ক্রিকেটের মতো জীবন যুদ্ধেও জিতে যাক রুবেলের ভাগ্য

২০১৬ সালের কথা। রেডিসন ব্লু ওয়াটার গার্ডেনের লাউঞ্জে বেশ ভিড়। সবাই সাংবাদিক। অধীর আগ্রহে অপেক্ষা একজনের জন্য। প্রতীক্ষার প্রহর পেরিয়ে তিনি এলেন। সদা হাস্যোজ্জ্বল মুখ, সপ্রভিত। অনুভূতিটা নিজেও ধরতে পারছেন না বোধ হয়। ধরতে পারার কথাও না। বাংলাদেশ জাতীয় দলে ফের ডাক পাওয়ার আশা যেখানে ছেড়ে দিয়েছিলেন, সেখানে ৮ বছর পর আবারও দেশের হয়ে মাঠে নামবেন, সেটাও বাংলাদেশ; ভাবতে পারাটাও যেন স্বপ্নাতীত। কিন্তু কীভাবে কীভাবে যেন ভাগ্যটা ঘুরে গেল তার। ফাস্ট বোলার রুবেল হোসেনের ইনজুরিতে তিনি জায়গা পেলেন দলে, যদিও তিনি স্পিনার। তারপরও, ঘরোয়া ক্রিকেটে টানা পারফরম্যান্স, হাইপারফরম্যান্স ইউনিটে (এইচপি) সম্ভাবনাময় হয়ে ওঠার দরুণ বয়সের কোঠা ৩০ পার করেও হাসলেন জাতীয় দলে।

লোকটি মোশাররফ হোসেন রুবেল। ২০১৬ সালে আফগানিস্তানের বিপক্ষে তৃতীয় ওয়ানডে ম্যাচ দিয়ে জাতীয় দলে ফিরেছিলেন ৮ বছর পর। ফেরাটাও হয়েছিল রঙিন। ২৪ রান খরচ করে নিয়েছিলেন ৩ উইকেট। ঐ ম্যাচের আগে খেলেছিলেন ৪টি ওয়ানডে, যেখানে সবমিলিয়ে ছিল মাত্র ১ উইকেট।

৮ বছর পর জাতীয় দলে ফেরার পর ক্যাম্পে মিরাজের সঙ্গে মোশাররফ রুবেল; Image source: BCB 

বাংলাদেশের পেশাদার ক্রিকেটের অনন্য এক নাম মোশাররফ রুবেল হঠাৎই আক্রান্ত হলেন ব্রেইন টিউমারে। অবশ্য অসুস্থতার শুরুটা নাকি হয়েছিল আরও আগে। সর্বশেষ বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগে (বিপিএল) কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ান্সের হয়ে এক ম্যাচ মাঠে নেমেছিলেন। পরের সময়গুলোতে অসুস্থ হয়ে যান। একাধিকবার টিম হোটেলেই অজ্ঞান হয়ে পড়েন। পরবর্তীতে ডাক্তাররা জানান, ব্রেইন টিউমারে আক্রান্ত ৩৭ বছর বয়সী রুবেল।

১.

মোশাররফ হোসেন রুবেল চলমান ঢাকা প্রিমিয়ার ডিভিশন ক্রিকেট লিগের জন্য তৈরি হচ্ছিলেন। যেহেতু তিনি জাতীয় দলের বাইরে আছেন, তাই ঘরোয়া ক্রিকেটের উপর নির্ভর করতে হয় তাকে। অবশ্য এই ঘরোয়া ক্রিকেটেই তিনি পেয়েছেন অভাবনীয় সব সাফল্য।

সে কথা থাক। রুবেল এবার লিগ খেলতে পারেননি। বিপিএলের সময় থেকে শুরু হওয়া অসুস্থতা আরও চেপে ধরেছিল তাকে। প্রতিনিয়ত মাথায় ব্যথা অস্বস্তিতে ফেলে দেয় তাকে। না পেরে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হলেন। তখনই জানলেন জীবনের সবচেয়ে বড় দুঃসংবাদের কথা। গেল ৮ মার্চ রাজধানীর একটি হাসপাতালে এমআরআই করার পর জানলেন ব্রেইন টিউমারের কথা।

বোলিংয়ে মোশাররফ হোসেন রুবেল; Image Source: Dhaka Tribune

হঠাৎ এমন দুঃসংবাদে যতটা না তিনি, তার চেয়েও বেশি ভেঙে পড়েছিল তার পরিবার। তবে টিউমার এই মুহূর্তে প্রাথমিক অবস্থায় আছে, এটাই ছিল একমাত্র আত্মবিশ্বাসের পাথেয়। নিজেকে এবং পরিবারকে সামাল দিয়েছিলেন সে কথাতেই। তার পরপরই অস্ত্রোপচারের জন্য সিঙ্গাপুরের মাউন্ট এলিজাবেথে যাওয়ার প্রক্রিয়া শুরু করেন।

রুবেল তখন গণমাধ্যমকে বলেছিলেন,

টিউমারটা প্রাথমিক পর্যায়ে আছে, এটাই খানিকটা আত্মবিশ্বাস জোগাচ্ছে। খবরটা শুনে আমার চেয়েও আমার পরিবার বেশি ভেঙে পড়েছে। দ্রুত অপারেশন করতে হবে। সিঙ্গাপুরের মাউন্ট এলিজাবেথে করার চেষ্টা করছি। আশা করছি দুই-তিনদিনের মধ্যেই ভিসা পেয়ে যাবো।

মোশাররফ হোসেন রুবেলের ব্রেইন টিউমারের খবর পাওয়ার পর থেকেই তার আন্তর্জাতিক ও ঘরোয়া ক্রিকেটের সতীর্থরা নিয়মিত তার খোঁজখবর নিয়েছেন, তার পাশে থেকেছেন। নিউজিল্যন্ড সফরে থাকা বাংলাদেশ জাতীয় দলের ওপেনার তামিম ইকবাল সেখান থেকেই নিয়মিত খোঁজখবর নিয়েছেন। দেশে ফিরেও পাশে থেকেছেন, এখনও আছেন। মাশরাফি বিন মুর্তজা আর সাকিব আল হাসানরা বারবার পাশে থাকার কথা জানিয়েছেন।

সফল অস্ত্রোপচারের পর হাসপাতালের বিছানায় রুবেল; Image Source: Facebook

সবকিছু মিলিয়েই মোশাররফ রুবেলের আত্মবিশ্বাস খানিকটা হলেও বেড়েছিল। পাশাপাশি বিসিবিও পাশে ছিল তার। অর্থনৈতিকভাবে সাহায্যও মিলেছে তাদের কাছ থেকে। সব মিলিয়েই রুবেল সুস্থ হয়ে ফিরে আসার আশা নিয়ে, আবারও ঘূর্ণি বলে মাঠ কাঁপানোর প্রত্যাশা জাগিয়ে দেশ ছেড়েছিলেন।

যাওয়ার দু’দিন আগে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে লিখেছিলেন,

আমি আগামী পরশুদিন সিঙ্গাপুরে অস্ত্রোপচার করাতে যাচ্ছি। একসাথে সবার ফোন ধরতে পারিনি বলে খুবই দুঃখিত। শুধু একটা কথা বলতে চাই, সবার কাছ থেকে দোয়া আর ভালোবাসা পেয়ে আমি আপ্লুত। চিরঋণী হয়ে গেলাম। কীভাবে এই ঋণ শোধ করবো জানি না। শুধু ছোট্ট ধন্যবাদ দিতে চাই সাকিব, তামিম, ম্যাশ, রিয়াদ, বিজয়, সানি, রিংকু, তারেক ভাই, এনাম, রাজ্জাক, মার্শাল, সোহান, শুভ, হুমায়ূন শাহীন, আকরাম ভাই,  মিল্টন ভাই, উদয় ভাই, সুমন ভাই, দুর্জয় ভাই, নান্নু ভাই, সুজন ভাই, নাফিসা আপু, সালাউদ্দিন স্যার, ইমরান স্যার, ফাহিম স্যার, বাবু ভাই, আমার পরিবার ও আমার স্ত্রীকে। কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ান্স, খুলনা টাইটান্স, গাজী গ্রুপ, ওয়াল্টন, বিসিবি, ব্যাংক, ঢাবির বন্ধুরা; সবাইকে ধন্যবাদ। হয়তো বা অনেক গুরুত্বপূর্ণ নাম মিস হয়ে গেছে লেখায়। সারাদিন লিখেও শেষ করা যাবে না। সবার দোয়ায় ইনশাআল্লাহ আবার সবার মাঝে ফিরে আসবো। সবাইকে আমার অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে ধন্যবাদ।

সিঙ্গাপুরে সফলভাবেই অস্ত্রোপচার সম্পন্ন হয়েছে রুবেলের। অপারেশন থিয়েটারে ঢোকার আগে তার হাসিমুখ ছড়িয়ে পড়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। গেল ১৯ মার্চ বিখ্যাত নিউরোলজিস্ট ডাক্তার এলভিন হংয়ের অধীনে অস্ত্রোপচার হয় তার।

অস্ত্রোপচারের পর থেকে এখন পর্যন্ত রুবেল সুস্থ আছেন, ভালো আছেন।

অস্ত্রোপচারের পর; Image Source: Jagonews24.com

রুবেল বলে গিয়েছিলেন তিনি আবার ফিরবেন, ভালোভাবেই ফিরবেন। যে মাঠ তাকে দিয়েছিল উজাড় করে, তিনি সেখানেই ফিরবেন সুস্থ হয়ে। সৌভাগ্য তার, ফিরতে পারছেন রুবেল।

অপারেশনের পর অপেক্ষা ছিল কেবল বায়োপসি প্রতিবেদনের। সেটাতেও উৎরে গেছেন ক্রিকেটার মোশাররফ রুবেল। জানা গেছে, টিউমারের আর কোনো জীবাণু নেই। অর্থাৎ, ক্যান্সারের শঙ্কাটাও নেই। তার মস্তিস্কে যে টিউমার ছিল সেটি মিডল গ্রেডের। তাই রেডিও থেরাপি ও কেমোথেরাপি দুটোই দিতে হবে। 

২.

মানুষ হিসেবে মোশাররফ হোসেন রুবেলের বেশ খ্যাতি আছে। নির্ঝঞ্ঝাট, হাসিখুশি ও দারুণ পরিশ্রমী এই ক্রিকেটার কখনোই কোনো বিতর্কের মুখে পড়েননি।

আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার দেখে রুবেলের ক্রিকেটীয় পরিসংখ্যান বিচার করতে গেলে ভুল হতে পারে। কারণ, এখন পর্যন্ত ঘরোয়া ক্রিকেটে বাংলাদেশের যে ক’জন ক্রিকেটার নিজেদের সেরাটা দিয়ে খেলে যাচ্ছেন, তাদের মধ্যে রুবেল একজন। বাঁহাতি এই বোলিং অলরাউন্ডার ১১২টি প্রথম শ্রেণীর ম্যাচ খেলে নিয়েছেন ৩৯২ উইকেট। ব্যাটিংয়ে ৩,৩০৫ রান, রয়েছে ২টি সেঞ্চুরি আর ১৬টি হাফ সেঞ্চুরি।

‘লিস্ট এ’ ম্যাচ খেলেছেন ১০৪টি। উইকেট ১২০টি। ব্যাটে ১,৭৯২ রান, ৮টি হাফ সেঞ্চুরি। ঘরোয়া টি-টোয়েন্টিতে ৫৬ ম্যাচ খেলে ৬০ উইকেট আর ৬২ রান।

বিপিএলে খুলনা টাইটান্সের হয়ে উদযাপনে রুবেল; Image Source: BCB

২০০৮ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ম্যাচ দিয়ে জাতীয় দলে অভিষেক হয়েছিল মোশাররফ রুবেলের। একই বছরে মোট চারটি ম্যাচ খেলেছিলেন। ব্যাট হাতে ২৬ রানের পাশাপাশি বল হাতে একটি মাত্র উইকেট পাওয়া রুবেলের শুরুটা ভালো হয়নি। কিন্তু সেই শুরুর পর আর শুরু হয়নি তার। বারবার আলোচনায় থেকেছেন, জাতীয় দলের ক্যাম্পে ডাক পেয়েছেন; প্রাথমিক দলে, এমনকি ১৫ সদস্যের মূল দলেও ছিলেন অনেকবার। কিন্তু মূল একাদশে থেকে আর মাঠে নামা হয়নি তার। শেষ পর্যন্ত ২০১৬ সালে সেই যে আফগানিস্তানের বিপক্ষে মাঠে নেমে ৩ উইকেট পাওয়া, আর জাতীয় দলে ফেরা হয়নি। এখনও ঘরোয়া ক্রিকেটকেই পুঁজি করে জীবিকা নির্বাহ করছেন। ৩৭ বছর বয়সেও তার পারফরম্যান্সে ক্ষুরধার।

রুবেলরা এভাবেই ক্যারিয়ারের সাথে লড়াই করতে করতে জীবনের সাথে লড়াইটা চালিয়ে যান। ফিরে আসেন বারবার, দুঃখ ভুলে হাসিমুখে।

This is an article based on Mosharraf Hossain rubel, who is a pioneer criketer of Bangladesh damostic arena. He is also a national cricketer who played 5 ODI. Recently he is attacked by Brain Tumor. All necessary link has been hyperlinked.
Feature Photo: BCB

Related Articles

Exit mobile version