ফাইনালে ওল্ড ট্রাফোর্ডে জুভেন্টাসকে টাইব্রেকারে হারিয়ে সেবার শিরোপাও জিতে নেয় সিডর্ফ-শেভোচেঙ্কোর মিলান।