আয়ারল্যান্ডের বেলফাস্ট শহরে কোনো এক দুপুরে যদি ডক স্ট্রিটে গেলে দেখতে পাবেন মোটামুটি কিছুটা ব্যস্ত পরিবেশ। সেইলরটাউনের আমেরিকান বারের দরজা খুলে ভেতরে ঢুকলেই আবার অন্য চিত্র। ছিমছাম, শান্ত ধরনের পরিবেশ। দেয়ালের দিকে তাকালে দেখতে পাবেন ইউরোপিয়ান ফুটবলের বিভিন্ন ছবি, ক্লাবগুলোর স্কার্ফ হয়তো ঝুলছে। হঠাৎই দেয়ালে ঝুলানো সাদাকালো একটি ছবিতে চোখ আটকে যাবে আপনার। ছবিতে দেখতে পাবেন সাদা শার্ট, কালো শর্টস পরিহিত এক ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে আছেন ট্রফি নিয়ে। ট্রফিটি ডান হাতে ধরা, কারণ ভদ্রলোকের হাত একটাই, বাম হাত কনুইয়ের নিচ থেকে বাকি অংশটুকু কাটা। ট্রফি হাতে এই খেলোয়াড়ের নাম জিমি হ্যাস্টি, আইরিশ ফুটবলের এক কিংবদন্তি।
১৯৬০ সালে ডান্ডক ফুটবল ক্লাবের চেয়ারম্যান জিম মালোন ক্লাবের বোর্ডকে জানান, তিনি জিমি হ্যাস্টি নামের এক প্রতিভাবান সেন্টার ফরোয়ার্ডের খোঁজ পেয়েছেন, উত্তর আয়ারল্যান্ড সীমান্তের দল নিউরি টাউনের হয়ে যে ফরওয়ার্ড কেবল গোলের পর গোল করে যাচ্ছে। লম্বা, শক্তপোক্ত এই খেলোয়াড়ের ছিল অভাবনীয় ব্যালেন্স, সাথে বাতাসে ছিলেন বিধ্বংসী। মালোন বললেন, ডান্ডকের উচিত যত দ্রুত সম্ভব এই প্রতিভাকে দলে আনা। বোর্ডের আরেকজন সদস্যও সায় জানালেন চেয়ারম্যানের কথায়, হ্যাস্টির কথা শুনেছেন তিনিও। তবে সমস্যা একটাই, তার বাম হাত নেই।
বোর্ড সাধারণত তাদের চেয়ারম্যানের কথা কখনো ফেলে না। তবে এবার তার ব্যাতিক্রম হলো; মালোনকে বলা হলো,
“We are not in the business of freaks!”
কিন্তু মালোন কি আর বোর্ডের কথার ধার ধারেন নাকি! বোর্ডকে জানালেন, ইতঃমধ্যেই নিজের পার্সোনাল চেক দিয়ে জিম হ্যাস্টিকে সাইন করিয়ে নিয়েছেন তিনি। হ্যাস্টি তখন ডান্ডকের পথে রওনা দিয়ে দিয়েছেন।
“বোর্ড খুশি ছিল না, তবে জিম মালোনের আস্থা ছিল জিমির উপর। আমরা আসলে জানতামই না, কী আশা করা উচিত তার থেকে।”
বলছিলেন ষাটের দশকে দলের অধিনায়ক জন মারফি।
বোর্ডের মুখ ব্যাজার করে দিয়ে ১৯৬০ সালের ২০ নভেম্বর হ্যাস্টিকে মাঠে নামান মালোন। অরিয়েল পার্কে কর্ক সেল্টিকের বিপক্ষে সেই ম্যাচে সবাই অপেক্ষা করছিল কি হয় তা দেখার জন্য। মনে হচ্ছিল ডান্ডকের অর্ধেক মানুষই বুঝি ম্যাচ দেখতে চলে এসেছেন।
দর্শকদের হতাশ করেননি হ্যাস্টি। একটা গোল তো করলেনই, তার সাথে নিজের ফুটবল স্কিলের পসরা সাজিয়ে রীতিমতো সবাইকে তাক লাগিয়ে দিলেন। ক্লাবের অফিশিয়াল রেকর্ডে আরও লেখা,
“ডিফেন্ডারদের পেছন ফেলে এগিয়ে যাওয়ার অবিশ্বাস্য ক্ষমতা ছিল তার। তিনি কেবল স্কোরারই ছিলেন না, প্রতিটি আক্রমণের তিনি ছিলেন জেনারেলের মতো। যতক্ষণ না সতীর্থদের পায়ে বল পৌঁছে যাওয়ার মতো নিখুঁত সুযোগ পেতেন, ততক্ষণ বল ধরে রাখতেন নিজ পায়ে।”
মালোনের বিশ্বাসের উপযুক্ত প্রতিদানই দিয়েছিলেন হ্যাস্টি, তুড়িতে উড়িয়ে দিয়েছিলেন যত সংশয়ের মেঘ। মারফি বলেন,
“জিমির ছিল অসাধারণ ব্যালেন্স। দু’পায়েই গোল দিতে পারত সে, সাথে ছিল অসাধারণ একজন হেডার। একজন খেলোয়াড়ের কাছে আপনি যা চান, সবই ছিল তার মাঝে।”
এভাবেই শুরু হলো অসাধারণ এক ফুটবলারের গল্প, যিনি নিজের শারীরিক প্রতিবন্ধকতাকে বুড়ো আঙ্গুল দিয়েছেন, অনুপ্রেরণা দিয়ে গেছেন নিজের সতীর্থ এবং ফ্যানদের। চিহ্ন রেখে গেছেন ফুটবলের ইতিহাসে।
১৯৩৬ সালে উত্তর বেলফাস্টের এক ডকল্যান্ডে জন্ম জিমি হ্যাস্টির। ডকল্যান্ডে জন্ম, তাই কপালে দিনমজুরিই লেখা ছিল। কিন্তু ১৪ বছর বয়সে কারখানায় গিয়ে প্রথম দিনেই মেশিনে কাজ করতে গিয়ে হ্যাস্টি নিজের বাম হাত হারান। এই দুর্ঘটনার কারণে তার জীবন চলার পথ অনেকটাই সংকীর্ণ হয়ে আসে। নটিংহ্যাম ফরেস্ট থেকে ডাক পেয়েছিলেন, কিন্তু ইনস্যুরেন্সজনিত কারণে যেতে পারেননি। কিন্তু হার মানেননি এই আইরিশ, আইল্যান্ডম্যাগীর হয়ে অপেশাদার লিগে কিছুদিন খেলে যোগ দেন নিউরি টাউনে। সেখান থেকেই চোখে পড়েন ডান্ডক চেয়ারম্যানের।
৬ ফুট ১ ইঞ্চির একহাতবিশিষ্ট এই খেলোয়াড়কে ট্যাকল করবে কি করবে না, এই নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দে থাকত প্রতিপক্ষের ডিফেন্ডাররা। কিন্তু প্রথম দশ ম্যাচেই যখন হ্যাস্টি গোলের বন্যা বইয়ে দিলেন, তখন আর তার সক্ষমতা নিয়ে কারো প্রশ্ন ছিল না। এরিয়ালে তার অসাধারণ দক্ষতার একটি রহস্য ছিল তার হাতের বাকি অংশটুকু। হ্যাঁ, ঠিকই পড়েছেন। সেই বাকি অংশ দিয়ে ডিফেন্ডারদের সাথে এরিয়াল ডুয়ালে বাড়তি সুবিধা নিতেন হ্যাস্টি। হাত দিয়ে চেপে ধরে লাফ দিতেন, ফলে ডিফেন্ডার এরিয়ালে খুব একটা সুবিধা করতে পারতো না। হ্যাস্টির সতীর্থ মারফি বলছিলেন,
“রেফারি দেখে ভাবত, জার্সি থেকে একটা হাতা ভাসছে।”
একের পর এক গোল করতে থাকলেন হ্যাস্টি, পয়েন্ট টেবিলে উপরে উঠতে থাকল ডান্ডক। সেই সঙ্গে উপরে উঠতে থাকল সমর্থকদের আশার পারদ। “এক হাতের এই দস্যুকে সবাই দেখতে চাইতো,” মারফি বলে যান, “মনে হতো যেন শহরে সার্কাস এসেছে। লিগকে নিজের দাস বানিয়ে ফেলেছিল সে।”
হ্যাস্টি ছিলেন খুবই অমায়িক প্রকৃতির। হাসিমুখে ভক্তদের অটোগ্রাফের আবদার পূরণ করতেন, সতীর্থদের সাথে মিশে যেতেন খুব সহজেই, দেখতেও ছিলেন বেশ সুদর্শন এবং ছিমছাম।
দলের আরেক স্ট্রাইকার ক্যালান সন্তানের মৃত্যুতে শোকাহত ছিলেন। জানতে পেরে লিখেছিলেন একটি চিঠি,
“জিমি আমাকে একটি চিঠি দিয়েছিল, ভালবাসা আর দরদে ভরা ছিল সেই চিঠি। আমি এটা কখনো ভুলব না।”
ক্যালান পরে সেই চিঠি দিয়ে দেন আরেক সন্তানহারা মা-বাবাকে, হ্যাস্টির সেই চিঠিতে কিছুটা হলেও লাঘব হয়েছিল সেই দম্পতির দুঃখ।
প্রায়ই ইনজুরিতে থাকা সত্ত্বেও ছয় মৌসুমে হ্যাস্টি করেছিলেন ১০৩ গোল। ১৯৬৩ সালে ডান্ডকের ত্রিশ বছরের অপেক্ষার অবসান ঘটে। ত্রিশ বছরে প্রথমবারের মতো লিগ জিতে ডান্ডক। এই লিগ এসেছিল হ্যাস্টির হাত ধরে।
গুঞ্জন উঠেছিল নটিংহ্যাম নাকি দলে নিতে চায় এই স্ট্রাইকারকে। কিন্তু আয়ারল্যান্ডের মতো ইংল্যান্ড দাপিয়ে বেড়ার সুযোগ হয়নি হ্যাস্টির। পরবর্তীতে জানা গেল, নটিংহ্যাম হ্যাস্টিকে দলে নিতে চায়নি, কারণ তিনি ‘বিকলাঙ্গ’।
লিগ জেতার কারণে ইউরোপিয়ান কাপে খেলার সুযোগ পায় ডান্ডক। ড্র’তে প্রতিপক্ষ হিসেবে ডান্ডকের সামনে পড়ে জুরিখ। হোম ম্যাচে খুব একটা সুবিধা করতে পারেনি হ্যাস্টির দল। ৩-০ গোলে সেই ম্যাচটি হারে ডান্ডক। তবে দ্বিতীয় লেগে জ্বলে ওঠেন হ্যাস্টি, দারুণ এক এসিস্টে গোল করান ডার্মটকে দিয়ে, নিজেও করেন একটি। আরেকটি গোল প্রায় পেয়েই গিয়েছিলেন, বাঁধা হয়ে দাঁড়ায় ক্রসবার – ১৫ গজ দূর থেকে তার শট বারে লেগে ফিরে আসে। জুরিখ একটি গোল করলে ৪-২ এগ্রিগেটে পরের রাউন্ডে চলে যায় তারা। কিন্তু হ্যাস্টির কারণে তৈরি হয় অনন্য এক রেকর্ড। প্রথমবারের মতো ইউরোপের কোনো প্রতিযোগিতায় ম্যাচ জেতে আয়ারল্যান্ডের কোনো দল।
ডান্ডকের হয়ে এই গোলমেশিন যেন থামছিলেনই না। ১৯৬৩-৬৪ সম্পূর্ণ ইনজুরিমুক্ত একটি মৌসুম কাটান তিনি, সেই মৌসুমেও করেন ৩৫ গোল। এরপর থেকে ধীরে ধীরে ইনজুরি জাঁকিয়ে ধরতে থাকে। ডান্ডকের হয়ে শততম গোল করার কিছুদিন পরই ১৯৬৬ সালে ওরিয়েল পার্ক ছাড়েন এই কিংবদন্তি। কিছুদিন ড্রগহেডা ইউনাইটেডের হয়ে খেলার পর অবসর নেন হ্যাস্টি। অবসরের আগে অবশ্য জিতে গিয়েছিলেন আয়ারল্যান্ডের টপ স্কোরার অফ দ্য ইয়ারের পুরষ্কার।
ফুটবল ছেড়ে হ্যাস্টি শুরু করেন নতুন জীবন। ছোটবেলার প্রেমিকা মার্গারেটকে বিয়ের পর তাদের ঘর আলো করে আসে দুই ছেলে পল এবং মার্টিন। বুকমেকারের চাকরি করে জীবন ভালই চলছিল।
১৯৭৪ সালের ১১ অক্টোবর। সময়টা সকাল ৮টার কিছু আগে। ব্রোহাম স্ট্রিট দিয়ে নিজের কাজে যাচ্ছিলেন ৩৮ বছর বয়সী হ্যাস্টি। এসময় একটি গাড়ি এসে থামে, নামে একজন বন্দুকধারী। ঠিক তিনটি গুলি করে পিছন থেকে। মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন হ্যাস্টি।
পরবর্তীতে জানা যায়, হত্যাকারী ছিল প্রোটেস্টান অ্যাকশন গ্রুপের সদস্য। এই ছদ্মনামধারী গ্রুপের আসল নাম ছিল উলস্টার ভলান্টিয়ার ফোর্স, যাদের কাজ ছিল আইরিশ স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় আইরিশদের গোপন তথ্য ব্রিটিশদের দেওয়া। হ্যাস্টি হত্যার পিছনে তাদের উদ্দেশ্য ছিল ক্যাথলিক কমিউনিটিতে ভীতি ছড়িয়ে দেওয়া। যে কেউই তাদের টার্গেট হতে পারে, এ বার্তাই তারা দিয়েছিল এই আইরিশ কিংবদন্তিকে হত্যার মধ্য দিয়ে। তবে হত্যাকারী কখনো ধরা পড়েনি।
জিমি হ্যাস্টি হয়তো মারা গিয়েছেন। এতগুলো বছর পরও তার নাম ডান্ডকে এখনো ভেসে বেড়ায়। এক হাতের এই খেলোয়াড়ের গল্প এমনভাবে লোকের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়েছে, যেন কোনো লোকগাথা। পড়বে না-ই বা কেন! আইরিশ ফুটবলে যখন ফ্লাডলাইট আসেনি, তার আগ থেকেই যে আয়ারল্যান্ডের মাঠে আলো ছড়িয়ে গিয়েছিলেন জিমি হ্যাস্টি!