১৩, ৬, ৬, ৪১*, ৫৫, ২, ৮০*। বিশ্বকাপে হাসিম আমলার রান সাত ইনিংসে মাত্র ২০৩। তবে কি আমলার শেষের শুরুটা দেখে ফেলছে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট?
একটা সময় রেকর্ড থেকে প্রতিটি দ্রুততম হাজার রানের মাইলফলক কোহলি থেকে কেড়ে নেওয়াটা আমলার জন্য রুটিন হয়ে দাঁড়িয়েছিল। ২,০০০ রান থেকে ৭,০০০ রান, সবগুলো মাইলফলক অর্জনে আমলাই ছিলেন বিশ্বের দ্রুততম। যেমনতেমনভাবে না, দ্বিতীয় থাকা কোহলি থেকে ঢের ইনিংস কম খেলে। সেই আমলাই এইবার ৮,০০০ রান তুলতে কোহলি থেকে খেলে ফেললেন এক ইনিংস বেশি। নিজের ১৫০তম ইনিংসে ৭০০০ রান পূর্ণ করার পর আমলার পরবর্তী হাজার রানের মাইলফলক ছোঁয়ার ক্ষেত্রে দ্রুততম হওয়ার জন্য তা করতে হতো ২৪ ইনিংসেই। তা যে সেরা ফর্মের আমলার জন্য ‘দুধভাত’ ব্যাপারই ছিল, তা বলার অপেক্ষা রাখেনা। তবে গত দুই বছরের পড়তি ফর্মের জন্য তা কঠিন হয়ে ওঠে এই প্রোটিয়া ওপেনারের জন্য। শেষ পর্যন্ত তাই পারেননি আমলা, পারেনি তার দলও। ১৭৬তম ইনিংসে এসে ৮,০০০ রান পূর্ণ করে এই রেকর্ডটি ছিনিয়ে নিতে পারেননি কোহলি থেকে, কোহলির লেগেছিল ১৭৫ ইনিংস।
একদিনের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের ব্যাটিং দানবদের কথা বললেই প্রথমেই আসবে ‘ফ্যাবুলাস ফোর’ এর নাম। বিরাট কোহলি, স্টিভ স্মিথ, কেন উইলিয়ামসন, জো রুট। কিন্তু হাশিম আমলা এদের কারো থেকেই কম নন, বরং কিছু কিছু ক্ষেত্রে এদেরকেও ছাড়িয়ে গিয়েছেন। কিন্তু ক্যারিয়ারের বেশিরভাগ সময়েই পাদপ্রদীপের আলো থেকে দূরে থাকা আমলা হয়তো নীরবে-নিভৃতেই পারফর্ম করে যেতে পছন্দ করেন। এই প্রথম হয়তো সবার চোখের নজরে পড়লেন আমলা। দুর্ভাগ্যবশত, তার রানখরার জন্যই এখন আতসকাঁচের নিচে হাশিম আমলা।
দুই বছরের মতো সময় ধরে রানের জন্য লড়াই করে যাচ্ছেন আমলা। ২০১৯ সালে পাকিস্তানের বিপক্ষে স্বস্তির এক সেঞ্চুরির আগে তার সর্বশেষ আন্তর্জাতিক সেঞ্চুরি ছিল ২০১৭ সালের অক্টোবর মাসে। বাংলাদেশের বিপক্ষে ঘরের মাঠে সেবার ৯ দিনের মাথায় দুই টেস্টে দুইটি শতক হাঁকিয়েছিলেন তিনি। তারপর থেকেই নিজেকে হারিয়ে খুঁজছেন সময়ের অন্যতম সেরা এই ব্যাটসম্যান। দক্ষিণ আফ্রিকার বিশ্বকাপ ভরাডুবির পেছনে সম্ভবত সবচেয়ে বেশি দায়ী তাদের সেরা ব্যাটসম্যানই। এবারের ইংল্যান্ড আসরে প্রায় প্রতিটি ম্যাচের শুরুতেই আমলার উইকেট হারিয়ে চাপে থাকা দক্ষিণ আফ্রিকা পড়েছে আরো বড় ধরনের চাপে।
২০১৮ সালে এই ডানহাতি ওপেনার ৩০.৭৭ গড়ে করেছেন মাত্র ৫৫৪ রান। যা কি না এই সময়ে সবচেয়ে বেশি রান পাওয়ার তালিকায় প্রথম ৫০ জনেরও বাইরে। যদিও আমলা ২০১৮ সালে খেলতে পেরেছেন মাত্র ১৯টি ইনিংস। কিন্তু আমলার জন্য এই পরিসংখ্যান অবশ্যই হতাশাজনক, যেখানে আমলার ওয়ানডে ক্যারিয়ার গড় ৪৯.৪৭ এবং টেস্টে ৪৬.৪১। কমপক্ষে ৫,০০০ রান করেছেন, এমন ওপেনারদের মধ্যে আমলার ওয়ানডে গড়ই সবচেয়ে বেশি। সেই তুলনায় ৩০.৭৭ গড় হতাশাজনক ও একইসাথে বিস্ময়কর। এই ১৯ ইনিংসের মধ্যে সেঞ্চুরি তো নেই-ই, এমনকি ৫০ ছাড়ানো ইনিংসও মোটে চারটি। যার মানে, প্রতি ৫ ম্যাচে একটি করে পঞ্চাশোর্ধ্ব ইনিংস খেলেছেন তিনি, যা কি না তার ক্যারিয়ারের তুলনায় ঢের কম। ২০১৮ সালের আগে ১৫৫ ইনিংসে আমলা খেলেছেন ৬০টির বেশি পঞ্চাশ ছাড়ানো ইনিংস।
মূলত ২০১৮ সাল ছিল আমলার ক্যারিয়ারের সবচেয়ে বাজে ওয়ান ডে বছর। শুধু ওয়ানডে ইনিংস হিসাব করলে আমলা মাত্র ২৮.৬৪ গড়ে করেছেন ৩১৫ রান, পঞ্চাশোর্ধ্ব ইনিংসও মোটে দুইটি। আর এই গড় আমলার ক্যারিয়ারেও সর্বনিম্ন গড়।
তবে ২০১৯ সালে পাকিস্তান সিরিজে একটু সময়ের জন্য হলেও নিজেকে খুঁজে পেয়েছিলেন আমলা। সেই সিরিজেই প্রায় দেড় বছরের সেঞ্চুরি খরা কাটান তিনি। আর এদিকে দক্ষিণ আফ্রিকান ক্রিকেট বোর্ড আমলার উপরই রেখেছেন পূর্ণ আস্থা। এই দলের সবচেয়ে বেশি অভিজ্ঞ সেনানী আমলাই। একদিনের আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারে ১৭৮ ইনিংসে করেছেন ঈর্ষণীয় ৮,১১৩ রান, শতক হাঁকিয়েছেন ২৭টি। পুরো ক্যারিয়ারে সব মিলিয়ে করেছেন ১৮,০০০ এর মতো রান। সর্বমোট রানের দিক দিয়ে প্রোটিয়াদের মধ্যে শুধুমাত্র জ্যাক ক্যালিস ও ডি ভিলিয়ার্সই এগিয়ে রয়েছেন আমলা থেকে। তার এই ব্যাটিং অভিজ্ঞতার উপরই পূর্ণ আস্থা রাখে প্রোটিয়া ক্রিকেট বোর্ড। প্রস্তুতি ম্যাচে রান করে ফেরার ইঙ্গিত দিলেও বিশ্বকাপে এসে আবার চুপ তার ব্যাট। যেখানে আমলার হওয়ার কথা ছিল দলের ব্যাটিং মেরুদণ্ড, সেখানে প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচেই চাপে ভেঙে পড়ে সবার আগে প্যাভিলিয়নের পথ ধরেছেন তিনি। একমাত্র অর্ধশতকটিও এসেছে নিউ জিল্যান্ডের সাথে অগুরুত্বপূর্ণ ম্যাচে। কারণ, ততদিনে দক্ষিণ আফ্রিকা বিশ্বকাপ থেকেই ছিটকে গেছে।
দুর্দান্ত সব স্ট্রোকের ফুলজুড়ি ও নান্দনিক সব কাভার ড্রাইভে চার হাঁকাতে জানা আমলা এইবার সবচেয়ে বেশি ভুগেছেন পেস আক্রমণের কাছে। বিশেষ করে বলতে গেলে, পাওয়ারপ্লে’তে নতুন বলের পেস আক্রমণের সামনে। সর্বশেষ কবে আমলাকে এত নড়বড়ে মনে হয়েছিল, সেটি সম্ভবত স্বয়ং আমলাও মনে করতে পারবেন না। জোফরা আর্চারের বাউন্সারে ভূপাতিত হওয়া আমলা যেন নিজের বর্তমান ফর্মেরই প্রতিচ্ছবি। জসপ্রীত বুমরাহ, শেলডন কটরেল, মোহাম্মদ আমির কারো হাত থেকেই রেহাই পাননি তিনি।
ফর্ম হারানোর পাশাপাশি আরো একটি ভয়ঙ্কর ব্যাপার হলো, আমলার বয়স। কিছুদিন আগেই ৩৫ থেকে ৩৬ বছরে পা দিয়েছেন এই প্রোটিয়া ব্যাটসম্যান। এই বয়সে এসে তাই আমলা নিজেকে ফিরে পাবার জন্যও আর বেশি সময় বা ম্যাচ কোনোটিই পাবেন না।
তবে এই দুঃসময়ে অবশ্য সতীর্থদের পাশেই পাচ্ছেন আমলা। কাগিসো রাবাদা আশাবাদী, আমলা খুব দ্রুতই স্বরূপে ফিরতে পারবেন। তার কাঁধে ভরসার হাত রেখেছেন অধিনায়ক ডু প্লেসিও। ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ম্যাচের আগে সংবাদ সম্মেলনে আমলার প্রতি ভরসার কথাই শুনিয়ে যান পেসার কাগিসো রাবাদা। তিনি বলেন,
‘তার সতীর্থ হিসেবে আমরা হ্যাশকে পূর্ণ সমর্থন দিয়ে যাব। কারণ, আমাদের বিশ্বাস আছে, আমলা যেকোনো মুহূর্তেই নিজের ম্যাজিক ফিরিয়ে আনতে পারবেন। ততদিন পর্যন্ত আমরা ওকে পূর্ণ সমর্থন দিয়ে যাব, এবং আমরা আশাবাদী সে দ্রুতই রানে ফিরবে।’
তারপরও প্রশ্ন থেকেই যায়। কতদিন পর্যন্ত দক্ষিণ আফ্রিকান ক্রিকেট বোর্ড আমলার উপর আস্থা রাখবে? কিংবা কতদিন পর্যন্তই বা আমলার অভিজ্ঞতা কোনো কাজে আসবে দক্ষিণ আফ্রিকা দলের জন্য? আর সর্বোপরি কতদিনই বা দক্ষিণ আফ্রিকা আশাবাদী হয়ে থাকবে আমলার ফর্মে ফেরার জন্য? সেটা যতদিনই হোক না কেন, ক্রিকেটভক্তদের আশা, আমলা খুব দ্রুতই নিজেকে ফিরে পাবেন। কারণ, ফর্ম ইজ টেম্পোরারি, বাট ক্লাস ইজ পারমানেন্ট। আর শুধু দক্ষিণ আফ্রিকার স্বার্থেই নয়, ক্রিকেটের স্বার্থেই আমলাকে প্রয়োজন। কারণ, আধুনিক ক্রিকেটের মারকাটারি যুগে ক্লাসিক্যাল ব্যাটসম্যানদের মতো চোখকে আনন্দ দেওয়ার সামর্থ্য যে কয়জনের আছে, তার মধ্যে হাশিম আমলা যে অন্যতম!