প্লেয়ারস আননোন ব্যাটেল গ্রাউন্ড, যা পাবজি নামে পরিচিত, অনলাইন এই গেমটি ইতিমধ্যেই বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। তবে এরকম অনেক গেমই হঠাৎ হঠাৎ জনপ্রিয়তা পেয়ে থাকে, কিন্তু এই গেমটি একটু ব্যতিক্রমী। তাই এটা এখন পর্যন্ত খুব জনপ্রিয় অবস্থায় আছে এবং মনে হচ্ছে, এটা এত তাড়াতাড়ি হারিয়ে যাবে না। আর বাংলাদেশেও পাবজি হয়ে উঠেছে অনেক জনপ্রিয়, ছোট থেকে বড় সবাইকেই দেখা যাচ্ছে এই গেমটি খেলতে। আর আজকের আলোচনায় থাকছে পাবজি এবং এর সু- বা কু-প্রভাব।
পাবজির ইতিহাস
এই গেমটির ধারণা আসে কিমজি ফুকাসাকু পরিচালিত ব্যাটেল রয়্যাল নামক জাপানী একটি চলচ্চিত্র থেকে, যেটা প্রচারিত হয় ২০০০ সালে। এর কাহিনী বেশ আলাদা। এখানে ৯ম এবং ১০ম শ্রেণীর ছাত্র-ছাত্রীদের একটি অজানা দ্বীপে নিয়ে যাওয়া হয় কিছু খাবার, পানি এবং অস্ত্রসহ। আর তাদের গলায় একটি ব্যান্ড বেঁধে দেয়া হয়, কেউ যদি পালানোর চেষ্টা করে তাহলে সেই ব্যান্ড ফেটে সে মরে যাবে। আর দ্বীপটি থেকে সে-ই ফিরে যেতে পারবে, যে কি না সবাইকে হত্যা করে একা ঐ দ্বীপে বেঁচে থাকতে পারবে।
এই গেমটি এখন ছোট থেকে বড় সবাই খেলে। আর এই গেমটি ই-স্পোর্টস দুনিয়ায় খুব ভালোভাবেই আলোড়ন সৃষ্টি করতে পেরেছে। এখন প্রত্যেক বছরই গ্লোবাল চ্যাম্পিয়নশিপ থেকে শুরু করে সব ধরনের চ্যাম্পিয়নশিপ হয়ে থাকে এই গেমটির।
বাংলাদেশেও এখন অনেক তরুণ-তরুণীকে এই গেমটি খেলতে দেখা যায়। ভারতীয় প্লেয়ার ‘ডায়নামো’, ‘মরটাল’, ‘স্কাউট’সহ অনেকেই জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে এই গেমটির লাইভ স্ট্রিমিং করে। এছাড়া বাংলাদেশেও অনেকেই জনপ্রিয়তা পেয়েছে লাইভ স্ট্রিমিং করে। এর মধ্যে ‘আমিনুব’, ‘নিউব’ এরা বেশ জনপ্রিয়। তাদের সবাই নিজেদের ইউটিউব চ্যানেলের মাধ্যমে লাইভ স্ট্রিমিং করে থাকে।
আবার অনেকে এটাকে কেন্দ্র করে করছে অনেক ব্যবসা। এই গেমে অনেক ধরনের ‘ইনগেম’ জিনিসের দরকার হয়, যেমন- ‘স্কিন’, ‘রয়্যাল পাস’ ইত্যাদি। আর এগুলো কেনার জন্য দরকার হয় ‘ইউসি’ (আননোন ক্যাশ), আর সেটা কিনতে হয় অর্থের বিনিময়ে। কিন্তু অনেকের কাছেই ক্রেডিট কার্ড নেই বা সে জানে না এগুলো কেনার প্রক্রিয়া। আর তাই অনেকে ফেসবুক পেজ বা ওয়েবসাইট খুলে তাদের ইউসি প্রদান করে থাকেন টাকার বিনিময়ে। অনেকের মনে হতেই পারে যে, এটা আর তেমন কী ব্যবসা! কিন্তু তাদের এই ধারণাকে ভুল প্রমাণ করে আসল চিত্র। যারা এসব ব্যবসা করছে, তারা সার্ভিস দিয়ে কুলিয়ে উঠতে পারছে না। কম করে হলেও প্রত্যেকদিনই ১০ থেকে ২০ জন তাদের কাছে আসে ইউসি কেনার জন্য।
আবার অনেকে পাবজিকে কেন্দ্র করে করছে কাপড় ও পাবজির অস্ত্রের প্লাস্টিক মডেলের ব্যবসা। আর বলতেই হয়, তাদের এই ব্যবসা খুব ভালোভাবেই চলছে। শুধু এটাই নয়, অনেকেই পাবজি থিমের আদলে গড়ে তুলেছে রেস্টুরেন্ট। এমনকি বাংলাদেশই এরকম রেস্টুরেন্টের দেখা মিলবে, যেখানে পুরো রেস্টুরেন্টকে সাজানো হয়েছে পাবজি গেমের থিম অনুযায়ী।
আর যদি কথা বলতে হয় যে পাবজির নির্মাতা প্রতিষ্ঠান ‘পাবজি কর্পোরেশন’ এর লাভ-লোকসানের ব্যাপারে, তাহলে বলতেই হয়- তাদের এই জীবনে আর কোনো গেম তৈরি না করলেও চলবে! কেননা ভিডিও গেমস রিসার্চ ফার্ম ‘নিকো পার্টনার’ থেকে পাওয়া তথ্য মোতাবেক পাবজি কর্পোরেশনের ২০১৮ সালের মোট আয় হলো ৯২০ মিলিয়ন ডলার (প্রায়), আর সেখান থেকে তাদের মুনাফা হয়েছে ৩১০ মিলিয়ন ডলার (প্রায়)। এ বিষয়ে টুইটের মাধ্যমে জানিয়েছেন নিকো পার্টনার্সের সিনিয়র অ্যানালিস্ট দানিয়াল আহাম্মেদ। কিন্তু এই আয়ে পাবজি কর্পোরেশন সন্তুষ্ট নয়, তারা আরও ভালো লাভ আশা করেছিল, যদিও এটা মোটেও কম কিছু নয়। আর সবচেয়ে চোখে পড়ার বিষয় হচ্ছে, এই কোম্পানির মোট আয়ের ৫৩% এসেছে এশিয়া থেকে।
সাধারণত ভিডিও গেমকে এখনও অনেকেই বাঁকা চোখে দেখে। আর কোনো গেম জনপ্রিয়তা পেলে তো কথাই নেই। তবে অনেকেই এই ধারণাটি ভাঙার চেষ্টা করছে। সবাই তুলে ধরছে এই গেমটির ভালো এবং উপকারী দিকগুলো। এ প্রসঙ্গে ইউনিভার্সিটি অব উইসকন্সিনের মনোবিজ্ঞানী সি. সোয়ন গ্রিন বলেছেন, “ভিডিও গেমস আপনার ব্রেইনের পরিবর্তন ঘটায়” । এই গেমটির মাধ্যমে বিশ্বের নানা প্রান্তের মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করা সম্ভব হয়, আবার এই গেমটির মাধ্যমে মানুষ অনেক নতুন কিছু শিখতে পারে, যেমন- এই গেমটি খেলার সময় তাদের অনেক বাধার সম্মুখীন হয়। আর তাদের সেই বাধাগুলো পার করে আসতে হয়। এর মাধ্যমে তাদের নানা ধরনের সমস্যা সমাধানের পথ খুঁজে পায়, এবং সমস্যা সমাধানে পটু হয়ে ওঠে। তাছাড়াও এই গেমটিতে অনেক কিছুর ব্যাপারে খেয়াল রেখে খেলতে হয়, যেমন- খেলার সময় কোনদিক থেকে শত্রু আসছে, বা কোন পরিস্থিতিতে কোন অস্ত্র ব্যবহার করলে সবচেয়ে ভালো হবে ইত্যাদি।
একদিকে পাবজি এখন গেমিং দুনিয়ায় একদম তুঙ্গে, আর অন্যদিকে সন্তানের অভিভাবকেরা এই গেমকে কেন্দ্র করে উদ্বিগ্ন সময় পার করছেন। ভারতে এই গেমের প্রসঙ্গ সেখানকার প্রধানমন্ত্রী পর্যন্ত পৌঁছে গেছে। এক অভিভাবক এই গেম নিয়ে তার কাছে আপত্তি জানিয়েছেন এবং ভারতে একজনের রিটের মাধ্যমে সেটা হাইকোর্ট নিষিদ্ধও করে দেয়। কিন্তু পরে এটা সমালোচনার মুখে পড়লে সেই নির্দেশনা সরিয়ে নিতে হয়।
প্রত্যেক বাবা-মা তাদের সন্তানদের নিয়ে উদ্বিগ্ন, কেননা অনেকেই একে আসক্তির পর্যায়ে নিয়ে গেছে। এবং উদ্বিগ্ন হওয়াটাই স্বাভাবিক, কেননা ভারতে এই গেমটির কারণে আঠার বছর বয়সী এক তরুণ আত্মহননের পথ বেছে নেয়। কেননা, তার বাবা-মা তাকে পাবজি খেলার জন্য নতুন ফোন কিনে দেয়নি। আর চীনে ১৩ বছর বয়সী এক কিশোর নিহত হয় পাবজির চরিত্রের মতো বিল্ডিং থেকে লাফ দিতে গিয়ে। তার মায়ের বক্তব্য হলো, তার ছেলে খুব হাসিখুশি স্বভাবের ছিল। কিন্তু সে এই গেমের কারণে প্ররোচিত হয়ে এরকম পদক্ষেপ নিয়েছে।
আবার চীনের হুয়াইয়ান শহরের ৬ষ্ঠ শ্রেণীর এক শিশু ছাদ থেকে লাফ দেয়ার চেষ্টা করে, যখন তার মা তার ফোনটি কেড়ে নিয়েছিল। এক গবেষণার মাধ্যমে জানা গেছে, চীনে ১৮% কিশোর ভিডিও গেমসের আসক্ত।
এই গেমটি পুরো বিশ্বে বেশ আলোড়ন সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছে। আবার অনেকের ধারণা, এটা মানুষকে করে তুলছে আসক্ত, আর সবাইকে নিজের লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত করছে। কিন্তু অন্যদিকে পাবজিকেই নিজের লক্ষ্য করছে অনেকে, তারা হতে চায় প্রফেশনাল স্ট্রিমার এবং গেমার।
গেমিং একটি পেশা হিসেবে এখনও বাংলাদেশে তেমনভাবে সাড়া ফেলতে পারেনি। তাই সবাই এই গেম খেলাকে অহেতুক মনে করছে। কিন্তু এতে কোনো সন্দেহ নেই যে, গেমিং বা স্ট্রিমিং একসময় বাংলাদেশেও একটি পেশা হিসেবে বিবেচিত হবে।
এই আলোচনার শেষে বলা যায়, একটি মুদ্রার দুটি পিঠ থাকে। তাই ভিডিও গেম খেলার যেমন ভালো দিক আছে, তেমনি অনেক খারাপ দিকও আছে। তাই সবকিছুর মতোই যদি ভিডিও গেমস সীমার মধ্যে থেকে খেলা যায়, তাহলে তার ফল ভালো আসবেই। কিন্তু সীমার বাইরে গেলেই বিপদ, অন্তত ছোট শিশু বা অপ্রাপ্তবয়স্কদের জন্য তো অবশ্যই।