চলতি বছরের শুরুর দিকের কথা। ঢাকায় তখন শ্রীলঙ্কা ও জিম্বাবুয়েকে নিয়ে বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলের ত্রিদেশীয় ওয়ানডে সিরিজের ব্যস্ততা। সেই সিরিজে নির্বাচকরা যা-ই করুন, দুজন ক্রিকেটারকে নিয়ে ভজকট করে ফেলেছিলেন মাশরাফি বিন মুর্তজা। দলে এনামুল হক বিজয় খেলছিলেন, নতুন করে ডাক পেয়েছিলেন মোহাম্মদ মিঠুন।
চার বছর পর জাতীয় দলে ডাক পাওয়া মিঠুনকে নিয়ে সেবার অনেক আলোচনা হয়েছিল। অনেকেই ভাবছিলেন বাংলাদেশের ক্রিকেটে গতানুগতিক নেতিবাচক তথা বাদ পড়াদের না ফেরানোর ‘ট্যাবু’ বোধহয় শেষ হলো। জাতীয় দলের বাইরে থাকা অনেক জ্যেষ্ঠরা তাই ফেরার আশায় বুক বেঁধেছিলেন। আর মিঠুন? হয়তো ত্রিদেশীয় ফাইনালের আগ পর্যন্ত নিজেকে ধাতস্থ করতেই সময় পার করেছিলেন।
ত্রিদেশীয় সিরিজের সবটুকু সময়ে বিজয়কে মাঠে নামিয়েছিলেন মাশরাফি, কেবল ফাইনাল ছাড়া। তাতে করে বিজয় খেলেছিলেন চারটি ম্যাচ। ইনিংসগুলো ছিল ১৯, ৩৫, ০ ও ১; অর্থাৎ বিশেষ সুবিধার নয়। কিন্তু ত্রিদেশীয় সিরিজের ফাইনালে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে হুট করে একার সিদ্ধান্তে বিজয়কে বসিয়ে দিলেন মাশরাফি। মাঠে নামিয়ে দিলেন মোহাম্মদ মিঠুনকে।
সেই শ্রীলঙ্কা, যাদের বিপক্ষে কোচ ছাড়া খেলতে নেমেছিল বাংলাদেশ। সেই শ্রীলঙ্কা, যাদের কোচ চন্দিকা হাতুরুসিংহে মাসখানেক আগেই নাটকীয়ভাবে বাংলাদেশের দায়িত্ব ছেড়েছিলেন।
এমন হাই ভোল্টেজ ম্যাচে মিঠুন ১০ রানে স্কোরবোর্ড চুকিয়ে ফিরেছিলেন। তারপরই রা রা পড়ে গিয়েছিল। পুরো ব্যাপারটিকে পরবর্তীতে মাশরাফি নিজের দায় হিসেবে মাথা পেতে নেন। ফাইনালে বাংলাদেশ হেরেছিল। কিন্তু বিজয়-মিঠুনের ব্যাপারটি মাথা থেকে সরেনি অধিনায়কের। পরবর্তীতে এক সাক্ষাতকারে তিনি জানিয়েছিলেন, বিজয়কে পুরো সিরিজ খেলানোর পর ফাইনালে হুট করে বসিয়ে দিয়ে তিনি ভুল করেছেন। পাশাপাশি, চার বছর পর যে ছেলেটি জাতীয় দলে সুযোগ পেল তাকে পুরো সিরিজে বসিয়ে রেখে ফাইনালে নামিয়েও তার সাথে তিনি প্রবঞ্চনা করেছেন।
প্রবঞ্চনা এই অর্থে যে, বাংলাদেশের ক্রিকেটীয় পরিবেশে হুট করে দলে ডাক পাওয়া কোনো ক্রিকেটার হুট করে মাঠে নেমে হুট করে জ্বলে উঠতে না পারলে তাকে ‘হুট’ করেই সরিয়ে দেওয়া হয়। হয়তো মাশরাফির ভয় ছিল, মিঠুনের সঙ্গেও একই কাজ না হয়। তাই প্রায়শ্চিত্ত করতে নেমেছেন তিনি।
১.
এশিয়া কাপের আগে উইন্ডিজ সফর করে বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দল। সেখানে দুই টেস্টের পাশাপাশি খেলে তিনটি ওয়ানডে ও তিনটি টি-টোয়েন্টির পূর্ণাঙ্গ সিরিজ।
মাশরাফির প্রায়শ্চিত্ত শুরু এই সফরের ওয়ানডে থেকে। টেস্টে ও টি-টোয়েন্টিতে জায়গা না পাওয়া বিজয়কে দিয়ে ক্যারিবিয়ানদের বিপক্ষে তিনটি ওয়ানডেতেই মাঠে নামালেন তিনি। কিন্তু বিজয় সুযোগটা কাজে লাগাতে পারেননি। টেস্টের দুটি ম্যাচেই লজ্জার হারের স্বাদ পাওয়া বাংলাদেশ ওয়ানডেতে সিরিজ জিতেছিল বুড়োদের কাঁধে চড়ে। কিন্তু না চাইতেই পাওয়া সুযোগে বিজয় খেলেছিলেন ০, ২৩ ও ১০ রানের তিনটি ইনিংস।
সেই সিরিজের মাঝখানেও মাশরাফি বিজয়কে নিয়ে কথা বলেছিলেন। তিনি জানিয়েছিলেন, বিজয়ের সঙ্গে যে ভুলটা তিনি ঘরের মাঠে ত্রিদেশীয় সিরিজে করেছেন; তার অভিযোজন প্রক্রিয়া তিনি উইন্ডিজ সফরে সুযোগ দিয়ে শেষ করছেন। কিন্তু বিজয় যদি সেই সুযোগ কাজে লাগাতে না পারে তাহলে আর তার কিছুই করার থাকবে না।
শেষ পর্যন্ত হয়েছেও তাই। উইন্ডিজ সফর থেকে দেশে ফিরে এশিয়া কাপের জন্য আর দলেই ডাক পাননি বিজয়। সেখানে ফিরেছেন মিঠুন। ফিরিয়েছেন মাশরাফি। আর মাশরাফিকে এ ব্যাপারে নির্বাচকদের কাছে সাফাই গেয়েছেন কোচ স্টিভ রোডস।
ফলাফলটা তো হাতেনাতেই পেয়েছে বাংলাদেশ। এবার হয়তো মাশরাফি নিজের গোয়ার্তুমির জন্য নিজেকেই বাহবা দেবেন। কারণ এশিয়া কাপের যে তিন ম্যাচ জিতে ফাইনালে জায়গা করেছে বাংলাদেশ, তার দুটিতেই বড় রানের ইনিংস খেলেছেন মোহাম্মদ মিঠুন। শুধু তা-ই নয়, মুশফিকুর রহিমের ১৪৪ রানের ইনিংস খেলার দিন তার সঙ্গে ১৩১ রানের জুটি গড়েন মিঠুন।
পাঁচ ম্যাচের প্রথমটিতেই ৬৩ রানের ইনিংস খেলেন মিঠুন। সেই ম্যাচে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ম্যাচ জিতে নেয় বাংলাদেশ। পরের তিনটি ইনিংসে মিঠুনের ব্যাটে এসেছে ২, ৯ ও ১ রান। শেষবার পাকিস্তানের বিপক্ষে ৬০ রানের অসাধারণ এক ইনিংস খেলেন, যা দলকে ঘুরে দাঁড়াতে সাহায্য করে। শেষপর্যন্ত সেই ম্যাচেও জয় আসে।
সব মিলিয়ে মিঠুন নিজের সামনের দিনগুলোতে জয়ের সূর্যোদয় দেখলে তা খুব দোষের হবে না। অন্যদিকে, যে গোয়ার্তুমিতে মাশরাফির কারণে মিঠুনের দলে ডাক পাওয়া, সাফল্য আসা; তাতে মাশরাফি নিজেও হয়তো আত্মিক প্রশান্তিতে ভুগবেন কিংবা ভুগছেন।
২.
একে তো পারফরম্যান্স খারাপ, সঙ্গে আবার শৃঙ্খলাজনিত ঝামেলা। দুইয়ে মিলিয়ে উইন্ডিজ সফরেই তোপের মুখে সাব্বির রহমান। বাংলাদেশের ‘একমাত্র’ এই টি-টোয়েন্টি স্পেশালিষ্ট উইন্ডিজ সফরে থাকতেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সমর্থকদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করে সমালোচিত হন।
জাতীয় দলের সফর শেষে শাস্তি পান সাব্বির। বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) পক্ষ থেকে তাকে ছয় মাসের জন্য আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে নিষিদ্ধ করা হয়। এই ঘটনা ঠিক এশিয়া কাপের দল ঘোষণার আগমুহূর্তে।
তাতেই ভাগ্য খুলে গেল মিঠুনের। শুনতে খারাপ লাগলেও সত্যি, সাব্বিরের নিষেধাজ্ঞা এশিয়া কাপে মিঠুনের জায়গা করে দিতে দারুণ সাহায্য করেছে। বিশেষ করে গেল বছর বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগে (বিপিএল) ডাকা ডায়নামাইটসের হয়ে দারুণ সাফল্যের পর থেকেই জাতীয় দলের সঙ্গে কোনো না কোনোভাবে ছিলেন মিঠুন। তারই ধারাবাহিকতায় ত্রিদেশীয় সিরিজে জায়গা পাওয়া।
কিন্তু শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ফাইনালের সেই ব্যর্থতাই হয়তো ভাবাচ্ছিল নির্বাচকদের। এমন সময়েই ত্রাতা হয়ে এলেন মাশরাফি। কোচ স্টিভ রোডসকে সঙ্গে নিয়ে এগিয়ে এলেন মিঠুনের জন্য।
কোচ ও অধিনায়ক দুজনেই জানতেন তারা কী চাইছেন। তারা চাইছিলেন এমন কেউ যে কি না ৬ নম্বরে ব্যাট করতে নেমে বড় ইনিংস খেলতে পারবে, পাশাপাশি স্পিন বল দারুণভাবে সামলাতে পারবে। মিঠুন, যিনি কি না মূলত একজন ওপেনার, তাকে দিয়ে এই কাজটা সম্ভব বলেই মানছিলেন রোডস-মাশরাফি।
সেই সময়ে আবার ‘এ’ দলের হয়ে মাত্রই আয়ারল্যান্ড ‘এ’ দলের বিপক্ষে দুটি হাফ সেঞ্চুরি খেলে ফিরেছেন মিঠুন। সব মিলিয়েই ব্যাটে-বলে মিলে গিয়েছিলেন মিঠুন।
সে কারণেই অধিনায়ক-কোচ মিলে নির্বাচকদের উপর চাপ প্রয়োগ করতে সমস্যা হয়নি। প্রধান নির্বাচক মিনহাজুল আবেদীন নান্নুর ভাষায়, ‘কোচ ও অধিনায়ক মিলে আমাদের কাছে মিঠুনকে দলে চেয়েছিলেন। তাকে সাব্বিরের জায়গায় ৬ কিংবা ৭ নম্বর ব্যাটিং পজিশনের জন্য নেওয়া হচ্ছে।’
৩.
মাশরাফি ও স্টিভ রোডস এমন কাউকে চেয়েছিলেন যে কি না মিডল অর্ডারে নেমে বড় ইনিংস খেলতেও পারবে, সঙ্গে স্পিন বলটা দারুণ সামলাতে পারবে।
মিঠুন সেক্ষেত্রে সেরা পছন্দ হতে পারতেন। হয়েছেনও তা-ই। এশিয়া কাপের সবগুলো ম্যাচেই সুযোগ পেয়েছেন মিঠুন। যার মধ্যে দুটি ম্যাচে হাফ সেঞ্চুরি। সৌভাগ্যবশত, সেই দুই ম্যাচেই জিতেছে বাংলাদেশ দল। কিন্তু দুর্ভাগ্য একটাই, ফাইনালে জ্বলে উঠতে পারেননি তিনি।
টুর্নামেন্টের প্রথম ম্যাচে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে মিঠুন কেবল ৬৩ রানের ইনিংসই খেলেননি, মুশফিকুর রহিমের সঙ্গে গড়েন ১৩৩ রানের বিশাল জুটি। সেই ম্যাচে মুশফিক খেলেন ১৪৪ রানের ইনিংস।
মিঠুনকে নিয়ে দারুণ খুশি মুশফিকুর রহিম। তিনি বলেছেন,
‘মিঠুন সবসময়ই ইতিবাচক। তাকে আমি কখনোই বলিনি যে তুমি ডট বল খেল। আমি তাকে সবসময় বলেছি তুমি প্রথম ৫-৬ ওভার স্রেফ উইকেটে দাঁড়িয়ে থাকো। নিজেদের অনুকূলে পরিস্থিতিটা টেনে আনো, রান রেট নিয়ে চিন্তা করো না।’
নতুন করে আলোচনা হচ্ছে, মিঠুন নিজের সেরাটা দিয়ে চেষ্টা করে যাচ্ছেন। জাতীয় দলে তার সাফল্যের পেছনে সবচেয়ে বড় কাণ্ডারি হিসেবে কাজ করেছে ঘরোয়া ক্রিকেট লিগগুলো। ২০১৪ সালে প্রথমবার জাতীয় দলের জার্সিতে খেলার পর আবারও খুব কষ্টে পাওয়া সুযোগ যে তিনি হাতছাড়া করবেন না, তা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই।
এশিয়া কাপের পর্দা নেমে গেছে। কিন্তু মাশরাফি যে গোয়ার্তুমি করে মিঠুনকে সুযোগ দিতে চেয়েছেন, ফলাফল যা-ই হোক; তাতে তিনি সফল।
ফিচার ইমেজ- Getty Image