প্রত্যেক দল চায় বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় খুব সহজে ম্যাচের ফলাফল নিজেদের পক্ষে নিয়ে আসতে। আর দর্শকরা গাঁটের পয়সা খরচ করে হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের ম্যাচ দেখতে আসেন, একপেশে ম্যাড়মেড়ে ম্যাচে তাদের পয়সা উসুল হয় না। ব্যাটসম্যানরা চার ছয় হাঁকাবে, বোলাররা উইকেট তুলে নেবে, ফিল্ডাররা দুর্দান্ত ক্যাচ লুফে নেবে – এমন সব দৃশ্য দেখার জন্যই তো দর্শকরা খেলা দেখতে বসেন।
বর্তমানে ক্রিকেট খেলা অনেকটাই ব্যাটিংবান্ধব খেলায় পরিণত হয়েছে। বোলারদের উপর ছড়ি ঘুরিয়ে ব্যাটসম্যানরা একের পর এক চার-ছয় হাঁকিয়ে দর্শকদের মনোরঞ্জন করে। উইকেটগুলোও তৈরি হয় সেই অনুযায়ী। চার-ছয়ে ভরপুর ম্যাচগুলোতে যেমন উত্তেজনা থাকে, তেমনি অল্প পুঁজির নাটকীয় ম্যাচগুলোর মধ্যেও কম উত্তেজনা থাকে না। বিশ্বমঞ্চে এমন লো-স্কোরিং ক্লাসিক ম্যাচগুলোর নাটকীয়তা সম্পর্কে চলুন জেনে আসা যাক।
অস্ট্রেলিয়া বনাম ইংল্যান্ড
১৯৭৫ সালের বিশ্বকাপের প্রথম সেমিফাইনালে মুখোমুখি হয় অস্ট্রেলিয়া এবং ইংল্যান্ড। হেডিংলিতে ১৯৭৫ সালের ১৮ই জুন ম্যাচটি মাঠে গড়ায়। ব্যবহৃত উইকেট, লাল বল, সাদা পোশাক এবং আন-কাভারড পিচে বিশ্বকাপ ক্রিকেটের ইতিহাসে প্রথম সেমিফাইনাল অনুষ্ঠিত হয়।
অস্ট্রেলিয়া টসে জিতে ইংল্যান্ডকে ব্যাটিংয়ের আমন্ত্রণ জানায়। সবুজ উইকেটে ইংলিশ ব্যাটসম্যানদের তখন ভয়ের কারণ ছিলেন বিদ্যুৎগতির দুই পেসার ডেনিস লিলি এবং জেফ থমসন। এই দুই পেসার অ্যাশেজেও ইংলিশ ব্যাটসম্যানদের ভুগিয়েছিলেন। তাই এই দুই পেসারদের বল মোকাবেলা করার সময় বেশ সাবধানী ছিলেন ইংল্যান্ডের ব্যাটসম্যানরা। লিলি এবং থমসনের বলে ৪৩ রান তুলে মাত্র এক উইকেট দিলেও বাঁহাতি পেসার গ্যারি গিলমোরের বোলিং তোপের সামনে মুখ থুবড়ে ইংলিশরা।
এই বাঁহাতি সুইং বোলার গ্রুপ পর্বের একটি ম্যাচও খেলেননি। এই ম্যাচের আগে মাত্র তিনটি ওয়ানডে খেলার অভিজ্ঞতা ছিলো তার। এদিন হেডিংলির মেঘাচ্ছন্ন পরিবেশ কাজে লাগিয়ে দুর্দান্ত বোলিং করেন গিলমোর। তিনি ‘বুমেরাং’ সুইং বোলিং করে ইংল্যান্ডের টপ অর্ডার ধ্বসিয়ে দেন। ওভার দ্য উইকেট থেকে একের পর এক ইনসুইং ডেলিভারিতে পাঁচ ইংলিশ ব্যাটসম্যানকে পরাস্ত করেন তিনি।
গ্যারি গিলমোর একাই ইংল্যান্ডের প্রথম ছয় ব্যাটসম্যানকে সাজঘরে ফেরান। তার শিকারে পরিণত হওয়া ইংলিশ ব্যাটসম্যানদের রানসংখ্যা ছিল যথাক্রমে ২, ৬, ৮, ৭, ৪ এবং ০। তার বোলিং তাণ্ডবের মুখে পড়ে মাত্র ৩৭ রানে সাত উইকেট হারায় ইংল্যান্ড। শেষদিকে অধিনায়ক মাইক ডেনিসের ২৭ রান এবং দশ নাম্বারে ব্যাট করতে নামা জিওফ আর্নল্ডের ১৮ রানের ইনিংসের উপর ভর করে শেষ অবধি ৯৩ রান সংগ্রহ করেছিলো বটে, তবে গ্যারি গিলমোর ১২ ওভার বল করে মাত্র ১৪ রানের বিনিময়ে ছয় উইকেট শিকার করেছিলেন।
তার দায়িত্ব এখানেই শেষ হয়ে যায়নি। ইংল্যান্ডের দেওয়া ৯৪ রানের লক্ষ্যে ব্যাট করতে নেমে অস্ট্রেলিয়া মাত্র ৩৯ রানেই ছয় উইকেট হারিয়ে বসে। ক্রিস ওল্ড তিনটি এবং জন স্নো (যদিও আমেরিকান টিভি সিরিজ গেইম অফ থ্রোন্সের সঙ্গে তার খুব একটা সম্পর্ক নেই) দু’টি উইকেট শিকার করে দলকে জয়ের স্বপ্ন দেখাচ্ছিলেন। তবে তাদের জয়ের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ান গিলমোর, এইবার দলের বিপর্যয়ের মুখে ব্যাট হাতে প্রতিরোধ গড়েন বাঁহাতি আক্রমণাত্মক এই ব্যাটসম্যান। ডগ ওয়াল্টার্সের সাথে সপ্তম উইকেট জুটিতে ৫৫ রান যোগ করে অস্ট্রেলিয়াকে চার উইকেটের জয় এনে দেন তিনি। তার ব্যাট থেকে আসে ২৮ বলে ২৮* রান, যা পুরো ম্যাচের মধ্যে ব্যক্তিগত সর্বোচ্চ রানের ইনিংস। তার দুর্দান্ত নৈপুণ্যে অস্ট্রেলিয়া বিশ্বকাপের ফাইনালে জায়গা করে নেয়।
নিজের এমন অনবদ্য নৈপুণ্য সম্পর্কে গ্যারি গিলমোর বলেন,
‘এটা এমন একটি দিন, যা আপনার জীবনে একবার কিংবা দুইবার ঘটে।’
এই অলরাউন্ডার এরপর আর মাত্র দুটি ওয়ানডে ম্যাচ খেলেছিলেন, যার মধ্যে একটি ১৯৭৫ সালের বিশ্বকাপ ফাইনাল। অস্ট্রেলিয়া ফাইনালে ওয়েস্ট ইন্ডিজের কাছে পরাজিত হলেও গিলমোর ব্যাটে বলে সফল ছিলেন। বল হাতে ৪৮ রানের বিনিময়ে পাঁচ উইকেট শিকারের পর ব্যাট হাতে ১১ বলে ১৪ রান করেছিলেন।
ভারত বনাম ওয়েস্ট ইন্ডিজ
তখনও ক্রিকেট বিশ্বে ওয়েস্ট ইন্ডিজের একক রাজত্ব চলছিলো। ক্রিকেট ইতিহাসের প্রথম দুই বিশ্বকাপ ঘরে তোলার পর হ্যাটট্রিক শিরোপা জয়ের দ্বারপ্রান্তে ছিল ক্লাইভ লয়েড বাহিনী। তখনকার ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলে মাইকেল হোল্ডিং চতুর্থ পেসার হিসাবে খেলতেন। ভারসাম্যপূর্ণ ও ভয়ংকর এই দলটির বিপক্ষে তখন কোনো দলই দাঁড়াতে পারতো না।
১৯৮৩ সালের ২৫শে জুন, লর্ডসে তৃতীয় শিরোপা জয়ের লক্ষ্যে ভারতের বিপক্ষে মাঠে নামে ওয়েস্ট ইন্ডিজ। অ্যান্ডি রবার্টস, জোয়েল গার্নার, ম্যালকম মার্শাল এবং মাইকেল হোল্ডিংদের দিয়ে সাজানো ছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজের বোলিং লাইনআপ। এমন ভয়ংকর পেস অ্যাটাক নিয়ে যেকোনো অধিনায়ক আগে বোলিং করার সাহস দেখাবেন, ক্লাইভ লয়েডও তাই করলেন। টসে জিতে ভারতকে প্রথমে ব্যাটিং করার আমন্ত্রণ জানান।
ব্যাট করতে নেমে ওয়েস্ট ইন্ডিজ পেস ব্যাটারির সামনে কোনো ভারতীয় ব্যাটসম্যানই বড় ইনিংস খেলতে পারেননি, রবার্টস তিনটি এবং মার্শাল, গোমেজ ও হোল্ডিং দু’টি করে উইকেট শিকার করলে ভারত ১৮৩ রানেই গুটিয়ে যায়। ফাইনালে গর্ডন গ্রীনিজ, ডেসমন্ড হেইন্স, ভিভ রিচার্ডস এবং ক্লাইভ লয়েডদের মতো ব্যাটসম্যানদের সামনে সেটা মোটেও যথেষ্ট নয়। তবে কপিল দেবের নেতৃত্বে ফাইনালে ওঠা ভারত ম্যাচের মাঝপথে হার মেনে নেয়নি।
ওয়েস্ট ইন্ডিজের ওপেনার গর্ডন গ্রীনিজকে মাত্র এক রানে সাজঘরে ফেরান সান্ধু। এরপর দ্বিতীয় উইকেট জুটিতে ৪৫ রান যোগ করা ডেসমন্ড হেইন্স এবং ভিভ রিচার্ডসকে ফেরান মদন লাল। পরে তিনি ল্যারি গোমেজকেও সাজঘরের পথ দেখান। মিডিয়াম পেসার মদন লালের গতি না থাকলেও মনের জোরটা ছিল পুরোদমে, আর এতেই তিনি ওয়েস্ট ইন্ডিজের টপ অর্ডার ধ্বসিয়ে দেন। ভিভ রিচার্ডস মাত্র ২৮ বলে ৩৩ রান করে ম্যাচ ভারতের কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলেন, তখনই মদন লাল তাকে থামান। এরপর আরেক মিডিয়াম পেসার মহিন্দর অমরনাথ তিন উইকেট শিকার করলে ওয়েস্ট ইন্ডিজ মাত্র ১৪০ রানে গুটিয়ে যায়, এবং ভারত ৪৩ রানের জয় পায়। ভারতের জয়ে অবদান রাখেন ১২ রান খরচায় তিন উইকেট নেওয়া অমরনাথ এবং ৩১ রান খরচায় সমানসংখ্যক উইকেট শিকার করা মদন লাল।
এই ম্যাচের মধ্য দিয়েই ভারতীয় ক্রিকেটে বিপ্লব ঘটে। এই টুর্নামেন্টের আগে মাত্র ৪০টি ওয়ানডে ম্যাচ খেলার সুযোগ পাওয়া ভারত শিরোপা ঘরে তোলে, যার মধ্য দিয়ে ক্রিকেট বিশ্বে নতুন পরাশক্তির আবির্ভাব ঘটে। এরপর পরবর্তী বিশ্বকাপের আগে ভারত ৭৩টি ওয়ানডে ম্যাচ খেলার সুযোগ পেয়েছিলো। বর্তমানে ক্রিকেট বিশ্বের অন্যতম পরাশক্তি ভারতের ভাগ্য বদল করেছিলো লর্ডসের এই লো-স্কোরিং ম্যাচটি।
কেনিয়া বনাম ওয়েস্ট ইন্ডিজ
বিশ্বকাপ ক্রিকেটে অনেকবার অঘটন ঘটেছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় অঘটন ১৯৯৬ সালের বিশ্বকাপে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে কেনিয়ার জয়।
ওয়েস্ট ইন্ডিজ তখনও ক্রিকেট বিশ্বের অন্যতম শক্তিশালী দল। অন্যদিকে কেনিয়া তাদের প্রথম বিশ্বকাপ খেলছে। কেনিয়ার মূল একাদশে স্টিভ টিকোলো ছাড়া আর কেউই প্রফেশনাল ক্রিকেটার ছিলেন না। তাদের ক্রিকেট বোর্ড তাদের অনুশীলনের জন্য একটা সাদা বলের ব্যবস্থাও করতে পারেনি, পরে তারা লাল বলের সাদা রঙ করে বিশ্বকাপের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করে।
১৯৯৬ সালের ২৯শে ফেব্রুয়ারি, আসরের প্রথম তিন ম্যাচে পরাজিত হওয়ার পর চতুর্থ ম্যাচে শক্তিশালী ওয়েস্ট ইন্ডিজের মুখোমুখি হয়েছিলো কেনিয়া। এই ম্যাচে কোনো বাজিকর কেনিয়ার পক্ষে বাজি ধরেনি। বলা বাহুল্য, তাদের জয়ের সম্ভাবনাও ছিলো শূন্যের কোটায়।
পুনেতে টসে জিতে কেনিয়াকে প্রথমে ব্যাটিং করার আমন্ত্রণ জানায় ওয়েস্ট ইন্ডিজ। তখন ওয়েস্ট ইন্ডিজের বোলিং আক্রমণে ছিলেন অ্যামব্রোস এবং ওয়ালশ। শুরুটাও করেছিলো ফেভারিট হিসেবেই, কেনিয়ার স্কোরবোর্ডে ৪৫ রান যোগ হতেই ওয়ালশ প্রথম তিন উইকেট শিকার করেন। এরপর নিয়মিত বিরতিতে উইকেট হারাতে থাকা কেনিয়া শেষ পর্যন্ত ১৬৬ রান সংগ্রহ করে। এই রান সংগ্রহ করতে অবদান রেখেছিলেন স্টিভ টিকোলো, হিতেশ মোদি এবং থমাস ওডোয়ো; টিকোলো সর্বোচ্চ ২৯ রান, মোদি ২৬ রান এবং ওদোয়ো ২৪ রান করেন। তবে কেনিয়ার স্কোরবোর্ডে সবচেয়ে বেশি রান ‘মিস্টার এক্সট্রা’র, ওয়েস্ট ইন্ডিজের ৩৭টি অতিরিক্ত রান খরচের বদৌলতেই কেনিয়া শেষ পর্যন্ত ১৬৬ রান সংগ্রহ পায়।
কেনিয়ার দেওয়া ১৬৭ রানের লক্ষ্যে ব্যাট করতে নেমে ২২ রানের মধ্যেই দুই ওপেনারের উইকেট হারায় ওয়েস্ট ইন্ডিজ। তখনও জয়ের ব্যাপারে কোনো সন্দেহ ছিল না ওয়েস্ট ইন্ডিজের, কারণ হাতে যে ব্রায়ান লারা ছিলেন! কিন্তু লারা সেদিন শুরু থেকেই তাড়াহুড়ো করছিলেন, প্রথম বলে চার মারার পর আরও কয়েকটি বলে এলোপাতাড়ি ব্যাট চালিয়েছিলেন তিনি। তখন ওয়েস্ট ইন্ডিজের দ্বাদশ ব্যক্তি এসে তাকে বলে যান ঠাণ্ডা মাথায় ব্যাট করতে। কে শুনে কার কথা, নিজের খেলা ১১তম বলে আবারও আক্রমণাত্মক শট খেলেন তিনি, যার ফলে উইকেটরক্ষক তারিক ইকবালের হাতে ক্যাচ দিয়ে সাজঘরে ফেরেন। কেনিয়ার উইকেটরক্ষক তারিক ইকবাল ছিলেন একেবারে আনাড়ি, ম্যাচের শুরুতে অনেকবার বল তালুবন্দী করতে ব্যর্থ হয়েছিলেন, যা দেখে তার সতীর্থরাও হাসাহাসি করছিলেন। শেষ পর্যন্ত তিনিই লারার গুরুত্বপূর্ণ ক্যাচটি তালুবন্দী করেন।
ব্রায়ান লারার বিদায়ের পর ওয়েস্ট ইন্ডিজের আর কোনো ব্যাটসম্যান উইকেটে থিতু হতে পারেননি। দলের পক্ষে সর্বোচ্চ ১৯ রান করেছিলেন চন্দরপল। শেষ পর্যন্ত ওয়েস্ট ইন্ডিজ মাত্র ৯৩ রানে সব ক’টি উইকেট হারায়, যার ফলে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ৭৩ রানের জয় পায় কেনিয়া। তাদের এই জয়ে বড় অবদান রাখেন অধিনায়ক মরিস ওদুম্বে ও রজব আলি, ওদুম্বে ১০ ওভারে মাত্র ১৫ রানের খরচায় তিন উইকেট শিকার করেন এবং রজব আলি লারার উইকেটসহ সমসংখ্যক উইকেট শিকার করেন।
ম্যাচ শেষে ম্যাচ জয়ের নায়ক ওদুম্বে ওয়েস্ট ইন্ডিজের ড্রেসিংরুমে গিয়ে ব্রায়ান লারাকে অটোগ্রাফ দেন, এবং বলেন,
‘দুই বছর আগে আমি তোমার অটোগ্রাফ চেয়েছিলাম, তুমি ফিরিয়ে দিয়েছিলে। এখন আমি বলতে পারবো আমার অটোগ্রাফ তোমার কাছে আছে।’
অস্ট্রেলিয়া বনাম নিউজিল্যান্ড
২০১৫ সালের ২৮শে ফেব্রুয়ারি বিশ্বকাপের গ্রুপ পর্বের ম্যাচে মুখোমুখি হয় দুই প্রতিবেশী দেশ নিউজিল্যান্ড এবং অস্ট্রেলিয়া। নিউজিল্যান্ডের অকল্যান্ডে ম্যাচটি অনুষ্ঠিত হয়। বিশ্বকাপের লো-স্কোরিং এই ম্যাচে আদিম যুগের ওয়ানডে ম্যাচের ছাপ ছিল। ব্যাটসম্যানদের খেলায় পরিণত হওয়া ক্রিকেটের ফাঁকে এ ম্যাচে রাজত্ব করে দুই দলের বোলাররা।
অকল্যান্ডে টসে জিতে প্রথমে ব্যাট করার সিদ্ধান্ত নেওয়া অস্ট্রেলিয়ার শুরুটা খুব একটা খারাপ হয়নি। ওয়াটসন, ওয়ার্নারের ছোটখাটো ইনিংসগুলোর উপর ভর করে তিন উইকেটে ৯৫ রান সংগ্রহ করেছিলো অজিরা। এরপর-ই ধ্বংসযজ্ঞ চালান ট্রেন্ট বোল্ট; তিনি একে একে মাইকেল ক্লার্ক, মিচেল মার্শ, গ্লেন ম্যাক্সওয়েল, মিচেল জনসন এবং মিচেল স্টার্কের উইকেট শিকার করেন। এর ফলে তিন উইকেটে ৯৫ রান থেকে হুট করেই ১০৬ রান তুলতে নয় উইকেট হারিয়ে বসে অস্ট্রেলিয়া। এরপর শেষ উইকেট জুটিতে কামিন্সের সাথে ৪৫ রান যোগ করে বোলারদের লড়াই করার পুঁজি এনে দেন হাডিন, এই উইকেটরক্ষক-ব্যাটসম্যান খেলেন ৪৩ রানের ইনিংস। নিউজিল্যান্ডের হয়ে ট্রেন্ট বোল্ট ২৭ রানের বিনিময়ে পাঁচ উইকেট শিকার করেন।
অস্ট্রেলিয়ার দেওয়া ১৫২ রানের লক্ষ্যে ব্যাট করতে নেমে ব্রেন্ডন ম্যাককালামের ব্যাটে চড়ে উড়ন্ত সূচনা পেয়েছিলো স্বাগতিক নিউজিল্যান্ড। তিনি মাত্র ২৪ বলে সাতটি চার এবং তিনটি ছয়ের মারে ৫০ রান করে সাজঘরে ফিরেছিলেন। তিনি যখন কামিন্সের বলে আউট হন, তখন নিউজিল্যান্ডের স্কোরবোর্ডে ৭.৪ ওভার শেষে ৭৮ রান ছিল। এরপর অজিদের ম্যাচের ফেরানোর নায়ক মিচেল স্টার্ক এক রানে রস টেইলরকে এবং শূন্য রানে গ্রান্ট এলিয়টকে সাজঘরে ফেরালে ৭৯ রানে চার উইকেট হারিয়ে বসে নিউজিল্যান্ড। সেখান থেকে দলকে জয়ের পথে রাখেন অ্যান্ডারসন এবং কেন উইলিয়ামসন।
গ্লেন ম্যাক্সওয়েলের বলে স্টার্কের হাতে ক্যাচ দিয়ে কোরি অ্যান্ডারসন যখন পঞ্চম ব্যাটসম্যান হিসেবে সাজঘরে ফেরেন, তখন নিউজিল্যান্ডের জয়ের জন্য ৩০ ওভারে মাত্র ২১ রান প্রয়োজন ছিল। সেখান থেকেই ম্যাচের মোড় ঘুরিয়ে দেন মিচেল স্টার্ক। দুর্দান্ত সব ইয়র্কারের প্রদর্শনীতে রঙ্কি এবং সাউদির উইকেট দ্রুত তুলে নেন, যার ফলে নিউজিল্যান্ড ১৪৬ রান তুলতেই নয় উইকেট হারায়। তখনই জয়ের স্বপ্ন দেখা শুরু করছিলো অস্ট্রেলিয়া। অন্যপ্রান্তে স্টার্কের বলে তাসের ঘরের মতো কিউই ব্যাটিং লাইনআপ ভেঙে পড়লেও উইলিয়ামসন নিজের উইকেট আঁকড়ে পড়ে ছিলেন। অবস্থা বেগতিক দেখে বাড়তি সময় অপচয় না করে কামিন্সের বলে ছক্কা হাঁকিয়ে নিউজিল্যান্ডের এক উইকেটের জয় নিশ্চিত করেন তিনি। স্টার্ক মাত্র ২৮ রানে ছয় উইকেট শিকার করলেও দলকে জয় এনে দিতে পারেননি, উইলিয়ামসনের অপরাজিত ৪৫ রানের উপর ভর করে শেষ হাসিটা হাসে নিউজিল্যান্ডই।
ইংল্যান্ড বনাম ওয়েস্ট ইন্ডিজ
২০০৪ সালের ২৫শে সেপ্টেম্বর দ্য ওভালে চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির ফাইনালে শিরোপা জয়ের লক্ষ্যে মাঠে নামে ইংল্যান্ড এবং ওয়েস্ট ইন্ডিজ। সেপ্টেম্বরের শেষদিকে দ্য ওভালের উইকেট থাকে শতচ্ছিন্ন, আর এমন উইকেটে মিডিয়াম পেসাররা হয়ে ওঠেন বেশ কার্যকরী। ফাইনালে বল হাতে ওয়াভেল হাইন্ডস, পল কলিংউড, এমনকি মার্কস ট্রেসকোথিকের মতো বোলাররাও দুর্দান্ত বোলিং করেছিলেন। পুরো ম্যাচে কোনো দল একটিও ছক্কা হাঁকাতে পারেনি।
ফাইনালে টসে জিতে প্রথমে ইংল্যান্ডকে ব্যাটিং করার আমন্ত্রণ জানায় ওয়েস্ট ইন্ডিজ। ব্যাট করতে নেমে নিয়মিত বিরতিতে উইকেট হারাতে থাকলেও মার্কস ট্রেসকোথিকের ১০৪ রানের ইনিংসের উপর ভর করে ইংল্যান্ড ২১৭ রান সংগ্রহ করে। ওয়েস্ট ইন্ডিজের ওয়াভেল হাইন্ডস ১০ ওভার বল করে মাত্র ২৪ রান খরচায় তিন উইকেট শিকার করেছিলেন।
জবাবে ওয়েস্ট ইন্ডিজও খুব একটা সুবিধা করতে পারেনি। ৪৭ রান করা চন্দরপল যখন পল কলিংউডের বলে মাইকেল ভনের হাতে ক্যাচ তুলে দেন, তখনও জয়ের জন্য ৭১ রান প্রয়োজন ছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজের। হাতে ছিলো মাত্র দুই উইকেট। তখনই জুটি বাঁধেন কোর্টনি ব্রাউন এবং ইয়ান ব্রাডশ’, তারা দুইজন মাটি কামড়ে উইকেটে টিকে ছিলেন। দুর্দান্ত বোলিং করতে থাকা অ্যান্ড্রু ফ্লিনটফ এবং স্টিভ হার্মিসনের বলে কোনো প্রকার ঝুঁকি না নিয়ে খেলছিলেন তারা দু’জন। পর্যাপ্ত ওভার থাকার কারণে এই দুই পেসারের ওভার দেখেশুনে খেলার সময় পেয়েছিলেন তারা। শেষ পর্যন্ত তারা নিজেদের পরিকল্পনায় সফল হয়েছিলেন। শেষ পাঁচ ওভারে যখন জয়ের জন্য ২৪ রান প্রয়োজন ছিল, তখন ফ্লিনটফ ও হার্মিসনের কোনো ওভার আর বাকি ছিল না। তাই তারা দু’জন অনায়াসেই সাত বল বাকি থাকতে দুই উইকেটের জয় নিশ্চিত করেন।
এই দুইজন নবম উইকেট জুটিতে ৭১ রান যোগ করে ওয়েস্ট ইন্ডিজকে চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির শিরোপা এনে দিয়েছিলেন। ম্যাচসেরা ইয়ান ব্রাডশ’ ৩৪* এবং কোর্টনি ব্রাউন ৩৫* রানের ইনিংস খেলেছিলেন। তাদের বীরত্বে ইংল্যান্ডের বৈশ্বিক ট্রফি জয়ের অপেক্ষা আরও দীর্ঘায়িত হয়েছিলো।