বর্তমান সময়টা বিষয়ভিত্তিক বিশেষত্বের। সবাইকে সবকিছুতে পারদর্শী হতে হবে, এমন চিন্তাধারা এখন নিতান্তই প্রাচীনপন্থী। সব বিষয়ে মোটামুটি ভালো হওয়ার চেয়ে, যেকোনো একটি বিষয়ে খুব ভালো হওয়াটাকেই এখন সম্মানের চোখে দেখা হয়। তারপরও কিন্তু সকল কাজের কাজিদের আবেদন এখনো পুরোপুরি ফুরোয়নি। কিংবা সব কাজ না হোক, একাধিক বিষয়ে দখলদারিত্ব থাকলে সেটিকে সমাজ সম্মানের চোখেই দেখে, অলরাউন্ডার তকমাও সেঁটে দেয় তাদের নামের পাশে। আমাদের আজকের আলোচনা ফুটবল জগতের এমনই কিছু অলরাউন্ডারকে নিয়ে।
ফুটবলকে যারা পেশা হিসেবে নেন, তাদেরকে খুব কম বয়স থেকেই কঠোর পরিশ্রম করে আসতে হয়, বয়সভিত্তিক দলগুলোতে নিয়মিত খেলতে হয়। পড়াশোনার জন্য তারা সময় পান না বললেই চলে। ফলে খুব কমসংখ্যক পেশাদার ফুটবলারই প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা চালিয়ে যেতে পারেন, হতে পারেন উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত।
পেশাদার ফুটবলারদের মধ্যে উচ্চশিক্ষিত হওয়ার প্রবণতা ঠিক কতটা কম? অনেকেই জেনে হবেন, ২০১৫ সালে সান্ডারল্যান্ড ফরওয়ার্ড ডানকান ওয়াটমোর যখন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রথম শ্রেণীর ডিগ্রি নিয়ে গ্র্যাজুয়েশন সম্পন্ন করলেন, তিনি ছিলেন ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগের ইতিহাসে এমন কৃতিত্বধারী মাত্র দ্বিতীয় ফুটবলার!
সুতরাং একটি বিষয় বেশ পরিষ্কার যে, পেশাদার ফুটবলাররা উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হওয়াকে কখনোই খুব বেশি প্রাধান্য দেন না। কেনই বা দেবেন! সারাদিন ফুটবল খেলার পর আবার বইখাতা নিয়ে বসা খুবই কষ্টকর একটি কাজ। তাছাড়া কেবল ফুটবল খেলাটাকেই সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়া হলে, একসময় এ খেলা থেকেও মিলিয়ন ইউরো আয় করা সম্ভব। তাহলে অহেতুক কষ্ট করে পড়াশোনা করে কী লাভ!
কিন্তু সবক্ষেত্রেই যেমন ব্যতিক্রম থাকে, তেমনই ব্যতিক্রম কিছু খেলোয়াড় আছেন পেশাদার ফুটবলের জগতেও, যারা শীর্ষস্থানীয় পর্যায়ে ফুটবল খেলে বিশ্বব্যাপী খ্যাতি লাভ যেমন করেছেন, তেমনই দূরে ঠেলে দেননি উচ্চশিক্ষিত হওয়ার ইচ্ছাকেও। তাদের মধ্যে কেউ হয়তো ফুটবলার হিসেবে নাম করার আগেই উচ্চশিক্ষা সম্পন্ন করেছেন, কেউ আবার নতুন করে পড়াশোনা শুরু করেছেন। আবার কেউ কেউ ফুটবল ও পড়াশোনা দুটোই একই সাথে চালিয়ে গেছেন অভিন্ন দক্ষতায়।
চলুন পাঠক, জেনে নিই এমন কয়েকজন তারকা ফুটবলারের ব্যাপারে, যারা কি না পড়াশোনার বেলায়ও সমান সফল।
আন্দ্রে আরশাভিন
আর্সেনাল ভক্তদের কাছে আরশাভিন এক হতাশার নাম। অসামান্য প্রতিভা নিয়ে গানার্স শিবিরে হাজির হলেও, খেলার মাঠে সেই প্রতিভার পূর্ণ বিচ্ছুরণ তিনি ঘটাতে পেরেছেন খুব কমই। সবার আগেই তার যে অর্জনটির কথা মাথায় আসবে, তা হলো অ্যানফিল্ডের আট গোল থ্রিলারে তার ভূমিকা। লিভারপুলের বিপক্ষে, তাদেরই ঘরের মাঠে ৪-৪ গোলে ড্র করে এসেছিল আর্সেনাল, এবং চারটি গোলই এসেছিল আরশাভিনের পা থেকে। এছাড়া আর্সেনালের হয়ে তার অর্জনের খাতা খুব একটা ভারি নয়।
তবে শিক্ষাজীবনে তিনি বেশ সফল ছিলেন। পড়াশোনা করেছিলেন সেইন্ট পিটার্সবার্গের ইউনিভার্সিটি অফ টেকনোলজি অ্যান্ড ডিজাইন্সে। লাভ করেছিলেন ফ্যাশন ডিজাইনে ডিগ্রিও। পরবর্তীতে তিনি রাশিয়ায় নিজস্ব ফ্যাশন লাইনও খোলেন, যা তাকে পরিণত করে দেশটির অন্যতম জনপ্রিয় ফ্যাশন ডিজাইনারে। খেলাধুলা আর ফ্যাশন ডিজাইনকেও তিনি একীভূত করেছিলেন নিজের রচিত “Development of Sportswear Manufacturing” শীর্ষক থিসিসটিতে। সম্ভবত আর্সেনালের হয়ে আশানুরূপ সাফল্য পাচ্ছিলেন না বলেই, দলটির সক্রিয় খেলোয়াড় থাকাকালীনই থিসিস লেখা শুরু করে দিয়েছিলেন তিনি।
ভিনসেন্ট কোম্পানি
তারকাসমৃদ্ধ ম্যানচেস্টার সিটি স্কোয়াডেও ভিনসেন্ট কোম্পানিকে বিবেচনা করা হয় মেরুদন্ড হিসেবে। সতীর্থদের মধ্যে অন্যতম প্রভাবশালী খেলোয়াড়ও তিনি। শুরুতে তিনি দলে যোগ দিয়েছিলেন ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার হিসেবে। পরবর্তীতে বনে যান সেন্টার ব্যাক। এ পজিশনে তিনি বর্তমান বিশ্বের সেরাদেরও একজন। ম্যানচেস্টার সিটির হয়ে প্রিমিয়ার লিগ, লিগ কাপ, এফএ কাপ সবই জিতেছেন তিনি। হয়েছেন ইংলিশ ফুটবলের মৌসুমসেরা খেলোয়াড়ও। বর্ষসেরা দলেও তার উপস্থিতি নিয়মিত।
কিন্তু ফুটবলবিশ্বে ছড়ি ঘোরাতে শুরু করার পরও পুরোপুরি সন্তুষ্ট ছিলেন না এই বেলজিয়ান। তাই তো ২০১২ সালে তিনি ম্যানচেস্টার বিজনেস স্কুলে ভর্তি হয়ে যান বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন নিয়ে পড়ার লক্ষ্যে। অনেক পরিশ্রমের পর ২০১৭ সালে তিনি এমবিএ সম্পন্ন করেন। তার আরো একটি বড় যোগ্যতা হলো, অধিকাংশ ইংলিশ ফুটবলারের চেয়েও ভালো ইংরেজি বলতে পারেন তিনি।
এডউইন ফন ডার সার
তাকে প্রায়ই বিবেচনা করা হয় নিজ প্রজন্মের সেরা গোলরক্ষক হিসেবে। অনেকে তো নির্দিষ্ট একটি প্রজন্মের গন্ডি পেরিয়ে তাকে রাখে সর্বকালের সেরাদের তালিকায়ও একদম উপরে। সাবেক এই ডাচ আন্তর্জাতিক তারকা ২৭টি মেজর ট্রফি নিয়ে ইতিহাসের সবচেয়ে সফল গোলরক্ষকদের একজন। বিশেষ করে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডে কাটানো বছরগুলো ছিল তার ক্যারিয়ারের সেরা সময়। দুটি ভিন্ন ক্লাবের হয়ে চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জিতেছেন তিনি। ১৯৯৫ সালে আয়াক্সের হয়ে, আবার ২০০৮ সালে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের হয়ে। ১৯৯২ সালে আয়াক্সের হয়ে উয়েফা কাপও জিতেছিলেন তিনি।
ইংল্যান্ডসহ গোটা বিশ্বে এমন অজস্র উঠতি গোলরক্ষকের দেখা পাওয়া যাবে, যাদের প্রাথমিক অনুপ্রেরণা ছিলেন ফন ডার সারই। কিন্তু তিনি কেবল তার খেলোয়াড়ি জীবনের সফলতাকেই জীবনের একমাত্র প্রাপ্তি হিসেবে মেনে নিতে চাননি। খেলা থেকে অবসরের পর এখন তিনি আয়াক্সের মার্কেটিং ডিরেক্টর। পাশাপাশি তিনি ইন্টারন্যাশনাল স্পোর্টস ম্যানেজমেন্টে মাস্টার্স ডিগ্রি লাভেরও দোরগোড়ায়। এছাড়া একই কোর্সে ব্যাচেলর ডিগ্রিও আছে তার ঝুলিতে।
হুয়ান মাতা
বিশ্বকাপ, ইউরো, চ্যাম্পিয়নস লিগ- কী নেই মাতার ট্রফি কেবিনেটে! ২০১১ সালে চেলসিতে যোগ দিয়েছিলেন তিনি, এবং প্রথম মৌসুমেই ব্লুজদের চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জয়ে বিশাল বড় অবদান রেখেছিলেন। আকারে ছোটখাট হলেও, ড্রিবলিং ও প্লেমেকিংয়ে তার কার্যকারিতা অসাধারণ। কিন্তু তারপরও, তাকে নিয়ে আলোচনা হয়ে থাকে খুব কমই। সাম্প্রতিক সময়ের অন্যতম আন্ডাররেটেড ফুটবলারদেরও একজন তিনি।
তবে খেলার মাঠে যোগ্য সম্মান না পেলে কী হয়েছে, তিনি তার মুনশিয়ানা দেখিয়েছেন শিক্ষাক্ষেত্রে। ফলে তার সামগ্রিক সিভি একেবারেই হালকা নয়। মাদ্রিদের ইউনিভার্সিটি ক্যামিলো হোসে সেলা থেকে স্পোর্টস সায়েন্স ও ফিন্যান্স বিষয়ে ডিগ্রি নিয়েছেন তিনি।
জর্জো কিয়েল্লিনি
বর্তমান সময়ের সেরা ডিফেন্ডার কে, এমন প্রশ্নের জবাবে অনেকেই বেছে নেবে কিয়েল্লিনিকে। সেন্টার ব্যাক হিসেবে খ্যাতি গোটা বিশ্বজোড়া। এখন তাকে নিয়ে আরো বেশি আলোচনা হচ্ছে ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো জুভেন্টাসের যোগ দেয়ার পর থেকে। জুভেন্টাসের রক্ষণভাগের ‘বিবিসি'(বোনুচ্চি-বারজাগলি-কিয়েল্লিনি)-র একজন তিনি। সাম্প্রতিক অতীতে তুরিনের বুড়িদের যত সাফল্য, সেসব কৃতিত্বেরও তিনি বড় অংশের দাবিদার।
তার শ্রেষ্ঠত্বও কেবল খেলার মাঠে সীমাবদ্ধ নেই। জুভেন্টাসে খেলার সময়ই ২০১০ সালে ইউনিভার্সিটি অফ তুরিন থেকে ইকোনমিক্স অ্যান্ড কমার্সে লরিয়া (ব্যাচেলর্স ডিগ্রি) সম্পন্ন করেন তিনি। তবে সন্তুষ্ট থাকেননি শুধু এটুকুতেই। খেলোয়াড়ি জীবন যখন মধ্যগগণে, তখনো ধরে রেখেছেন শিক্ষার প্রতি নিজের অশেষ অনুরাগ। ফলে একই কোর্সে ২০১৭ সালে মাস্টার্স ডিগ্রিও সম্পন্ন করেন তিনি।
ফ্র্যাঙ্ক ল্যাম্পার্ড
তিনি চেলসির সর্বকালের সেরা কি না, তা হয়তো প্রশ্নসাপেক্ষ। কিন্তু দর্শক জরিপে জন টেরি ও দিদিয়ের দ্রগবার সাথে সবসময়ই সেরা তিনে অবস্থান করেন তিনি। সবধরনের প্রতিযোগিতায় ২১১ বার জালে বল জড়িয়ে, তিনি ক্লাবটির সর্বোচ্চ গোলদাতা। পাশাপাশি তিনি প্রিমিয়ার লিগে মিডফিল্ডার হওয়া সত্ত্বেও দেড় শতাধিক গোল করা মাত্র সাতজন ফুটবলারেরও একজন। প্রিমিয়ার লিগে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ অ্যাসিস্টও তারই, উপরে কেবলই রায়ান গিগস।
গোল করা মূল কাজ না হওয়ার পরও যেমন ল্যাম্পার্ড অনায়াসে গোলের পর গোল করে যেতেন, তেমনই নিজের শখ পূরণ করার জন্য শুরু করা ল্যাটিন কোর্সটিকেও তিনি পরবর্তীতে এতটাই গুরুত্বের সাথে নিয়েছিলেন যে, এ কোর্সে কেবল ডিগ্রিই লাভ করেননি, পেয়েছেন ‘এ’-ও!
শেষ কথা
অনেকের কাছেই মনে হতে পারে, পেশাদার ফুটবলারদের জন্য উচ্চশিক্ষা লাভ বিলাসিতা বৈ আর কিছুই নয়। কিন্তু ইদানিং এ বিষয়ে মানসিকতা পরিবর্তন হচ্ছে। সবাই তো আর মেসি বা রোনালদো নন যে শুধু ফুটবল খেলেই এত বিপুল পরিমাণ অর্থ আয় করে ফেলবেন যে পরের কয়েক প্রজন্ম পায়ের উপর পা তুলে খেতে পারবে! গড়ে একজন পেশাদার ফুটবলারের সর্বোচ্চ পর্যায়ের ক্যারিয়ার স্থায়ী হয় আট বছর। এই আট বছরই তাদের অর্থ উপার্জনের সেরা সময়। এমন অনেক ফুটবলারই আছেন যারা কেবল খেলোয়াড়ি জীবনের উপার্জন দিয়েই বাকি জীবন কাটিয়ে দিতে চান। এজন্য তারা আর কোনো দক্ষতাও অর্জন করেন না।
কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি যে, খেলোয়াড়ি জীবনে যথেচ্ছ অর্থ খরচের পরও অর্থের আগমন কখনো থামত না বটে, কিন্তু অবসরের পরও যারা ব্যয়ের ক্ষেত্রে লাগাম না টানেন, তাদেরকে বড় ধরনের বিপাকে পড়তে হয়। এক জরিপে দেখা গেছে, প্রতি পাঁচজনের মধ্যে দুজন পেশাদার ফুটবলারই খেলোয়াড়ি জীবনে ইতি টানার পাঁচ বছরের মধ্যেই ব্যাংক কর্তৃক দেউলিয়া ঘোষিত হন। এর প্রধান কারণ তাদের পর্যাপ্ত শিক্ষার অভাব এবং অন্য কোনো দক্ষতা না থাকা, যার ফলে অবসরের পর তাদের মধ্যে সচেতনতাও আসে না, আর নতুন উপার্জনের পথও সৃষ্টি হয় না। এমন দূরবস্থায় যাতে পড়তে না হয়, সে লক্ষ্যে আজকাল অনেক পেশাদার ফুটবলারই খেলার পাশাপাশি উচ্চশিক্ষা কিংবা কোচিং ও ধারাভাষ্য কোর্স করে রাখছেন, বিভিন্ন ব্যবসার সাথেও সম্পৃক্ত হচ্ছেন।
চমৎকার সব বিষয়ে রোর বাংলায় লিখতে আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন এই লিঙ্কে: roar.media/contribute/