ছয় বলে ছয় ছক্কার যত রেকর্ড

ওভারের প্রতিটি বল সীমানার বাইরে গিয়ে পড়ছে। অনিশ্চয়তাময় ক্রিকেটে এমন দৃশ্য খুবই বিরল। ক্রিকেট বিশ্বে এমন ঘটনা প্রথম দেখা গিয়েছিল ১৯৬৮ সালে। আর বর্তমানের টি-টোয়েন্টির যুগে এই ঘটনা ঘটে চলেছে নিয়মিত বিরতিতে। আজ এমন কয়েকজন ক্রিকেটারের ব্যাট থেকে আসা ছয় বলে ছয় ছক্কার সেই গল্প শোনানো হবে আপনাদের।

স্যার গারফিল্ড সোবার্স- নটিংহ্যামশায়ার (১৯৬৮)

ইংল্যান্ডের প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে এই অভাবনীয় কান্ড ঘটিয়েছিলেন ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেটের বিস্ময় পুরুষ স্যার গারফিল্ড সোবার্স। নটিংহ্যামশায়ারের হয়ে সোবার্স যার বল মেরে ছাতু করেছিলেন, তিনি ছিলেন গ্ল্যামরগনের স্পিনার ম্যালকম ন্যাশ।

ক্রিকেট ইতিহাসে স্যার গারফিল্ড সোবার্সের প্রথম ছয় ছক্কার রেকর্ড; Source: getty images

সোবার্স ব্যাট করতেন বাঁ হাতে। সোয়ানসি মাঠে গ্ল্যামারগনের ম্যালকম ন্যাশের সেই বিখ্যাত ওভারের প্রথম তিনটি বল উড়ে গেলো যথাক্রমে মিড অন, মিড উইকেট ও মিড অফে মাথার ওপর দিয়ে। চতুর্থ বল সজোরে পুল করলেন সোবার্স। স্কয়ার লেগ অঞ্চল দিয়ে সীমানার বাইরে পড়লো বলটি। পঞ্চম বলে ব্যাট তুলে মারতে গিয়ে ক্যাচ তুলে দেন সোবার্স। কিন্তু দুর্ভাগ্য ফিল্ডারের। সেই ক্যাচ তিনি ধরেন সীমানার বাইরে গিয়ে। ন্যাশের ষষ্ঠ বল ছিল শর্ট পিচ। দিনের জঘন্যতম ব্যবহার পেল সেই বলটি। সোবার্সের দুর্দান্ত প্রহারে সেটা গিয়ে পড়লো সোয়ানসির ত্রিসীমানার বাইরে। স্লিপে দাঁড়িয়েছিলেন পিটার ওয়াকার। শেষ বলে সোবার্সের মার দখে তিনি একবারে থ! বিস্মিত মুখে বলেছিলেন, “ছয় না, ওটাতো বারো হয়েছে“।

রবি শাস্ত্রী- মুম্বাই (১৯৮৫)

সকলে ভেবেছিলেন, এমন ধুন্ধুমার কান্ড বোধহয় আর কোথাও কখনোও দেখা যাবে না। ষোলো বছর পরে ভারতের অলরাউন্ডার রবি শাস্ত্রী ভারতের প্রথম শ্রেণীর এক ম্যাচে মুম্বায়ের হয়ে খেলতে নেমে বারোদার বাঁ-হাতি স্পিনার তিলকরাজের বলে পরপর ছয়টি ছয় মেরে প্রমাণ করলেন, ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি হয়। সোবার্সের পর দ্বিতীয় ব্যাটসম্যান হিসেবে শাস্ত্রী এই অনন্য কীর্তিটি গড়েন।

বাঁ-হাতি স্পিনার তিলকরাজের বলে রবি শাস্ত্রীর বিধ্বংসী ইনিংস; Source: sportskeeda.com

মুম্বায়ের ডান হাতি ব্যাটসম্যান শাস্ত্রী রেকর্ডটি করেন রঞ্জি ট্রফিতে। সোবার্সের ওই ইনিংসে আর কোনো রেকর্ড না হলেও শাস্ত্রীর ইনিংসে তৈরি হয় বেশ কয়েকটি রেকর্ড। সেদিন মাত্র ১২৩ বলে ডাবল সেঞ্চুরি করেছিলেন তিনি, তা-ও মাত্র ১১৩ মিনিটে। এ সময়ের মধ্যে দু’শ রান করার ভাগ্য এর আগে আর কোনো ভারতীয় তো নয়ই, কোনো ব্যাটসম্যানেরই হয়নি। তাই এটি একটি বিশ্বরেকর্ড।এই ইনিংসে ১৩টি ছয় মেরেছেন শাস্ত্রী, সাথে ১৩টি বাউন্ডারিও।

হার্শেল গিবস- দক্ষিণ আফ্রিকা (২০০৭)

ক্রিকেটের একদিনের আন্তর্জাতিক ম্যাচে দক্ষিণ আফ্রিকার উদ্বোধনী ব্যাটসম্যান হার্শেল গিবস এক ওভারে ছয় ছক্কা হাঁকানোর রেকর্ডটি গড়েন। ২০০৭ সালে ক্রিকেট বিশ্বকাপে ওয়েস্ট ইন্ডিজের সেন্ট কিটসে অনুষ্ঠিত সেই ম্যাচে নেদারল্যান্ডসের ড্যান ফন বাঙ্গের এক ওভারে ছয় ছক্কা হাঁকান গিবস।

নেদারল্যান্ডসের ড্যান ফন বাঙ্গের ছয় বলে হার্শেল গিবসের ছয় ছক্কা; Source: ESPNcricinfo

একদিনের আন্তর্জাতিক ক্রিকেট এই প্রথম দেখল এক ওভারে ছয় ছক্কার ঘটনা। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে প্রথমবারের মতো এবং ক্রিকেট ইতিহাসে তৃতীয় ব্যাটসম্যান গিবস এই অনন্য কীর্তিটি করেন। এই কীর্তি করার পেছনে রয়েছে এক মহৎ উদ্দেশ্যও। একটি দাতব্য প্রতিষ্ঠানের জন্য অর্থ সংগ্রহের উদ্দেশ্যে একটি স্পন্সর প্রতিষ্ঠান ছক্কা মারার প্রতিযোগিতার আয়োজন করে। ম্যাচে যত বেশি ছক্কা মারা হবে, ঐ দাতব্য প্রতিষ্ঠানের জন্য তত বেশি অর্থ সংগৃহীত হবে। আর ওই দাতব্য প্রতিষ্ঠানের জন্য বেশি অর্থ সংগ্রহের উদ্দেশ্যেই নাকি গিবস এই ছক্কাগুলো মারেন।

যুবরাজ সিং- ভারত (২০০৭)

২০০৭ সালের প্রথম টি-টুয়েন্টি বিশ্বকাপে এই অবিশ্বাস্য ঘটনাটি ঘটে। ব্যাটসম্যান ছিলেন ভারতের বিধ্বংসী বাঁহাতি ব্যাটসম্যান যুবরাজ সিং। আর হতভাগ্য বোলার ইংল্যান্ডের স্টুয়ার্ট ব্রড। ১৯ সেপ্টেম্বর দক্ষিণ আফ্রিকার ডারবানের কিংসমেডে অনুষ্ঠিত সেই খেলা যুবরাজের এক ওভারে ছয় ছক্কার কারণেই শুধু ক্রিকেট ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে থাকবে না, আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে সবচেয়ে কম বলে অর্ধ শতক করার জন্য ক্রিকেটের রেকর্ডবুকে যুবরাজের নামটি লেখা থাকবে। মাত্র ১২ বলে ফিফটির সেই রেকর্ড এখনও টিকে আছে। এই রেকর্ড করার পেছনে ইংল্যান্ডের অলরাউন্ডার ফ্লিনটফের অবদান ছিল বলে মনে করেন যুবরাজ। কারণ ১৯তম ওভারে ছয় ছক্কার আগের ওভারেই ফ্লিনটফের স্লেজিংয়ের শিকার হন যুবরাজ। দুজনের মধ্যে শুরু হয় তীব্র বাদানুবাদ। আর তার খেসারত দিতে হয় হতভাগা ব্রডকে।

ব্যাট হাতে ফ্লিনটফের স্লেজিংয়ের জবাব দেন যুবরাজ; Source: India Today

রেকর্ড করা ওভারে ব্রডের করা প্রথম বলটি মিড উইকেটের ওপর দিয়ে মাঠের বাইরে পাঠান যুবরাজ। পরের বলটি স্কয়ারের দিকে ফ্লিক করে ছক্কা হাঁকান। তৃতীয় বলটি সীমানা পার করেন এক্সট্রা কাভারের ওপর দিয়ে। তিন বলে তিন ছয় খেয়ে দিকভ্রান্ত ব্রড চতুর্থ বলটি করলেন ফুলটস। ব্যাকওয়ার্ড পয়েন্টের ওপর দিয়ে ছয় মারেন যুবি। পঞ্চম বলটি ছক্কা মারেন মিড উইকেটের ওপর দিয়ে। ছয় নম্বর বলটিও মিড অন দিয়ে ছক্কা হাঁকান যুবরাজ। যুবরাজ সেই ম্যাচে ১৬ বলে ৩ চার ও ৭ ছক্কায় ৫৮ রানের এক দুর্দান্ত ইনিংস উপহার দেন দর্শকদের।

যুবরাজের ছয় ছক্কায় হতভম্ব ব্রড; Source: Zee News

অ্যালেক্স হেলস- নটিংহ্যামশায়ার (২০১৫)

২০১৫ সালের ন্যাটওয়েস্ট টি-টোয়েন্টি ব্লাস্টে নটিংহ্যামশায়ার হয়ে অ্যালেক্স হেলস ওয়ারউইকশায়ারের বিপক্ষে ছয় বলে ছয় ছক্কা মারেন। তবে তিনি এই ছয় ছক্কা শিকার করেন কিন্তু ওয়ারউইকশায়ারের দুই বোলার- ওয়ারউইকশায়ারের ফাস্ট বোলার বয়েড র‌্যাঙ্কিন এবং স্পিনার আতিক জাভেদের বলে। স্বভাবতই তার ছয় ছক্কা আসে দুই ওভারের পরপর ছয় বলে।

ওয়ারউইকশায়ারের বিপক্ষে অ্যালেক্স হেলসের বিধ্বংসী ইনিংস; Source: ESPNcricinfo

২৬ বছর বয়সী হেলস প্রথম তিনটি ছক্কা মেরেছিলেন ইনিংসের দ্বাদশ ওভারের শেষ তিন বলে পেসার বয়েড র‌্যাঙ্কিনকে। পরের ওভার আতিক জাভেদের দ্বিতীয় বলে স্ট্রাইক পান হেলস। জাভেদের পরপর তিন বলে ছয় হাঁকান হেলস। ক্রিকেট ইতিহাসে ২ ওভার  পরপর ছয় মারার ইতিহাস সত্যিই বিরল। ওই ইনিংসে হেলস ৪৩ বল খেলে ৫ চার ও ৮ ছয়ে করেন অপরাজিত ৮৬ রান। আর এই সুবাদে ওয়ারউইকশায়ারের ১৪২ রানের লক্ষ্য ১৪.৩ ওভারেই সহজেই পেরিয়ে যায় নটিংহ্যামশায়ার।

৫ চার ও ৮ ছয়ে অ্যালেক্স হেলসের অপরাজিত ৮৬ রান; Source: skysports.com

রস হোয়াইটলি- উস্টারশায়ার (২০১৭)

২০১৭ এর ন্যাটওয়েস্ট টি-টোয়েন্টি ব্লাস্টে হেডিংলিতে খেলা হচ্ছিল ইয়র্কশায়ারের বিপক্ষে উস্টারশায়ারের। ইয়র্কশায়ার প্রথমে ব্যাট করতে নেমে ২০ ওভারে ডেভিড উইলির ৫৫ বলে ১১৮ রানের ঝড়ো ইনিংসের সুবাদে ২৩৩ রানের বিশাল স্কোর দাঁড় করায়। ২৩৪ রানের জেতার লক্ষ্যে ব্যাট করতে নেমে উস্টারশায়ার ১৫ ওভারে সংগ্রহ করেছিল ১৩৬ রান। জয়ের জন্য উস্টারশায়ারের দরকার ৩০ বলে ৯৮ রান।

টি-টোয়েন্টি ব্লাস্টে রস হোয়াইটলির ঝড়ো ইনিংস; Source: ESPNcricinfo

এ সময় পাঁচ নম্বরে ব্যাট করতে নামেন বাঁহাতি রস হোয়াইটলি।  ১৬তম ওভারে বল করতে আসেন তরুণ বাঁহাতি স্পিনার  কার্ল কারভার। কারভারের করা প্রথম বলটি ছিল অফ স্টাম্পের খানিকটা বাইরে। হোয়াইটলির সজোরে মারা সেই বলটির গন্তব্য হয় মাঠের বাইরে। দ্বিতীয় বলটিকে লেগ সাইড দিয়ে সীমানার বাইরে পাঠান তিনি। তৃতীয় বল লং অনের ওপর দিয়ে আবার ছক্কা মারেন। কারভারের চতুর্থ বলটি ছিল ফুলটস। আর স্বাভাবিকভাবেই তাতে ছক্কা হাঁকান হোয়াইটলি। পরের বলটি ওয়াইড দেন কারভার। ফলে নার্ভাস কারভারের পরের দুটি বলও ছক্কা হাঁকাতে কুন্ঠাবোধ করেননি হোয়াইটলি, যদিও ম্যাচটি শেষ পর্যন্ত জেতাতে পারেননি হোয়াইটলি। উস্টারশায়ার শেষ পর্যন্ত ১৯৬ রান করতে সক্ষম হয়। ২৬ বলে ৬৫ রানের এক অনবদ্য ইনিংস খেলেন হোয়াইটলি, যার মধ্যে ৮ ছয় ও ২ চারের সাহায্যে তিনি এই রান করেন।

ফিচার ইমেজ- sportskeeda.com

Related Articles

Exit mobile version