লিসা স্টালেকার: অনাথাশ্রম থেকে চ্যাম্পিয়ন

২০১৩ সাল।

ভারতে অনুষ্ঠিত মেয়েদের বিশ্বকাপ ট্রফি জিতলো অস্ট্রেলিয়া। সেই অস্ট্রেলিয়া দলের হয়ে বিশ্বকাপ জয়ের আনন্দে মাতলো ভারতেরই এক মেয়ে-লিসা স্টালেকার।

হ্যাঁ, মেয়েদের ক্রিকেটের অন্যতম সফল তারকা লিসা স্টালেকার অস্ট্রেলিয়ার হয়ে সারাটা জীবন ক্রিকেট খেলেছেন। এই দলের হয়েই যা কিছু কীর্তি করেছেন। কিন্তু জন্মটা তার ভারতে। তবে ওই জন্মস্থানটুকুই জানা যায়। এই তারকা ক্রিকেটারের প্রকৃত বাবা-মা কে, সে সন্ধান কালের গর্ভে হারিয়ে গেছে। পুনে শহরের এক অনাথাশ্রম থেকে তাকে নিয়ে গিয়েছিলেন তখনকার ইংলিশ বাবা ও ভারতীয় মা দম্পতি। তারপর কেনিয়া হয়ে অস্ট্রেলিয়ায় থিতু হয়েছিলেন তারা। সেই থেকে নিজেকে অস্ট্রেলিয়ান হিসেবেই বড় করে তুলেছেন লিসা।

বিগ ব্যাশে লিসা; Image Source: Getty Image

জন্মস্থান ভারতের হলেও লিসার পরিচয় বহুবিধ। তার পালক বাবা ইংল্যান্ডের, মা ভারতীয়, জন্ম ভারতে, বড় হয়েছেন যুক্তরাষ্ট্র ও কেনিয়াতে এবং শেষ অবধি হয়ে উঠেছেন একজন অস্ট্রেলিয়ান।

২০১২ সালে প্রথমবারের মতো নিজের জন্মস্থান বা সেই অনাথাশ্রম দেখতে গিয়েছিলেন লিসা স্টালেকার। এ বছর আবার গিয়েছিলেন সেই জন্মস্থানে, আর সেখানে গিয়েই প্রথমবারের মতো নিজের এই পরিচয় নিয়ে কথা বলতে গিয়ে আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েছিলেন বর্তমানে অবসর নিয়ে ফেলা এই সাবেক অলরাউন্ডার।

৩৯ বছর বয়সী লিসা এই অনাথাশ্রম প্রথম দেখার স্মৃতি মনে করতে গিয়ে বলছিলেন,

‘আমি যে কতোটা আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েছিলাম প্রথমবার এখানে এসে, সেটা মনে করলেও বিস্মিত লাগে।’

১৯৭৯ সালের ১৩ আগস্ট পুনে শহরের কোনো এক বাড়িতে জন্ম লিসার। তখন তার নাম রাখা হয়েছিলো ‘লায়লা’। লিসার প্রকৃত বাবা-মা তার ভরণপোষণ চালাতে না পেরে জন্মের পরপরই তাকে দিয়ে যান এই শহরের শ্রীবৎস অনাথাশ্রমে। আর এখানেই তার সাথে সাক্ষাৎ হয় নতুন বাবা-মায়ের।

মুম্বাইতে জন্মানো হারেন এবং ইংল্যান্ডে জন্মানো সু স্টালেকার তখন আরেকটি সন্তান দত্তক নেওয়ার জন্য ভারতে এসেছিলেন। তাদের আগে থেকেই ক্যাপ্রিনি নামে একটি কন্যা ছিল। এবার লক্ষ্য ছিল ভারত থেকে একটি ছেলে দত্তক নেবেন; পরিবারটা পূর্ণ হবে। ভারতের বিভিন্ন প্রান্ত একটি ছেলের জন্য ঘুরে বেড়ালেন এই দম্পতি, কিন্তু পেলেন না। অবশেষে পুনেতে এনে এই শ্রীবৎস অনাথাশ্রমে পৌঁছালেন। এখানে এসেও ছেলে খুঁজছিলেন ; কিন্তু তখনই দেখা হয়ে গেলো তাদের ‘লায়লা’র সাথে। বাদামী চোখের উচ্ছ্বল এই মেয়েটিকে দেখে এতটাই ভালো লেগে গেলো যে, ছেলের কথা ভুলে গেলেন তারা। সিদ্ধান্ত নিলেন, এই মেয়েটিকেই দত্তক নেবেন।

আইনি কাজ শেষ করে সবাই মিলে পাড়ি জমালেন যুক্তরাষ্ট্রের মিশিগানে। সেখানে লায়লার নাম রাখা হলো ‘লিসা’। যুক্তরাষ্ট্রে অবশ্য বেশিদিন থাকা হলো না তাদের। এরপর লিসার বাবা কেনিয়ায় চলে গেলেন মিশনারি’র একটা কাজ নিয়ে; পরিবারও সেখানে চললো। সবশেষে তারা পাড়ি জমালেন অস্ট্রেলিয়ায়, সিডনিতে স্থায়ী হলো এই পরিবারটি। আর এখানেই লিসার ক্রিকেটে হাতেখড়ি।

বিশ্বকাপ ট্রফি হাতে লিসা; Image Source: New Idea

শুরুতে ছেলেদের সাথে বাড়ির সামনে ক্রিকেট খেলতেন। এক স্মৃতিচারণে লিসা বলেছিলেন, ছোটবেলায় জানতেন না যে, মেয়েরাও আলাদা করে ক্রিকেট খেলে। তিনি কেন ক্রিকেট খেলা শুরু করেন, সেটা বলতে গিয়ে মজা করে বলেছিলেন,

‘ভারতীয় হিসেবে আমার রক্তেই হয়তো ক্রিকেট ছিল।’

নিজের ‘ভারতীয়’ পরিচয়টার প্রথম মুখোমুখি হয়েছিলেন ২০১২ সালে। তখন ভারত সফরে এসেছিলো অস্ট্রেলিয়া দল। তাদের পুনেতে খেলাও ছিল। লিসার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে ছিল না সেই অনাথাশ্রম খুঁজে বের করার, কিন্তু একদিন তার ম্যানেজারের আগ্রহে চললেন শ্রীবৎস অনাথাশ্রমে। লিসা বলছিলেন,

‘ওখানে যাওয়াটা আমার ইচ্ছা ছিল না; কোনো পরিকল্পনাতেও ছিল না। আমি এমনিতেই পুনে শহরে ছিলাম তখন। আমার ম্যানেজার সেই সময় একদিন বললো, ‘আমরা কেন ওটা খুঁজে বের করার চেষ্টা করছি না?’ আমরা বের হলাম।’

অবশ্যই এই অনাথাশ্রমের কোনো স্মৃতি লিসার ছিল না। তিনি যখন এই জায়গা ছেড়ে গিয়েছিলেন, তখন একেবারেই দুগ্ধপোষ্য শিশু। তারপরও লিসা যখন অনাথাশ্রমে পা রাখলেন তার নাকি একটা পরাবাস্তব অনুভূতি হয়েছিলো; মনে হচ্ছিলো, এটা তিনি চেনেন।

ওই অনাথাশ্রম থেকে ফিরে বাবাকে ফোন দিলেন। সেই কথোপকথনের কথা আজও মনে করতে পারেন লিসা,

‘আমি ওখান থেকে ফিরে রাতে বাবাকে ফোন দিলাম। বাবা জিজ্ঞেস করলে, ‘তুমি কি ওই সরু সিঁড়িটা দিয়ে উঠেছিলে, যেখানে নবজাত শিশুরা থাকে?’ আমি বলেছিলাম, ‘হ্যাঁ।’’

লিসা বুঝতে পারলেন ওই নবজাতকদের ঘরেই তিনি ছিলেন এক সময়। তিনি আবেগ ভরা গলায় বলছিলেন,

‘আমার পালক বাবা মায়ের পায়ের চিহ্ন ধরে ওই সিঁড়িটা বেয়ে ওঠাটা ছিল আমার জন্য এক প্রশান্তির ব্যাপার।’

এই অনাথাশ্রমে বসে লিসা ভাবছিলেন, এই বাচ্চারা, যাদের এখন কেউ নেই, এদের কী হয়? নিজের কথাই যেন ভাবছিলেন। এই বাচ্চাদের যদি কেউ দত্তক না নেয়, তাদের পরিণতি কেমন হতে পারে? তাকে যদি স্টালেকার দম্পতি দত্তক না নিতেন তিনি কি আজকের লিসা হয়ে উঠতেন?

লিসা স্টালেকার হয়ে ওঠাটা কম কথা নয়। বিশ্বের প্রথম নারী ক্রিকেটার হিসেবে ১ হাজার রান করেছেন ও একশ’ উইকেট নিয়েছেন। অস্ট্রেলিয়ার হয়ে ৮টি টেস্ট ও ১২৫টি ওয়ানডে খেলেছেন। ওয়ানডেতে ২৭২৮ রান ও ১৪৬ উইকেটের মালিক তিনি। মেয়েদের ক্রিকেটের প্রথমদিকের তারকা এই লিসা স্টালেকার।

ভারতের বিপক্ষেই খেলছেন; Image Source: Philip Brown

নিজে নিজে ভাবেন, যদি তার ওই অনাথাশ্রমেই থেকে যেতে হতো, তাহলে কোথা থেকে আসতো এতো রান আর উইকেট!

লিসার চোখের সামনে একটা মেয়েকে নরওয়ের এক দম্পতি দত্তক নিলেন। লিসা যেন নিজেকে দেখতে পাচ্ছিলেন,

‘বাচ্চা মেয়েটা তার প্রকৃত বাবা-মায়ের ঠিকানা ছেড়ে নতুন বাবা-মায়ের সাথে নরওয়ে চলে যাচ্ছিলো। আমার মনে হচ্ছিলো, ‘ওয়াও, মেয়েটার জীবন আজ থেকে বদলে যাচ্ছে। আজ থেকে সে অন্য এক পরিচয়ে ভিন্ন এক মানুষ হিসেবে বড় হয়ে উঠবে।’

শ্রীবৎস অনাথাশ্রম থেকে প্রতি বছর এরকম অনেক বাচ্চা দেশে বিদেশে ঘর খুঁজে পায়। এর মধ্যে অনেকে আবার বড় হয়ে নিজের প্রকৃত বাবা মায়ের সন্ধানে ফিরে আসে। লিসা যখন প্রথম এই অনাথাশ্রমে ফিরলেন, কর্তৃপক্ষ ভেবেছিলো, তিনিও বুঝি তার প্রকৃত বাবা-মায়ের সন্ধান চাইবেন।

কর্তৃপক্ষ চাইলে সে ব্যবস্থা করেও দিতে পারতো। কিন্তু লিসা নিজেই সেটা চান না। তিনি বলছিলেন,

‘তারা আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলো, আমি আমার প্রকৃত বাবা-মায়ের সন্ধান খুঁজে পেতে চাই কি না। আমি বলেছি, ‘না, আসলে আমি সেটা চাই না।’ তারা এই কথার প্রতি সম্মান দেখিয়েছে।’

লিসা তার বর্তমান বাবা-মাকেই বাবা-মা হিসেবে দেখতে চান।

এই অনাথাশ্রমে লিসা যে সম্মান পেয়েছিলেন ফিরে, সেটা তিনি ভুলবেন না। তার সম্মানে এখানে অনুষ্ঠান হয়েছিলো, আলোকসজ্জা হয়েছিলো। লিসা নিজে সেই অনুষ্ঠানের বর্ণনা দিয়েছেন,

‘আমার আমার জন্য একটা স্বাগত জানানোর উৎসব করেছিলো। আমি বসেছিলাম, আমার চারপাশে আলো জ্বালানো হয়েছিলো। আমাকে ভারতের ঐতিহ্যমতো স্বাগত জানানো হয়েছিলো।’

এখন তিনি ধারাভাষ্যকার; Image Source: IPL

লিসা এখানেই সন্তুষ্ট থাকতে চান। তিনি চান সব অনাথের তার মতো একটা নতুন ঠিকানা হোক, কিন্তু তিনি তার প্রকৃত বাবা-মাকে খুঁজে পেতে চান না। তিনি চান না, স্টালেকার পরিবারের বদলে অন্য কারো সাথে আর নিজের পরিচয় জুড়ে নিতে।

যে বাবা একদিন হাত ধরে ক্রিকেট মাঠে নিয়ে গিয়েছিলেন, তিনিই লিসার একমাত্র বাবা। যে মা তাকে কোলে করে সমুদ্র চিনিয়েছিলেন, তিনিই লিসার একমাত্র মা।

Featured Image Source : DNAindia

Related Articles

Exit mobile version