গত মৌসুমে গ্রীষ্মকালীন দলবদলের সময়ে বিশাল অঙ্কের ট্রান্সফার ফি’র বিনিময়ে যখন অ্যালিসনকে দলে ভেড়ান হয়, তখন অনেক বিশেষজ্ঞই কিছুটা সংশয়ান্বিত ছিল। এই ব্রাজিলিয়ান গোলরক্ষক আসার পর লিভারপুলের ডিফেন্সিভ রেকর্ড রাতারাতি পাল্টে যাওয়ার পরেও অনেক বিশেষজ্ঞ তার গুরুত্ব ঠিক মানতে চাইলো না! তাদের মতে ডাচ সেন্টারব্যাক ভার্জিল ভ্যান ডাইকের অসাধারণ ফর্মের কারণে অ্যালিসনকে সেভাবে কোনো বিপদের সম্মুখীন হতেই হচ্ছে না, তাই অ্যালিসনের যতটুকু প্রশংসা প্রাপ্য ছিল সেটাও অনেকে ভ্যান ডাইকের পকেটে দিয়ে দিচ্ছিল!
তবে চ্যাম্পিয়নস লিগে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ সেভ করে নিজের জাতটা ঠিকই চিনিয়েছিলেন অ্যালিসন। এরপরও যদি কোনো সংশয়বাদীর মনে ন্যূনতম কোনো সন্দেহ থেকেও থাকে, তবে তাদের জন্য এই মৌসুমটাই যথেষ্ট। গত মৌসুমে লিভারপুলের পুরো রক্ষণভাগে যারা ছিলেন, এই মৌসুমেও তারা সবাই আছেন। তফাৎ শুধু একটাই, ইনজুরির কারণে মৌসুমের এই প্রথমভাগ মিস করছেন অলরেডদের প্রথম পছন্দের গোলরক্ষক অ্যালিসন। মজার ব্যাপার হচ্ছে, এই একজনের অভাবেই লিভারপুলের ডিফেন্সিভ রেকর্ডে অনেক বড় ফারাক চোখে পড়ছে!
এখন পর্যন্ত এই মৌসুমের প্রিমিয়ার লিগে হওয়া আট রাউন্ডের মধ্যে মাত্র দুটি রাউন্ডে ক্লিনশিট রাখতে পেরেছে অলরেডরা, যেখানে গত মৌসুমের প্রথম নয় ম্যাচের মধ্যে ছয়টিতেই ক্লিনশিট ছিল তাদের! গত মৌসুমের চ্যাম্পিয়নস লিগে ছয়টি হোম ম্যাচে মাত্র দুটি গোল হজম করেছিল লিভারপুল, সেখানে এই মৌসুমের চ্যাম্পিয়নস লিগে অ্যানফিল্ডে মোটে এক ম্যাচ খেলেই হজম করতে হয়েছে তিন গোল, তাও আবার অপেক্ষাকৃত দুর্বল দল সালজবার্গের কাছে।
অথচ অ্যালিসনের বদলে লিভারপুলের গোলবার সামলানোর দায়িত্ব যার কাঁধে পড়েছে, সেই আদ্রিয়ান যে খুব খারাপ খেলছেন তাও কিন্তু না। প্রায় প্রতিটি ম্যাচেই তিনি বেশকিছু ভালো সেভ করে যাচ্ছেন, তবুও কেন এতটা তফাৎ দেখা যাচ্ছে? মূল ব্যাপারটা বুঝতে হলে আগে লিভারপুলের পুরো সিস্টেমটা নিয়ে কিছু আলোচনা করতে হবে। দলটির কোচ ইয়ুর্গেন ক্লপ প্রায় প্রতিটি ম্যাচেই দলকে ৪-৩-৩ ফর্মেশনে খেলান, হাই-প্রেসিং ফুটবল তার কৌশলের অন্যতম প্রধান স্তম্ভ। আর সেই প্রেসিংয়ের শুরুটা হয় তাদের আক্রমণভাগের তিন তারকা সালাহ, মানে আর ফিরমিনোর মাধ্যমেই। প্রতিপক্ষ যখন নিজেদের রক্ষণভাগ থেকে বল পায়ে আস্তে-ধীরে আক্রমণ সাজাতে শুরু করে, তখন এই তিনজন একসাথে প্রেস করে প্রতিপক্ষ ডিফেন্ডারদের স্বাভাবিক পাসিং ফুটবলে বিঘ্ন ঘটান।
তবে এই প্রেসিং ফুটবলে সবচেয়ে কার্যকরী ভূমিকা রাখে লিভারপুলের মিডফিল্ডের তিন খেলোয়াড়, একটু খেয়াল করলেই দেখা যাবে যে ক্লপের দলে সেভাবে কোনো সৃজনশীল মিডফিল্ডার নেই। হেন্ডারসন, ফ্যাবিনহো, ভাইনালডাম, মিলনার, কেইটা– প্রত্যেকের ডিফেন্সিভ ওয়ার্করেট অসাধারণ। সেন্ট্রাল মিডফিল্ডে প্রতিপক্ষ কোনো আক্রমণ সাজানোর চেষ্টা করলেই এই তিনজন এসে সেই আক্রমণ প্রতিহত করার চেষ্টা করেন। মিডফিল্ডারদের প্রত্যেকেই ডিফেন্সিভ দায়িত্বে ভূমিকা রাখায় লিভারপুলের দুই ফুলব্যাক– ট্রেন্ট আলেকজান্ডার আর্নল্ড ও অ্যান্ড্রু রবার্টসন স্বাধীনভাবে আক্রমণে ওঠার সুযোগ পান। যখনি এই দুজনের কেউ আক্রমণে যান, তখন তাদের রেখে যাওয়া স্পেস কাভার করার দায়িত্ব ওই তিন মিডফিল্ডারের একজন বুঝে নেন।
আর প্রতিপক্ষের যখন আক্রমণ করতে লিভারপুলের রক্ষণভাগে চলে আসে, তখন লিভারপুলের দুই সেন্টারব্যাক তাদের প্রতিহত করতে সামনে চলে আসে। এমন পরিস্থিতিতে ভাইনালডাম বা ফ্যাবিনহোরাও নিচে নেমে এসে ভ্যান ডাইকদের সাহায্য করেন। আর প্রতিপক্ষ যখন নিজেদের সবটুকু নিয়ে অলরেড সীমানায় আক্রমণ চালানোর চেষ্টা করেন, তখন লিভারপুলের সব খেলোয়াড় একসাথে রক্ষণভাগে ফিরে এসে সেই আক্রমণ প্রতিহত করার চেষ্টা করেন। এক্ষেত্রে পাল্টা আক্রমণ সাজানোর জন্য একমাত্র সালাহ ডান প্রান্তের কিছুটা ওপরে অবস্থান নেন।
যে দল নিজেরা এত হাই প্রেসিং ফুটবল খেলে, তাদের নিজেদের বিল্ড-আপ ফুটবলটাও শক্তিশালী হওয়া প্রয়োজন। নইলে এই প্রেসিং উল্টো বুমেরাং হয়ে ফিরে আসতে পারে। আক্রমণ সাজানোর ক্ষেত্রে লিভারপুল নিজেদের রক্ষণভাগ থেকে ছোট ছোট পাস খেলে সামনে যাওয়ার চেষ্টা করে। এক্ষেত্রে প্রতিপক্ষ ফরোয়ার্ডরা যদি ভ্যান ডাইক বা ম্যাটিপদের পাসিং লেন ব্লক করে প্রেস করার চেষ্টা করেন, তবে তারা গোলরক্ষকের কাছে ব্যাকপাস দিয়ে সেই চাপ থেকে বের হওয়ার উপায় বের করেন।
আর ঠিক এই জায়গাটাতেই অ্যালিসনের অভাব অনেক বেশি টের পাচ্ছে লিভারপুল। এই মৌসুমে অ্যালিসনের ইনজুরির পরে গোলবার সামলানোর দায়িত্ব যখন আদ্রিয়ানের কাছে এলো, তখনো নিজেদের সেই পুরনো পাসিং নিয়ম মেনে যাচ্ছিল লিভারপুল। আর তেমনটা করাই স্বাভাবিক ছিল, কারণ আদ্রিয়ান নিজেও একজন বল প্লেয়িং গোলরক্ষক। কিন্তু প্রথম দুই-তিন ম্যাচেই বেশ বড় একটি সমস্যা সবার সামলে চলে এলো। বল প্লেয়িং গোলরক্ষক হলেও আদ্রিয়ানের সক্ষমতাটা ঠিক অ্যালিসনের সমপর্যায়ে না। তারচেয়েও বড় কথা হচ্ছে, যখন প্রতিপক্ষ ফরোয়ার্ডরা খুব বেশি প্রেস করেন, তখন আতঙ্কিত হয়ে স্বাভাবিক পাস দিতে গিয়েও ভুল করে ফেলছিলেন আদ্রিয়ানো।
উদাহরণ হিসেবে সাউদাম্পটনের বিপক্ষে ম্যাচটি উল্লেখ করা যায়, ৮৩ মিনিটে ভ্যান ডাইক যখন আদ্রিয়ানকে ব্যাকপাস দেন, তখনো সাউদাম্পটন স্ট্রাইকার ড্যানি ইংস বেশ দূরে অবস্থান করছিলেন। তাছাড়া আদ্রিয়ানের ডান পাশে বেশ সহজ একটি পাসিং লেন খোলা ছিল। কিন্তু ইংসের প্রেসে ঘাবড়ে গিয়ে তার পায়েই বল তুলে দেন তিনি! এমন কিছু ঘটনার কারণে লিভারপুলের ডিফেন্ডাররা আদ্রিয়ানের ওপর সেভাবে আর আস্থা রাখতে পারছিল না, তাই তার ওপর চাপ কমাতে তার দিকে নিজেদের মধ্যে পাস দেওয়ার প্রবণতা কমানোর চেষ্টা করে তারা।
এর ফলে নিজেদের রক্ষণভাগে অলরেডদের স্বাভাবিক বিল্ডাপ ফুটবল বেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তাছাড়া নিরীহ পরিসংখ্যান দেখলেও অ্যালিসন আর আদ্রিয়ানের পাসিং সক্ষমতার পার্থক্যের প্রমাণ পাওয়া যাবে। গত মৌসুমের প্রিমিয়ার লিগে ৩৮ ম্যাচ খেলে অ্যালিসনের সফল পাস দেওয়ার শতকরা হার ছিল ৮০ ভাগ, সেখানে এই মৌসুমে আদ্রিয়ানের সফল পাস দেওয়ার শতকরা হার ছিল ৭৪ ভাগ।
এই মৌসুমে লিভারপুলের ক্লিনশিট কম থাকার আরেকটি প্রধান কারণ আদ্রিয়ানের নির্ভুল না থাকা। ব্রাইটন বা বার্নলির মতো মধ্যম সারির দলের গোলরক্ষক হলে ম্যাচে চার-পাঁচটি ভালো করলেই বাহবা পাওয়া যাবে, কিন্তু লিভারপুলের মতো শিরোপাপ্রত্যাশী দলের গোলরক্ষক শুধুমাত্র সেভের কারণে শতভাগ প্রশংসা পাবে না। বড় দলের গোলরক্ষক হলে নিজের গোলবারে শট কিছুটা কম আসবে, কিন্তু যা আসবে সেগুলোর মধ্যে সাধ্যমত সবই সেভ করতে হবে। লেস্টারের বিপক্ষে শেষ ম্যাচটির কথাই বলা যাক, ম্যাচে লেস্টারের বেশকিছু শট দারুণ দক্ষতায় ঠেকিয়ে দিয়েছিলেন আদ্রিয়ান। কিন্তু ৮০ মিনিটে ম্যাডিসন যে শটে গোল দিলো, সেটি আদ্রিয়ানের শরীরের নিচ দিয়েই গেছে। একদম শীর্ষ মানের রিফ্লেক্স হলে সেই শটটি অবশ্যই ঠেকানো যেতো।
আর এখানেই আদ্রিয়ানের সাথে অ্যালিসনের আসল পার্থক্য, গত মৌসুমে নিজের জোনে যত শট আসে, সেগুলোর প্রায় সবই সেভ করার কারণে লিভারপুল এত বেশি ক্লিনশিট রাখতে সক্ষম হয়েছিল। আদ্রিয়ান অনেক ভালো সেভ করছে ঠিকই, কিন্তু নির্ভুল না থাকা আর সেভ করার ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে না পারার কারণেই অ্যালিসনের অভাবটা অলরেডরা ঠিকই টের পাচ্ছে।
তাহলে কি লিভারপুলের গত মৌসুমের অসাধারণ ডিফেন্সিভ রেকর্ডের সিংহভাগ কৃতিত্বটা অ্যালিসনেরই ছিল? ঠিক এই জায়গাটাতেই আমরা ভুল করে বসি, আক্রমণভাগের একজন খেলোয়াড় একা হয়তো দারুণ কিছু করতে পারে কিন্তু রক্ষণভাগে শুধু একজনের ভালো পারফর্মেন্স দলকে সুরক্ষিত রাখার নিশ্চয়তা দিতে পারে না। গত মৌসুমে লিগের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচে যখন ম্যানসিটির মুখোমুখি হলো লিভারপুল, তখন কিন্তু অলরেডদের রক্ষণভাগের প্রায় সবাই ভালো খেলেছিল। শুধুমাত্র এক লভ্রেনের ভুলের কারণে সেই ম্যাচ হেরে বসে তারা এবং মৌসুম শেষে সিটিজেনদের বিরুদ্ধে ওই হারটাই অনেক বড় তফাৎ গড়ে দিয়েছিল।
তাই ভ্যান ডাইকের জন্য অ্যালিসন এত ক্লিনশিট পাচ্ছে অথবা অ্যালিসনের সব অতিমানবীয় সেভের কারণে ভ্যান ডাইক বেঁচে যাচ্ছে– উভয় কথাতেই বেশ বড়মাত্রায় গলদ আছে। অ্যালিসন, ভ্যান ডাইক, ম্যাটিপ, রবার্টসন কিংবা আর্নল্ড– এরা প্রত্যেকে নিজেদের দায়িত্ব পালন করে দলের সাফল্যে নিজেদের মতো করেই অবদান রাখছে। মজার ব্যাপার হচ্ছে, অ্যালিসন না থাকায় অলরেডরা সেভাবে ক্লিনশিট না পেলেও আক্রমণভাগের খেলোয়াড়দের দারুণ পারফর্মেন্সে এখন পর্যন্ত লিগে এক পয়েন্টও তারা খোয়ায়নি। সামনের গেমউইকেই অ্যালিসনের ফেরার কথা, নিজেদের পূর্ণশক্তি নিয়ে বহু বছরের লিগখরাটা এবার তারা ঘোচাতে পারে কি-না সেটাই এখন দেখার বিষয়।