বিমানবন্দরে শত শত ক্যামেরা দেখে আগেই ভড়কে গিয়েছিলেন। সাংবাদিকদের ভিড়, লোকে লোকারণ্য! এসবের সাথে তিনি খুব একটা অভ্যস্ত নন। নিজের দেখেও এসব আছে, কিন্তু এমন ‘বাড়াবাড়ি’ নেই। তবে ২৪ ঘন্টার মাঝে টের পেলেন, এগুলো আসলে ‘বাড়াবাড়ি’ নয় একটুও। এগুলো আবেগ। ক্রিকেটের প্রতি বাংলাদেশের সমর্থকদের আবেগ। নিজের প্রথম আনুষ্ঠানিক সংবাদ সম্মেলনে এসে স্বীকার করে নিলেন, এত সাংবাদিকও তার একসাথে কখনও দেখা হয়নি।
এই সবই ঘটেছে বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের নতুন হেড কোচ দক্ষিণ আফ্রিকার রাসেল ডোমিঙ্গোর সাথে। বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলের দায়িত্ব নেওয়ার পর প্রথমবার বাংলাদেশে নেমেই এমন অভিজ্ঞতা হলো তার। তাতেই বুঝে নিলেন, দেশটা আর যা-ই হোক, ক্রিকেটে আপ্রাণ।
ক’দিন আগে সাক্ষাতকার দিতে এসেছিলেন বিসিবির প্রধান কার্যালয়ে। উদ্দেশ্য ছিল হাই পারফরম্যান্স ইউনিটের (এইচপি) কোচ হওয়া। সেখান থেকে হয়ে গেলেন প্রধান কোচ। বিশ্বকাপে বাংলাদেশের আশাহত পারফরম্যান্সে বলি হতে হয়েছিল সাবেক কোচ স্টিভ রোডসকে। চাকরিটা হারিয়েছেন তিনি। তাতে করে শূন্য হয়েছে প্রধান কোচের পদ। সেই জায়গায় নতুন কোচ নিতে বিসিবি বিজ্ঞাপন দিয়েছিল, আবেদন করেছিলেন প্রোটিয়া ডোমিঙ্গো। আরও আবেদন করেছিলেন মাইক হেসন, মিকি আর্থার, অ্যান্ডি ফ্লাওয়ার, পল ফারব্রেস আর গ্রান্ট ফ্লাওয়ারের মতো হাই প্রোফাইল কোচরা। যদিও বিসিবির মূল পছন্দের তালিকায় ছিলেন হেসন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত প্রোটিয়া ডোমিঙ্গোকে এইচপি নয়, প্রধান কোচের দায়িত্বই দেওয়া হলো।
বিসিবিসহ বাংলাদেশের ক্রিকেট সংশ্লিষ্ট, এমনকি সমর্থকরা পর্যন্ত বাংলাদেশের কোচ ইস্যুতে তাকিয়ে ছিল ভারতের দিকে। কারণ ভারতের সর্বোচ্চ ক্রিকেট সংস্থা বিসিসিআইও খুঁজছিল নতুন কোচ। তাদের তালিকাতেও উপরের দিকেই ছিলেন মাইক হেসন। শেষ পর্যন্ত হেসনের ভাগ্য খোলেনি। পুরনো কোচ রবি শাস্ত্রীর উপর ভরসা রেখেছে কোহলি-রাইডুদের দল। তখনই আলোচনা আরও জোরদার হয় যে, মাইক হেসনই হতে পারেন বাংলাদেশের নয়া কোচ।
শেষপর্যন্ত তা হয়নি। হেসনের চাহিদা ও বাংলাদেশ দল নিয়ে তার কাজ করতে চাওয়ার মানসিকতা ডোমিঙ্গোর সামনে হার মেনেছে। নানা শর্ত, আকাশছোঁয়া পারিশ্রমিক, দলকে পুরো সময় দিতে না পারা, সরাসরি সাক্ষাৎকার তো দূরে থাক, ইমেইলেও দায়সারা উত্তর; সবকিছু মিলিয়ে হেসনের প্রতি আগ্রহ হারিয়েছিল বাংলাদেশের প্রতিনিধিরা।
তবে এই জায়গায় অনেকটা এগিয়ে ছিলেন রাসেল ডোমিঙ্গো। তিনি সশরীরে ঢাকায় এসে সাক্ষাৎকার দিয়েছেন। দলের ব্যাপারে নিজের পরিকল্পনা জানিয়েছেন, প্রতিটি ক্রিকেটার ধরে ধরে বোর্ডের সামনে উপস্থাপনা করেছেন। ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা, কোন ক্রিকেটারকে কতদূর নেওয়া যাবে, নির্দিষ্ট ক্রিকেটারদের পারফরম্যান্সের দুর্বলতা, উন্নতির সুযোগ; সবকিছু নিজের প্রেজেন্টেশনে বলেছেন রাসেল। বোর্ড কর্তারা জানিয়েছেন, রাসেল ডোমিঙ্গো বাংলাদেশের সাথে কাজ করতে মুখিয়ে আছেন। এই দলটা নিয়ে তার চিন্তাভাবনা পানির মতো পরিস্কার। আর সেই কারণেই সুযোগটা তারই হয়েছে।
শুধু তা-ই নয়, ডোমিঙ্গো বাংলাদেশ দলের সাথে কাজ করতে চেয়েছেন পুরোটা সময় ধরে। কখনও পেশাদার ক্রিকেট না খেলা এই কোচকে নিয়ে বিসিবি সভাপতি আনুষ্ঠানিক ঘোষণার দিন জানিয়েছিলেন, ডোমিঙ্গো কোনো রকম বিরতি ছাড়া আগামী দুই বছর বাংলাদেশের সাথে প্রতিদিন কাজ করতে চেয়েছেন।
ডোমিঙ্গোর কাছ থেকে বাড়তি যে জিনিসটা বাংলাদেশ পাবে, তা হলো জাতীয় দলের পাশাপাশি বয়সভিত্তিক দল থেকে নতুন প্রতিভা তুলে আনার ক্ষেত্রেও আগ্রহ থাকবে এই কোচের। অতীতে খুব বেশি কোচের মাঝে এই ইচ্ছাটা দেখা যায়নি। যদিও মাত্র সাবেক হয়ে যাওয়া রোডসও ডোমিঙ্গোর মতো একই পথে হাঁটতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তার আগেই চাকরিটা খোয়াতে হয়েছে তাকে।
এক সাক্ষাৎকারে রাসেল ডোমিঙ্গো বলেছেন,
আমি আসলে জানি না তারা (বিসিবি) আমার মধ্যে ব্যতিক্রম কী পেয়েছেন। তবে আমি যেটা বলতে পারি তা হলো আমি অনূর্ধ্ব-১৫ দল থেকে শুরু করে জাতীয় দল; সব জায়গায় কাজ করেছি। তাই আমি জানি কীভাবে সিস্টেমটা কাজ করে। অবশ্যই জাতীয় দল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, এ নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু আপনাকে অবশ্যই জাতীয় দলের নিচের দলগুলোতে কী হচ্ছে সে ব্যাপারে জানার আগ্রহ থাকতে হবে। জাতীয় দলে আসা মানে ফর্ম নিয়ে আলোচনা। যদি ক্রিকেটারদের ফর্মে আনার ব্যাপারে আমার খুব ছোট কিছুও করার থাকে সেটাও আমার কাছে অনেক গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করি।
তিনি আরও বলেন,
বাংলাদেশ দারুণ একটা দল। অনেক ভালো কিছু ক্রিকেটার এই দলে আছে। তার চাইতে বড় কথা হলো, বেশ কিছু তরুণ ক্রিকেটাররা দলে ভালো করছে যে কারণে জ্যেষ্ঠ ক্রিকেটারদের উপর চাপ বাড়ছে। একইভাবে অসময়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে নামিয়ে দেওয়াটাও বাজে প্রভাব ফেলছে। এখানে আমাকে তাদের (ক্রিকেটারদের) প্রয়োজন।
নির্দিষ্ট একটা লক্ষ্য নিয়েই বাংলাদেশের দায়িত্ব নিয়েছেন ডোমিঙ্গো। ওয়ানডেতে চার নম্বরে দেখতে তিনি। জোর দিতে চান সাদা পোশাকের টেস্টেও। তার মতে, টেস্ট ক্রিকেট ছাড়া কোনো দলের উন্নতি খুব বেশি দূর সম্ভব নয়। দলের বর্তমান সদস্য এবং নতুন, পাশাপাশি যারা সামনের দিনগুলোতেও উঠে আসছে তাদের ব্যাপারেও মনোযোগী হতে চান এই প্রোটিয়া।
এ ব্যাপারে তার ভাষ্য,
আমাদের আসলে পাইপলাইন আরও বড় করা উচিত দলের উন্নতির জন্যই। এভাবেই বাংলাদেশ ক্রিকেট দল আগামী ৫-৬ বছরে এগিয়ে যাবে। তাছাড়া বাংলাদেশ শেষবার টেস্ট খেলেছে ৬ মাস আগে। অনেক বড় সময় কিন্তু এটা। টেস্ট বেশি না খেললে উন্নতি করা কঠিন। আমার মনে হয় টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের কারণে এই দল এখন বেশি টেস্ট খেলার সুযোগ পাবে। প্রায়ই বাংলাদেশ দুই ম্যাচের টেস্ট সিরিজের আয়োজন করে, যেখানে অন্যান্য দল ৩-৪ ম্যাচের সিরিজ খেলে। আমার মনে হয় বাংলাদেশ দল সাদা বলে অনেক বেশি গুরুত্ব দেয়।
নিজের নতুন মিশনের প্রথম দিন একটু বেশিই আগে পৌঁছেছিলেন মিরপুর শেরে বাংলা জাতীয় ক্রিকেট স্টেডিয়ামে। আগেই জানতেন, বাংলাদেশের ঢাকা শহরে জ্যামের বদনাম আছে। একাধিকবার বয়সভিত্তিক দল নিয়ে বাংলাদেশ সফরে সেই অভিজ্ঞতাও মোটামুটি তার আছে। কিন্তু এবার একটু উল্টোই হলো তার সাথে। গুলশানের হোটেল থেকে ভোর ছ’টায় রওয়ানা দিয়ে মাত্র ২০ মিনিটে পৌঁছে গেলেন স্টেডিয়ামে। সবার আগে।
এটা জানা কথা যে, টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের ফলাফলের উপর নির্ভর করছে ২০২৩ বিশ্বকাপে সুযোগ পাওয়া। সেই ধারাবাহিকতায় সফরটা সহজ হবে না কারো জন্যই। তাই যত দ্রুত পারা যায় নিজের কাজটা গুছিয়ে নিতে চান ডোমিঙ্গো। সেই ধারাবাহিকতায় দলের সদস্যদের সাথে সুসম্পর্ক তৈরি করাকেই বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন তিনি।
দলের প্রতিটি সদস্যের উপর আলাদা নজর রাখা এমনকি ঘরোয়া ক্রিকেটেও নজর রাখার কাজ করবেন ডোমিঙ্গো। বোর্ড সভাপতি নাজমুল হাসান পাপনও একই কথা জানিয়েছেন।
দক্ষিণ আফ্রিকান এই কোচ দলের কোচিং স্টাফদের নিয়ে একসাথে কাজ করতে চান। একে অপরের প্রতি বিশ্বাস অর্জনের মাধ্যমেই দলকে এগিয়ে নেওয়া সম্ভব বলে বিশ্বাস করেন তিনি। একইসাথে হাই পারফরম্যান্স ইউনিটের কোচ সায়মন হেলমট ও নির্বাচকদের সাহায্যও তিনি শতভাগ পাবেন বলে আশাবাদী।
ডোমিঙ্গোর কোচিং ক্যারিয়ার নিয়ে সুখ্যাতি আছে। এখন সেই খ্যাতি কাজে লাগিয়ে খানিকটা হেলে পড়া বাংলাদেশ দলকে আবার চাঙ্গা করতে পারবেন কি না তা সময়ই বলে দেবে।