তাইজুল, মিরাজ কিংবা অপু; জিম্বাবুয়ে সিরিজে বাংলাদেশের হয়ে বোলিংয়ে সবচেয়ে বেশি প্রভাব রেখেছেন। সেই স্পিনারদের সাফল্যের পেছনে বাংলাদেশ জাতীয় দলের স্পিন কোচ সুনীল যোশীর কৃতিত্ব ভুললে চলে না। নিজের ছাত্রদের নিয়ে তার মুখে যেমন ঝরেছে ফুলঝুরি, তেমনই বাংলাদেশ দলে একজন লেগ স্পিনার আর চায়নাম্যানের প্রয়োজনীয়তা তাকে খুব করে পোড়াচ্ছে। এ নিয়ে কিছু উদ্যোগও হাতে নিয়েছেন। তবে বিশ্বকাপের আগে বাংলাদেশের আরও অনেক কিছুই করার ছিল যা এখনও করা হয়নি, এমনই ভাবনা তার। বাংলাদেশ স্পিন ও বাংলাদেশ দলের স্পিনার নিয়ে এক সাক্ষাতকারে খোলামেলা আলাপ করেছেন স্পিন কোচ সুনীল যোশী।
তাইজুলের পারফরম্যান্সকে কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?
প্রথমত, তাইজুলকে অভিনন্দন। আমি এই দলটির সঙ্গে প্রায় এক বছরেরও বেশি সময় ধরে আছি। আমি দেখেছি তাইজুল কতটা পরিশ্রম করে, যদিও সে মাত্র একটা ফরম্যাটে খেলে। ও ঘরোয়া লিগে (জাতীয় ক্রিকেট লিগ) অনেক বল করে। ফলাফলও পাচ্ছে, সত্যিই ও খুব ভালো করছে। এ নিয়ে সে টানা তিন ম্যাচে পাঁচ উইকেট পেল। আমি চেষ্টা করেছি আমার অভিজ্ঞতা, আমি ক্রিকেটার থাকা অবস্থায় যা শিখেছি তা তাইজুলের সঙ্গে শেয়ার করতে। সে-ও এগুলো ভালোভাবে নিয়েছে। এখন সে টের পাচ্ছে লাল বলে ধারাবাহিকতা, সিমের পজিশন, মানসিকতা এবং বোলিংয়ে বৈচিত্র্য আনা কতটা গুরুত্বপূর্ণ। তবে তাইজুল কঠোর পরিশ্রম করে। আমি যদি কখনও তাকে কোনো নির্দিষ্ট বিষয় অনুশীলন করতে বলেছি, সে করেছে। খেলার ব্যাপারে সে খুব আন্তরিক। সে কারণেই ভালো ফলাফল পাচ্ছে তাইজুল।
মনে হচ্ছিলো সাকিবের অনুপস্থিতিতে স্পিনাররা নিজেরাই দায়িত্ব নিয়ে খেলেছে…
আপনি হয়তো খেয়াল করেছেন, তাইজুল ১১০ ওভার পর্যন্ত বল করেছে। তবে বাংলাদেশ দলের প্রধান অস্ত্র নিঃসন্দেহে সাকিব আল হাসান। মিরাজ, তাইজুল অথবা অন্য যেকোনো স্পিনার বলেন, যেকোনো ফরম্যাটে স্পিনারদের মধ্যে দলে সাকিব সেরা। সাকিব এমন একজন ক্রিকেটার যে দলকে নেতৃত্ব দেয় এবং সবাইকে অনুপ্রাণিত করে। সাকিবের অনুপস্থিতিতে নাজমুল ইসলাম অপু, তাইজুল আর মিরাজদের পুরো দায়িত্বটা পড়ে যায়। আমরা ওয়ানডে সিরিজেও দেখলাম, টেস্টেও দেখলাম। তারা যেভাবে বল করেছে, বিশেষ করে তাইজুল; দারুণ ছিল। তাইজুল টেস্টের জন্য নিজের মানসিকতা দৃঢ় করেছে। যখন আপনি টেস্টে কাউকে বল করবেন, তখন সবকিছু নির্ভর করবে আপনার দক্ষতা আর ধৈর্য্যের উপর। তাইজুল সেই ব্যাপারটা গ্রহণ করেছে এবং সেভাবেই এগিয়েছে।
অনেক খেলোয়াড় আছে যারা মাত্র একটি ফরম্যাটে খেলতে গিয়ে সুবিধা করতে পারে না। আপনার কি মনে হয় তাইজুল এক্ষেত্রে আলাদা?
আমরা মিরাজকে তিন ফরম্যাটেই খেলতে দেখছি। অবশ্য তাকে কৃতিত্ব দিতেই হবে কারণ, সে আসলেও দারুণ কাজ করছে। যদিও তাইজুল কেবল একটা ফরম্যাটেই খেলছে, তাই এই ফরম্যাটের জন্য অনুশীলনে নিজের পুরোটা দিতে পারছে। প্রতিটি আলাদা সিরিজে, আমরা আলাদা আলাদা বলে খেলি। এই ব্যাপারগুলো তাইজুলকে প্রভাবিত করে, কারণ সে কেবল একটি ফরম্যাটেই খেলে, যেখানে মিরাজ দলের সাথে তিনটি ফরম্যাটেই থাকার সুযোগ পাচ্ছে।
মেহেদী হাসান মিরাজকে নিয়ে বলুন। কীভাবে সে এত ধারালো হচ্ছে?
মিরাজের হাতের তালুর দিকে তাকান। ওর আঙ্গুলগুলোও অনেক বড়। এসব তাকে বোলিংয়ে বাড়তি সুবিধা দেয়। আমি বলবো ‘গড গিফট’। পৃথিবীর খুব বেশি স্পিনারের লম্বা আঙ্গুল নেই। মিরাজ এশিয়ান পণ্য, বাংলাদেশি পণ্য। কারণ তার হাত ও তার হাতের আঙ্গুল। এগুলোর মাধ্যমে সে অন্যান্য স্পিনারদের চেয়ে বেশি বল ঘোরাতে পারে। আর টেস্টে এই সুবিধাটা কাজে লাগাতে পারলে কী হয় তা তো দেখতেই পাচ্ছেন। আমার মতে, যেকোনো ব্যাটসম্যানের সামনেই বোলার হিসেবে মিরাজ একটু অস্বস্তিকর।
নাজমুল ইসলাম অপুকে তিন ফরম্যাটেই বিবেচনা করা হচ্ছে। এটা কি তার সহজাত ডিফেন্সিভ বোলিং স্টাইলের কারণে?
আপনি যদি নাজমুল ইসলামের ইতিহাস ঘাটেন, সে শুরু করেছিল টি-টোয়েন্টি দিয়ে। সেখান থেকে ওয়ানডে তারপর টেস্ট। অর্থাৎ, তার মধ্যে অবশ্যই এমন কিছু আছে যা সে দলকে দিতে পারে। যেকোনো খেলোয়াড়, ধরুন সে ফাস্ট বোলার হোক কিংবা স্পিনার, একই একশনের বোলিং যদি সে বারবার করতে পারে সেটা তার জন্য অনেক বড় সুবিধা। সব ফরম্যাটেই এই সুবিধায় চড়ে নিজের ধারাবাহিকতা বজায় রাখা সম্ভব।
এসব কারণেই ক্রিকেটের বিভিন্ন অংশে বিশেষজ্ঞ কোচ রাখা হয়। যদিও অপুর জন্য এটা একেবারেই শুরুর সময়। আমরা তাকে সময় দিতে চাই। সে তিন ফরম্যাটে খেলার মতোই সম্ভাবনাময় খেলোয়াড়।
বাংলাদেশের অন্যান্য স্পিনারদের নিয়ে কিছু বলুন, যাদেরকে আপনার চোখে সম্ভাবনাময় মনে হচ্ছে।
আমাদের নাঈম হাসান আছে। আমি ওকে গেল এক বছর ধরে দেখছি। বিকেএসপিতে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ওয়ার্ম-আপ ম্যাচে খেলতে দেখেছি। প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে নাঈমকে আমি ৭ উইকেট, ৮ উইকেট করে নিতে দেখেছি। নিজের বোলিংয়ে বৈচিত্র্য আনার ব্যাপারে সে অনেক কাজ করেছে। ৬ ফুট ২ ইঞ্চি লম্বা এই ছেলে চাইলে বাউন্সও দিতে পারে। আমাদের সানজামুল ইসলাম আছে। সে-ও ভালো উইকেট নিচ্ছে। এই মুহূর্তে এমন অনেক স্পিনারই ভালো করছে যারা কি না ভবিষ্যতে বাংলাদেশ দলের জন্য আলোকবর্তিকা হয়ে দাঁড়াতে পারে।
এসব তরুণ স্পিনারদের নিয়ে আপনি কী ধরনের পরিকল্পনা করছেন?
আমরা ট্যালেন্ট হান্টের পরিকল্পনা করছি। যখন এই ব্যাপারটা চূড়ান্ত হবে, তখন এ নিয়ে আশা করি অনেক কথা জানাতে পারবো। আমরা বোর্ডকে একটা প্রস্তাব দিয়েছলাম। যেখানে আমরা চেয়েছিলাম একটা ট্যালেন্ট হান্টের মাধ্যমে লেগ স্পিনার কিংবা চায়নাম্যান খুঁজে আনা যায়। আমি চট্টগ্রামে গিয়ে এমন কিছু স্পিনারকে দেখেছি। আমরা যদি কক্সবাজারে সুযোগ পাই, হয়তো আরও কিছু দেখতে পাবো। যদি সবকিছু ঠিক থাকে তাহলে বিপিএলের মধ্যেও একটা স্পিন ট্যালেন্ট হান্ট আমরা করবো। এটাও একটা প্ল্যাটফর্ম হতে পারে।
বাংলাদেশ দলে লেগ স্পিনার দেখা যায় না। তানবীর হায়দার এবং জুবায়ের হোসেন লিখনের দারুণ সম্ভাবনা ছিল, কিন্তু তারা নিজেদেরকে এগিয়ে নিতে পারেনি। আপনার কি মনে হয় এই জায়গাটাতে আরও একটু স্বচ্ছ প্রক্রিয়া থাকা জরুরি?
আমি আপনাকে অনিল কুম্বলের উদাহরণ দিতে পারি। জুনিয়র ক্রিকেট থেকে টেস্ট ক্রিকেট পর্যন্ত, আমি তার সাথে খেলেছি। লোকে বলতো অনিল হলো মিডিয়াম পেসার। তার একশন নাকি লেগ-স্পিনার হিসেবে যায় না। কিন্তু সেই লোকটিই টেস্ট ক্রিকেটের অন্যতম সেরা উইকেটশিকারি হয়ে গেল।
তো ব্যাপারটা হলো কেবল স্পিনার নয়, এগুলো নির্ভর করে আমরা কীভাবে আমাদের বোলারদের পরিচর্যা করছি। কীভাবে আমরা দেখছি, তাদের নিয়ে আমাদের আগামী এক কিংবা দুই বছরে কী ধরনের পরিকল্পনা আছে। এই সময়ের মধ্যে আমরা তানবীর কিংবা লিখনকে দেখেছি। দেখেছি নতুন রিশাদ হোসেনকেও। এই ছেলেটিকে আমি শেষ এক বছর ধরে লক্ষ্য করে আসছি। সে বেশ ধারাবাহিক। জাতীয় ক্রিকেট লিগে ছেলেটি কিছু ম্যাচ খেলেছে। চার উইকেট নিয়েছে এক ম্যাচে। অনূর্ধ্ব-১৯ দলের হয়ে ভালো বল করছে।
প্রত্যেক স্পিনারের জন্য অধিনায়ক এবং টিম ম্যানেজমেন্টের সমর্থন প্রয়োজন হয়। আপনি কীভাবে স্পিনারদের নিয়ে এই সিরিজে পরিকল্পনা করবেন? উদাহরণস্বরুপ, জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে আমরা আমাদের তরুণ স্পিনারদের পরখ করে দেখতে পারতাম। এটা এজন্য সেরা সময় হতে পারতো, যার মাধ্যমে তাদের বোলিংয়ের বৈচিত্র্যও দেখে নিতে পারতাম।
যেমন- ভারতে অফস্পিনার, লেগ স্পিনার এবং চায়নাম্যান; সবাই খেলে। তো আমাদেরকে একটা বড় আসরের জন্য তৈরি হওয়ার আগে অবশ্যই প্রস্তুতি নিতে হবে। আমরা বিশ্বকাপ খেলতে যাচ্ছি আট মাস পর। এই মুহূর্তে আমাদের প্লেয়ার পুলে অন্তত ১৫-২০ জন ক্রিকেটার থাকার কথা। এখানে টিম ম্যানেজমেন্ট আছে, নির্বাচক আছে, তারা সেগুলো শনাক্ত করবে।
বাংলাদেশ দল কি স্পিনার মাহমুদউল্লাহ রিয়াদকে প্রয়োজনের তুলনায় কম ব্যবহার করছে?
আমি একটা কথা রিয়াদকে বলেই যাচ্ছি যে, তার উচিত টি-টোয়েন্টিতে বল করা। সে এই ফরম্যাটে চার ওভার বল করবে। অবশ্যই এটা দেখতে হবে যে সে কীভাবে নিজেকে তৈরি করছে। ও মূলত লোয়ার মিডল অর্ডারে বাংলাদেশের মেরুদণ্ড। অবশ্যই তার বোলিং করার ওই সক্ষমতাটাও আছে। আমরা তাকে বল করতে দেখেছি, তার দক্ষতাও কম নয়। বিশেষ করে তার অফ-স্পিনের বেসিকটা অসাধারণ। তো আবারও বলছি, তার বোলিংটা করা উচিত। আমাদের উচিত তাকে এ নিয়ে চাপ দেওয়া।