তার সময়ের বিশ্বসেরা উইকেটরক্ষকদের একজন ছিলেন জ্যাক রাসেল। ক্রিকেটার থাকা অবস্থায়ই শুরু করেছিলেন আঁকাআঁকি। সাবেক এই ক্রিকেটার এখন পুরোদস্তুর শিল্পী। জ্যাক রাসেলের গ্লাভস ছেড়ে তুলি ধরার রোমাঞ্চকর গল্প পড়বেন আজ।
ব্রিস্টলের চিপিং সদবারি এলাকায় জ্যাক রাসেলের আর্ট গ্যালারিতে ঢুকলে আপনার প্রথম মনে হবে, তার ক্যানভাস কেবল ক্রিকেট নয়; পুরো জীবন।
আগামী মাসে ৫৫ বছর পূর্ণ করতে যাওয়া রাসেল ছিলেন তার সময়ের সেরা একজন উইকেটরক্ষক। ১৯৮৮ সাল থেকে ১৯৯৮ সাল অবধি ইংল্যান্ডের হয়ে ৫৪টি টেস্ট এবং ৪০টি ওয়ানডে খেলেছেন তিনি। এর পরেও ছয় বছর গ্লুস্টারশায়ারের হয়ে ‘লিস্ট এ’ ক্রিকেট খেলা চালিয়ে গেছেন। ২০০৪ সালে সবধরনের ক্রিকেটকে বিদায় বলেছেন। এর আগেই ক্রিকেটের পাশাপাশি চিত্রশিল্পকে জীবনের অংশ করে নিয়েছেন ইংল্যান্ডের এই সাবেক উইকেটরক্ষক।
রাসেলের গ্যালারিতে গেলে আপনি বিচিত্র সব বিষয়ের ছবি খুঁজে পাবেন- গ্লুস্টারশায়ার জেলার কটসওল্ড কাউন্টির শ্বাসরোধ করা এক প্রাকৃতিক দৃশ্য, উত্তর উইলটশায়ারে রোডবার্ন গ্রামের কুঁড়েঘর, লন্ডনের যুদ্ধস্বরণী সেনোটাফের ব্যস্ত দৃশ্য; এমনকি চিপিং সদবারি এলাকার একটা রাস্তার দৃশ্যও আছে এখানে।
রাসেল তার এই ছবি আঁকার শুরুটা বলতে গিয়ে বলছিলেন,
“আমি সবসময়ই আগ্রহী ছিলাম। তবে কখনো আর্ট স্কুলে যাইনি। কিন্তু রেমব্রান্ট, জন কনস্ট্যাবল, জেমস হুইসলার, জেএমডব্লু টার্নার, ডেভিড শেপার্ড, ট্রেভর চেম্বারলিন, জন সিঙ্গার সার্জেন্ট; এদের ছবি দেখতে খুব পছন্দ করতাম।”
রাসেল এই সেকালের চিত্রকরদের ছবির প্রশংসা করে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটিয়ে দিতে পারেন। কিন্তু পেশাদার ক্রিকেটার হয়ে ওঠার আগে তুলিটা কখনোই হাতে নেওয়া হয়নি তার। আর সেটা যখন হলো, একটা হতাশার কারণেই হলো।
বৃষ্টিতে যখন খেলা ভেসে যায়, সেই বিষণ্ন সময়টাতে কোনো ক্রিকেটার একটু তাস খেলেন, কেউ সাহিত্যে ডুবে যান। কিন্তু রাসেলকে এসব কখনোই টানেনি। এরকম বৃষ্টিতে ভেসে যাওয়া একটা তিনদিনের ম্যাচের হতাশ সময়েই রাসেল প্রথম নিজেকে ছবি আঁকা শেখাবেন বলে ঠিক করলেন।
রাসেলের প্রথম শিল্পটা ছিলো একটা দুই-বাই-দুই স্কেচ। উস্টার কাউন্টি মাঠের পেছনে সেভার্ন নদীর একজন মানুষ গাছের নিচে বসে একটা খবরের কাগজ পড়ছে। এই এতগুলো বছর পার করে এসেও রাসেল সেই ছবিটা যত্ন করে রেখে দিয়েছেন। কারণ, এটাই তার জীবনের নতুন একটা শুরুর প্রতীক। এই সময়ে তিনি বুঝতে পারেন, তিনি ছবি আঁকতে পারেন। কিন্তু কাউকে সেই ছবি দেখানোর সাহসটা করে উঠতে পারেননি।
১৯৮৭ সালের পাকিস্তান সফর রাসেলের এই মানসিকতটা বদলে দিলো। রাসেল বলছিলেন,
“আমি ভারত ও পাকিস্তান খুব পছন্দ করি। এখানকার লোকগুলো অসাধারণ। আর ছবি আঁকার বিষয় এখানে অফুরন্ত। আমি পেশোয়ারকে খুব ভালোবেসে ফেলেছিলাম। ১৯৮৭ ও ১৯৯৬ বিশ্বকাপে অসাধারণ সময় কেটেছে ওখানে। ১৯৮৭ সালের পাকিস্তান সফর আমাকে ১৯৮৮ সালের প্রথম প্রদর্শনীর বিষয়বস্তুর জোগান দিয়ে ফেললো। সেই প্রদর্শনীতে দুই দিনে চল্লিশটা স্কেচ বিক্রি হয়ে গিয়েছিলো। এর বছর দুই পর আরেকটা অয়েল পেইন্টিংয়ের প্রদর্শনীতে ৩০টা ছবি বিক্রি হয়ে গেলো। আর ওখান থেকেই সব শুরু হলো।”
“এই দুটো প্রদর্শনীতে যখন সব ছবি বিক্রি হয়ে গেলো, তখন আমি বুঝলাম, আমার একটা সুযোগ আছে। কিন্তু ওখান থেকেই আমাকে পরিশ্রমটাও শুরু করতে হলো। এখন এই ৩০ বছর পরে এসেই আমি পেইন্টিং বিক্রি করছি।”
শুরুতে শুরুতে শিল্পের প্রতি এই আবেগ আর আকর্ষণের ফলে রাসেল একগাদা অতিরিক্ত ব্যাগ নিয়ে সফরগুলোতে যেতেন। ইংল্যান্ড দলের ম্যানেজমেন্ট তখনও অনুমান করতে পারেনি, এই বাড়তি ব্যাগগুলোতে কী থাকতো,
“আমাকে কিপিং আর ব্যাটিং সামগ্রীর জন্য আলাদা একটা ব্যাগ নিতে হতো। এটা আসলে একটা অজুহাত ছিলো। কারণ, ওই অতিরিক্ত ব্যাগটা আমার পেইন্টিং, ব্রাশ আর ক্যানভাসে বোঝাই থাকতো।”
তার সতীর্থরা শুরুতে তাকে নিয়ে খোঁচাখুচি করতেন। কিন্তু একসময় তারা টের পেলেন, এটা আর মজার বিষয় নেই। এটা এখন সিরিয়াস একটা ব্যাপার। সতীর্থদের সমর্থন পেলেও একজন কোচ নাকি রাসেলকে আঁকাআঁকি ছেড়ে দিতে বলেছিলেন। রাসেল বলছিলেন,
“একজন কোচ আমাকে এটা ছেড়ে দিতে বলেছিলেন। কারণ, এটা নাকি সময়ের অপচয়। ভালো করেছি যে সে কথা আমি শুনিনি।”
সামরিক বিষয়াদি নিয়ে ছবি আঁকাতেও রাসেলের বেশ আগ্রহ।
১৯৯০ সালের ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে রাসেল ‘রাস্টি বি’ নমে একটা ছবি আঁকেন; এটা ছিলো ব্রিটিশ রয়্যাল নেভির ষষ্ঠ এইএমএস, একটা বিমানবাহী জাহাজের ছবি। গায়নাকে দল যখন বৃষ্টিতে হোটেলবন্দী হয়েছিলো, সেই সময়ে এঁকেছিলেন এই ছবিটা।
‘ককলশেল হিরোস’ নামে তার একটা ছবি কেন্টে রয়্যাল মেরিন ব্যারাকে ঠাঁই পেয়েছে। এই ছবিটাতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে জার্মান অধিকৃত ফরাসি বন্দর বোর্দোতে অভিযানে যাওয়ার আগে ক্যানুতে চড়া কমান্ডোদের দেখা যাচ্ছে। এই ছবিটা আঁকতে গিয়ে রাসেলকে যুদ্ধের অভিজ্ঞদের সাথে কথা বলতে হয়েছিলো। রাসেল বলছিলেন,
“আমি সবসময় সামরিক ইতিহাস নিয়ে আগ্রহী। এই কাজটা করতে গিয়ে আমার অনেক অভিজ্ঞ যোদ্ধার সাথে আলাপ করতে হয়েছে। এটা দারুণ উপভোগ্য ব্যাপার ছিলো। আমি বিশ্বযুদ্ধের বেঁচে থাকা বেশ কিছু সৈনিকের ছবি এঁকেছি। এর মধ্যে ইংল্যান্ডের শেষ জীবিত যোদ্ধা হ্যারি প্যাচেরও ছবি ছিলো।”
পোর্ট্রেটের কথা এলে রাসেলের আঁকার জগত বড়ই বৈচিত্র্যময়। ডিউক অব এডিনবরা প্রিন্স ফিল্পি, প্রয়াত কৌতুক অভিনেতা নরম্যান উইজডম থেকে শুরু করে ইংল্যান্ডের বিশ্বকাপজয়ী ফুটবলার ববি চার্লটন; সবার কাছেই আছে রাসেলের আঁকা তাদের পোট্রেট। রাসেল বলছিলেন,
“এরিক ক্লাপটনকে সরাসরি দেখে আঁকা প্রথম ব্যক্তি আমি। উনি বলেছিলেন, আমি করতে পারবো। অসাধারণ অভিজ্ঞতা ছিলো। উনি খুব লাজুক ছিলেন। ফলে আমাকে জানালা দিয়ে দেখে তার ছবি আঁকতে হয়েছিলো।”
আরেক দিকে আফ্রিকার বুনো জীবন রাসেলকে ঘর থেকে টেনে বের করে নতুন এক জগতের মুখোমুখি করে দিয়েছিলো,
“দক্ষিণ আফ্রিকা একটা জাদুর দেশ। আমার ওখানে মাঠে ও মাঠের বাইরে অসাধারণ সময় কেটেছে। ম্যাচগুলোর মাঠে মাঠে আমি বাইরে গিয়ে দেশটার নানা ছবি এঁকেছি; এর মধ্যে বন্যজীবনও ছিলো।”
১৯৯৬ সালে ইংল্যান্ডের জিম্বাবুয়ে সফরে রাসেল একটা নদীর পাড়ে জলহস্তীর অসাধারণ কিছু ছবি আঁকেন।
ক্রিকেটের বাইরে বিভিন্ন খেলার মাঠেও রাসেলকে এই ছবির আগ্রহে নিয়মিত দেখা যায়। ২০০৬ সালে শেফিল্ডে স্নুকার চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনাল নিয়ে তার চমৎকার একটা গল্প আছে। বিবিসি তখন রাসেলের ওপর একটা প্রামাণ্যচিত্র বানাচ্ছিলো। তারা চাচ্ছিলো রাত ৮টার মধ্যে রাসেল এখানকার চ্যাম্পিয়নকে ও পরাজিতকে নিয়ে একটা ছবি আঁকবেন। সেই আঁকার প্রক্রিয়াটা তারা ভিডিও করবে। এই সময়সীমা থাকার কারণে রাসেলকে আগে থেকে চ্যাম্পিয়ন কে হবে, সেটা অনুমান করে ছবিটা আঁকতে হয়েছিলো!
তবে এসব খেলাকে গুরুত্ব দেওয়ার পরও রাসেলের সেরা কাজগুলো যেনো ক্রিকেটের জন্যই তোলা ছিলো। তার ওয়েবসাইটে লেখা আছে,
“জ্যাকের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের অভিজ্ঞতা তাকে এমন একটা জ্ঞান দিয়েছে যে, তিনি বুঝতে পারেন কখন ক্রিকেটের সেরা দৃশ্যটা আঁকা সম্ভব হবে। এই বিশ্বে তার চেয়ে যোগ্য আর কে আছে!”
অবসর নেওয়ার সাত বছর পর মাঠে বসে অ্যাশেজের ছবি এঁকেছিলেন। সেই অভিজ্ঞতা বলছিলেন,
“২০০৫ সালে আমি অনেকগুলো ছবি মাঠে বসে সরাসরি এঁকেছি। ওল্ড ট্রাফোর্ডে সেটা ছিলো মজার একটা অভিজ্ঞতা। আমার পেছনে পাঁচশ লোক বসা ছিলো। তারা সবাই বলছিলো, কীভাবে ছবি আঁকা উচিত আমার।”
“সেই যে একটা লোক গাছের নিচে খবরের কাগজ পড়ছে, সেই ছবি থেকে আমাকে অনেকটা পথ পাড়ি দিতে হয়েছে। একটা সময় ছিলো, আমি কাউকে ছবি আঁকা দেখাতে ভয় পেতাম। আর পরে সেটা আমাকে সরাসরিও করতে হয়েছে।”
ওই সিরিজের ট্রেন্ট ব্রিজ টেস্টে রাসেল সিলেন থার্ড ম্যান বাউন্ডারির পেছনে। ওখান থেকে দেখলেন অ্যান্ড্রু স্ট্রাউস শূন্যে উড়ে অ্যাডাম গিলক্রিস্টের সেই ক্যাচ নিলেন। সাথে সাথে রাসেল সে দৃশ্য আবার তৈরি করলেন।
যখন ক্রিকেট খেলতেন, তখন দুটোকে একসাথে চালানোটা সোজা কাজ ছিলো না। রাসেল বলছিলেন, অনেকবার তিনি ছবি আঁকা ছেড়ে দিতে চেয়েছেন,
“ছবি আঁকা আমার জন্য শুরুতে খুব কষ্টের ছিলো। আমাকে নিজের ভুল থেকে শিখতে হয়েছে। আমি অনেকবার ছেড়ে দিতে চেয়েছি। কিন্তু আমার প্রতিজ্ঞা আমাকে টিকিয়ে রেখেছিলো। সম্ভবত আমি হারতে পছন্দ করি না বলে ছাড়িনি। আমাকে তখন কিপিং নিয়েও বাড়তি কাজ করতে হতো। এখানে আমাকে শারীরিক ও মানসিকভাবে অনেক বেশি কষ্ট করতে হয়েছে। তবে দুটোই আমি ভালোবাসি। আপনি যদি প্রেমেই পড়েন, কষ্ট করা ছাড়া আর উপায় কী!”
এখানে তিনি নিজের ক্যারিয়ারে ছয়টা বছর মাইক আথারটনের অধীনে খেলায় সৌভাগ্যবান মনে করেন। আথারটন এই ছবি আঁকার জন্য রাসেলকে অনেক ছাড় দিয়েছেন,
“মাইক আথারটন সফরে অসাধারণ ছিলেন। যখন তিনি দেখতেন যে আমি ক্লান্ত হয়ে পড়েছি, আমাকে বলতেন পরের ট্রেনিং সেশনে না এসে ছবি আঁকতে। এটা আমার ব্যাটারিকে রিচার্জ করে দিতো। এটা আমার ক্রিকেটেরও অনেক উপকার করেছে।”
হ্যাঁ, কখনো কখনো রাসেলের মনে হয়েছে এই নানা ধরনের কাজ করার ফলে তার ওপর বাড়তি বোঝা চেপে বসেছে। সেটা থেকে নিজেই উদ্ধারও পেয়েছে,
“শুরুতে শুরুতে এমন মনে হতো। সারাদিন গ্লুস্টারশায়ারের হয়ে ফিল্ডিং করেছি। সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে ছবির অর্ডার নিয়ে বসেছি। পরে অবশ্য আমি একজন এজেন্ট পেয়ে গেলাম। যে আমার জন্য এই গ্যালারিটা ঠিক করে দিলো। গত ২৫ বছর ধরে এখানেই আছি।”
এই বছরের পর বছর ধরে ছবি আঁকা। কী এমন আছে, যেটা রাসেলের মধ্যে ক্ষুধাটা টিকিয়ে রেখেছে? রাসেল একটু ঘোরলাগা একটা উত্তর দেন,
“নিখুঁত ছবিটা আঁকার জন্যই চেষ্টা করে যাচ্ছি। তবে আমি চাই, আমি যেন কখনো সেটা করতে না পারি। কারণ, আমি এঁকে যেতে চাই। পেইন্টিং হলো ক্রিকেটের মতো। আপনি কখনোই শেখা বন্ধ করতে পারবেন না। কখনোই এটা শিখে ফেলতে পারবেন না। চিরদিন আপনাকে উন্নতি করে যেতে হবে।”
রাসেল এখনও উন্নতি করছেন।
ফিচার ইমেজ: gazette series