ক্রিকেট-কর্তৃত্বের হাতবদল: ইংল্যান্ডের একচ্ছত্র আধিপত্যে ভারতের চ্যালেঞ্জ

ঝটিকা সফরে ইংল্যান্ডে গেছেন সিদ্ধার্থ শঙ্কর রায়। এই সময় ঘটে গেছে অবাক কাণ্ড। সেমিফাইনালে স্বাগতিকদের হারিয়ে প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপ ক্রিকেটের ফাইনালে ভারত। এমন সুযোগ প্রতিদিন কড়া নাড়ে না দুয়ারে, মা-বাবা ও গুরুজনের আশীর্বাদ ছিল নিশ্চয়ই; নইলে এমন সৌভাগ্য কী করে হলো?

সিদ্ধার্থ শঙ্কর রায় — বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ। ভারতীয় কংগ্রেস পার্টির গুরুত্বপূর্ণ সদস্য। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছেন, ভারতের শিক্ষামন্ত্রীর দায়িত্বও সামলেছেন শক্ত হাতে, সরকারের পক্ষ থেকে নতুন অ্যাসাইনমেন্ট প্রাপ্ত হয়েছেন ইংল্যান্ডে। সুযোগ লুফে নিতে জানেন তিনি, বিসিসিআই মহাসচিব এনকেভি সালভে তার রাজনৈতিক সহকর্মী। তিনি ডাকলেন তাকে,

‘সালভে, এই ম্যাচ তো দেখতেই হয়। জীবনে এক-আধবারই আসে এমন সুযোগ। দুটো টিকেটের ব্যবস্থা করো। দেশের ফাইনাল দেখব মাঠে বসেই।’

অগ্রজের অনুরোধ রাখতেই হয়। আর এমন আহামরি কিছু তো চাননি, স্রেফ দুটো টিকেট; সুযোগ পেলে স্বদেশের বিশ্বকাপ ফাইনাল কে না দেখতে চাইবে? সালভের ফোন যায় ইংলিশ ক্রিকেটের দায়িত্বশীলদের কাছে। কিন্তু সৌজন্যতাবোধের চূড়ান্ত সর্বনাশ করে তারা প্রত্যাখ্যান করে ভারতীয় ক্রিকেট প্রধানের অনুরোধ। সালভে তার রাজনৈতিক বন্ধুর জন্য দুটো টিকেট চেয়েও পান না! তাকে বলা হয়,

“আপনাকে ইতঃমধ্যেই দুটো টিকেট দেওয়া হয়েছে। আপনি চাইলে সেগুলো ব্যবহার করতে পারেন। তবে আর কোনো টিকেট দিতে পারছি না বলে দুঃখিত।”

ধরণী দ্বিধা হয় না কেন? এই লজ্জা রাখবেন কোথায় সালভে? দাঁতে দাঁত চেপে অপমান হজম করেন বিসিসিআই চীফ।

এনকেপি সালভে, তৎকালীন বিসিসিআই চীফ; Image Credit: Indiacontent.in

বিলেতি গ্রীষ্মের মনোরম প্রকৃতি উপভোগ করার মতো। যদিও যে সময়টাকে বিলেতি মানুষজন ‘গরম’ বলে আরাম করে, আহ্লাদী হয়, সে সময়টাই ভারতীয় উপমহাদেশের মানুষের জন্য শীত শীত ব্যাপার। ছ্যাহ, একে সামার বলে? আমাদের উঠোনে এসো, ৩০-৩৫ ডিগ্রি উত্তাপকে কী বলো, দেখবো তাহলে।

তবে প্রকৃতির নিজেকে খোলামেলা উপস্থাপনা চোখ ধাঁধায় যে কারো, নীরস ও পাথুরে প্রাণেও আনে আনন্দোচ্ছ্বাস। ঝকঝকে তকতকে চকমকে চারপাশ, পথ-ঘাট-মাঠ-প্রান্তরে সুশাসন ও নীতির ব্যবহার, সভ্যতা সংস্কৃতিতে বনেদিয়ানা, আচার সংস্কারে সুসভ্য মনোভাব — ইংল্যান্ড দেশটাকে ভালো লাগার অনেক কারণ আছে। উপমহাদেশের রাজনীতিবিদদের অনেকের কাছেই সভ্যতার চূড়ান্ত মানদণ্ড বিলেতি প্রভুরাই। স্বদেশের নানান অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা ও অপরিচ্ছন্ন সমাজব্যবস্থা থেকে গিয়ে কেউ যখন ইংল্যান্ডের সুনিপুণ সমাজ কাঠামো দেখতে পান, তখন দীর্ঘশ্বাস বেরোয় বুক চিরে। আহা, কবে আমাদের দেশটা এমন স্বয়ংসম্পূর্ণ হবে, নিয়মনিষ্ঠ হবে! রাজনীতিবিদরা যেহেতু দেশের নেতৃত্ব দেন, দেশ পরিচালিত করেন, তাই তাদেরই দুঃখবোধটা বেশি থাকে হয়তো। 

সিদ্ধার্থ শঙ্কর রায় — পরে পাঞ্জাবের রাজ্যপালও হয়েছেন। সুদীর্ঘ রাজনৈতিক ক্যারিয়ারে সাফল্য ও প্রাপ্তির বরমাল্যে অভিনন্দিত হয়েছেন বহুবার। আমাদের এই রচনায় তিনি কেবলই সূচনা চরিত্র পেয়েছেন, অন্যতম মূখ্য চরিত্র পালন করছেন এনকেভি সালভে। সেই সালভে, যিনি টিকেট চেয়েও না পেয়ে প্রচণ্ড অপমানিত বোধ করেছেন। মনে মনে পণ করে বসেছেন, ক্রিকেট বিশ্বকাপকে তিনি ইংলিশদের উঠোন-ছাড়া করে ছাড়বেন। এই অপমান এবং ইংলিশ ক্রিকেটের অহঙ্কার ও দম্ভের চড়া মূল্য তিনি নেবেনই।

একদিকে সালভে টিকেট চেয়ে পাননি, অথচ অন্যদিকে লর্ডসের ফাইনালে দেখা গেল ভিআইপি গ্যালারির অর্ধেকই ফাঁকা। মুখোমুখি ফাইনালে ওয়েস্ট ইন্ডিজ ও ভারত। শ্বেতাঙ্গ দেশে দু’টি কৃষ্ণাঙ্গ শক্তির এমনই লড়াই, সে যতই বিশ্বশ্রেষ্ঠত্বের আয়োজন হোক, যেন নাক-উঁচু সাদা মানবদের মনোযোগ পাওয়ার অধিকার রাখে না।

ওয়েস্ট ইন্ডিজ নির্দিষ্ট কোনো দেশ নয়, বরং ক্যারিবিয়ানের ছোট ছোট দ্বীপপুঞ্জের ঐক্যবদ্ধ ক্রিকেট শক্তি। সেই দ্বীপপুঞ্জের কোনো কোনোটায় ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ খুঁটি গেড়েছিল বহু বছর, ভারতীয় উপমহাদেশে তো একশ’ নব্বই বছরের দীর্ঘ শাসনের ইতিহাস আছে ইংল্যান্ডের। দুটি উপনিবেশীয় শক্তি ক্রিকেটের চূড়ান্ত লড়াইয়ে উত্তীর্ণ হয়েছে তাদেরকেই হারিয়ে, ইংলিশ ক্রিকেট ও জাতির জন্য পিত্তি জ্বলে যাওয়ার মতো ব্যাপারই বটে! সেটারই প্রতিফলন দেখা যায় ব্রিটিশ পত্রিকাগুলোয়, ভারত-ইংল্যান্ড সেমিফাইনালের পর শিরোনাম হয় — ইংল্যান্ডকে লজ্জা উপহার দিয়ে ফাইনালে ভারত।

ভারতের বিশ্বকাপ জয়; Image Source: Getty Images

ভারত ধীরে ধীরে গুছিয়ে উঠছে তখনো। অর্থনৈতিক সক্ষমতা নেই, সেটা বলাই বাহুল্য; রাজনৈতিক ক্ষমতাও বলার মতো নয়। হরেক জাতি-গোত্র ও নানান স্বাধীনতাকামী জনপদের চ্যালেঞ্জ সামলানো বড্ড মুশকিল। বিসিসিআইয়ের নিজেরও সেরকম কোনো আর্থিক সঙ্গতি নেই। বিশ্বক্রিকেটে দলটা পায়ের ভিত শক্ত করতে মরিয়া, ক্রিকেট শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশও করেনি সেভাবে। ১৯৮৩ বিশ্বকাপেই প্রথমবারের মতো গ্রুপপর্ব পার হয় ভারত, বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হলেও সেটা স্রেফ ‘ফ্লুক’ অনেকের চোখে। বিশ্বক্রিকেটের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ তখনও ইংল্যান্ডের হাতে। এমসিসি — মেরিলিবোন ক্রিকেট ক্লাব, যা তখন পর্যন্ত ক্রিকেটের সর্বোচ্চ সংস্থা। ইংলিশ ক্রিকেট ও এমসিসি প্রধান একজনই। আইন-কানুন-নিয়ম সমস্তই এমসিসি গড়ে-ভাঙে। আরেক প্রাচীন ক্রিকেট শক্তি অস্ট্রেলিয়াও ইংল্যান্ডের হ্যাঁ-তে হ্যাঁ ও না-তে না বলে। পুরো ক্রিকেট ব্যবস্থা যেন একপেশে। বাকি সদস্য কেউ কোনো প্রস্তাব রাখবে এবং ভোটাভুটিতেই তা সমাধান হবে, ব্যাপার সেরকম নয়। ইংল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়ার আছে ভেটো পাওয়ার। পছন্দ না হলে সরাসরি প্রত্যাখ্যাত হতে হবে। তাই সালভে যখন ভাবলেন ক্রিকেট বিশ্বকাপ ইংল্যান্ডের বাইরে নিয়ে আসবেন, তা শুনতে যতই এক্সাইটিং হোক, আদতে অসম্ভব প্রায়।

কিন্তু সালভেও হাল ছাড়ার পাত্র নন। বিশ্বকাপ বিজয়ের আনন্দ অনুষ্ঠানে উদযাপনের পাশাপাশি পাকিস্তান ক্রিকেট বোর্ডের প্রধান, এয়ার চীফ মার্শাল নুর খানের সঙ্গে কিঞ্চিৎ জরুরী আলাপ সেরে রাখেন, 

‘আচ্ছা, বিশ্বকাপ যদি আমরা ভারতে আয়োজন করি কেমন হয় তাহলে?’

‘বাহ, খুব ভালো। তা দেশবাসীর সামনে, স্বদেশের মাঠে ক্রিকেট বিশ্বকাপ তো আমাদেরও  খেলতে ইচ্ছে হয়?’

‘হ্যাঁ, অবশ্যই। কেন নয়? তাহলে পাকিস্তান-ভারত যৌথ আয়োজক তো হতেই পারে।’

সালভে কথা বলেন শ্রীলঙ্কা ক্রিকেট বোর্ডের সেক্রেটারির সঙ্গেও। অস্ট্রেলিয়া ও ইংল্যান্ডের যে সুপ্রিম পাওয়ার, তার মোকাবেলায় পাকিস্তান-ভারত-শ্রীলঙ্কা নিয়ে এশিয়ান ব্লক তৈরি করে ফেলেন বিসিসিআই প্রধান। 

এনকেপি সালভে ও বিশ্বকাপ জয়ী দলের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী; Image Source: Getty Images

বিশ্বজয়ী ভারতীয় ক্রিকেট দল স্বদেশে পায় উষ্ণ অভ্যর্থনা। বিজয় মিছিল, রোড শো, পুষ্পমাল্য… নানান রকম আয়োজনে বরণ করে নেয়া হয় বিশ্বজয়ী বীরদের। প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর আন্তরিক অভিনন্দনেও সিক্ত হয় গোটা দল। বাবা জওহরলাল নেহেরু হাতে-কলমে রাজনীতি শিখিয়েছেন, মেয়েও যেন যোগ্য পিতার যোগ্য কন্যা। অনমনীয় দৃঢ়তা ও জাদুকরী ব্যক্তিত্বের অধিকারী তিনি। অভিনন্দন অনুষ্ঠানের এক ফাঁকে বিসিসিআই বস এনকেপি সালভে যা যা ঘটেছে, সব তুললেন প্রধানমন্ত্রীর কানে। সব বলতে সব; সেই দুটো টিকেট থেকে শুরু করে এশিয়ান ব্লকের প্রস্তুতি, সবটুকু। সাথে রাজকোষে শূন্য ভাণ্ডারের অনুযোগ শোনাতেও বাদ দিলেন না। মিসেস গান্ধী সব শুনে কেবল একটি প্রশ্ন রাখলেন,

“কী করতে চাও এবার?”

সালভে তার পরিকল্পনা ব্যাখ্যা করেন। প্রধানমন্ত্রী এবার শরণাপন্ন হন এক ভারতীয় ধনকুবেরের। তিনি রিলায়েন্স গ্রুপের স্বত্বাধিকারী — ধীরুভাই আম্বানি। তাকেও একটিমাত্র প্রশ্ন করেন ইন্দিরা গান্ধী, 

‘বিশ্বকাপ ক্রিকেট যদি ভারতে হয়, খরচ বহন করতে পারবে?’

ধীরুভাই আম্বানি বিচক্ষণ ব্যক্তি। তৎক্ষণাৎ বুঝে ফেললেন, এক বিশাল সুযোগের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন তিনি। বিন্দুমাত্র দেরি না করে উত্তর দিলেন,

‘বিশ্বকাপ যদি ভারতে আনতেই পারেন, তাহলে আপনাকে ব্ল্যাঙ্কচেক দিতে রাজি আছি আমি।’

ধীরুভাই আম্বানির অর্থনৈতিক নিশ্চয়তা পেয়ে প্রধানমন্ত্রী সালভেকে দেন সবুজ সংকেত — তুমি তোমার কাজ চালিয়ে যাও। পরিকল্পনার সফল বাস্তবায়নে যা যা করা লাগে, করো।

নিশ্চিত আশ্বাসে বলীয়ান হয়ে পূর্ণ উদ্যমে কাজে লেগে পড়েন সালভে। ১৯৮৪ সনে লাহোরে পাকিস্তান-ভারত-শ্রীলঙ্কার প্রতিনিধিদের নিয়ে মিটিংয়ে বসেন বিসিসিআইয়ের প্রতিনিধি জগমোহন ডালমিয়া, যিনি বেঙ্গল ক্রিকেটের প্রতিনিধি হিসেবে বছর কয়েক আগে যুক্ত হয়েছেন বোর্ডে। তার সভাপতিত্বে শুরু হলো উপমহাদেশের বুকে বিশ্বকাপ আয়োজনের আনুষ্ঠানিক উদ্যোগ। 

নিজেদের মধ্যে সকল আলোচনা, সম্ভাবনা শেষে বিশ্বক্রিকেটের মিটিংয়ে ভারতের তরফ থেকে প্রস্তাব রাখা হলো — পরের বিশ্বকাপের যৌথ আয়োজক হতে চায় পাকিস্তান ও ভারত। প্রস্তাবের ভালো-মন্দ বিবেচনার পূর্বেই রাগে-ক্ষোভে কেঁপে উঠে ইংলিশ ক্রিকেট। এ কেমন স্পর্ধা, কী ধরণের দুঃসাহস? বিশ্বকাপ আয়োজন কি ছেলের হাতের মোয়া নাকি যে কেউ এলো আর আয়োজনের ভার পেয়ে গেল!

মুহূর্তেই নাকচ হয়ে গেল প্রস্তাব। দুই কথা বলার সুযোগই নেই কারো। বিসিসিআই বুঝে গেল, এভাবে হবে না। সেটা অবশ্য এমনিই জানতেন ভারতীয় অফিসিয়ালরা; রাজি হবে না আইসিসি, ঘি তুলতে আঙ্গুল বাঁকাতেই হবে। তবে ভারতের স্ট্র্যাটেজিটাই ছিল এটা – একবার এই সম্ভাবনার বীজটা বপন করা। এরপর ছলে-বলে-কলে-কৌশলে ইংল্যান্ডের বন্ধুকে বাগে এনে ইংলিশ ক্রিকেটকে কোণঠাসা করতে হবে। অস্ট্রেলিয়ার কাছে গেল বিকল্প প্রস্তাব — রোটেশন পলিসি। বিশ্বকাপ শুধু একটি দেশেই কেন হবে, আমরা বরং এই দেশ-সেই দেশ রোটেট করে বিশ্বকাপ আয়োজন করি। এবারেরটা উপমহাদেশে হলে পরেরটা হবে অস্ট্রেলিয়ায়। এই টোপ ফেলার মতো নয়, অনায়াসে গিলে নিল ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়া — অতি উত্তম প্রস্তাব। তোমাদের প্রতি শতভাগ সমর্থন আছে, কিন্তু সেটা নিয়ে ‘ওপেন ব্যালট’-এ ভোট দেওয়া সম্ভব নয় আমাদের পক্ষে। বার্তাটা পরিষ্কার, সামনাসামনি ভোটাভুটিতে অস্ট্রেলিয়া পারবে না ইংল্যান্ডের বিপক্ষে দাঁড়াতে। ভারতীয় ক্রিকেট মেনে নিল অস্ট্রেলিয়ার সীমাবদ্ধতা, অস্ট্রেলিয়া তো অনুকূলে এসে গেছে। ‘ওপেন ব্যালট’ না হোক, ‘ক্লোজড ব্যালট’ই সই! বাকি কেবল ঐ নাক-উঁচু ইংলিশ ক্রিকেট। 

ধীরুভাই আম্বানির হাতে ব্ল্যাঙ্কচেক; Image Source: Getty Images

টেস্ট-খেলুড়ে আটটি দেশের দু’টি করে মোট ১৬ ভোট, আর ২১টি সহকারী দেশের একটি করে একুশ ভোট — মোট ৩৭ ভোট। তখন আইসিসির মোট বাজেটের ৬০ শতাংশই পেত আটটি টেস্ট-খেলুড়ে দল, আর বাকি সব সহকারী দলগুলো সাকুল্যে পেত ৪০ শতাংশ। সালভে বুঝলেন, এই সুযোগ। ব্ল্যাঙ্ক চেকও আছে পকেটে। ‘যা থাকে কপালে’ ভেবে ইংল্যান্ডের তুলনায় সহকারী দেশের অংশগ্রহণ সম্মানী চারগুণ এবং টেস্ট খেলুড়ে দেশের পাঁচগুণ বৃদ্ধির ঘোষণা দিল ভারত। ফলে অর্থলোভের টোপ গেলার সম্ভাবনা রইল অনেকের। ভোটাভুটি শেষে দেখা গেল, ১৬-১২ ভোটে পাক-ভারত যৌথ বিশ্বকাপ আয়োজন জিতে গেছে। কিন্তু সেই ফলাফল ঘোষণায় প্রবল আপত্তি জানাল ইংল্যান্ড। তারা হাস্যকর কুযুক্তির আশ্রয় নিল,

‘পাকিস্তান ক্রিকেট বোর্ডের কোনো প্রতিনিধি তো আমাদের চোখে পড়েনি। তাদের ভোট এলো কী করে?’

নেহায়েতই মামুলি একটা কথা মনে হচ্ছে কি? তাহলে ইংলিশ ক্রিকেটের ইঙ্গিতটা নিয়ে পরিষ্কার করতেই হয়। পাকিস্তান ক্রিকেট প্রতিনিধি ছিলেন চীফ জাস্টিস নাসিম হাসান শাহ, যিনি নেহায়েতই খর্বকায় – বেঁটে খাটো মানুষ। চেয়ারে বসলে টেবিলের উপরিভাগে তার মাথা সেভাবে উঠে আসে না। এমসিসি বলতে চাইল, তারা জাস্টিস শাহকে নাকি দেখেইনি।

চীফ জাস্টিস নাসিম হাসান শাহ; Image source: Facebook 

 

এ কেমন ছেলেমানুষি ছলচাতুরী! নাসিম শাহ তাজ্জব বনে গেলেন। প্রচণ্ড অপমান নীরবে চেপে রাখলেন ছোট্ট বুকে। 

ভোটাভুটি আবার শুরু হলো। ইংল্যান্ড কিছু বলার আগেই জাস্টিস নাসিম শাহ চেয়ারে দাঁড়িয়ে গেলেন, দু’হাত উর্ধ্বে তুলে জানান দিলেন উপস্থিতি। এবারে দেখতে পাচ্ছো তো আমাকে? হলো এবারে ভোট? 

সে হলো বটে। এবারেও পাক-ভারতের পক্ষেই গেল ফলাফল। তারপরও টালবাহানার শেষ নেই; এটা হলে সেটা, সেটা হলে ওটা… চলতেই থাকে। ভারতীয় ক্রিকেটও নাছোড়বান্দা। পাকিস্তান ক্রিকেটও ছাড় দেবে না একরত্তি। পাক-ভারত লেগে রইল জোঁকের মতো। যাবতীয় প্রশ্নের সদুত্তর দিয়ে তারা দাবি আদায়ে অনড়।

শত আপত্তি সত্ত্বেও যখন ইংলিশ ক্রিকেট বুঝল যে বিশ্বকাপ আর ইংল্যান্ডে রাখা সম্ভব নয়, তখন সর্বশেষ প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে রাখল কয়েকটি মোক্ষম জিজ্ঞাসা —

‘তোমাদের দেশে সূর্যাস্ত অনেক তাড়াতাড়ি হয়, তাহলে ষাট ওভারের ক্রিকেট পরিচালনা কীভাবে করবে?’

উত্তর দেয়া হলো,

‘আমরা বরং পঞ্চাশ ওভারে নামিয়ে আনব ম্যাচ। সমস্যা তো নেই।’

আবার প্রশ্ন,

‘বিশাল বড় দেশ ভারত। এ মাথা থেকে সে মাথা যেতে বহু পথ পাড়ি দিতে হয়। ক্রিকেটারদের ট্যুর শিডিউল ম্যানেজ করা কীভাবে সম্ভব?’

আশ্বস্ত করা হলো,

‘আমাদের যাবতীয় ট্যুর শিডিউল বিশ্বকাপ কেন্দ্রিক হবে। সব রুট, ফ্লাইট বিশ্বকাপ ফিক্সচার বিবেচনায় নিয়ে রি-শিডিউল করা হবে।’

প্রশ্নের শেষ নেই,

‘ব্রডকাস্টিং ও টেলিকাস্ট ব্যবস্থা তো অত্যাধুনিক নয়!’

উত্তরে ক্লান্তি নেই,

‘সবকিছু সময়ের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে ঢেলে সাজানো হবে, করা হবে আধুনিকায়ন।’

তবু সংশয়, নানা শঙ্কা —

‘বিশ্বকাপ আয়োজনে তো ম্যালা খরচ। সামলাতে পারবে?’

উড়িয়ে দেয়া হয় শঙ্কা। আশ্বস্ত করা হয়।

‘তা নিয়ে ভাবা লাগবে না তোমাদের। পুরো টুর্নামেন্টের জন্য ত্রিশ কোটি টাকার বাজেট আছে আমাদের।’

এরই মধ্যে দারুণ এক চাল দিল এমসিসি। তারা জানালো, দক্ষিণ আফ্রিকায় যে বর্ণবাদী কার্যক্রম চলছে, সেসব চলতে থাকলে অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ড, এবং নিউ জিল্যান্ডের পক্ষে এই বিশ্বকাপে খেলা সম্ভব নয়। তাই দক্ষিণ আফ্রিকাকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করতে হবে। ওদিকে, দক্ষিণ আফ্রিকাকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হলে ওয়েস্ট ইন্ডিজ তো নিজেদের সরিয়ে নেবেই, উপরন্তু দক্ষিণ আফ্রিকায় প্রবাসী ভারতীয়দেরকেও রীতিমতো ভাসিয়ে দেওয়ার মতো ব্যাপার হয়ে যাবে। রাজনৈতিকভাবে রীতিমতো বাজিমাৎ করে দেওয়ার মতোই চাল, বলাই বাহুল্য। তবে উপায়? 

সালভে আরেকবার জানান দিলেন নিজের রাজনৈতিক প্রজ্ঞার। দাবার চালে বাজিমাৎ করলেন একটা সহজ সমাধানে — দক্ষিণ আফ্রিকা নিষিদ্ধ হবে ঠিকই, তবে বিশ্বকাপের ঠিক এক বছর পর।  

কিছুতেই কুলিয়ে উঠতে না পেরে সবশেষে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার ধোঁয়া তুলল ইংল্যান্ড। পাক-ভারত যুদ্ধ যুদ্ধ মনোভাব, একে অপরকে সহ্যই করতে পারে না; ওরা কী করে বিশ্বকাপের মতো মহাআয়োজন যৌথভাবে সামাল দেবে? পাকিস্তান-ভারতের মধ্যকার চাপান-উতোর উত্তেজনার কারণে বিশ্বকাপ বয়কট করতে হতে পারে, জানিয়ে দিল তারা।

পাকিস্তানের তখনকার প্রেসিডেন্ট জেনারেল জিয়াউল হক ভারতে পা রেখে সমস্ত উত্তেজনায় পানি ঢেলে দেন; Image Source: Getty Images

তখন বিশ্বকাপের বাকি মোটে আটমাস। সালভের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ও আইপিজেএমসি সেক্রেটারি মিস্টার বিন্দ্রা সাক্ষাৎ করলেন পাকিস্তান প্রেসিডেন্ট জেনারেল জিয়াউল হকের সঙ্গে,

‘আপনি ভারতে আসছে না কেন? বিশ্বকাপটাই ভেস্তে যেতে বসেছে!’

‘ভারতের প্রধানমন্ত্রী তো আমাকে আমন্ত্রণ জানায়নি। কীভাবে যাই?’

‘আরে, ওসব আমন্ত্রণ-ফামন্ত্রণ বাদ দিন। চলে আসুন। উত্তেজনা প্রশমন করুন।’

এবং সবাইকে অবাক করে দিয়ে জেনারেল জিয়াউল হক বিন্দ্রার কথা রাখলেন। ভারত সফরে গিয়ে সমস্ত উত্তেজনায় টানলেন যতিচিহ্ন। শেষমেষ অনেক গাইগুই করে বাধ্য হয়ে ইংলিশ ক্রিকেট মেনে নিল বিশ্বকাপ ক্রিকেটের উপমহাদেশীয় আয়োজন।

উপমহাদেশ পেল বিশ্বকাপ আয়োজনের গৌরবজ্জ্বল সম্মান।

এখানেই শেষ নয়। দুর্গম ও দুরতিক্রম্য বন্ধুর পথ পরিক্রমার একটি অংশ মাত্র। ঝঞ্ঝা বিক্ষুব্ধ সময় সামলে, নিয়তি, দুর্ভাগ্য ও কঠিন অর্থাভাব পেরিয়ে শেষপর্যন্ত উপমহাদেশে কীভাবে গড়াল বিশ্বকাপ তা রইল পরের অংশে, যা পড়তে পারেন এই লিঙ্ক থেকে:

ক্রিকেট-কর্তৃত্বের হাতবদল: বিশ্বক্রিকেটের নিয়ন্ত্রণ নেয়ার পথে ভারতের প্রথম পদক্ষেপ

This article in Bengali language, on about how cricket power transfer from England to India. And how India and Pakistan jointly organized world cup 1983 after facing numerous problems. 

Featured Image: PA Photos

Related Articles

Exit mobile version