আক্ষেপ; এ শব্দটি একেক মানুষের কাছে ক্ষেত্রবিশেষে একেক বার্তা বহন করলেও সবার কাছে এর মর্মার্থ এক। প্রত্যেক মানুষের আক্ষেপের স্থান, কাল, পাত্র ভিন্ন। এক্ষেত্রে, একজন ফুটবলারের আক্ষেপ কেমন হতে পারে?
খুবই সোজা উত্তর। শিরোপা না জেতার। যেমন- লিওনেল মেসির মতো একজন ফুটবলার সারাজীবন আক্ষেপ করবেন নিজের দেশের হয়ে কোনো শিরোপা না জেতার জন্য (এখন পর্যন্ত)। তবে এমনও কিছু ফুটবলার আছেন, যারা বিশ্বসেরা, নিজেদের প্রমাণ করে নিয়ে গেছেন সেরাদের কাতারে। চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জিতেছেন বা বিশ্বকাপের সোনালি ট্রফিটাও ছুঁয়ে দেখার সৌভাগ্য হয়েছে। কিন্তু তাদের আক্ষেপের স্থান হলো- ক্লাবের হয়ে তারা কখনও লিগ শিরোপা জিততে পারেননি, অথচ লিগ শিরোপাকে প্রত্যেকটি ক্লাবই মর্যাদার সাথে গ্রহণ করে থাকে।
আজ ফোর ফোর টু’র সৌজন্যে এমন কয়েকজন ফুটবলারের কথা তুলে ধরা হবে, যারা চ্যাম্পিয়ন্স লিগ বা বিশ্বকাপের মতো ট্রফি জিতলেও, ক্লাবের হয়ে লিগ শিরোপা না জেতার আক্ষেপ সারাজীবন করে যাবেন।
গ্যারি লিনেকার
বর্তমান ফুটবল প্রজন্ম গ্যারি লিনেকারকে চেনে তর্কের ফুটবলের মঞ্চে। ফুটবল থেকে অবসর গ্রহণ করার পর ম্যাচ বিশ্লেষক, ধারাভাষ্যকার হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে করতে তিনি এখন তর্কের ফুটবলের পন্ডিত। তাই বর্তমান প্রজন্মের অনেকেই ভুলে গেছে খেলোয়াড় লিনেকারকে।
১৯৭৮ থেকে ১৯৯৪ সাল পর্যন্ত খেলেছেন তিনি। ফুটবল অফ দ্য প্লেয়ার জিতেছেন দুবার, ব্যালন ডি’অরে রানার্স-আপ হয়েছেন একবার, প্রিমিয়ার লিগে ও ‘৮৬ এর বিশ্বকাপে জিতেছেন গোল্ডেন বলও। তাই কোনো সন্দেহ ছাড়াই বলা যায়, গ্যারি লিনেকার ইংল্যান্ড এবং সর্বকালের সেরা স্ট্রাইকারদের একজন। তার ক্যারিয়ারের বড় শিরোপা হলো কোপা ডেল রে, এফএ কাপের মতো শিরোপা। তিনি কখনোই ইউরোপিয়ান কাপ এবং কোনো ক্লাবের হয়েই লিগ শিরোপা জিততে পারেননি।
লিনেকারের ক্যারিয়ার শুরু হয় লেস্টার সিটির যুবদলের হয়ে। লেস্টার সিটির বি দলের হয়ে যদিও তিনি প্রিমিয়ার লিগের দ্বিতীয় বিভাগের শিরোপা জিতেছেন, তবে সেটা তেমন উল্লেখযোগ্য নয়। পরবর্তী সময়ে খেলেছেন এভারটন, বার্সেলোনা ও টটেনহাম হটস্পারের হয়ে। কিন্তু লিগ কখনোই জিততে পারেননি তিনি। ১৯৮৪ সালেও প্রিমিয়ার লিগ জেতে এভারটন। লিনেকার ছিলেন ৮৫/৮৬ মৌসুমে। তিনি বার্সেলোনা চলে যান পরের মৌসুমে। ৮৫/৮৬ মৌসুমে এভারটন প্রিমিয়ার লিগে দ্বিতীয় হলেও, লিনেকার বিদার নেবার মৌসুমে আবার চ্যাম্পিয়ন হয় তারা। বার্সেলোনা থাকাকালীন মৌসুমে ঘটে একই ঘটনা।
হয়তো বিধাতা তার ভাগ্য এভাবেই নির্ধারিত করে রেখেছিলেন। তাই কয়েকটি ক্লাবের হয়ে ধারাবাহিক ভালো পারফর্মেন্স ধরে রাখলেও তার ক্লাব কখনো লিগ জেতেনি।
সক্রেটিস দে অলিভিয়েরা
পেলে, গারিঞ্চাদের সময়ের পর ব্রাজিলে নতুন যে প্রজন্ম গড়ে উঠেছিলো, সেই প্রজন্মের অন্যতম উজ্জ্বল মুখ ছিলেন সক্রেটিস। মধ্যমাঠে খেলতেন আক্রমণাত্মক ফুটবলার হিসেবে। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে, ব্রাজিলের সেই স্বর্ণালি প্রজন্ম কোনো শিরোপা জেতেনি।
১৯৮২ বিশ্বকাপে ব্রাজিলকে অন্যতম সেরা দল হিসেবে ধরা হচ্ছিল। এর অন্যতম কারণ প্রতিভাবান সক্রেটিস। কিন্তু সেবার ব্রাজিল বিশ্বকাপ শেষ করে পঞ্চম হয়ে। সক্রেটিসকে নিয়ে এই একই দল ১৯৮৩ এর কোপা আমেরিকা ফাইনালও হেরেছিলো। আর ১৯৭৯ সালে কোপা আমেরিকায় শেষ চারে ছিলো ব্রাজিল।
ব্রাজিলের হয়ে তার অর্জন এটুকুই। ক্লাব ক্যারিয়ারে তিনি খেলেছেন বোটাফেগো, ফ্লামেঙ্গো ও করিন্থিয়ান্সের মতো প্রথম সারির দলে। কিন্তু তিনি থাকাকালীন কখনো তার দল লিগের শিরোপা অর্জন করতে পারেনি। লিগের বাইরে কিছু শিরোপা অর্জন তো করেছেন ঠিকই, কিন্তু লিগ শিরোপা ছোঁয়া হয়নি তার।
১৯৮৩-তে দক্ষিণ আমেরিকার খেলোয়াড় সেরা নির্বাচিত হয়েছিলেন তিনি, ১৯৮২-তে ছিলেন ফিফার সেরা একাদশে। ব্রাজিলের ডোমেস্টিক কাপ কোপা পাউলিস্তায় ১৯৭৬ সালে সর্বোচ্চ গোলদাতা হয়েছিলেন একজন মাঝমাঠের খেলোয়াড় হয়ে। কিন্তু লিগ তো দূরে থাক, সক্রেটিসের মতো একজন খেলোয়াড়ের ক্যারিয়ারে কোনো বড় শিরোপাই যে নেই!
স্টিফেন জেরার্ড ও জেমি ক্যারাঘার
বর্তমানে লিভারপুল ইয়ুর্গেন ক্লপের অধীনে সুসময় পার করছে। কিন্তু তারা এ অবস্থায় আসার আগে পার করেছে দীর্ঘ এক হতাশাজনক সময়। তা-ও আগে লিভারপুল পার করেছে তাদের ইতিহাসের সবথেকে সাফল্যমণ্ডিত সময়গুলো। সেই দলের অন্যতম সদস্য ছিলেন স্টিফেন জেরার্ড ও জেমি ক্যারাঘার। দীর্ঘ সময় ধরে লিভারপুলের ড্রেসিং রুম ভাগাভাগি করে নিয়েছিলেন তারা। জেরার্ড ও ক্যারাঘার দুজনই ইংল্যান্ড জাতীয় দলের অন্যতম মুখ ছিলেন। একইভাবে দুজনই লিভারপুলে দীর্ঘ সময় ধরে খেলেছেন। ক্যারাঘার ওল্ড ট্রাফোর্ডে তার ক্যারিয়ার শেষ করলেও জেরার্ড অল্প সময়ের জন্য গিয়েছিলে এলএ গ্যালাক্সিতে।
জেরার্ড লিভারপুলের হয়ে এফএ কাপ, চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জিতলেও ১৭ মৌসুমে কখনো তিনি বা তার দল জেতেনি লিগ শিরোপা। ক্যারাঘার খেলতেন রক্ষণাত্মক পজিশনে। তিনিও অ্যানফিল্ডে খেলেছেন ১৭ মৌসুম, কিন্তু প্রিমিয়ার লিগ শিরোপা থেকে গেছে অধরা। অথচ সেসময়ের লিভারপুল উয়েফার সমস্ত প্রতিযোগীতাসহ এফএ কমিউনিটি শিল্ড, ফুটবল লিগ কাপ থেকে এফএ কাপ সমস্ত কিছু জয় করে ফেলেছিলো।
স্ট্যানলি ম্যাথিউস
স্ট্যানলি ম্যাথিউস ইংলিশদের ফুটবল ইতিহাসে এক কিংবদন্তী। তিনি ফুটবল ক্যারিয়ার শুরু করেছিলেন ১৯৩২ সালে স্টোক সিটির হয়ে। স্টোক সিটির হয়ে দীর্ঘ সময় খেললেও তার অধিকাংশ অর্জন ব্যাকপুলের হয়ে। ১৯৫৬ সালে যখন ব্যালন ডি অর জিতে নেন, তখনও তিনি ব্যাকপুলের খেলোয়াড়। মাঠে তিনি যে পজিশনে খেলতেন, তৎকালীন সময়ে তার নাম ছিলো আউটসাইড রাইট। মূলত সেই সময়ে ২-৩-৫ ফর্মেশন বেশি জনপ্রিয় ও কার্যকর ছিলো বলে এ পজিশনে খেলেই বিশ্বমাত করেছে ম্যাথিউসের দল।
আউটসাইড রাইট হলো আউটসাইড ফরোয়ার্ডের পরিবর্তিত নাম। রাইট ও লেফট উইংয়ের মাঝে একজন অতিরিক্ত খেলোয়াড় হিসেবে খেলে থাকতেন এই পজিশনের খেলোয়াড়েরা। এবং এই পজিশনকে ভিন্ন এক রূপ দান করেছিলেন ম্যাথিউস। ফ্রাঞ্জ বেকেনবাওয়ার তার সম্পর্কে বলেছিলেন,” মাঠের ফুটবলে এমন কেউ নেই যে তাকে থামাতে পারবে।”
স্টোক সিটির মূল দলে যখন তার অভিষেক হয় তখন ক্লাবটি খেলে ইংল্যান্ডের দ্বিতীয় বিভাগে। ১৯৩২/৩৩ মৌসুমে দ্বিতীয় বিভাগের শিরোপা জেতে স্টোক সিটি। কিন্তু তা প্রিমিয়ার লিগের আসল শিরোপা নয়। ক্লাবটির সাথে ৮ মৌসুম খেলে ব্যাকপুলের হয়ে খেলেন টানা ১৫ মৌসুম। কিন্তু কখনোই প্রিমিয়ার লিগের শিরোপা জিততে পারেননি তিনি। ১৯৬১/৬২ মৌসুমে তিনি ফিরে যান পুরনো ক্লাব স্টোক সিটিতে। স্টোক সিটি তখন অবনমিত হয়ে খেলছে দ্বিতীয় বিভাগে। ভাগ্যের নির্মম পরিহাস, পরের মৌসুমেই দ্বিতীয় বিভাগে চ্যাম্পিয়ন হয়ে আবার প্রিমিয়ার লিগে ফিরে আসে স্টোক সিটি। পরবর্তীতে আর দুই মৌসুম খেলা চালিয়ে যান স্টানলি ম্যাথিউস। ২৩ মৌসুম প্রিমিয়ার লিগে খেলে শিরোপা না ছুঁয়ে এই কিংবদন্তী অবসর নেন ১৯৬৫ সালে।
গর্ডন ব্যাঙ্কস
ইংলিশ ফুটবলের ইতিহাসে সেরা গোলরক্ষকের অালোচনা উঠলে তাতে গর্ডন ব্যাঙ্কসের নাম থাকবেই। সর্বকালের সেরা না হলেও তার স্থান দেয়া হয় লেভ ইয়াসিনের পরে। ১৯৬৬ সালের বিশ্বকাপজয়ী ইংল্যান্ড দলের গোলরক্ষকের দায়িত্বে ছিলেন তিনি। ফিফার সেরা গোলরক্ষক নির্বাচিত হয়েছিলেন টানা ৫ বার।
তবে কোনো লিগ না জিতে ক্যারিয়ার শেষ করার জন্য তার আক্ষেপ হয়তো বাকিদের থেকে তুলনামূলকভাবে কম। চেস্টারফিল্ডের হয়ে ক্যারিয়ার শুরু করা গর্ডন ব্যাঙ্কস পরবর্তীতে খেলেছেন লেস্টার সিটি ও স্টোক সিটির মতো মধ্যমসারির ক্লাবে। তাই লিগ শিরোপা হাতে না তোলার ঘটনা বেশ স্বাভাবিক। তবে জাতীয় দলের হয়ে ৭৩ ম্যাচে গোলরক্ষকের দায়িত্ব পালন করা ব্যাঙ্কস উভয় ক্লাবের হয়ে ফুটবল লিগ কাপ জিতেছেন। বিশ্বকাপজয়ী এ গোলরক্ষের ক্লাবের শিরোপার পরিসংখ্যান এতটুকুই।
ববি মুর
ইংল্যান্ডের আরও এক কিংবদন্তী ফুটবলারের গল্প। ববি মুরও ইংল্যান্ডের বিশ্বকাপজয়ী দলের সদস্য ছিলেন। কিন্তু তার ক্লাব ক্যারিয়ার তেমন জাঁকজমকপূর্ণ নয়। জেরার্ড ও ক্যারাঘারের মতোই তিনি ছিলেন ‘ওয়ান ক্লাব ম্যান’। ক্যারিয়ারের সেরা সময় পার করেছেন ওয়েস্টহ্যামে। সেখানে তিনি চারবার সেরা খেলোয়াড় নির্বাচিত হয়েছিলেন। ওয়েস্টহ্যামে থাকাকালীন সময়ে ক্লাবটি বেশিরভাগ মৌসুমে তালিকার ১০ এর নিচে থেকে শেষ করেছে। ১৯৭০ সালে মুর যখন ব্যালন ডি অর জেতেন, সে মৌসুমে তার ক্লাব লিগ শেষ করেছিলো তালিকার ১৭তম স্থানে। তাই এটা পরিষ্কার যে, ববি মুর এই কিংবদন্তীদের তালিকায় স্থান পেয়েছেন সম্পূর্ণ তার প্রতিভার জোরে।
ক্লাব ক্যারিয়ারে তিনি ওয়েস্টহ্যামের হয়ে এফএ কাপ জিতেছেন। এটাই তার জেতা সর্বোচ্চ শিরোপা। এবং বিশ্বকাপ জেতার পাশাপাশি একবার তার দল পৌঁছে গিয়েছিলো উয়েফা ইউরোর সেমি-ফাইনালে।
এছাড়াও, হালের মার্কো রিউস অথবা বিশ্বকাপ ও ইউরোপা জয়ী ফরাসি ফরোয়ার্ড আন্তোনিও গ্রিজমান কখনো লিগ শিরোপা জেতেননি। লিগ শিরোপা জেতার স্বাদ পাননি ফার্নান্দো তোরেস, ড্যানিয়েল ডি রসি বা হুয়ান মাতার মতো খেলোয়াড়রাও। তাদের অনেকেই অন্তিম লগ্নে এসে উপস্থিত হয়েছেন, হয়তো অপূর্ণ এ আশা নিয়ে তারা ক্যারিয়ার শেষও করবেন!